পঞ্চব্যাঞ্জন ও জনৈক বিদেশী

এনকিদু এর ছবি
লিখেছেন এনকিদু (তারিখ: সোম, ০৪/০৮/২০০৮ - ২:০৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের দুই বিদেশী সহকর্মী ইয়ান এবং য়ান । প্রথম দিকে এদের দুইজনের নামের উচ্চারন আমরা আলাদা করতে পারতাম না, তবে কয়েকবার শোনার পর বুঝে ফেলেছি কার নাম কিভাবে বলতে হয় । তবে এরা এখনো আমাদের সবার নাম ঠিকমত বলতে পারেনা । বাংলা-ভাষী হয়ে জন্মানোর বহু সুফলের একটি হল অনেক ভাষার আজগুবি উচ্চারন সহজেই আয়ত্ত্ব করা যায়, কিন্তু সেই আজগুবি ভাষাভষীরা অনেক চেষ্টাতে বাংলার অংশবিশেষ মাত্র ঠিকমত উচ্চারন করতে পারে - যে অংশের উচ্চারন গুলো তাদের ভাষার সাথে মিলে । এই যেমন ইয়ান আর য়ানের কথাই ধরা যাক । তাদের মাতৃভাষায় D এর উচ্চারন 'ড' এর মত না, 'দ' এর মত । দুপুরে আমরা ভাত খেতে বসি যখন, এরা বসে একবাটি দুধ আর কর্নফ্লেস্ক নিয়ে । খাবার টেবিলে বসে বলে, "can I have some গরোম দুদ please", 'ধ' উচ্চারণ করতে পারেনা । 'গরোম দুদ' এর বাটিটা তার সামনে রেখে গেলে পরিচারককে বলে "দন্যবাদ" । দুপুরে খাবার সময় আমরা আয়েশ করে মাছ মাংস ডাল ভাত খাই আর এই বেচারা খায় গরোম দুদ আর কর্নফ্লেক্স । প্রতিদিন কর্নফ্লেস্ক আর গরোম দুদ এর অত্যাচার থেকে বাঁচানর জন্য একদিন আমরা তাদেরকে দুপুরে আমাদের সাথে বাঙ্গালি খাবার খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিলাম "কড়াই গোসত" নামে ধানমন্ডির মোটামুটি নামকরা একটি রেস্তোরাঁয় । বিরাট উৎসাহ নিয়ে নিমন্ত্রন রক্ষা করতে গিয়েছিল ইয়ান । য়ান যেতে পারেনি । তার তখন হাল্কা জ্বর ছিল, বাংলাদেশের আবহাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি তখনো ।

ইয়ান সবার আগেই রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসেছিল, তার সাথে ছিল আমাদের কেউ একজন । এরপর আমি ঢুকলাম, আমার সাথে রাবন । একটু পর স্পর্ষ, মাচুপিচু, শৌজিং (যথারীতি মাচুকে গালাগালি করতে করতে) এবং অন্যেরা এল । বাকি থাকল মারদুক, সে এটিএম থেকে টাকা তুলতে গিয়েছে । ইয়ানের মুখোমুখি বসলাম আমি, আমার ডানে স্পর্ষ । ইয়ানের ডানে শৌজিং আর বামের আসন টা খালি রাখা হল মারদুকের জন্য, বাকিরা যার যার মত বসে পড়েছে । একটু পরেই মারদুক এল, তার জন্য রেখে দেয়া জায়গায় বসতে বসতে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল ।

"য়ান কই ?", ইয়ানের কাছে জানতে চায় মারদুক ।

"য়ান এখন বিছানায়, আনুভূমিক ভাবে শায়িত", জানায় ইয়ান ।

"মানুষ উলম্ব ভাবে শায়িতে হয় কেমনে আমার জানা নাই, শায়িত হতে হলে আনুভূমিকই হবার কথা", মারদুকের এই কথায় সবাই হেসে ওঠে ।

একটু পর খাবারের তালিকা দিকে আমরা মনযোগ দিলাম । ইয়ান জিজ্ঞেস করলাম পছন্দের কোন খাবার আছে কিনা । উত্তরে সে হাত-মুখ নেড়ে এবং বিশেষ মুখভঙ্গী করে যা বলল তার অর্থ হল অনেকটা এরকম : "আমি অভিযান করতেই এসেছি, বিস্ময়কর যা কিছু খাওয়াবে তাই খাব অনেক মজা করে । শুধু একটু খেয়াল রেখ - আমার মুখের ভেতরে দিলে বাইরেটাও লাল হয়ে যায় এরকম ঝাল কিছু যেন না থাকে ।"

