আইস স্কেটিং-এ একসন্ধ্যা

ধুসর গোধূলি এর ছবি
লিখেছেন ধুসর গোধূলি (তারিখ: শনি, ০৮/১২/২০০৭ - ৩:৫০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বছরের এই সময় শহরের আনাচে কানাচে ঐতিহ্যবাহী মেলা বসলেই বুঝা যায় ক্রিসমাস আসছে। প্রতিটা রাস্তার মুখে বাতিজ্বলজ্বল বোর্ডে রাস্তার নাম লেখা হয়, লাইটিং ফাইটিং, সবুজ রঙের বিছালি দিয়ে ইতিউতি সাজানো হয় দোকানপাট। ফ্রিডেন প্লাৎসে প্রতিবছরই ভাইনাখট-মার্কটে একটা আইসস্কেটিং এরিয়া বানানো হয়। এসময় এই জায়গাটাতে যতোবারই যাই ততোবারই সেরেন্ডিপিটির কথা মনে হয়।

শখের বশে দেড়বছর আগে ইনলাইনার স্কেটিং শিখছিলাম। ধুপধাপ পড়ে গিয়ে হাতের তালু হয়ে গিয়েছিলো চালুনীর মতো, সূড়কীর খোঁচা খেয়ে। ডান হাতের কব্জি 'ফ্রী-হ্যান্ড' নাড়াতে পারিনি অনেকদিন। হাঁটুতেও ব্যাথা ছিলো টনটন। তারপরেও ইনলাইনারে এটলিস্ট দাঁড়ানো শিখেছি, তাতেই খুশী আমি। চলতে পারিনা তো কী হয়েছে! বরফের উপর স্কেটিং করার শখ আমার আজন্ম। সিডনীতে ম্যাকুয়ারী সেন্টারে বিশাল বরফের রিং-এ দেখতাম পিচ্চিপাচ্চা গুলা খিলখিলিয়ে কচাং-কুচাং করে এমাথা ওমাথা দৌড়াচ্ছে। আমি বিগম্যাকে কামড় দিতে দিতে দেখতাম আর ভাবতাম, 'এই পুলাপানগুলা ক্যামনে এইরম চিক্কন একটা ব্লেডের উপর দিয়া ফুচুৎ ফাচুৎ কইরা দৌড়ায়!'

ছোট ভাই আসার পর থেকে তারে নিয়া খুবেকটা বেড়ানো হয় নাই। হয় ওর সময় নাই, নয়তো আমার। কালকে বিকেলের দিকে দুজনেরই টাইমিঙে মিলে গেলে জিজ্ঞেস করলাম আইস স্কেটিংএ যাবে কিনা। ব্যাটা ঘাঁইঘুঁই করে 'হ্যাঁ' বললো নাকি 'না', ঠিক বুঝলাম না। গেলাম তারপরেও কুন্সট মিউজিয়ামের পাশে বিশাল বরফের রিংএ। লাল-নীল বাতি দিয়ে, চান্দিনা দিয়ে সাজানো জায়গাটা। দেখলেই একটা ভালো লাগা শুরু হয়। কোটি কোটি পোলাইন-আবাল-বাল-বৃদ্ধ-বনিতা-সেনোরিটা সবাই রিং এর এর এমাথা ওমাথা করছে হাত-কোমর ধরাধরি ছাড়াছাড়ি করে।

