বিবর্তনবাদীর পুরান

এনকিদু এর ছবি
লিখেছেন এনকিদু (তারিখ: সোম, ২৮/০৭/২০০৮ - ৩:১৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

০.

বিবর্তনবাদ বলে আজকের পৃথিবীর সব জীব নাকি আদিম এককোষী জীবের বংশধর । আজ থেকে বহু লক্ষ বছর আগে সাগরের পানিতে প্রথম প্রান বিকাশ লাভ করে । তারপর বিবর্তনের ধারায় ক্রমাগত জন্ম নিতে থাকে বিস্ময়কর প্রানী । চলতে থাকে ততোধিক বিস্ময়কর পথে তাদের বিবর্তন । পৌরানিক কাহিনীর থেকে কোন অংশে তা কম না । আজকের পৃথিবীর সব প্রানী সেই এককোষী প্রানী থেকেই বিবর্তিত হয়ে এসেছে । প্রত্যেক প্রানীর জন্মের সময় বিবর্তনের এই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে । ডিমের ভেতরেই হোক আর মাতৃগর্ভেই হোক, প্রত্যেক প্রানীর জীবন শুরু হয় এককোষী জীব হিসেবে । পানিতে । তারপর তার প্রজাতী বিবর্তনের যেই পথে ঘুরে আজকের রূপ পেয়েছে, সেও একই পথ পরিভ্রমন করে মাতৃ গর্ভে(স্তন্যপায়ী) অথবা ডিমের মধ্যে(পাখি বা সরীসৃপ) অথবা আরো বিশাল কোন জলাধারে(মাছ) । তারপর সে জন্ম নেয় ।

[বিবর্তনে অনাগ্রহীরা ১ বাদ দিয়ে ২ এ চলে যেতে পারেন]

১.

জীবনের শুরুটা হয়েছিল পানিতে । পৃথিবীর স্থলভাগে প্রথমে জীবনের ছোঁয়া লাগেনি । জলভাগ বলতে তখন ছিল এখনের সব মহাসাগরের চেয়েও বিশাল বড় এক জলাশয় । সেই বিশাল মহাসাগরে ছিল কিছু এককোষী জীব । এদের এক দল সূর্যের কাছ থেকে শক্তি আহরন ও নিজের দেহে সঞ্চয় করা শিখে নিল - এরা হল উদ্ভিদ । অপরদল শক্তির জন্য নির্ভরশীল হয়ে উঠল উদ্ভিদকূলের উপর - এরাই প্রানী । বিবর্তন চলতে থাকে এদেরক নিয়েই । এককোষী প্রানী আর উদ্ভিদেরা বংশ বিবর্তিত হয়ে সরল বহুকোষী জীবে পরিনত হয় । তারপর পানি ছেড়ে মাটিতে উঠে এল উদ্ভিদের একটি দল । প্রানীরা তখনো মাটিতে উঠে আসার মত বৈশিষ্ট্য অর্জন করেনি, তার প্রয়োজনও তারা বোধ করেনি । পর্যাপ্ত সূর্যালোক পেলেই উদ্ভিদের চলে, অন্য কিছু তাদের লাগেনা এবং এখানে হুমকি হয়ে দাঁড়ানর জন্য প্রানীর দল নেই । কাজেই উদ্ভিদের দল স্থলে বসবাস ও বংশবৃদ্ধি করতে থাকল নির্বিঘ্নে । আদিম উদ্ভিদদের বংশধরেরা ছড়িয়ে পড়তে থাকে স্থলভাগে এক অঞ্চল থেকে অপর অঞ্চলে । নতুন নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে তাদের অভিযোজন ঘটে । বহু বছরের বিবর্তনের ফলে একসময় সমগ্র স্থল্ভাগ ঢেকে যায় বিচিত্র সব উদ্ভিদে ।

