মাতৃত্ব/ মাতৃত্বে নারীবাদ/ নারীবাদী মাতৃত্ব

ধুসর জলছবি এর ছবি
লিখেছেন ধুসর জলছবি [অতিথি] (তারিখ: সোম, ৩১/১০/২০১৬ - ৭:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমরা যে নারীপুরুষ সম অধিকারের কথা বলি, সাম্যাবস্থার কথা বলি নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই যা অপরিহার্য, সেই সকলের জন্য সমান পৃথিবী তৈরির কথা বলার সময় আমরা সকলের মধ্যে মায়েদেরকে গোনায় ধরি না। বংশবিস্তারের জন্য নারীর জরায়ু ছাড়া আর কোন বিকল্প ব্যবস্থা যতদিন পর্যন্ত না আবিষ্কার হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত মাতৃত্ব নারীর জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকবে। তাই নারীমুক্তির কথা মুখে বলে মাতৃত্বকে আলাদা পাল্লায় মাপলে সেই মুক্তি আদৌ কখনও আসবে বলে আমার মনে হয় না। যে নারীবাদকে এদেশে সবাই কম বেশি সন্দেহের চোখে দেখে আর মাতৃত্বকে মহত্তের চোখে দেখে, সেই নারীবাদ আর মাতৃত্ব একটা অপরটার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নারীবাদ প্রতিষ্ঠা করতে হলে সমাজের মাতৃত্ব নিয়ে ধ্যানধারণায় বদল আনতে হবে আবার মাতৃত্বকে সহজ, সহায়ক এবং কার্যকরী করার জন্যও নারীবাদের প্রচার দরকার।

নারীবাদ যেমন মাতৃত্ব নিয়ে সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে তেমনি মাতৃত্ব নারীবাদের প্রয়োজনটাকে আরও সামনে নিয়ে আসে। নারীবাদ বলে একটা মেয়ে কখন মা হবে, আদৌ হবে কিনা সেটা কেবলমাত্র একটা মেয়ের সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত, সমাজের চাপিয়ে দেয়া দায় না। আবার একটা মেয়ে মা হওয়ার মাত্রই তার যাবতীয় সকল বৈশিষ্ট্য ভুলে তাকে একমাত্র মা হিসেবেই বিচার করাটাও নারীর তথা সমাজের উন্নয়নের পথে অনেক বড় একটা অন্তরায়।

একটা মানুষ ঠিকঠাক-মত বড় করে তুলতে পারাটা খুব সরল দায়িত্ব কিন্তু না। ধৈর্য, অধ্যবসায়, সাহস, সৃজনশীলতা, নিত্যনতুন সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এই সবই একজন মায়ের মধ্যে থাকতে হয়। পৃথিবীর আর কোন কাজ, পড়াশুনাতে একই সাথে এতগুলো ব্যাপারে পারদর্শী হতে হয় বলে আমার জানা নেই। তাই মা হওয়াটাকে খুব হালকা-ভাবে নেয়াটা যেমন মূর্খতা তেমনি আবার এত কঠিন একটা বোঝা একজন মানুষের কাঁধে জোরপূর্বক চাপিয়ে দিয়ে তাকে প্রতিনিয়ত সমাজের কাঠগড়ায় দাড় করানোটাও মূর্খতা।

মাতৃত্ব অবশ্যই সবচেয়ে অসাধারণ অভিজ্ঞতাগুলোর একটা। আমি সবসময় খুব চমৎকার একজন মা হতে চেয়েছি। আমার মাতৃত্ব পরিচয় নিয়ে আমি যথেষ্ট উচ্ছ্বসিত কিন্তু ঝামেলা লাগে তখন যখন আমাকে কেউ শুধুই মা বলে পরিচিত হতে বলে। আমি একটা চমৎকার বাচ্চাকে পৃথিবীর জন্য বড় করে দিয়ে যেতে চাই তার মানে এই না যে এইটাই আমি একমাত্র চাই। আমি আরও অনেক অনেক কিছু করতে চাই, এবং এই চাওয়ার সাথে আমার মাতৃত্বের কোন বিরোধ আমি দেখি না। বিরোধ সেই বাধা প্রতিবন্ধকতার সাথে যেটা মা হওয়ার কারণে/ উপলক্ষে সমাজ প্রতিনিয়ত আমার পথে বিছিয়ে রাখছে।

