বিবাহবিচ্ছেদ এবং সন্তান বনাম আমাদের জাতিগত অ-সংবেদনশীলতা

ধুসর জলছবি এর ছবি
লিখেছেন ধুসর জলছবি [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৭/০৭/২০১৭ - ১২:৩০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গত কয়েকদিন ধরে বাচ্চার কথা ভেবে বাবা মাকে সবকিছু সহ্য করে নেয়ার উপর প্রচুর লেখাজোকা, বকবক পড়ে, শুনে মাথায় প্রশ্নটা আসল। একটা বাচ্চা সুন্দর ভাবে বড় করতে কি লাগে? একটা সুন্দর পরিবেশ, তাই তো? আসুন একটু চিন্তা করে দেখি তো, আমরা আমাদের বাচ্চাদেরকে কিরকম চমৎকার পরিবেশ দেই, দিচ্ছি?

একটা বাচ্চার জন্য সবচেয়ে কাছের মানুষ তার মা, তাই তো?, প্রতিটা বাচ্চার জন্য তার মা সুপারহিরো, কারণ সেই তাকে আগলে রাখে সকল অসহায়ত্ব আর দুর্দিনে শেষ আশ্রয় হয়ে। এখন সেই সুপারহিরো মাকে যখন আপনি দেখেন মার খেতে? এতটা অসহায় হতে, এতটা যে, জোড়ে কাঁদতে পর্যন্ত পারে না, তখন? যেই মা নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে পারে না সে আপনাকে কি বাঁচাবে দুর্দিনে? এখন আপনি যখন বড় হন এমন একটা বাসায় যেখানে আপনার জীনের একভাগ দাতা অত্যাচারী, আরেকভাগ দাতা অত্যাচারিত, আপনি কি খুব চমৎকার পরিবেশে বড় হচ্ছেন ?

খুব অচেনা লাগছে কথাগুলো? এদেশে ৮৭ ভাগ মহিলা তার স্বামী দ্বারা শারীরিক, মানসিক ভাবে অত্যাচারিত হয়। সহজ ভাষায়, এদেশে ৮৭ ভাগ সন্তান তার মাকে অত্যাচারিত হতে দেখে বড় হয়। এদেশে ৮৭ ভাগ বাচ্চা তার বাবাকে অত্যাচারী দেখে বড় হয়। আপনাদের মধ্যে কতভাগ মানুষ এই জীবনে অস্থির হয়েছেন এই বাচ্চাগুলোর কথা ভেবে? তারা কিসের মধ্যে বড় হচ্ছে, কেমন করে সুস্থ মানুষ হবে এটা ভেবে ভয় পাচ্ছেন কতজন?

এদেশে কতভাগ মানুষ বাচ্চার সামনে মিথ্যে কথা বলে? ইদানীং কালের বাবা মারা তো বাচ্চাকে দেখিয়ে দেখিয়ে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও কিনে। সন্তান আছে এমন কতভাগ মানুষ ঘুষ খায়? কতভাগ মানুষ লোক ঠকায়? অন্যকে আঘাত করে? অন্য ধর্মের মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে? আরেকজনের অধিকার খর্ব করে? বাচ্চাকে প্রতিযোগিতার মেশিন ভেবে কতজন বাবা মা বাচ্চার শৈশব কৈশোর বিষিয়ে দিচ্ছে? কতজন বাবা মা নিজের ইচ্ছেকে বাচ্চার উপর চাপিয়ে দিয়ে বাচ্চার পটেনশিয়ালটি নষ্ট করছে? কতজন বাচ্চার হাতে ট্যাব ধরিয়ে দিচ্ছে কারণ বাচ্চাকে দেয়ার সময়/ ধৈর্য নেই, কিন্তু সমাজের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে ২/৩ টা বাচ্চা না নিলেও চলছে না? নিজেদের হতাশা ক্ষোভ রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে জানেন না বলে কথায় কথায় বাচ্চাকে চড়, থাপড় লাঠির বাড়ি দিচ্ছেন কতজন বাবা মা? বাচ্চার সামনে বাসার গৃহপরিচারিকাকে মারছেন কত জন? এদের সংখ্যা কি খুব কম? মোটেই না। তাহলে এই মানুষগুলো তাদের বাচ্চাকে কি পরিবেশ দিচ্ছেন? সুস্থ, ভাল, বাচ্চা বড় করার জন্য আদর্শ পরিবেশ আমরা তৈরি করতে পারছি? আপনারা কতজন এই বাচ্চাগুলোর কথা ভেবে অস্থির হচ্ছেন?