ঝাল এদের সয় না । এর আগে এক জাপানীকে ঝাল খেয়ে প্রায় মরার দশা হতে দেখেছিলাম । আমরা যতখানি ঝাল স্বাদ পেলে "জীভে জল আসে", সেই পরিমান ঝালে এদের "কলিজার পানি বের হয়ে যায়" । আমরা চিন্তা ভাবনা এবং আলোচনা করে ভাতের সাথে ডাল, নিরামিষ, বেগুন ভাজি, কয়েক রকম ভর্তা নিলাম ।

ইয়ান এর মাঝে বলল, "তোমরা তো অনেক রকম ভর্তা খাও তাইনা ? আমরাও smashed potato খাই " । বেশ, আলু ভর্তাও যোগ হল । এই রেস্তোরাঁতে "কড়াই গোসত" নামের গরুর মাংসের একটা ভাল রান্না হয়, আমরা তার ভাল ভক্ত । বিশেষ ব্যঞ্জন হিসেবে সেই জিনিসও নিলাম । মাছ না খেলে বাঙ্গালি হওয়া যায় না, তাই ইলিশ মাছ ভাজাও নেয়া হল কয়েক ফালি । ইয়ান সবকিছুতেই রাজি, অভিযান বলে কথা ।

খাদ্যের পর পানীয়ের প্রসঙ্গ উঠলে ইয়ান সবার আগে বোরহানি খাবার বায়না ধরল । কে নাকি তাকে বলেছে এই দেশে বোরহানি নামে একটা ভাল জিনিস পাওয়া যায় । আমরা নিজেরা বোরহানি এমনিতেও নিতাম, ইয়ানের জন্য বোরহানি এবং কোক উভয়ই নেয়া হল । টেবিলে খাবার আসতে খানিকটা সময় লাগবে । আমি এই সুযোগে ইয়ান কে বুঝিয়ে দিলাম বোরহানি জিনিসটা আসলে কী । সবশুনে ইয়ানের মন্তব্য, "এখানে সব রকম স্বাদ - টক, ঝাল, মিষ্টি একটু একটু করে আছে । বেশ বেশ । এই জিনিসেরই নাম বোরানি ।" এদের ভাষায় এই আরেক সমস্যা, 'হ' ধ্বনি সম্ভবত অনুপস্থিত, তাই 'হ' বাদ দিয়ে কথা বলে এরা । কারো নাম "রাহেদ" হলে ডাকে "রায়েদ", নাম "মাহমুদ" হলে ডাকে "মামুদ" ইত্যাদি ।

" বোরানি না, বোরহানি ", আমি শুধরে দেই ।

" বোর আনি ? "

" এভাবে না. বলার চেষ্টা কর 'bore' তারপর 'honey', তারপর দুটো একসাথে করে বলার চেষ্টা করে দেখ, তাহলে কাজ হতে পারে । ", বলি আমি ।

" বেশ, বোরআনি । ঠিক আছে না ? ", সঠিক উচ্চারণ করতে পারার আনন্দে ইয়ানের চোখ ঝিলিক দিচ্ছে । আমি আর বেচারার আনন্দটা মাটি করলাম না ।

" হ্যাঁ চলবে । এটার নামে যদিও 'honey' আছে, এর স্বাদ কিন্তু কোনদিক থেকেই 'honey'র কাছাকাছি না । সাবধানে খেও । "

" হুমম, ভাল জিনিস মনে করিয়ে দিয়েছ । তোমাদের কে একটা ব্যপারে সাবধান করে দিচ্ছি । আমাকে মারাত্নক কিছু খাইয়ে দিওনা কিন্তু । যদি আমার কিছু হয়ে যায়, তাহলে আমার বউ প্রথম যেই বিমান পাবে তাতে চড়ে বাংলাদেশে এসে হাজির হবে । তারপর তোমাদেরকে পেঁদিয়ে সোজা করে দিবে । "