সমাজের চাপিয়ে দেয়া এই একমাত্র ভূমিকাটা নিয়েই আমার সকল আপত্তি। কেন সমাজ ভাবছে যে মা হওয়া মানেই মেয়েরা পরিপূর্ণ, তার অন্য কোথাও আর কিছু দেবার নেই, বাচ্চা বড় করতে পারাটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য। আর কোন কারণে যদি বাচ্চাটা সঠিক মানুষ না হয়, যেটা না হওয়ার জন্য হাজারটা কারণ থাকতে পারে, তার মধ্যে খুব অল্প কয়েকটাই হয়ত মায়ের সাথে সম্পর্কিত, তবুও সমাজ একটা মাকেই সন্তান মানুষ না করার জন্য ব্যর্থতার গ্লানিতে ভোগাবে। সন্তান ধর্ষিত হলে মায়ের চাকরির দোষ, সন্তান ড্রাগ নিলে মায়ের উচ্চশিক্ষার দোষ। একজন মা হয়ত তার নিজের মেধা আর শ্রম দিয়ে দেশের জন্য মানুষের জন্য হাজার উপকার করেছে অথচ তার সব পরিশ্রম বিফল যদি কোন কারণে তার সন্তান জীবনে সাফল্য না পায়।

আমরা মেয়েদের সামনে দুইটা বিকল্প দিচ্ছি, তোমরা হয় মা হবে অথবা প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রতিষ্ঠিত মা হওয়ার কোন সুযোগ সমাজ দিচ্ছে না। এই প্রাগৈতিহাসিক মানসিকতার কারণে ইদানীং অনেক মেয়ে যারা ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখে অনেক সময় ইচ্ছে থাকলেও মা হওয়ার কথা চিন্তা করতেও ভয় পায়। মা হওয়ার প্রক্রিয়াটার ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় একটা মেয়ের শরীরে যে অদ্ভুত সব পরিবর্তন হয় তা থেকে পরবর্তীতে নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার জন্য একজন মানুষের সময় দরকার। সেই সময়টা কি আমাদের কেউ দেয়? অন্য সব প্রাণীর চেয়ে মানুষেরা স্বাবলম্বী হতে অনেক বেশি সময় নেয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটা সচল রাখতে একজন মা তার জীবন থেকে যে পরিমাণ সময় আর সম্ভাবনা খরচ করে সেটাকে পুষিয়ে নিয়ে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর সহায়তা কি সমাজ তাকে দেয়?

মাতৃত্ব-কালীন ছুটিটাকে এখনও এদেশের বেশিরভাগ মানুষ অপ্রয়োজনীয় চোখে দেখে। মাতৃত্ব-কালীন ছুটি কাটিয়ে এসে সহকর্মীদের ভ্রূকুটি আর বাঁকা কথা সহ্য করেনি এমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া বিরল হবে এদেশে। আমার চেয়ে অর্ধেক মেধা আর শ্রম খরচ করা ছেলেটাও ভাবছে আমার আর চাকরি করার কি দরকার? মা হওয়ার পর আমার মেধা বা শ্রম দেয়ার ক্ষমতা তো জাদুবলে কমে যাচ্ছে না তবুও মা হলেই এমন ভাবার কারণ হল সফল মা হওয়াই একটা মেয়ের জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য এই চিন্তার যায়গাটা থেকে বের হতে না পারা।