না, আপনারা শুধু অস্থির হন যখন কেউ শান্তিপূর্ণ ভাবে বিবাহ বিচ্ছেদের সীধান্ত নেন। শান্তিপূর্ণ বললাম কারণ ওই যে, বউ মারলে সমস্যা নেই, বউ থাকতেও আরেকটা রক্ষিতা রাখলে সমস্যা নেই, ঘরে বউ রেখে অফিসে গিয়ে অন্য মেয়েদের জ্বালালে সমস্যা নেই, স্বামী রাতে কাজের বুয়ার বিছানায় গেলে সমস্যা নেই, স্বামী স্ত্রী পরস্পরকে অসম্মান, অবিশ্বাস করলে সমস্যা নেই, সারাদিন খিটমিট/ ঝগড়া/ মারামারি করলে সমস্যা নেই, জামাই বউয়ের মধ্যে মানসিক দূরত্ব কয়েক হাজার মাইল হলে সমস্যা নেই, সমস্যা শুধু ডিভোর্সে?

ডিভোর্স না দিলেই বাচ্চাকে খুব চমৎকার পরিবেশ দেয়া হয়, খুব সুস্থ সুন্দর বাচ্চা বড় হয়? সিরিয়াসলি, চারপাশে তাকান? আপনার যাবতীয় অশান্তি, হতাশা, নোংরামি, অস্বচ্ছতা, দুই নাম্বারি, দুঃখবোধ আপনার বাচ্চার উপর প্রভাব ফেলছে। খালি স্বামী স্ত্রী এক বাসায় থাকলেই বাচ্চা সুস্থ পরিবেশ পায় না। সুস্থ পরিবেশ একটা বিশাল কমপ্লেক্স জিনিস। বাবা মায়ের একত্রে থাকা তার একটা নির্ধারক, একমাত্র নির্ধারক না। বাবা মা একত্রে থেকেও পরিবেশ অসুস্থ থাকতে পারে, আবার বাবা মা আলাদা বাসায় থেকেও সুস্থ পরিবেশ বানানো সম্ভব যদি বাকি নির্ধারক গুলো ঠিক রাখা যায়।

প্রেগ্ন্যাসির সময় অনেক পড়াশোনা করেছি, বাচ্চা কিভাবে সুস্থ বুদ্ধিমত্তার করে বড় করা যায় তা নিয়ে। পড়ে যা পেয়েছিলাম তা হল বাচ্চারা প্রথম বুঝতে শিখে ভালবাসা। আর বুদ্ধিমান, মানসিক ভাবে সুস্থ বাচ্চা বড় করার প্রধান উপায় হল নির্ভেজাল ভালবাসা, আর কিছু না, ম্যাথ শেখাতে হবে না, কঠিন কঠিন শব্দ শেখাতে হবে না, শুধু ভালবাসাময় একটা পরিবেশ দিতে হবে, ব্যাস। ভালবাসাময় পরিবেশ মানে বাচ্চাকে ভালবাসা, বাচ্চার বাবা মা একজন আরেকজনকে ভালবাসা,বাসার বাকি মানুষগুলোও সবাই সবাইকে ভালবাসা। এমনকি বাসার গৃহপরিচারিকাকে আপনি কতটুকু ভালবেসে ব্যবহার করছেন সেটাও আপনার বাচ্চার মানসিক গড়নের জন্য জরুরী। আর যেই বাসায় ভালবাসা নেই সেই বাসা থেকে দূরে থাকা বাচ্চার জন্য মঙ্গল। কারণ ঘৃণা, হতাশা দেখে বড় হওয়া বাচ্চার মানসিক ভাবে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। তাই আপনি সমাজের কথা ভেবে ঘৃণা হতাশা নিয়ে একসাথে থাকলেই বাচ্চার খুব উপকার করে ফেলছেন না। বরং আপনার বাচ্চাকে মানসিক ভাবে অসুস্থ হওয়ার পটেনশিয়ালটি নিয়ে বড় করছেন। ওহ, ভাবছেন আপনার অপছন্দ, হতাশা বাচ্চা বুঝতে পারবে না? আপনার বাচ্চা আপনার আমার চেয়ে বেশী বুঝে, সে আমার আপনার এক ধাপ পরের সংস্করণ।