এদিকে জলভাগে প্রানীরাও বেশ বংশবৃদ্ধি করে চলেছে, চলছে তাদেরো বিবর্তন । মহাসাগরে তৈরী হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতীর প্রানীকে নিয়ে এক খাদ্য চক্র । চক্রের সবচেয়ে দূর্বল প্রানীগুলি নির্ভর করে জলজ উদ্ভিদের উপর । এদের থেকে আরো একটু শক্তি শালী প্রানীগুলো এদেরকে শিকার করে । তাদেরকে আবার শিকার করে তাদের থেকেও শক্তিশালী আরেক দল । এরকম চলতে থাকে সবচেয়ে বড় সবচেয়ে শক্তিশালী প্রানীটি পর্যন্ত । খাদ্য চক্রের যত উপরে যাওয়া যায় ভীষণ দর্শন সব প্রানী র দেখা পাওয়া যায় । সারা দেহ শক্ত খোলসে ঢাকা বিকট দর্শন দানব একএকজন । খাদ্য চক্রের একদম নীচের দিকে রয়েছে খোলস বিহীন কিছু দূর্বল প্রানী । প্রায় সবারই এরা খাদ্য, সবারই এরা শিকার । খোলস বিহীন প্রানীগুলোর মধ্যে একটি প্রজাতির মাথা থেকে দেহের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত লম্বালম্বি ভাবে বসানো ছিল স্নায়ুরজ্জু । এই স্নায়ুরজ্জুটাই তার দেহের উপর নিয়ন্ত্রন বজায় রাখে । বিচিত্র স্নায়ুতন্ত্রের সাহায্যেই অতি দ্রূত সাঁতরে এড়িয়ে যায় শিকারীর চোয়াল ।

বিবর্তনের নিয়ম বড়ই আজব । দূর্বলকে টিকতে দেয়না সে মোটেও আবার কাউকে সহজে নিশ্চিহ্ন হতেও দেয়না । একই সাথে দূর্বলের প্রতি সে খুবই নিষ্ঠুর আবার জীবনের যেকোন নমুনা, যেকোন জীব - সে যতই দূর্বল হোক, শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় গুনাবলী অর্জন করতে সাহায্য করে ক্রমাগত । সবচেয়ে শক্তিশালী জীবেরও থাকে ভীষণ দূর্বলতা । সবচেয়ে উন্নত সর্ববৃহৎ আর জটিল প্রানীও কুপোকাত হয় একেবারে অনুন্নত প্রানের সরলতম নমুনা - এককোষী জীবানুর হাতে । একক ভাবে কেউ সর্বশক্তিমান হতে পারেনা, আবার সবচেয়ে যে দূর্বল, উপযুক্ত পরিস্থিতিতে সেও পাকা শিকারী ।

স্নায়ুরজ্জুর অধিকারী প্রানীটিও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য বিবর্তিত হল । স্নায়ুরজ্জুটির চারপাশে তৈরী হল তরুনাস্থি, সেই সাথে আরো কিছু তরুনাস্থি নিয়ে তৈরী হল তার কঙ্কাল । সেই সাথে স্নায়ুতন্ত্র এবং মস্তিষ্কের খানিকটা উন্নতি ঘটিয়ে সেই হল পৃথিবীর প্রথম মেরুদন্ডী প্রানী । শক্ত খোলসে ঢাকা শিকারীদের অনেকেরই ছিল শত জোড়া উপাঙ্গ । তাদের সাথে পেরে উঠতে সেও বিবর্তিত হয়ে দুই জোড়া উপাঙ্গ পেল । শিকার বা আত্নরক্ষায় তার উপাঙ্গ জোড়া এখনো খুব একটা কাজে না লাগলেও তার চলাফেরায় বিরাট পরিবর্তন এনে দিল । খুব অল্প সময়ের মধ্যেই উপাঙ্গ গুলোর আরো উন্নতী সাধন করে সেগুলোকে করে নিল জলের নীচে চলাফেরার কার্যকর অঙ্গে । চলাফেরায় পরিবর্তন আসতেই একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছিল । শক্ত খোলসে ঢাকা প্রানীগুলোর আত্নরক্ষা ও শিকারের কৌশল যতই উন্নত হোক, তাদের চলাফেরা খুবই বৈচিত্র্যহীন । খোলসে ঢাকা শত জোড়া উপাঙ্গে যতই জোড় থাকুক, সেই অঙ্গের সঞ্চালনের সীমিত । সেই তুলনায় খোলসবিহীন দেহের নমনীয় উপাঙ্গের সঞ্চালন রীতিমত সীমাহীন । ক্রমে তার তরুনাস্থি সর্বস্ব কঙ্কালে দৃঢ়তা আসল, পেল হাড়ের কঙ্কাল । সেই কঙ্কালকে কাজে লাগিয়ে চলাফেরার জন্য জেলীরমত নমনীয় দেহে তৈরী হল পেশী ।