" সেক্ষেত্রে আমাদেরও মনে হয় তোমার আর য়ানের সাথে হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হওয়া লাগবে, তবে আনুভূমিক না হয়ে তোমার বউয়ের প্যাঁদানির কল্যানে আমাদেরকে উলম্ব হয়ে বিছানায় উঠে পড়তে হবে ", পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে মন্তব্য করে মারদুক ।

" হ্যাঁ, সবাই এক বিছানায় বান্ডিলে বেন্ধে উঠা লাগবে ", দিব্যদৃষ্টিতে দৃশ্যটা দেখতে পাই আমি । আমরা সবাই দশে মিলি করি কাজ, প্যাঁদানি খাই নাহি লাজ । তাই বান্ডিল বেন্ধে আমাদেরকে খাড়া করে হাসপাতালের বিছানায় উঠানো হয়েছে । আমাদের এক পাশের বিছানায় ইয়ান নিজে আনুভূমিক ভাবে শায়িত । "মারাত্নক জিনিস" খেয়ে আধমরা । তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে কটমট করে তাকিয়ে আছে ইসাবেল, ইয়ানের স্ত্রী । আমাদের অপর পাশের বিছানায় য়ান, সেও আনুভূমিক ভাবে শায়িত । চোয়াল ভাঙ্গা চেহেরায় একটা দুষ্টুমি হাসি, যার অর্থ " এখন কেমন লাগে মামারা ? আমাকে ফেলে বাঙ্গালি খানা খাও ? "

ইসাবেল এর ছবি দেখেছি ফেসবুকে, সামনাসামনি কখনো দেখিনি । গায়ের জোর কেমন হবে কে জানে । আমাদেরকে পেঁদিয়ে তারপর বান্ডিল বাঁধবে নাকি বান্ডিল বেঁধে তারপর পেঁদাবে - এই ব্যাপারে একটা ইয়ানকে কিছু জিজ্ঞেস করাটা উচিৎ হবে কিনা ভাবছিলাম, তখনি পরিচারক সবার জন্য বোরহানি নিয়ে এল ।

সবার সামনে এক গ্লাস বোরাহানি দেয়া হয়ে গেলে ইয়ান নিজের গ্লাস হাতে নিল । উৎসাহ দেয়ার জন্য আমি একটা দেঁতো হাসি দিলাম । হাসি নাকি দুইজন মানুষের মধ্যে সংক্ষিপ্ততম পথে সংযোগ স্থাপন করে । প্রথমে ইয়ান জিনিসটা নাকের কাছে নিয়ে শুঁকল ।

" গন্ধটা আজব ", বোরহানি সম্পর্কে তার প্রথম মন্তব্য । তারপর ছোটখাট একটা চুমুক দিল গ্লাসে । তারপর কিছুক্ষন নিরবতা ।
" আমার গলা থেকে শুরু করে তলা পর্যন্ত সব অনুভব করতে পারছি ! " এরপর আবারো নিরবতা ।
" আরে, জিহ্বার উপর কিচ্ছু জমে নেই । সব গলা দিয়ে নেমে গেল কিন্তু জিহ্বার উপরে সেই স্বাদ জমে থাকল না । জিহ্বার উপরে পানিয়ের স্বাদ বসে থাকলে খুব খারাপ লাগে । এই পানীয়টা আসলে খুবই ভাল । " আরো এক চুমুক, আগের থেকে একটু বড় । আবারো নিরবতা ।
" মনে হয় আমি এর ভক্ত হয়ে যাব ", ঘোষনা দিয়ে দিল ইয়ান । আমরা হেসে উঠি ওর কথায় । জীবনে আবার কবে কখন এই জিনিস খেয়ে ভক্তি ফলানর সুযোগ পাবে কে জানে । আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম ব্যাটা বোরহানির স্বাদ সহ্য করতে না পেরে কান্নাকাটি শুরু করে আমাদেরকে ঝামেলায় ফেলবে, সেই বিপদ যখন ঘটায়নি তাতেই আমি আপাতত খুশি ।