আসুন একবার চিন্তা করে দেখি, যে কোন উপায়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রেখে আপনি আপনার বাচ্চাকে আসলে কি শেখাচ্ছেন? মার খেয়েও সংসার আঁকড়ে থেকে গিয়ে মেয়েটাকে শেখাচ্ছেন যে জীবনে মার খেয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক, এর কোন প্রতিকার নেই, আর ছেলেটাকে শেখাচ্ছেন মারাটা স্বাভাবিক। অপমানিত হয়ে থেকে গিয়ে আপনার সন্তানকে দেখাচ্ছেন যে আত্মসম্মান জরুরী না, সমাজের ভয় জরুরী। ঘৃণা হতাশা পারস্পরিক অনাস্থা, অবিশ্বাস নিয়ে থেকে গিয়ে আপনি তাকে রিলেশনশিপ নিয়ে ভুল ধারনা দিচ্ছেন। এইরকম ভালবাসাহীন সম্পর্ককে সে স্বাভাবিক ভাবছে, নিজেও ভবিষ্যতে এমন সম্পর্ক চালিয়ে যাবে।আপনি চান আপনার আদরের শিশুটি একটা ভুল সম্পর্ক টেনে নিয়ে গুমরে গুমরে জীবন কাটাক?

আর আপনি সেই সম্পর্ক থেকে বের হয়ে গিয়ে তাকে শেখাতে পারেন যে পরে পরে মার খাওয়া কোন বিকল্প না। আপনি অপমান মেনে না নিয়ে তাকে জানাতে পারেন যে দুনিয়ায় বেঁচে থাকার দুটো, স্রেফ দুটো রাস্তা আছে, আত্মসম্মান সহ অথবা আত্মসম্মান ছাড়া। আর দ্বিতীয় দলের সাথে তেলাপোকার জীবনের কোন পার্থক্য নেই। আপনি ভুল সম্পর্ক থেকে বের হয়ে তাকে বোঝাতে পারেন যে ভুল সে যত বড়ই হোক (আচ্ছা, এই বেলা স্বীকার করে নেন, আমরা সকলেই ভুল করি, করেছি, করব) সেটা থেকে বের হওয়ার সুযোগ সবসময় আছে, থাকবে। একটা ভুল করে ফেললেই সেটাকে আঁকড়ে ধরে জীবন নষ্ট করতে হয় না। কেউ যেহেতু এই পৃথিবীতে দুবার আসবে না, তাই, এক জীবনের ভুলগুলোকে এক জীবনে শুধরে ফেলতে পারাটাই তাই সত্যিকারের সার্থকতা।

এবং আপনি ভুল, দুঃখী সম্পর্কে সন্তানের নাম করে আটকে থেকে তাকে ভাবাচ্ছেন সে দায়ী। আপনার সমাজের বিপক্ষে যাওয়ার সাহসের অভাবের দায়কে আপনি তার ঘাড়ে চাপাচ্ছেন। সে সারাজীবন ভাববে “যদি আমি না থাকতাম,আমার বাবা মা নিজের নিজের জীবন নিয়ে ভাল থাকত, আমার জন্য তারা একটা দুঃখী হতাশ জীবন কাটিয়েছে” কেন মিছে একটা বাচ্চার কাঁধে এত বড় একটা বোঝা দিয়ে বড় করবেন?

