ফিরে আসা ক্ষণ, ফেলে আসা স্মৃতি

ধুসর গোধূলি এর ছবি
লিখেছেন ধুসর গোধূলি (তারিখ: বুধ, ০২/০১/২০০৮ - ১১:৫৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কাল রাতেই টিভিতে দেখলাম সিডনীতে প্রতিবারের মতো এবারো জমকালো আতশবাজীর কারুকাজে ডার্লিংহারবারের আশপাশের পুরো এলাকা ঝলমলে রাঙিয়ে বরণ করে নেয়া হচ্ছে নতুন বছর। হার্বার ব্রীজ বা অপেরা হাউস দেখলেই ভেতর থেকে চুপসানো বেলুনের মতো একটা বাতাস বের হয়ে যায় হুশ করে। সেলুলয়েডের ফ্রেমের মতো একে একে ভেসে যায় অনেকগুলো ছবি চোখের সামনে দিয়ে। তাদেরই কয়েকটায় দূর থেকে তর্জনীর স্পর্শ বুলাই, দেখি কোথাও ময়লা টয়লা পড়লো কিনা!

সিডনী ছাড়ার আগের থার্টিফার্স্টের ফায়ারওয়ার্ক্সটা দেখেছিলাম একেবারে ব্রীজের গোড়া ওয়ালশ বে থেকে। হোটেলের ফ্রন্টে যারা কাজ করতাম তারা সবাই বেরিয়ে এসেছিলাম সামনের রাস্তায়। মাইক, ম্যাট, ডুয়েন, অ্যান্থনী, ডা(ই)ভিড, স্যালী, স্যাম, এরিখ- আমরা সবাই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ব্রীজ হতে আতশবাজীর বৃষ্টির আকারে ঝরে পড়া। হঠাৎ কে এক মাতালকে আমার খুব কাছে এসে ডার্লিং টার্লিং সম্বোধনে এঁকে বেঁকে, হেলে দুলে কথা বলতে দেখে ভয় পেয়ে 'ওমাগো' চিৎকার দিয়ে সোজা লবিতে চলে গিয়েছিলাম। ফ্রন্ট ম্যানেজার ম্যাক আর ট্রেভর আমার ভয়ার্ত চিৎকারে এগিয়ে এসে সান্ত্বনা দিয়েছিলো, 'ওরা কখনোই তোমার গায়ে হাত দিবে না যতোক্ষণ না তুমি এলাউ করো।' স্বস্তি পেয়ে সিকিউরিটি এল্যানের কাছাকাছি থেকে বাকি সময়টা উপভোগ করেছি। আর মনে মনে বলেছি, 'আমারে ডার্লিং বললি তো বললি তো তুই নিজে সুন্দরী ললনাই হইতি!

দেশে থাকা কালীন বছরের শেষ দিনটায় ঘরে ফিরতে একটু কষ্টই হতো। পুরো কামাল আতাতুর্ক এ্যাভেনিউ হেঁটে আসতে হতো বাস বা অন্য কোন যানবাহনের খোঁজে। সিডনীর বছর শেষের ঝাঝালো আলোতে ধাঁধানো চোখে গুলশান বনানীর অন্ধকারটা বড্ড জ্বালা ধরাতো। কোন রকমে পাশটাশ কাটিয়ে চলে আসতাম সারাদিন খাঁটা, অবসন্ন দেহ নিয়ে।