ততদিনে খোলসে ঢাকা অমেরদন্ডী প্রানীদের একটি দল ডাঙ্গার উপর উঠে এসেছে । পানির নীচে ভারী খোলসে খুব একটা সমস্যা হয়না, কিন্তু পানির উপরে চলাফেরা করতে হলে চাই হালকা খোলস । বিবর্তিত হয়ে তারা খোলস হাল্কা করে নিল, সেই সাথে হারাল বেশ খানিকটা নিরাপত্তা । তবে তাতে খুব একটা সমস্যা হয়নি সেই সময় কারন তাদেরকে শিকার করার মত কেউ তখন মাটির উপর ছিল না । বরং তারাই মনের সুখে মাটির উপর উদ্ভিদকূলের উপর নির্ভরশীল হয়ে বসবাস ও বংশবৃদ্ধি করতে থাকে । এরাই ভূপৃষ্ঠের প্রথম কীট পতঙ্গ । আবার শুরু হয় জটিল এক খাদ্য চক্রের । আবারো শুরু হয় টিকে থাকার তুমুল প্রতিযোগীতা আর সেই প্রতিযোগীতায় টিকে থাকার জন্য হাড্ডাহাড্ডি লড়াই । বিবর্তনের জটিল প্রক্রিয়া আবার নিজেকে প্রকাশ করে শত বিস্ময়কর গঠন আর বৈশিষ্ট্যের প্রানীর মাধ্যমে ।

পানির নীচে খাদ্য চক্রে ততদিনে অনেক কিছুই বদলে গেছে । কয়েক লক্ষ বছর আগেই পানি থেকে উঠে আসা কীটের কোন বংশধর যদি কোন কারনে পানিতে ফিরে যায় তাহলে দেখতে পাবে তার দাদা পরদাদাদের আমলের সুদিন আর নেই । পানির নীচে শক্ত খোলস আর বহুজোড় বিশিষ্ট পায়ের অধিকারী প্রানীরা টিকে থাকার লড়াইয়ে ধীরে ধীরে হেরে যাচ্ছে মেরুদন্ডীদের কাছে । হ্যাঁ, মেরুদন্ডীদের কাছে, মেরুদন্ডীরা এখন অনেক প্রজাতি মিলে বড়সড় এক গোষ্ঠী । গত কয়েক লক্ষ বছরে মেরুদন্ডীদের মধ্যে থেকে বিবর্তন ক্রমাগত জন্ম দিয়ে গেছে উত্তরোত্তর সবলতর প্রানী । আর তাদের উপাঙ্গ গুলো হয়ে উঠেছে সবল এবং পানির নীচে সাঁতরে চলাফেরার বিশেষ উপযোগী । একসময় খাদ্য চক্রের নীচের স্তরে পড়ে থাকা খোলসহীন মেরুদন্ডীর বংশধরেরা আজ উঠে এসেছে খাদ্যচক্রের বেশ খানিকটা উপরে । এরাই মৎসকূল । আজ অমেরুদন্ডীদের শিকার তারা হয় কম, বরং ছোটখাট অমেরুদন্ডীদেরকে আজ তারা শিকার করে অনায়াসে । তাদের পরিপাকতন্ত্রের তীব্র রাসায়নিক পদার্থের প্রভাবে অমেরুদন্ডীর খোলস ক্ষয়ে হজম হয়ে যায় ভেতরের কোমল অংশ । পানির নীচে অমেরুদন্ডীরা ধীরে ধীরে প্রাধান্য হারাতে থাকে মাছেদের কাছে ।