আমাদের খুব প্রচলিত একটা কথা আছে, বাবা মা আলাদা হয়ে গেলে বাচ্চারা নষ্ট হয়ে যায়। আমি জানিনা কি পরিসংখ্যানের জোরে এই ধারনা এত বদ্ধমূল। কিন্তু আমিতো অনেক নষ্ট/ অসভ্য ছেলেমেয়ে দেখেছি যাদের বাবা মা একত্রে থাকে, তাহলে? চারপাশ দেখে যা মনে হয়েছে, বাবা মা আলাদা হয়ে গেলে যেই বাচ্চা নষ্ট হয় তার নষ্ট হওয়ার প্রধান কারণ, বাবা মার আলাদা থাকা না বরং বাবা মা আলাদা থাকা নিয়ে সমাজের বাকি লোকজনের প্রতিক্রিয়া, বিষাক্ত মতামত। সেই বাচ্চা স্কুলে গিয়ে কথা শুনবে, খেলার মাঠে টিপ্পনী শুনবে, আত্মীয়স্বজন খোটা দিবে, উঠতে বসতে তার জীবন দুর্বিষহ করব আমরা সবাই মিলে। এখন তো ফেসবুকেও তার বাবা মা অথবা তাকে নিয়ে ট্রল হবে। কোন দুঃসাহসে তার বাবা মা সমাজের বেধে দেয়া নিয়মের বাইরে গিয়ে ভাল থাকতে চাইল, তার শাস্তিস্বরূপ আমরা তাকে আঘাতের পর আঘাত দিব, তার ভুলগুলিকে নিয়ে ব্যবচ্ছেদ করব। আরে, ওর বাবা মার ছাড়াছাড়ি হয়েছে, ও তো এমন করবেই, যদিও সে যা করেছে তা হয়ত এদেশে লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষ করে তবুও। সেই বাচ্চা যাই করুক, তা যত ছোটই হোক আমরা তার বাবা মাকে টেনে আনব, বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করাব। তাকে নষ্ট হওয়ার আগেই নষ্ট বানিয়ে দিব।

তারপর আমরা হা হুতাশ করব আহারে, বাচ্চাটা বাবা মায়ের ছাড়াছাড়ির কারণে নষ্ট হল। কি ভয়াবহ হিপোক্রেসি। আমরা ডিভোর্সের বিরুদ্ধে সোচ্চার হব, কিন্তু আমরা আমাদের নিজেদের অ-সংবেদনশীল আচরণ নিয়ে উদ্বিগ্ন হব না। আমরা স্বামী স্ত্রীকে একসাথে থাকতে বলব সেটা ব্যক্তির জন্য যত ভয়াবহ হোক না কেন, কিন্তু আমরা নিজেদের সহনশীলতা, সহমর্মিতার হাত বাড়াতে শিখব না। আরেকজনের সন্তানের জীবন নিয়ে ফেসবুক ফাটিয়ে ফেলব, কিন্তু নিজের, নিজেদের, আমাদের সকলের সন্তানদের জন্য একটা ভালবাসার, সহায়তার সমাজ বানানো নিয়ে মাথা ঘাঁটাব না। কারণ দিনশেষে আরেকজনের দোষ খুঁজে বের করে গালাগালি করলে নিজেদের দৈনন্দিন হতাশা, ক্ষোভ কমে, তাই না? অহেতুক মাথা খাটিয়ে বেশী কষ্ট করার দরকার কি?

আমি এতসব কথা এজন্য বলছি না যে আপনারা সকলে বিয়ের সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলেন। একটা সুন্দর ভালবাসাময় সম্পর্ক পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস। আমরা সবাই স্বপ্ন দেখি একটা দারুণ সম্পর্কের, একটা ভালবাসায় পরিপূর্ণ ঘরের। কিন্তু বাস্তবতা হল শতভাগ মানুষ সেটা পায় না। ঝামেলা হল যে পায় না তাকেও আমরা সমাজের দায় দিয়ে, সন্তানের ভাল হবার মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে সেই বোধহীন কুয়ায় আটকে রাখতে চাই, রাখি। কেউ সেটা মানতে না চাইলে তাকে পদে পদে জাজমেন্টাল কুরুচিপূর্ণ আচরণ করে জীবন দুর্বিষহ করে ফেলি। ভাবখানা এমন যে সম্পর্কটা ভেঙ্গে তারা পর্যাপ্ত দুঃখ পায় নি! তাই তাদের প্রাপ্য দুঃখ দেয়ার দায়িত্ব পালন করি। এই অদ্ভুত অসংবেদনশীল আচরণ নিয়ে বিন্দুমাত্র লজ্জাও পাই না আমরা!