আবার মেইক শিউর করলাম ছোট ভাইকে। ও এর আগে আইস স্কেটিং দূরের কথা, ইনলাইনারেও চেষ্টা করেনি। কোমর ভাঙতে আপত্তি আছে কিনা জেনে নেয়াই ভালো। পটিয়ে পাটিয়ে রাজী করিয়ে ফেল্লাম একসময় চান্দুকে। শ্যু বুঝে নিয়ে রিংএ নেমে বুঝলাম, নাহ্ যতোটা সোজা মনে করেছিলাম, জিনিষটা আসলে ততো সোজা না। আবার ইনলাইনারের মতো অতো কঠিনও না। বরফের উপর একটু চলতে গিয়ে পুরা টালমাটাল অবস্থা। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে ছোটভাইকে খুঁজতে গিয়ে দেখি বেচারার কয়েকবার পড়া হয়ে গেছে। আমি কাছে গিয়ে বললাম, 'আমারে দেখো। আমার মতো চলো, এইযে এমনে।'
ও তার স্বভাবসিদ্ধ দাঁত বের করা হাসি দিয়ে বলে, 'এহ্, তুমি তো নিজেই পইড়া যাও। যদি পড়তেই হয় তাইলে আর তোমারে ফলো করমু ক্যান?'

বগা মিয়া ধপাশ!বগা মিয়া ধপাশ!

আমি কইলাম, 'কি এতো বড় কথা! আমি স্কেটিং পারিনা? খাড়া দেখাইতাছি।' দিলাম ইয়া বিশাল এক দৌড়। সমস্যা হলো, অন্য যারা ওখানে আছে তারা সবাই মোটামুটি দক্ষ, আমার মতো এ্যামেচার না। তাদের ঘূর্ণনেও একটা লাইন আছে। আমার মতো বেলাইনে দৌঁড়ায় না। নিজেরা দৌঁড়ায় না, আশাও করেনা যে হুট করে একজন বেলাইনে এসে গায়ের উপর পড়বে। এখন সমস্যা হলো, আমি নাহয় এগুলো বুঝি, আমার টালমাটাল পা কি আর বুঝে এতোকিছু? ডানে বামে টলতে টলতে, লাটিমের মতো ঘুরতে ঘুরতে নিজেকে পড়া থেকে বাঁচাতে কাকে ধরেছি সেটাতো আর দেখিনি তখন। হঠাৎ শুনি, 'এন্টশুলডিগুং'। চোখ খুলে দেখি এক ললনাকে জাপ্টে ধরে দাঁড়িয়ে আছি, পাশেই তার বন্ধু চোখ ট্যারা করে দেখছে আমাকে। মনে মনে বললাম, !ল্যাও এলা ঠ্যালা সামলাও। এইবার বুঝি আমার মুখের মানচিত্র চ্যাঞ্জ হইবে এখনি!'
নাহ, বড়ই ভদ্দরলোক তারা। 'কাইন প্রবলেম' বলে একটা হাসি দিয়ে চলে গেলো আবার। আমিতো হেব্বি খুশী চোখ টিপি

তারপর?
আমি বুঝলাম না, আমার জুতা মাতাল হয়ে সব ললনাদের দিকেই কেমনে যায়! একবার আমি তাদের জাপ্টে ধরি, তো তারা পরেরবার আমাকে ধরে। উৎসাহ দেয়, কৌশল দেখায়। আমি তো রাপু খাপাং। একবার আমার গেইটলক গতি রোধ করতে গিয়ে এক পিচ্চিরে ছোঁ মেরে কোলে তুলে নিলাম। না নিলে অবশ্য বিশাল একটা সংঘর্ষ হয়ে যেতে পারতো। পিচ্চি তো ডরে কাইন্দা দেয় অবস্থা, আমি স্যরি মরি বলে, মুখ কাচুঁ মানু করে বললাম, 'নয়ে-নয়ে।' বাকি সময়টা সংঘর্ষের আগ মুহূর্তে সজোরে চিৎকার দিয়ে বেশ কয়েকজনকে ভড়কে দিয়েছি। পিচ্চি পোলাপান কয়েকটা আমার চিৎকার শুনে রিং থেকে লাফ দিয়ে কয়েক মিলিমিটার ওপরে উঠে গেছে নির্ঘাৎ।