বোরহানি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেই খাবার আসতে শুরু করল । ইয়ানের মধ্যে একটু অস্বস্তির ভাব দেখা যায়, কিন্তু কাঁটা চামচ ধরিয়ে দেয়ার পর অস্বস্তি দূর হয় তার । খাওয়ার শুরুতে নিরাপদ জিনিস গুলো এগিয়ে দিই আমরা । পাঁচমিশালী সব্জী আর আলু ইত্যাদির ভর্তা । সব্জীটা ইয়ানের বেশ ভাল লাগে । ভর্তা গুলো প্রথমে খালি খালি খাওয়া শুরু করেছিল । কেউ একজন ধরিয়ে দেয়, " ভাতের সাথে মিশিয়ে খেতে হয়, শুধু ভর্তা খেওনা " । সঠিক উপায়ে খাওয়ার পর ভর্তা গুলোও খুব একটা খারাপ লাগেনা তার । যাক, ব্যাটা না খেয়ে মরবে না, আর কিছু ভাল না লাগলেও ভর্তা ভাজি দিয়ে ঠুসে খেতে পারবে নিজে নিজেই । আমরা এবার নিজেরা ঝটপট হাত চালিয়ে গপাগপ খাওয়া শুরু করি ।

একটু পর ইয়ানের দিকে একটা কড়াই এগিয়ে দিয়ে বলি, " খাবে নাকি ? এখানের বিশেষত্ব এই খাবারটা, গরুর মাংসের একধরনের মশলাদার curry " । অভিযান প্রিয় লোকটা আগ্রহী হয়ে ছোট কয়েক টুকরা নিজের পাতে তুলে নেয় । কিছুক্ষণ পর আরো খানিকটা তুলে নেয় । বুঝলাম এটাও তার ভাল লেগেছে । আমার দিকে তাকিয়ে প্রসংস সূচক একটা ইঙ্গিত করে হাত দিয়ে ।

এরপর এল ইলিশ মাছ । ইয়ানের পাতেও এক ফালি দেয়া হল । ইয়ানের প্রথম প্রশ্ন, " এই মাছে কাঁটা আছে ? "

" অনেক ", জানাই আমি ।

" তাহলে তো আমার জন্য বিরাট সমস্যা । "

" ব্যপার না, তুমিও শিখে ফেলবে কাঁটা বাঁচিয়ে কিভাবে মাছ খেতে হয় । এই মাছে অনেক কাঁটা আছে ঠিকই, কিন্তু কাঁটা গুলো ছোট আর নরম ধরনের । মুখে নিয়ে অনেক্ষণ ধরে চিবিয়ে খাও । একসময় কাঁটারা নিজেই তোমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইবে । তখন সেগুলো মুখ থেকে বের করে রেখে দিতে হবে । " আমি কাজ চালানর মত একটা পদ্ধতি শিখিয়ে দিলাম ।

" এটাই কি standard procedure ? "

" না এটা একটা hack, কিন্তু তোমার পক্ষে standard procedure অনুসারে কাজ করা সম্ভব হবে না । তবে standard procedure টা এর থেকে অনেক সহজ, আমরা ওভাবে খাই । "

" তাই ? তা তোমরা কিভাবে খাও ? "

" হাত দিয়ে কাঁটা বেছে খাই । " আমার পাশে বসা স্পর্ষ বলে ।

" ও আচ্ছা " বলে hack করে মাছ খাওয়ার দিকে মন দিল ইয়ান ।

ইলিশ মাছের প্রথম খন্ডটি মুখে দিয়েই আক্ষরিক অর্থে তার চেহার বদলে যায় । জীবনে নাকি এত মজার জিনিস খায়নি সে । অনে সময় নিয়ে খায় এই খন্ডটা । ধীরে ধীরে একটা একটা করে কাঁটা মুখ থেকে বের করতে সময়টা যায় । তারপর লক্ষ করে আমরা কিভাবে হাত দিয়ে কাঁটা বেছে খাই । আমাদের অনুকরেনে সেও হাত লাগানর ধান্ধা করে । কাঁটা চামচ দিয়ে মাছটা চেপে ধরে প্রথমে । তারপর ডান হাত দিয়ে মাছের একটা কাঁটা টেনে আলাদা করে । কিন্তু এই পদ্ধতিতে সময় লাগে আরো বেশি । আরেকটা বিকল্প বুদ্ধি দেয়ার চেষ্টা করি আমি ।