বাচ্চা সামলে পড়াশুনা, চাকরি করার জন্য একজন মেয়ের যে সহায়ক ব্যবস্থা দরকার সেরকম কিছু আমাদের দেশে এখনও নেই। যদি কারো বর বা শাশুড়ি দয়া করে সাহায্য করে সে আগাবে নতুবা ঘরে বসে থাকতে হবে। চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য আরও মারাত্মক। প্রেগ্ন্যান্সির কারণে চাকরি হারিয়েছে, মা হওয়ার পর ছুটি পায়নি তাই চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে অথবা মা হওয়ার কারণে চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে এরকম ঘটনা এদেশে ভুঁড়ি ভুঁড়ি। যাদের এইসব পলিসি নিয়ে কাজ করার কথা তারা নিজেরাও ধরে বসে আছে যে মা হওয়ার পর আবার এত বাইরে দৌড়াদৌড়ি করার দরকার কি, বাচ্চা বড় করলেই তো মেয়েমানুষের জীবন সার্থক। এই অবস্থার থেকে বের হয়ে আসতে হলে, মায়েদের জন্য সহনশীল, সহায়ক কাজের পরিবেশ তৈরি করতে হলে সবার আগে এই “একমাত্র সাফল্য” জাতীয় মানসিকতা থেকে মানুষকে বের হয়ে আসতে হবে।

আমাদের দেশের মাতৃত্ব নিয়ে আরেক ক্ষতিকর অভ্যস্ততা হল মাকে অতিমানব জাতীয় কিছু ভাবার রীতি। তাই মা হওয়ার পর একজন নারীর যে সাধারণ আর দশটা মানুষের মত দুঃখ, কষ্ট, হতাশার বোধ থাকতে পারে মাকে মহামানব বানাতে গিয়ে সেটাকে আমরা প্রতিনিয়ত অস্বীকার করি, পোস্টপারটাম ডিপ্রেশন বা বেবি ব্লুকে সামাজিক ভাবে মানা তো অনেক দূরের ব্যাপার। আমরা ভেবে নিচ্ছি মা হওয়ার পর সে এতই খুশি আর সুখে পরিপূর্ণ থাকবে যে তার আর কোন ইচ্ছে অনিচ্ছা ভালো লাগা মন্দ লাগার অনুভূতি হওয়ারই কথা না। এর চেয়ে অসার যুক্তিহীন চিন্তা হতে পারে বলে আমার ধারনা নেই।

কিন্তু তার বিপরীতে বাবা হওয়ার ব্যাপারটাকে আমরা খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি কি? বাবা হওয়ার পর ছেলেদেরকে আমরা অসাধারণ ভাবছি না, তার সকল অনুভূতি ঠিকঠাক আগের মতই থাকছে ধরে নিচ্ছি। বাবা হওয়াটা সবচেয়ে সম্মানের না? তাই বাবা হওয়ার পরও ছেলেদের অনেক কিছু হতে হয়, হতে চাইতে হয় মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য?
একটা ব্যাখ্যা অনেকে দেয় যে মা হলে মেয়েদের হরমোনের পরিবর্তনের কারণে বাচ্চার প্রতি দুর্বলতা তৈরি হয়। কিন্তু এখনকার রিসার্চ বলছে সেটা ছেলেদের ক্ষেত্রেও হয়। মায়েদের যেমন সন্তানের ব্যাপারে মমতা বাড়ানোর জন্য হরমোনের উঠানামা আছে তেমনি বাবাদেরও আছে। তাই সন্তান জন্মের পর শুধু মা না বাবারাও বদলায়, বদলানোর কথা, বদলানো দরকারও।