একসময় মেরুদন্ডীরাও একজন দুইজন করে উঠে আসতে থাকে স্থলভাগে । প্রথম দিকে তারা আধাআধি ভাবে জলে-স্থলে দুই জগতেই চলাফেরা করত । স্থলে চলত শিকার, খাদ্যগ্রহন । আর প্রজনন থেকে শুরু করে জীবনের জন্য অপরিহার্য বাকি সব কাজ চলত পানিতে । এরাই ছিল পৃথিবীর প্রথম উভচর । স্থলে উঠে আসলেও, জলের সাথে তারা রয়ে গেল ঘনিষ্ঠ হয়ে । তবে উভচর জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য অভিযোজন ঘটল অনেক । দেহের ভার বহন করার জন্য পানির নীচে সাঁতারে চলার উপযোগী উপাঙ্গ গুলো হয়ে গেল 'পা' । উভচরদের মধ্যে থেকেই জন্ম নিল মেরুদন্ডীদের আরও দুটি বিশেষ গোষ্ঠী । একদলের সারা দেহ আঁশে ঢাকা - এরা হল সরীসৃপ । বিবর্তন এদেরকে করে তুলেছে পুরোদস্তুর ডাঙ্গার জীব । ডাঙ্গার জীব হলেও তাদের জীবন শুরু হয় পানি থেকেই । পানির থেকে দূরে গিয়েও কিভাবে পানিতে জীবন শুরু করা সম্ভব ? সম্ভব যদি পানিকে নিজের সাথেই বহন করা যায় । নিজের দেহের ভেতর ডিম নামের আধারে করে বয়ে বেড়ায় তারা পানিকে । সেই পানিতে শুরু হয় পরবর্তী প্রজন্মের জীবন । সরীসৃপদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য পানির সাথে সম্পর্ক একেবারে ছিন্ন করল না । রয়ে গেল পানির আশেপাশেই, কেউ কেউ আবার ফিরে গেল পানিতেই । সরীসৃপদের মধ্যে থেকেই পরে জন্ম নিল পক্ষীকূল - উড্ডয়নক্ষম মেরুদন্ডী প্রানী । আকাশে মুক্ত হয়ে উড়ার ক্ষমতা অর্জন করে ফেললেও তারা পানির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলনা । পূর্বপুরুষ সরীসৃপদের মত তাদেরও জীবন শুরু হয় পানিতেই । পার্থক্য শুধু তাদের ডিম নামক আধারটি সাধারনত হয় ক্যালসিয়ামের শক্ত খোলসে ঢাকা ।

উভচরদের বংশধরদের মধ্যে আরেক গোষ্ঠী লোমশ দেহের অধিকারী । পূর্বের সব মেরুদন্ডী প্রানীদের থেকে এরা আলাদা । এরা উষ্ণ রক্তের জীব । নিজের জন্য প্রয়োজনীয় উত্তাপ তারা তৈরী করতে পারে নিজের দেহেই । সেই মূল্যবান উত্তাপটুকু ধরে রাখার জন্যই তাদের লোমশ দেহ । জীবন এদেরো শুরু হয় পানিতেই । সরীসৃপের মত এরা ডিম পাড়ে না । এরা জলাধার বয়ে বেড়ায় নিজের দেহের ভেতরেই । দেহের ভেতরেই জলাধারে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে এদের সন্তানেরা । জন্মের সময় তারা ডিম ফুটে বের হয়না, ভূমিষ্ট হয় । স্তন্যপায়ীদের মধ্যে জন্ম নিল অসংখ্য সব জীব । বিচিত্র তাদের বৈশিষ্ট্য । কেউ তৃনভোজী কেউ মাংসশাসী । কেউ বিশাল কেউ অতি ক্ষূদ্র । এদের কেউ কেউ বহু বছর পর আবারো ফিরে গেল পানিতে । কয়েকজন আবার স্তন্যপায়ীর উন্নত গঠন নিয়ে পানিতে ফিরে গিয়ে তৈরী করল জলচর জীবদের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিস্ময় - তিমি'র বংশ । এরা বরফ যুগ পর্যন্ত টিকে রইল কোন রকমে । এর আগে তাদের পাত্তা পাওয়া যায়নি খুব একটা । কারন তার আগে অনেক বড় মাংসশাসী প্রানী, বিশালাকার সরীসৃপের দল পৃথিবীতে দাপড়ে বেড়াত । বরফ যুগে সেই সরিসৃপের দল নির্বংশ হয়ে যাওয়ার পর এরাই হয়ে উঠল পৃথিবীর খাদ্যচক্রের সবচেয়ে উপরের কয়েকটি স্তর ।