" এক কাজ কর, এক খন্ড মাছ সোজা নিজের মুখে দিয়ে দাও । তারপর চিবিয়ে খাও ভালমত । এই মাছের কাঁটা সব নরম, অনেক্ষন চিবিয়ে খেলে এমনিতেই কাঁটা-কুটা সব ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যাবে । "

এই পদ্ধতি ব্যবহার করে বেশ সাফল্য পায় ইয়ান । চোখে মুখে খুশি-খুশি ভাব করে ইলিশ মাছ টুকরো টুকরো করে খেতে থাকে ।

এক সময় আমাদের খাওয়া দাওয়া শেষ হয় । রেস্তোরাঁ থেকে আমরা ফিরে আসি অফিসে । অফিসে আমি আর ইয়ান এক সাথেই ঢুকি দরজা দিয়ে । বাকিরা আসছে আমাদের পিছে । দরজা দিয়ে ঢুকেই বড় কর্তার সামনে পড়ি আমরা দুইজন । বড় কর্তার চোখে মুখে উদ্বেগের ভাব স্পষ্ট । ইয়ানকে দেখেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন । বিদেশী ব্যাটা কোথায় গিয়ে কি না কি খেয়ে এসেছে কে জানে, এর কিছু হয়ে গেলে তার ভাল ঝামেলা হবে । প্রথমেই ইয়ান কে জিজ্ঞেস করেন " কি কি খেলে ইয়ান ? "

" আমি ফিন্নি খেয়েছি । ", ভুড়িতে হাত বুলিয়ে হাসি মুখে উত্তর দেয় ইয়ান । খাবারের শেষ পর্বে আমরা ফিন্নি খেয়েছিলাম, সেই জিনিসের নামটাই ইয়ান বলেদিল, মনে হয় এখনো তার জিভে সেই স্বাদ লেগে আছে ।

" সর্বনাশ ! ফিন্নিতো দুধ দিয়ে বানায় । ", আঁতকে ওঠেন আমাদের বড় কর্তা ।

" তাতে কি ? আমি তো মরি নাই " , ভুড়িতে আরেকবার হাত বুলিয়ে জানায় ইয়ান । ইয়ানের নিজের জীবনের ভয় নেই - বুঝতে পারেন বড় কর্তা । এবার আমার দিকে তাকিয়ে নিরেট বাংলায় বললেন "এই ব্যাটারে ফিন্নি খাওয়াইছেন কেন ? "

দুধ দিয়ে তৈরী খাবারের সাথে সর্বনাশের সম্পর্কটা আমার কাছে খুব একটা স্পষ্ট না । তবে ফিন্নির নাম শুনে যেরকম আঁতকে উঠেছেন, ইলিশ মাছ, কড়াই গোসত অথবা বোরহানির নাম শুনলে তো হৃদযন্ত্রে গোলমাল লেগে যাওয়ার কথা । ইয়ান অন্য জিনিসগুলোর নাম মনে করতে পারছেনা নাকি আমাকে বাঁচিয়ে দেয়ার জন্য বলল কে জানে । যে কারনেই হোক, ব্যাটা এই যাত্রা আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে স্বেচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় । আমি বলার মত কিছু না পেয়ে মুখে একটা হাসি লটকে রাখি । অবশ্য আমার জবাব মনে হয় তার খুব একটা প্রয়োজন নেই, কারন প্রশ্নটা শেষ করে নিজেই হো হো করে হেসে উঠেছেন । আমিও সুযোগ বুঝে তার সামনে থেকে পালাই ।

এই ঘটনার পরদিন ইয়ান নিজের দেশে ফিরে যায় । দেশে ফিরে দাপ্তরিক কাজের ইমেইল অ্যাকাউন্টে প্রথম মেইলে জানায় বাংলাদেশি খাবার খেয়ে তার কোন সমস্যা হয়নি । কাজেই তার স্ত্রীর হাতে মার খাওয়ার আশঙ্কা থেকে আমরা মুক্ত । তারপরের সব মেইলে আবার দাপ্তরিক কথাবার্তা ।