যে সম্পর্ক ভাঙ্গে, আমি, আপনি খালি চোখে তার শেষ ভাঙ্গনটা হয়ত দেখি, কিন্তু এর আগে সহস্রবারের চেষ্টা আর ব্যর্থতার খবরগুলো, হাজার দুঃখের, অসহায়ত্বের দিনরাত গুলো আপনার আমার খোলা চোখে পড়ে না, পড়া সম্ভবও না। আমরা প্রত্যেকেই একটা আলাদা জীবন নিয়ে আসি, কেউ কারও জীবন কোনদিনও কাটাব না, কেউ কাউকে কখনও পুরোপুরি জানব না। এই সামান্য সত্যটুকু বুঝতে এত কষ্ট কেন আমাদের?

তাই আরেকজনকে না জেনে তার দোষ গুন বিচার করা বন্ধ করুন। আরেকজনের জীবনকে দুর্বিষহ বানানোর জন্য সময় না দিয়ে নিজের জীবনকে সুন্দর বানানোর পিছনে মনোযোগ দিন। নিজে ভাল থাকার চেষ্টা করুন, আরেকজনকে ভাল থাকার সুযোগ দিন। আপনাকে দেখে যেন আপনার সন্তানও নিজেকে এবং চারপাশকে ভাল রাখতে শিখে।

রেফারেন্সঃ Proportion of women experiencing intimate partner physical and/or sexual violence at least once in their lifetime. Source: Bangladesh Bureau of Statistics, 2013. Violence Against Women Survey 2011. Dhaka, Bangladesh.


মন্তব্য

শিশিরকণা এর ছবি

গুরু গুরু
এইটা এই বৃষ্টি দিনে বেশি ঝাল দেয়া ঝালমুড়ির মত হইছে। এত উপাদেয় যে কথা ফেলে দেয়া যাচ্ছে না, আবার ঝালটাও সহ্য করতে চোখে পানি চলে আসছে। দেখি বাঙালির কেমন হজম হয় এইসব কথা।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

ধুসর জলছবি এর ছবি

ইতিমধ্যে গালি খেয়েছি জনগণকে বিবাহবিচ্ছেদে অনুপ্রাণিত করছি বলে। সেটা কখন করলাম যদিও বুঝিনি। বাঙালি লেখার কথাই বুঝে না, হজম কেমনে করবে আর কি বলব। তবুও মাঝে মধ্যে লিখে ফেলি সহ্য করতে না পেরে। মন খারাপ

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধরা যাক একটা কারাগারে থাকা অপরাধীদের মধ্যে আমরা জরীপ চালালাম - তাদের কতজন ভেঙে যাওয়া পরিবারের সন্তান আর কতজন অটুট পরিবারের সন্তান। জরীপের ফলটা কী আসবে সেটা আমাদের ধারণার বাইরে না। তবু আমরা সন্তানের দোহাই দিয়ে জোরজার করে যুযুধান দুইজন মানুষকে একটা সংসার করতে বাধ্য করবো। আমরা এটা ভেবে দেখিনা এই প্রতিদিনের যুদ্ধটা বরং সন্তানের জন্য অধিক ক্ষতিকর।

আমাদের কতগুলো স্থবির ধারণা থেকে বের হতে হবে -

১। যে সম্পর্কে ভালোবাসা নেই, সেখানে পারস্পারিক বিশ্বাস বা আস্থা নেই। এবং ভাইসভার্সা। অমন সম্পর্ককে স্ট্রেইটজ্যাকেটে ঢুকিয়ে টিকিয়ে রাখার দরকার নেই - সেখানে সন্তান থাকুক আর না-ই থাকুক।