তৃনভোজী স্তন্যপায়ীদের আরেকদল গাছে গাছে কাটিয়েদিল বহু বছর । গাছের ডালে তাদের আজব জগৎ । সেখানে চলাফেরার উপযোগী করতে তাদের দুই জোড়া পা বদলে গেছে অনেকখানি । এরা হল বাঁদর । মাটিতে যতদিন ভয়ঙ্কর সব সরীসৃপ আর মাংসশাসী প্রানির দল চলাফেরা করত এরা ততদিন মাটিতে সুবিধা করতে পারেনি । বাধ্য হয়েই বড় বড় গাছের ডালে তারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছে । এক সময় এদের একটি দল গাছের ডাল থেকে মাটিতে নেমে এল চিরদিনের জন্য । বহু বছর পর আবারো মাটিতে ফিরে আসার অনুভুতিটা কেমন ছিল আমরা আজ জানিনা । তাছাড়া ঘটনাটা কারো একার দ্বারা একদিনেও ঘটেনি । ঘটনার নায়ক নায়িকারা নিজেদের অজান্তেই ঘটিয়ে বসেছিল যুগান্তকারী একটি ঘটনা । বিবর্তনের পুরানে এই সম্ভবত সর্বশেষ বড় ঘটনা । সেই যে তারা নেমে এল গাছ থেকে, তারপর আর ফিরে যায়নি গাছের ডালে । পৃথিবীর ছোট্ট এক কোনায় ঘটেছিল এই ঘটনা । তার পর এক সময় তাদের বংশধরেরাই ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে । অনেক ঘুরল পৃথিবীর প্রান্তর থেকে প্রান্তরে দল বেঁধে । ঘুরে ঘুরে অনেক মরল, মাঝে মাঝে তারাও মার দিল, আর যখন পারে বিপদ পাশ কাটিয়ে দূরে দিয়ে সরে পড়ল । এছাড়া উপায় ছিলনা, কারন তারা দাঁত-নখ-শিং বিহীন নিতান্ত দূর্বল এক প্রজাতী । অনেকটা সেই বহু লক্ষ বছর আগে সাগরজলে বসবাসরত সব মেরুদন্ডী প্রানীর অভিন্ন পূর্বপুরুষের মত । তখন সারাদিনে জনপ্রতি একটা করে ফল-মূল কিছু খুঁজে পেলে আর সারাদিনে দলের কেউ মারা না পড়লেই দিনটা খুব ভাল গেল বলে তারা ধরে নিত । খুব ধীরে ধীরে অবস্থা বদলাতে থাকে । এক সময় এরা শিখে ফেলে শ্বদন্ত ছাড়াও কিভাবে মরন কামড় দেয়া যায় এবং আরো অনেক কিছু । আরো অনেক বার মরার এবং মারার পর তারা বুঝতে শিখল, তারা পৃথিবীতে খাদ্য গ্রহন এবং প্রজনন ছাড়াও অন্য কিছু করার সময় ও সুযোগ পাচ্ছে । এই বোধ তাদের মধ্যে যখন আসল, তত দিনে গাছ থেকে নেমে আসা বাঁদরদের বংশধরদের অনেক কিছুই বদলে গেছে । সারা দেহ জুড়ে থাকা ঘন লোমের আবরন অনেকটাই পাতলা হয়ে এসেছে । হাত গুলো আগের থেকে দূর্বল হয়ে পড়েছে, কিন্তু হয়ে উঠেছে অনেক সূক্ষ্ম কাজের উপযোগী । পা দুটি হয়ে উঠেছে বিশেষ ভাবে বলিষ্ঠ । আর সবচেয়ে বড় কথা, তাদের মেরুদন্ড হয়ে গেছে একেবারে ঋজু । খাদ্য গ্রহন আর প্রজননের চিন্তার বাইরে চিন্তা করতে শিখে ফেলেছে তারা - এই বোধ আসার পর প্রথম তারা তাদের ঋজু দেহ টানটান করে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখল । তাদের কাছে মনে হল পৃথিবীটা পৃথিবীটা সুন্দর । সেদিন থেকে পৃথিবী সুন্দর হল, এর আগে কেউ পৃথিবীকে সুন্দর বা অসুন্দর কিছুই বলেনি । বাঁদরের বংশধরেরা বদলে দিল পুরা পৃথিবীর রূপ ।