আমরা সন্তান লালনের পুরো প্রক্রিয়াটাতে মায়েদের একছত্র আধিপত্য দিয়ে রেখেছি। যে বাবা বাইরে হাজারও কঠিন সমস্যার সমাধান করছে, বাচ্চাকে দুধ বানিয়ে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ান বা ডায়াপার বদলের মত ছোট সহজ কাজগুলিও তারা করতে পারবে না ভাবা হয়। ব্যক্তিগতভাবে সমাজের ছেলেদেরকে এই অথর্ব ভাবার রীতিটাকে আমি খুব অপছন্দ করি। বাচ্চা পালার দক্ষতা নিয়ে কিন্তু মেয়েরাও জন্মায় না। প্রথমবার মা হলে একজন নারী যেমন সব আস্তে আস্তে শিখে নিতে পারে একজন স্বাভাবিক বুদ্ধির পুরুষও সেটা পারে। এবং নিজের বাচ্চার দেখভাল করার জন্য মহাপুরুষ হওয়ার দরকার নেই, একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হওয়াই যথেষ্ট।

ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য একটা মানুষকে রেখে যাওয়া খুব বিশাল একটা দায়িত্ব। একটা ভাল মা হতে চাওয়ার স্বপ্ন দেখাটার মধ্যেও কোন সমস্যা নেই। সমস্যা হল যখন ছেলেদের ইচ্ছের মধ্যে ভালো বাবা হওয়ার আকাঙ্ক্ষাটা সেভাবে উঠে আসে না। অথচ আমরা যে সাম্যের পৃথিবী দেখতে চাই, সন্তান লালন পালনের মত এত মূল্যবান একটা কাজকে একমাত্র নারীর উপর চাপিয়ে দিয়ে সেই পৃথিবী আমরা কখনই পাব না। আবার এখন অনেক গবেষণা বলছে সন্তানের মানসিক বিকাশের জন্য মা বাবা দুজনের সান্নিধ্যই প্রয়োজন। মা সবকিছু ছেড়ে বাসায় বসে আছে আর বাবা সংসারের অর্থের জোগান দিতে গিয়ে বাচ্চাকে সময় দিতে পারছে না এটা কখনই একটা আদর্শ সংসারের চিত্র হতে পারে না। ভালো মা এবং ভালো বাবা দুটোই সন্তান মানুষ করার ক্ষেত্রে জরুরী সূচক।

মাকে মহিমান্বিত করতে গিয়ে তার মানুষ রূপটাকে অবজ্ঞা/ অবহেলা করা বন্ধ করুণ। সন্তান বড় করার জন্য মা বাবা দুজনেরই ভূমিকা এবং দায় আছে। কাউকে তার লৈঙ্গিক পরিচয় দিয়ে বিচার করে তার ভূমিকাকে গন্ডিবদ্ধ করে না দিয়ে পৃথিবীর জন্য পুরুষ নারী উভয়েরই দায়কে স্বীকার করতে শিখুন। মেরী কুরি যদি সব ছেড়ে শুধু বাচ্চা পালায় মন দিতেন তাহলে আমরা রেডিয়াম পোলনিয়াম পেতাম না, আবার উনি মা না হলে আমরা উনার নোবেল পাওয়া কন্যাটাকেও পেতাম না। কেউ মা হোক অথবা না হোক তার যোগ্যতা আর সাফল্যকে মেধা, শ্রম, ইচ্ছে, আন্তরিকতার সূচক দিয়ে বিচার করতে না শিখলে সমাজ শুধু পিছন দিকেই হাঁটতে থাকবে। আবার একজন নারী তার নিজের শরীর, সুস্থতা, সম্ভাবনা, সময়কে বিনিয়োগ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পৃথিবীতে নিয়ে আসেন। এটা তার জন্য প্রকৃতির বেধে দেয়া একটা বিশেষায়িত কাজ, কিন্তু এটা তার একমাত্র কাজ না। এই সহজ সত্যটা মেনে তাকে তার এই কাজে সকল ক্ষেত্রে সাহায্য করা, তাকে মাতৃত্ব-কালীন আর পরবর্তীতে বিশেষ সুবিধা দেয়াটা যে রাষ্ট্র সমাজ তথা আমাদের সকলের দায়িত্ব, এই বোধটুকু হওয়াটাও সভ্য সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য অনস্বীকার্য।