২। কারও সাথে প্রেম করলেই তাকে বিয়ে করতে হবে এটা ভিত্তিহীন একটা ধারণা। বিবাহপূর্ব প্রেম আর বিয়ে এক বস্তু না। এমনকি দুইজনে লিভ ইন পার্টনার হলেও তাদের বিয়ে করতে হবে এটাও ভ্রান্ত ধারণা। যদি দুইজনেই পরস্পরকে বিয়ে করতে রাজী না থাকে, প্রস্তুত না থাকে তাহলে বিয়ে করা অনুচিত।

৩। বিয়ে সবার জন্য না। যে মানুষ বিয়েতে অনাগ্রহী বা বিয়ে করার উপযুক্ত না তাকে জোরজার করে বিয়ে দেবার দরকার নেই। বয়স হলেই বিয়ে করতে হবে এটা ভুল ধারণা।

৪। বিয়ে করলেই বাচ্চা নিতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। দু'জন মানুষ পুস্পরকে ভালোবেসে একসাথে থাকার জন্য বিয়ে করে - শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের জন্য না।

৫। শারিরীক কোন অসুবিধা না থাকলে কে কখন সন্তান নেবেন সেটা পার্টনার দু'জনের নিজস্ব ব্যাপার। অন্য কারও উচিত না সেখানে অযাচিত পরামর্শ দেয়া।

৬। কে, ক'টা সন্তান নেবেন সেটা পার্টনার দু'জনের নিজস্ব ব্যাপার। অন্য কারও উচিত না সেখানে অযাচিত পরামর্শ দেয়া।

৭। যদি পারস্পারিক ভালোবাসা ফুরিয়ে যায়, বিশ্বাস হারিয়ে যায়, আস্থা না থাকে তাহলে অবিলম্বে আপোষের ভিত্তিতে বৈবাহিক সম্পর্কটা থেকে বের হয়ে আসুন। বিস্ফোরকের বস্তার উপর বসবাস করা নিরাপদ না।

যেদিন থেকে আপনি আপনার পার্টনারের কাছে অন্য কারো সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলা শুরু করবেন সেদিন থেকে বুঝবেন আপনাদের পারস্পারিক সম্পর্কের কাঁটা দুটো বারোটার দিকে যাত্রা শুরু করেছে। অন্যের কাছে সততা, একনিষ্ঠতা দাবী করার আগে নিজে সৎ হোন - নিজের কাছে, আপনার পার্টনারের কাছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তিথীডোর এর ছবি

আপনার একেকটা মন্তব্য বাঁধিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে!
গুরু গুরু

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

সোহেল ইমাম এর ছবি

আপনার সাত সাতটা পয়েন্টের সাথেই একমত। মনে হলো মনের কথা বলেছেন। চলুক

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

ধুসর জলছবি এর ছবি

গুরু গুরু

সোহেল ইমাম এর ছবি

খুব দরকারি আর খুবই জরুরি কথা গুলো আপনি সুন্দর করে বলেছেন। এই মেসেজটা ঠিক করেছি আমার বন্ধু বান্ধবদের আর পরিচিত জনদের মধ্যে শেয়ার করবো।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

ধুসর জলছবি এর ছবি

ধন্যবাদ

নীড় সন্ধানী এর ছবি

এদেশের বিশাল অংশের মানুষের মধ্যে প্রাইভেসি এবং পরামর্শ এই দুটো ব্যাপারে সাধারণ জ্ঞানের অভাব অত্যন্ত পীড়াদায়ক। খুব শিক্ষিত বলে পরিচিত মানুষদের মধ্যেও এর অভাব প্রকট। দুজন নারী পুরুষ যখন একত্রে বসবাস শুরু করে তাদের মধ্যে অনেক রকমের শারিরীক-মানসিক-আর্থিক-সামাজিক-রাসায়নিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ব্যাপার ঘটতে পারে। বাইরের মানুষ ভেতরের রাসায়নিক ক্রিয়া সম্পর্কে কিছু না জেনে কেবল বাইরের ফলাফল দেখে উপযাচক হয়ে যে পরামর্শ দেয়(ধরে নিলাম উপকারী মানসিকতা নিয়ে), সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় এবং বিরক্তিকর, কখনো কখনো দুর্বিসহও হতে পারে। কোন অবস্থায় পরামর্শ দেয়া চলে, কোন অবস্থায় চলে না সেটা বোঝার ক্ষমতাও অধিকাংশ মানুষের নেই।