একেবারে শেষে চলতে গিয়ে দেখি কাকে যেনো ল্যাং মেরে দিয়েছি। ঘুরে সাহায্য করতে গিয়ে দেখি পিচ্চিটা মুখ বাঁকা করছে কাঁদবে বলে। এইবার আমি প্রমাদ গুণলাম। এতোক্ষণ জনগণ কিছুই বলে নাই। এইবার নিশ্চই এই পিচ্চির মা আইসা আমার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করবে, কিংবা তার পালোয়ান বাবা এসে আমার নাকের সাইনাসের বারোটা বাজাবে, আগের বারের ললনাদের সঙ্গের ছেলেগুলো এসে যদি একটা করেও লাগায় তাইলেও আমার শরীরে আর অক্ষত কোন জায়গা খুঁজে পাওয়ার কথা না। তড়িৎ ডিসিশন নিলাম, 'জলদি ভাগো!!!'


মন্তব্য

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

হাসি

হিমু এর ছবি

কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। সোয়া ছয়ফুট লম্বা এক দানবী এসে মুখ ব্যাদান করে বললো, "ডু হলৎসকপ্ফ! হাস্ট ডু ডাইনে আউগেন ফেরলোরেন? ঘরে মাবোন নাই?" এই বলে একটা আপার কাট বাম চোয়ালে, একটা শার্প জ্যাব ডান চোয়ালে।

হাসপাতালে শুয়ে ব্লগিং করতে কষ্ট হচ্ছে, আমরা জানি। গুটে বেসারুং!


হাঁটুপানির জলদস্যু

ধুসর গোধূলি এর ছবি

-গুটে বেসারুং-এর লাইগ্যা ফিলেন ডাংক কলিগে।
তুই ডাব লইয়া দেখতে আহিস আর লগে আনিস তোর কয়েকজন সৌন্দয্য ফ্রয়েন্ডিনেন চোখ টিপি
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

অয়ন এর ছবি

বাংলাভাষী ব্লগার হিসেবে অবোধ্য জার্মান ভাষা ব্যবহারের প্রতিবাদ জানাইলাম।

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

হা হা হা! যার চোখ যেইদিকে। ছোটভাইয়ের কাহিনী আরেকটু বললে তার পারফর্ম্যান্সও বুঝা যাইতো। চোখ টিপি
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- তার পারফর্মেন্স জাইনা কি করবেন? শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সে ধুপধাপ পড়তাছিলো আর পিচ্চিপাচ্চারা তারে টাইনা টুইনা তুলতাছিলো।

লেটেষ্ট খবর হইলো, সে স্কেটিং জিনিষটা ভালোই নাকি আয়ত্ত্ব করছে।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

সুমন চৌধুরী এর ছবি

দাঁতের আর হাড্ডিগুড্ডির মায়া কইরা এখনো যাওয়া হয় নাই। এখন মনে হইতেছে একটা ঢু মারা যাইতারে আনন্দদায়ক ঢুসঢাস খাইতে...



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- বদ্দা, এক্কারে সেইরম মজা। ঈমানে কই, সইত্য না হইলে পয়সা ফেরত।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

হাসান মোরশেদ এর ছবি

ডানে বামে টলতে টলতে, লাটিমের মতো ঘুরতে ঘুরতে নিজেকে পড়া থেকে বাঁচাতে কাকে ধরেছি সেটাতো আর দেখিনি তখন। হঠাৎ শুনি, 'এন্টশুলডিগুং'। চোখ খুলে দেখি এক ললনাকে জাপ্টে ধরে দাঁড়িয়ে আছি

কছ কি?
-----------------------------------------
মৃত্যুতে ও থামেনা উৎসব
জীবন এমনই প্রকান্ড প্রচুর ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- কি কই আবার! মন খারাপ
আমি কি আর পড়ার সময় এতো কিছু দেখছি নাকি?
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

পারেনও আপনি!
আমি অ্যাদ্দিন ধইরা আছি বরফের দেশে, কিন্তু আইস স্কেটিং শেখার ইচ্ছা হয় নাই কখনও। আমি দেইখাই মজা পাই।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- মাঠে নাইমা দেখেন সন্ন্যাসী, মজাটা আরও ব্যাপক সেখানে! চোখ টিপি
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।