তথ্যসূত্র
http://www.nhs.uk/news/2014/12December/Pages/Fathers-to-be-experience-hormone-changes.aspx
http://www.ehbonline.org/article/S1090-5138(99)00042-2/abstract
http://www.jstor.org/stable/353611?seq=1#page_scan_tab_contents
http://www.thenational.ae/lifestyle/family/the-importance-of-father-child-bonding


মন্তব্য

ঈয়াসীন এর ছবি

চলুক

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

ধুসর জলছবি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

দময়ন্তী এর ছবি

চমৎকার লেখা। ‌ চলুক

মায়ের সাথে সাথেই বাবাদেরও সমানভাবে ইনভলভ করাতে গেলে সন্তানধারণের খবর জানার সাথে সাথেই বাবা মা দুজনেরই এই সম্পর্কে কাউন্সেলিং হলে সবচেয়ে ভাল হয়। শুনেছি প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতে নাকি নাকি হয়। এটা খুব দরকারী।
পিতৃত্বকালীন ছুটিও যথেষ্ঠসংখ্যক দেওয়া দরকার। আপাতত ভারতে পিতৃত্বের ছুটি দুই সপ্তাহ। বাংলাদেশে কদিন?
এটা আরো বাড়ানো দরকার মনে করি।

সম্প্রতি ভারতে লোকসভায় নিয়ম করা হয়েছে যে প্রতিটা প্রাইভেট কোম্পানিতেও কর্মীদের সন্তানদের জন্য ক্রেশ করতে হবে। এটাও খুব জরুরী। ক্রেশ কর্মক্ষেত্রের লাগোয়া হলে মায়েরা অনেক নিশ্চিন্তে কাজে মন দিতে পারবেন (যদিও উক্টোতাও হয়। আমাদের পুণে অফিসেই হয়েছিল। কিছু মায়েরা গিয়ে ওখানেই বেশী সময় কাটাত) আমাদের ব্যাঙ্গালোর অফিসের সবকটা ব্র্যাঞ্চেই ক্রেশ আছে। ব্যাঙ্গালোর কসমোপোলিটান শহর, অধিবাসীরা মূলত ভারতের অন্য প্রান্ত থেকে এসে থাকেন চাকরির জন্য। ফলে বেশীরভাগ দম্পতিরই বাবা-মা শ্বশুর শাশুড়ীর সাপোর্টটা থাকে না, ফলে ক্রেশ হওয়াতে বাবা মায়েরা অনেক রিলিভড। ব্যাঙ্গালোর অফিসের ক্যান্টিনে দুপুরে খেতে গেলে ভারী ভাল লাগে। অনেক মায়েরাই সেখানে ক্রেশ থেকে বাচ্চাদের এনে নিজের সাথে বসিয়ে খাওয়ান। বাচ্চাগুলো ছুটোছুটি করে খেলে বেড়ায়। দারুণ লাগে। অফিশিয়াল স্ট্রেস ভুলে মন ভাল হয়ে যায়।
তো, এইটা সর্বত্র হলে ভাল ছাড়া খারাপ হবে না।

অন্য একটা প্রসঙ্গ একটু বলি। ফেসবুক, গুগল তাদের কর্মীদের এগ সংরক্ষণের খরচ দেবে বলে জানিয়েছে। তার মানে ক্কেউ যদি ৩০ থেকে ৩৫ এর মধ্যে মা না হয়ে কেরিয়ারে মন দেন তারপর ৩৮ এ বা ৪২ এ গিয়ে ঐ সংরক্ষিত এগ থেকে সন্তান ধারণ করেন -- সেটা নিয়ে আপনার কী মত?
আমি ব্যক্তিগতভাবে এটায় একটু স্কেপটিক। এমনিতে শুনতে ভাল হলেও, যে কেমন কেরিয়ার করে তারপর সন্তানের দিকে মন দিতে পারছে --- নামার মনে হচ্ছে এটা কিছুটা কর্পোরেটের থাবা একেবারে ব্যক্তিগত জীবন কন্ট্রোল করার দিকে চলে যাচ্ছে।