বিবাহ বিচ্ছেদ একটা দুর্ঘটনার মতো, কিন্তু সেটাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা এই সমাজের রীতি। কোন কারণে স্বামী স্ত্রী যদি আলাদা থাকারও সিদ্ধান্ত নেয়, সেটাও পাপের পর্যায়ে পড়ে যায়। অথচ আধুনিক জীবনের নানান রকম পরিস্থিতিতে কেউ শান্তিপূর্ণভাবে আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। এই প্রাইভেসিটাকে সম্মান করার মানসিকতাও নেই বেশীরভাগ মানুষের।

ভেঙ্গে যাওয়া সংসারের বাচ্চাদের জীবনটা আসলে কতটা কষ্টকর, সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। অনেক ক্ষেত্রেই নো ম্যানস ল্যাণ্ডের বাসিন্দার মতো অবস্থা হয় তাদের। কিন্তু ভেঙ্গে যাওয়া সংসারের বাচ্চা মানেই নষ্ট হয়ে যাওয়া এ ধারণা একদমই ভুল। সমাজের শীর্ষ অপরাধীদের অনেকেই সুস্থ সুন্দর পরিবারে থেকেও অপরাধের পথে পা বাড়িয়েছিল। খারাপ পরিবেশেও অনেক ছেলেমেয়ে ভালো হয়ে গড়ে উঠতে পারে তার নজির ভুরি ভুরি। আমার দুটো ভেঙ্গে যাওয়া পরিবারকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা আছে, যাদের সন্তানদের কেউই নষ্ট হয়নি বরং সুস্থ সুন্দর পরিবারের সন্তানদের চেয়ে তারা অনেক ভালোভাবে গড়ে উঠেছে। এর কারণ ছিল, তাদের চারপাশের মানুষদের কেউ ভাঙ্গা সংসারের সন্তান বলে তাদেরকে নিগ্রহ করেনি। আবার উল্টো অভিজ্ঞতাও আছে, সবকিছু ঠিক থেকেও চরম অপরাধী মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠেছে এমন পরিবারও দেখেছি।

আসলে কোন অনুঘটক কোন ঘটনা ঘটাবে সেটা কেউ আগ বাড়িয়ে বলতে পারে না। শুভাকাংখী পরিচয়ে যে মানুষগুলো উপযাচক হয়ে পরামর্শ খয়রাত করে, তারা নিশ্চুপ থাকলে ভুক্তভোগীরা অনেক উপকৃত হয়।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

ধুসর জলছবি এর ছবি

বিবাহ বিচ্ছেদ একটা দুর্ঘটনার মতো, কিন্তু সেটাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা এই সমাজের রীতি। কোন কারণে স্বামী স্ত্রী যদি আলাদা থাকারও সিদ্ধান্ত নেয়, সেটাও পাপের পর্যায়ে পড়ে যায়।

সেটাই। ঠিক এই কথাটাই বোঝাতে চেয়েছি। কারও জীবনে দুর্ঘটনা ঘটলে তাকে সাহায্যের বদলে প্যারা কেন দেই আমরা সেটাই আমার মাথায় ঢুকে না। মন খারাপ

শাব্দিক এর ছবি

অসাধারণ লিখেছ!
"সমাজ" নামের এই ব্যবস্থার দোহাই দিয়ে কত জীবন যে দুর্বিষহ হল, তার হিসাব কেউ রাখে না।

---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

সমাজ আজকাল বড্ড সমাজতান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে, সমাজবিচ্ছিন্ন তান্ত্রিক, বহুব্রীহি অর্থে। লেখায় চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এটা বহুব্রীহি নয়, বিকৃত মধ্যপদলোপী কর্মধারয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।