আগামী সপ্তাহে ইয়ান আবার বাংলাদেশ আসছে । আগের বার কথা দিয়েছিল আবার যখন সে এখানে আসবে, সে আমাদেরকে খাওয়াবে । ইয়ান কে কোথায় নিয়ে গিয়ে ছিল দিব আমরা এখনো ঠিক করিনি । তবে ধানমন্ডি লেকের পাশে লুচি এবং চাপ অথবা পুরান ঢাকার নীরবে নিয়ে ভর্তা ভাজি খাওয়ার একটা হাল্কা পরিকল্পনা আছে । সেক্ষেত্রে খরচ বেশি হবে না । ইয়ানের পকেট খালি করতে চাইলে বেশি খরচের জায়গা, মানে বিরাট কোন বুফেতে যাওয়া দরকার । দেখা যাক কি হয় হাসি


মন্তব্য

কীর্তিনাশা এর ছবি

হ্যা দেখা যাক কি হয়। আপনাদের ভোজন বিলাস সুখের হোক।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

এনকিদু এর ছবি

ধন্যবাদ ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

রাফি এর ছবি

খাবার বিষয়ক লম্বা পোস্ট পড়ে ক্ষুধা পেয়ে গেল। আগামীবার যাওয়ার আগে ডাক দিয়েন.

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

এনকিদু এর ছবি

যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে । বৃহষ্পতিবার রাতে কক্সবাজার রওনা দিচ্ছি । আসবেন নাকি ?


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

জি.এম.তানিম এর ছবি

ইয়ানের স্বাস্থ্য দেখে বোঝা যায় যে সে খানেওয়ালা টাইপেরই হবে।
অনেক সুন্দর একটা লেখার জন্যে ধন্যবাদ। লেখাটা অর্ধেক পড়তেই কারেন্ট চলে গেসিল...তাই মন্তব্যে দেরি হল!
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

এনকিদু এর ছবি

কষ্ট করে আবার মন্তব্য করার জন্য ফিরে এসেছেন, বিশাল ধন্যবাদ আপনাকে । চলেন, পরেরবার আপ্নারেও নিয়ে যাব ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

ochol aani এর ছবি

খাওয়া দাওয়া বিষয়ক সকল পোষ্ট ব্যান করা হউক... এই ভাবে বুভুক্ষু প্রবাস জীবনকে আরো বেশি ব্যথাতুর করে দেওয়ায় আপনাকেও ব্যান করা উচিত ... তবে লেখা ভালো হইছে...... হাসি

এনকিদু এর ছবি

কি লিখে আপনাকে স্বান্তনা দিব বুঝতে পারছি না । আপাতত একটা খোঁড়া স্বান্তনা দাঁড় করিয়েছি । গল্পের যেই অংশে খাবারের কথা আছে, ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখবেন, আমাদের সেই খাবার ভাল লাগল কিনা সেই ব্যাপারে খুব একটা বকবক করা হয়নি । দেশী খাবার খেয়ে বিদেশী লোকের প্রতিক্রিয়া নিয়েই মূলত পুরো গল্প । ওই ব্যাটারা তেল মশলা ছাড়া সিদ্ধ জিনিস খেয়ে অভ্যস্ত, ওদেরকে যা খেতে দিবেন তাতেই আহা আহা করে উঠার কথা । ধরে নেন আমরাও ওকে ধরে নিয়ে গিয়ে হাবিজাবি খাইয়ে দিয়েছি ।

পরেরবার খেয়েদেয়ে এসে তাহলে গল্পটা না পোস্টাই, কি বলেন ? নাকি পোস্টাবো ?


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

স্বপ্নাহত যাকে এর ছবি

মজাদার পোস্ট হাসি

এনকিদু এর ছবি

হাসি


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

স্নিগ্ধা এর ছবি

একবার আমার বাসায় খেতে ডেকেছিলাম কয়েকজনকে, তাদের মধ্যে এক এফ্রিক্যান এমেরিকান মেয়ে শেষমেষ বলেই ফেললো - এমন কালচার ও এই প্রথম দেখলো যার খাবারদাবারে এমনকি ডেজার্টও স্পাইসী!

আলস্যবশতঃ সেদিন আর কিছু না বানিয়ে ফ্রুট চাট ডেজার্ট হিসেবে পরিবেশন করেছিলাম। বেচারী!

ইয়ানকে মশলাদার খাবারও খাওয়াবেন, আবার 'ছিল'ও দেবেন? ও কি আর বাঁচবে?