২.

দুইপাওয়ালা ঋজু দেহের একটি জীব এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে সাগরের পাড়ে । লক্ষবছর আগে পৃথিবীর রূপ বদলে দিয়েছিল যারা তাদেরই এক বংশধর । আর্ধেক চাঁদের আলোতেও সৈকতে তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । আগেও অসংখ্য বার সে অনেক ঝামেলা করে সাগরের পাড়ে এসেছে । প্রতিবারের মত এবারো সীমিত সময়ের জন্য । আরো একবার সূর্যোদয় দেখার পর তাকে ফিরে যেতে হবে যেখানে তার বসবাস, শিকার, খাদ্যগ্রহন আর প্রজননের সহ সব কাজ হয় । সাগরতীর থেকে সেই জায়গা অনেক দূরে । বহু বছর আগের জলজ পূর্বপুরুষদের সাথে তার আজ বিশাল পার্থক্য । জীবন ধারনের জন্য প্রয়োজনীয় কোন কিছুর জন্যই সে সাগরের উপর সরাসরি নির্ভরশীল না । তবুও বার বার সাগরের কাছে চলে আসে আজব একটা অনুভূতির টানে । সুখ-দুঃখের শ্রেনীবিভাগের অনেক ঊর্ধ্বে সেই অনুভূতী ।

এই মুহূর্তে সে জোয়ারের পানি এগিয়ে আসা দেখছে মন্ত্রমূগ্ধ হয়ে । একটার পর একটা ঢেউ এগিয়ে এসে প্রতিবার শুকনো বালিয়াড়ি থেকে আরো একটু বেশি অংশ ভিজিয়ে দিয়ে যেতে থাকে । প্রতিবার ফিরে যাওয়ার সময় রেখে যায় কিছু একান্তই সামূদ্রিক জিনিস । কিছু ঝিনুকের খোলস, কয়েকটা জলজ উদ্ভিদ আর ভাল করে খুঁজলে পাওয়া যায় বেশ কিছু জীবন্ত সামূদ্রিক প্রানী । এই একটি দৃশ্য সে দীর্ঘক্ষন ধরে দেখতে পারবে কোন একঘেয়েমী বোধকরা ছাড়াই । প্রতিটি ঢেউ ভিন্ন, প্রতিটি ঢেইউয়ের সাথে ভেসে আসে নতুন কিছু জিনিস, বালির উপর প্রতিটি ঢেউয়ের রেখে যাওয়া দাগগুলোও একে অপরের থেকে ভিন্ন । লক্ষ লক্ষ বছর আগে তার পূর্বপুরুষ আদিম উভচরেরা এই রকম ঢেউয়ের উপর ভর করেই এগিয়ে আসত ডাঙ্গার দিকে । এই জন্যই কি তার এই দৃশ্য এত ভাল লাগে ? দুইপাওয়ালা জীবটা বুঝতে চেষ্টা করে কিন্তু বুঝে না । তার বুঝতে পারার কথাও না ।