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

ধুসর জলছবি এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি
এগ সংরক্ষণ করার সুযোগ দিলে কেউ কেউ হয়ত উপকৃত হবে, কিন্তু এটাকে আমি কোন সমাধান ভাবি না। বয়সের সাথে সাথে প্রেগ্ন্যান্সিতে কিছু কমপ্লিকেশন বাড়ে, এখনও পর্যন্ত মেডিক্যাল সায়েন্স সেটা বলে। যদিও এটা নিয়ে আরও অনেক গবেষণা দরকার। কিন্তু আমি ৩০ এ মা না হয়ে ৪০ এ হলেই বা কি যদি আমার জন্য সমাজ সহায়ক না হয়। একেজনের ক্যারিয়ারের উঠানামা একেক রকম, কারও জন্য তো ৪০ এ গিয়েই ক্যরিয়ারের সবচেয়ে ব্যস্ততম সময় হতে পারে, সেক্ষেত্রে? তারচেয়ে কেউ যখনই মা হোক, সেটা সে নিজের ইচ্ছে আর সুযোগ মিলিয়ে হোক কিন্তু তাকে একটা নির্দিষ্ট সময় ব্রেক দেয়ার জন্য যদি দেশ, সমাজ প্রস্তুত থাকে, আবার সে কাজে ফেরার পর তার জন্য চাহিদা বুঝে একটা সহায়ক ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখে, সর্বোপরি তার চারপাশের মানুষজন যদি তার ব্যাপারে সহায়ক হয় তাহলে কেউ মাতৃত্বের জন্য ব্রেকটা ২৫ এ নিল না ৪০ এ তাতে খুব বেশি কিছু যায় আসবে না মনে হয়।

Arpita এর ছবি

খুব ভালো লাগলো ওপরের লেখাটা।আরেকটা বিষয় হাইলাইট করার ইচ্ছে ছিল। যেটা আমি নিজে ফেস করছি। কোথাও আলোচনা হতে দেখি না। ক্রেস বা কাজের সময় এ ফ্লেক্সিবিলিটি ব্যাপারটা একান্ত ভাবেই IT ইন্ডাস্ট্রি- র সুবিধা। যেহেতু আমাদের দেশে শিক্ষিত মেয়েরা অনেকেই এই ইন্ডাস্ট্রি তে রয়েছেন সেহেতু সব আলোচনা ওই দিকেই ঘুরে যায়। আর এই সমস্ত সুবিধার জন্য বলতে বাধা নেই একমাত্র IT তেই মেয়েরা অনেকটা এগিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছেন। কিন্তু IT ছাড়া আর যে কোনো ইন্ডাস্ট্রি তেই টাইম অফ physical presence অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করা হয়। আমি কনস্ট্রাকশন রিলেটেড ইন্ডাস্ট্রি তে 3 টি দেশে কাজ করেছি। ইন্ডিয়া, USA আর কানাডা। প্রতিটা দেশ ওয়ার্ক culture totally different হলেও এই একটা বিষয় এ কোনো পরিবর্তন নেই। বাচ্চা ছোট থাকা কালীন এই দীর্ঘ সময় অফিস এ বসে থাকা (কাজ থাক বা না থাক) অত্যন্ত কাউন্টার প্রোডাকটিভ বলে মনে হয়। IT ইন্ডাস্ট্রি র বাইরে প্রত্যেকের একই গল্প।তাই এই সমস্ত ইন্ডাস্ট্রি te একটা বয়স এর পর মেয়েরা পুরো উধাও হয়ে যায়। নয় ঘন্টা অফিস এ আর দুঘন্টা ড্রাইভ করে ছোট বাচ্চার দেখাশোনা খুব ই দুঃসাধ্য ব্যাপার।অসম্ভব নয় তবে প্রচুর যুদ্ধ করতে লাগে। নরওয়ে না কোথায় দেখলাম কাজের টাইম কমিয়ে ছয় ঘন্টা করা হচ্ছে। আমার মনে হয় এটা একটা মেয়েদের জন্য খুব ভালো change । 6 ঘন্টা বা 8 ঘন্টা কাজ যাই হোক না কেন টাইম অফ ফিজিক্যাল presence আমরা যাকে বলি মুখ দেখানো র টাইম কমানো বা ফ্লেক্সিবিলিটি থাকাটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ দাবি র মধ্যে আসা উচিত।মাতৃত্ব কালীন ছুটি অবশ্যই কিন্তু কাজের সময় ই ফ্লেক্সিবিলিটি থাকলে অনেক মেয়েই এইসব ইন্ডাস্ট্রি থেকে হারিয়ে যাবে না।