এনকিদু এর ছবি

বাঁচবে মানে, একেবারে ফুলে ফেঁপে উঠবে । শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী সে কিছুদিনের মধ্যেই দেশে এসে কক্সবাজার বেড়াতে যাচ্ছে । সস্ত্রীক হবার সম্ভাবনা আছে । মনে হচ্ছে বাংলাদেশী খাবারে লোভ হয়ে গেছে । সাথে করে বউকেও নিয়ে এসেছে এবার ।

আগেরবার ফিন্নি খাওয়ার সময় তার মধ্যে দারুচিনি এলাচ ইত্যাদি দেখে ইয়ানও আপনার আফ্রিকান আমেরিকান অতিথির মত কিছুটা অবাক হয়েছিল । আমারা সবরকম 'স্পাইসি' জিনিস খাই, by any chance নোনতা desert ও আছে কিনা জিজ্ঞেস করেছিল হাসি


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

খাইদাইয়ের ‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍এমন রসানো গপ্পো পইড়া আমি যার পর নাই ক্ষিপ্ত!

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর?

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

এনকিদু এর ছবি

আর আপনি যে পান-টান নিয়ে কত রকম জিনিস লিখেন সেগুলার কি হবে ? আমারটা নাহয় রসানো গল্প, আপনার গুলা তো একেবারে 'ভিজা' ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

তানবীরা এর ছবি

একনিদু, আমি দেশে যাওয়া উপলক্ষ্যে লাষ্ট জানুতে আমার এক ফ্রেন্ড সব ফ্রেন্ডদেরকে কড়াই গোস্তে খাওয়ালো। একদিকে একটা ছোটমতো স্পেস আছে না, যেখানে মাত্র চার / পাচটা টেবিল আছে, সেখানে আমরা বসেছিলাম, এতো হৈ চৈ করেছি ছোটবেলার মতো যে, কয়েক বার আমাদেরকে বিনীত অনুরোধ করা হয়েছে আস্তে করার জন্য আর কেউতো আমাদের পাশের টেবলগুলোতে বসেইনি।
ওদের হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানীও মজার, বোরহানী আর কড়াই গোস্তও ভালো শুধু ফিন্নী ভালো না, ফিন্নী ভালো স্টার এর। ট্রাই করে দেখবেন, ধানমন্ডি দুই নাম্বারে।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

এনকিদু এর ছবি

স্টারের ফিন্নি আমিও খেয়েছি তানবীরা আপু, আসলেই অনেক ভাল । তবে কড়াই গোস্তের হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানীটা আমার খুব একটা ভাল লাগেনি ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

মুশফিকা মুমু এর ছবি

হিহিহি মজার হাসি
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

এনকিদু এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

রেনেট এর ছবি

কড়াই গোসত ধান্মন্ডির কোথায়? খরচাপাতি কেমন?
-----------------------------------------------------
We cannot change the cards we are dealt, just how we play the hand.

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

এনকিদু এর ছবি

ধানমন্ডিতে, ঝিকাতলা বাস স্ট্যান্ডের কাছাকাছি । xiamen নামের একটা চীনা খাবারের রেস্টুরেন্ট আছে, সেই একই বিল্ডিং এ ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

এনকিদু এর ছবি

খরচাপাতি মাঝারি । একেবারে কম না, আবার আকাশ ছোঁয়াও না ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

এলোমেলো ভাবনা এর ছবি

পোষ্ট পড়ে এখন পঞ্চব্যংজন খেতে ইচ্ছা করছে।


হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে, মন বাড়িয়ে ছুঁই,

দুইকে আমি এক করি না এক কে করি দুই৷

স্পর্শ এর ছবি

চামচ দিয়ে ইলিশ মাছ খাওয়া অইদিনই আমি প্রথম শিখছি।!!
....................................................................................
অতঃপর ফুটে যাবার ঠিক আগে হীরক খন্ডটা বুঝলো, সে আসলে ছিল একটা মামুলি বুদবুদ!


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

এনকিদু এর ছবি

আমার সাথে খাতির রাখেন, আরো অনেক জিনিস চামচ দিয়ে অথবা ছাড়াই খাওয়া শিখিয়ে দিব চোখ টিপি


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

Munia এর ছবি

Onek vhalo legeche lekhata pore... amader deshi khabarer kono tulonai cholena onnyo desher khabarer sathe...হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।