জার্মানীতে বছর শেষের উদযাপনটাও কেমন নিরামিষ লাগে। না উন্মুক্ত জায়গায় বিরামহীনভাবে চলে পটকাবাজী, না পুটুশ করে খুলে ফেলা শ্যাম্পেইনের বোতল থেকে 'গোলাপজল' ছিঁটানো হয়! কোলনে রাইনের পাড় ধরে ঘন্টাখানেক সময়ব্যাপী চলেছে ছোটখাটো পটকা আর আতশবাজী পুড়ানো। আমাদের দেশে বিয়েতেই এর চাইতে বড় বড় বাজি পুড়ানো হয়। কোলনারেনায় স্বল্প বসনা, শ্যাম্পেইন হাতের লাল রঙা ঠোঁটের সেই ললনা, কিংবা হয়মার্কটে পায়ে এসে রকেটের হামলাকে বাদ দিলে ২০০৭ এর শেষের সময়টুকু মোটেও পার্থক্য আনতে পারেনি অন্যান্য বারের চেয়ে। জার্মানীতে প্রথমবার 'বছর শেষ উদযাপনে' টুকুশ টাকুশ বাজি ফাটানোর শব্দে বিরক্ত হয়ে ঢুকে পড়েছিলাম এক পোলিশ পাবে। ওখানেই পরিচয় হয় পাতার মতো এক পোলিশ মেয়ের সঙ্গে। ওর ভাঙা ইংরেজী আর আমার না-পারা জার্মানে বেশ ভালোই বাৎচিত চালিয়ে গেছিলাম সেরাতে। গল্প শেষে ও চলে গেলো তার পথে, আমি বসে আরেকটা 'রাডলা' মেরে দিলাম নিঃশ্চিন্তে।

বয়স বেড়ে যাচ্ছে নির্ঘাৎ। ৩১ ডিসেম্বরতো তাই জানান দেয়। বুড়িয়ে যাওয়ায় নিজের মনের যে ব্যাথাটুকু, সেটা আড়াল করতেই কিনা মানুষ নেমে পড়ে ঘটিবাটি নিয়ে। পটকা পাটকি আর পানীয়-র পোটলা পুটলী নিয়ে। আর আমি বুড়া হওয়ার জলজ্যান্ত সন্ধিক্ষণে বরাবরের মতো ভাবনার সেলুলয়েডে নিজেকে দেখে ভাবি, 'গল্পটাতো অন্যভাবেও লেখা হতে পারতো!'


মন্তব্য

সৌরভ এর ছবি

আর আমি বুড়া হওয়ার জলজ্যান্ত সন্ধিক্ষণে বরাবরের মতো ভাবনার সেলুলয়েডে নিজেকে দেখে ভাবি, 'গল্পটাতো অন্যভাবেও লেখা হতে পারতো!'

হুমম।


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

ধুসর গোধূলি এর ছবি
বিপ্লব রহমান এর ছবি

বরাবরের মতো ভালো লিখেছেন। ...বর্ষ বিদায় - যজ্ঞর সঙ্গেএকাত্ন হতে না পারার বেদনাটুকু হৃদয় ছুঁয়ে গেলো। ধন্যবাদ।


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

ধুসর গোধূলি এর ছবি
কনফুসিয়াস এর ছবি

আপনে আবার সিডনি ছিলেন কবে? কয়দিন আগেই না ক্রাউন এর গল্প করলেন আমার কাছে!
-------
থার্টিফার্স্ট-এ ইয়ারার পাড়ে বইসা আতশবাজী দেখলাম। জটিলস্য!
আপনারে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
-----------------------------------
যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- মিয়া নেক্সট টাইম আপনের কাছে জিউসের মন্দিরের ভাঙা থাম গুলার গল্প করুম, নাইলে ক্রেমলিনের সেই আলিফ লায়লা মার্কা প্রাসাদটার! চাল্লু
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

শেখ জলিল এর ছবি

হুম। বেশ স্মৃতিকাতরতার পোস্ট।
আশা করি দীর্ঘশ্বাস মিলিয়ে যাবে নতুন বছরের উন্মত্ত হাওয়ায়...

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

ধুসর গোধূলি এর ছবি
নজমুল আলবাব এর ছবি

সব যায়গায় পানি আর বেটি খুজে খালি... বিতলা কুনহানকার

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

ধুসর গোধূলি এর ছবি
আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

গল্পটাতো অন্যভাবেও লেখা হতে পারতো!

আমি কিছু কবো না।

ধুসর গোধূলি এর ছবি
সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

নজমুল আলবাব মন্তব্য করেছেন: "সব যায়গায় পানি আর বেটি খুজে খালি..."

পাবলিকের কথা শুইনেন না! ঠিক লাইনেই আছেন আপনি চোখ টিপি

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

ধুসর গোধূলি এর ছবি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।