ধুসর জলছবি এর ছবি

চলুক সময়ের ফ্লেক্সিবিলিটির ব্যাপারে সহমত।
ফ্লেক্সিবিলিটির অবস্থা তো আমাদের দেশে উল্টো। মনে করেন আমি নিজের কাজ ঠিকমত করি, আমার বস খুশি। আমি লাঞ্চে বাইরে খেতে গিয়ে ৩ ঘন্টা কাটিয়ে আসলাম, বা বললাম ব্যাংকের কাজে যাচ্ছি, ২ ঘন্টা পরে আসলাম, তেমন কিছুই হবে না, কাজ তো করছি। কিন্তু সেই আমারই ছোট বাচ্চা আছে আর আমি অফিসে বলে বাচ্চার জন্য কোথাও গিয়েছি, ১ ঘন্টা আগে অফিস থেকে গিয়েছি, তাহলে সেই কথা শুধু আমাকে না, বাকি যারা মা আছেন তাদেরকেও শুনতে হবে "এরা তো বাচ্চার পিছনেই দৌড়ায়, কাজ করবে কখন?" "বাসায় ছোট বাচ্চা রেখে কাজ করার কি দরকার" "তোমার পরিবার তো অনেক স্টাব্লিসড, শুধু শুধু বাচ্চাটাকে কষ্ট দিচ্ছ কেন" ইত্যাদি ইত্যাদি।

সোহেল ইমাম এর ছবি

মাকে একটা দৈব ভূমিকা দিয়ে কিন্তু এক রকম ফাঁকিই দেওয়া হয়। বলা হচ্ছে মায়ের চেয়ে বড় কেউ নেই ইত্যাদি কিন্তু কার্যত মা নিজে নিজের মানবিক অধিকারহীন এক রকম দাসই কি হয়ে পড়েননা? এ নিয়ে ভাবা হচ্ছে, লেখা হচ্ছে এটাই কাজের কথা। চিন্তাটা অবশ্যই আগে পাল্টাতে হবে। আপনার লেখাটা সেই পরিবর্তনের স্রোতে আরো কিছু ঢেউ যোগ করে দিক। লেখাটা ভালো লাগলো।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

ধুসর জলছবি এর ছবি

কিন্তু কার্যত মা নিজে নিজের মানবিক অধিকারহীন এক রকম দাসই কি হয়ে পড়েননা?

সেটাই হয়। ধন্যবাদ হাসি

কর্ণজয় এর ছবি

মার্তৃত্ব এবং সন্তানপালন, এই দুটি বিষয়কে সমাজ কাঠামো কীভাবে দেখছে- তার ওপরই অনেককিছু নির্ভর করে। আর লেখাটা ভাল লাগলো।

ধুসর জলছবি এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।