মাত্র হাজার খানেক প্রজন্ম আগেও এর পূর্বপুরুষেরা বুঝতে পারত প্রকৃতির অনেক কিছু । খাদ্য গ্রহন আর প্রজনন ছাড়াও অন্যান্য বিষয় নিয়ে চিন্তা করার মত গুনাবলীর বিকাশ ঘটেছিল তাদের মাঝে । কিন্তু গত কয়েক প্রজন্ম থেকেই তারা খুব বিপন্ন বোধ করতে শুরু করেছে, সব চিন্তা ভাবনা তাই কেন্দ্রীভূত করেছে খাদ্য গ্রহন এবং প্রজননের দিকে । আজ এদের অবস্থা হয়েছে অনেকটা সমাজবদ্ধ কীটের মত । খায় দায় বংশবিস্তার করে, জীবনে আর কিছু নাই । সূর্য উঠলেই তারা নেমে পড়ে খাদ্য আর প্রজননের চিন্তায় । এর চাইতে বেশি কিছু তারা জানে না । এদের ধারে কাছে বুদ্ধিমত্তার অপর কোন জীবের আবির্ভাব না হওয়া পর্যন্ত এদের অবনতীর এই ধারা চলতেই থাকবে । কারন প্রতিযোগীতার সঙ্কটে বিবর্তন স্থবির হয়ে পড়ে । আর প্রতিযোগীতা শূন্য পরিবেশে তা উল্টোদিকে যেতে থাকে । যেমন হয়েছে এই দুইপাওয়ালা জীব গুলোর ক্ষেত্রে ।

বিবর্তন কোন বৈশিষ্ট্য সহজে নিশ্চিহ্ন হতে দেয় না । মাঝে মাঝেই উপযুক্ত পরিবেশে সেই সুপ্ত বৈশিষ্ট্য গুলো তাদের অস্তিত্ব জানান দেয় । বিবর্তনের ধারায় এর ভেতরে সুপ্ত হয়ে যাওয়া অনুভূতী গুলো সমূদ্রের কাছে আসলেই জেগে উঠতে থাকে । আবার দূরে চলে গেলেই সেগুলো লুকিয়ে যায় অবচেতন মনের অনেক গভীরে । যথেষ্টবার সমূদ্রের কাছে আসলে এই জীবটির ভেতরে সুপ্ত গুনগুলো প্রকট হয়ে উঠবে । বিশাল জলাশয়ের কাছে আসলে জীবনের যেকোন নমুনা, তা সে যত ক্ষূদ্রই হোক, উদ্বেলিত হবেই । বহু প্রজন্ম ধরে তার পূর্বের জীবনের সমস্ত অভিযানের ইতিহাস তার মজ্জাগত । তার মধ্যেই রয়েছে তার পূর্বপুরুষেরা, তারই পূর্বের সব জীবন । সময় হলে তার পূর্ব জীবনের অভিজ্ঞতাই তাকে চিনিয়ে দেবে কোনটা কি । এসবই তার মজ্জাগত । তবে আপাতত এই ব্যপারে কারোই কিছু করার নেই । আমরা শুধু আশাই করতে পারি সে যেন আবারো ফিরে আসে সাগরের পাড়ে, আজব এই অনুভূতির টানে ।


মন্তব্য

কীর্তিনাশা এর ছবি

দারুন লিখেছেন!
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিষাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

এনকিদু এর ছবি

ধন্যবাদ ।
তবে আমার সন্দেহ আছে, আদৌ এটা কিছু হয়েছে কিনা বুঝতে পারছিনা ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

রাফি এর ছবি

এক বাদ দিয়ে দুই এ আসলাম; তাতেও মাথা ঘুরতেছে। খালি পেটে গুরুপাক হয়ে গেছে বোধহয়।
দেখি আরেকদিন সবটা পড়ব.

---------------------------------------
অর্থ নয়, কীর্তি নয় ,স্বচ্ছলতা নয়-
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে;

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

এনকিদু এর ছবি

আগেই বলেছিলাম 'পইড়েন না' ।
পড়লেন কেন ?
আমার দোষ নাই ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

দিগন্ত এর ছবি

সুন্দর গদ্য জটিল হয়েছে হাসি


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।