প্রকৃতির ঈশ্বর

ফারুক হাসান এর ছবি
লিখেছেন ফারুক হাসান (তারিখ: বুধ, ১১/০৮/২০১০ - ১১:৪৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

"The best way to predict the future is to invent it" - থিওডর হুক 
 
এত কিছু থাকতে ভবিষ্যৎ নিয়ে পড়লাম কেন? পড়লাম কারণ, সেটাই তো আমাদের টেস্টিং গ্রাউন্ড। কে সঠিক আর কে ভুল, কে অস্ত্বিত্বহীন আর কে নিয়ন্তা, কে টেকসই আর কে ফুটোকড়ি – ভবিষ্যতই তো আমাদের বলতে পারে। অতীতকে নানাভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু এক্সট্রাপোলেশন করে সঠিক আন্দাজ কয়জনই বা করতে পারে?
 
ভবিষ্যৎ আসে প্রাকৃতিক নিয়মে, এখন পর্যন্ত মানুষ ভবিষ্যতকে পুরোপুরি গড়তে শিখে নি। তবে মানুষ নিরন্তর যেটা শিখছে তা হলো প্রকৃতির অনুকরণ, ইমিটেশন অফ নেচার। এই শেখাটা সে শিখছে প্রকৃতির কাছ থেকেই, তাকে পর্যবেক্ষণ করে। একটা সময় ছিল যখন এর মূল কারণ ছিল স্রেফ টিকে থাকা। মানুষ টিকে গেছে। কিন্তু তার শেখার নেশা তাকে ছাড়ে নি। টিকে থাকার পর এসেছে আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাসিতা। তারপরও মানুষ আরো শিখতে চায়, জানতে চায়। কিন্তু মহাবিশ্বের গোপন রহস্য জেনে তার কী লাভ? জানার এই প্রবৃত্তির উৎস কী?

 
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা পদার্থবিদ মানা হয় রিচার্ড ফাইনম্যানকে। তার মতে, যখন আপনি এমনকিছু নিয়ে চিন্তা করেন যেটা আপনি ঠিক ঠাউরে উঠতে পারছেন না (যে ব্যাপারটা আসলে কী) তখন দেখবেন আপনার মধ্যে একধরনের দুর্বিষহ অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছে। এটাই হচ্ছে কনফিউশন। কনফিউশন বা বিভ্রান্তি হচ্ছে এক চরম কষ্টের অনুভূতি যার কারণেই আপনি অসুখী শালার কি এমন জিনিস যে বুঝি না! সম্ভবত দুনিয়ার অন্য কোনো প্রাণির ক্ষেত্রে এই ‘বিভ্রান্তি’ কোনো সমস্যা তৈরি করে না। আর তাই তারা বিভ্রান্ত হয়ও কম আর হলেও সাথে সাথে সেটা দূর করার ঝামেলায় যায় না। কী দরকার বাবা লাইফটাকে অযথা কমপ্লিকেটেড করে!
 
অন্য প্রাণিদের এই যে ‘ড্যাম কেয়ার’ এটিচ্যুড এটা কিন্তু মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়েই এসেছে। না হলে এই দুনিয়ার বুকেই আজ মানুষের থাকত হাজারো প্রতিন্দ্বন্দ্বী। কল্পনা করুন অবস্থাটা! প্রকৃতির নানান খেয়ালে বিভ্রান্ত প্রাণিরা চিন্তা করছে, নানান জ্ঞানের সমাবেশ ঘটছে মাকড়সার মাথায়, পাখিদের মস্তিষ্কে, ফড়িংয়ের জগতে, মাছের রাজ্যে। হয়তো ডলফিনেরা আটলান্টিকের তলায় গড়ে তুলছে কোনো পাতাল ঢাকা, প্যারিস কিংবা পাতাল নিউইয়র্ক! একবার ভাবুন - আমরা যেমন সাগরতলের রহস্য ভেদ করতে অক্সিজেন মাস্ক নিয়ে ডুব দেই, তেমনি ডলফিনেরাও বায়ুজগতের রহস্য উন্মোচন করতে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে ওদের আবিষ্কৃত কোনো ওয়াটার মাস্ক পড়ে! ভাগ্যিস, বাস্তবে সেটা হয় না! সমস্ত প্রাণিজগতের চেয়ে মানুষ এতটাই এগিয়ে যে নিজের যোগ্য প্রতিন্দ্বন্দ্বী খুঁজতে তাকে মহাবিশ্বের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। ব্যাপারটা আশ্চর্যজনক যে বুদ্ধিমান এলিয়েনরা সব বাস করে ভিনগ্রহে!
 
মানুষ বিভ্রান্ত হয় কিন্তু বেশিক্ষণ বিভ্রান্ত থাকতে চায় না। একটা না একটা যুক্তি, বিশ্বাস কিংবা আশা তাকে বিভ্রান্তির চোরাগলি থেকে বের করে নিয়ে আসে। গ্রামের যে অশিক্ষিত ভোটার তারো দেখবেন ভোটের সময় নিজস্ব একটা পছন্দ আছে। ধরে নিন, সব প্রার্থীই খারাপ। ফলাফল- ভোটার বিভ্রান্ত। এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের উপায় – যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের বিভ্রান্তি দূর করা। যে কারণে সে প্রার্থীদের এমন একটা ভালো দিকের কথা চিন্তা করতে শুরু করে যেটার ভিত্তিতে কাউকে বেছে নেয়া যায়। হয়ত দেখা গেল কোনো একজন প্রার্থী অন্যদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত গরিব। তখন তার দরিদ্রতাই একটা গুণ হিসেবে আবির্ভূত হয়, কারণ ভোটার নিজেও গরিব। ফলাফল - বিভ্রান্তির অবসান।
 
একটা সাপও কিন্তু বিভ্রান্ত হতে পারে, হয়ত মানুষ দেখে কিংবা হঠাৎ ভূমিকম্প হলে। ফলাফল – সে হয় গর্তে লুকায়, না হয় দাঁতের গোড়ায় বিষ জমা করে। তার মস্তিষ্কে একটাই জিনিস প্রোগ্রাম করা – শত্রু নাগালের মধ্যে থাকলে দংশন কর। অন্য কোনো উপায় তার মাথায় আসে না। পুরো প্রাণিজগতেরই একই অবস্থা। হাজার বছর ধরে অতিথি পাখিরা কষ্ট স্বীকার করে শীত থেকে বাঁচতে পুরো একটা মহাদেশ পাড়ি দেয় কিন্তু এর চেয়ে সহজ কোনো উপায় বের করে না। মহা ধুরন্ধর যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সেও পর্যন্ত কখনো বন্দুক নিয়ে হরিণ শিকারে বের হতে পারে নি। শিম্পাঞ্জী খাবার না পেলে বিভ্রান্ত হয়, কিন্তু তাকে এখন পর্যন্ত ধান চাষ করতে দেখা যায় নি কোথায়ো।
 
কিন্তু মানুষের একটা অসাধারণ ব্যাপার আছে। বিভ্রান্ত হলে মানুষের সৃষ্টিশীলতা বেড়ে যায়। আগুন আবিষ্কারের ব্যাপারটাই ধরুন। বজ্রপাতের ফলে যখন বনে আগুন লাগে তখন প্রকৃতির এমন কীর্তি দেখে মানুষ বিভ্রান্ত হয়। এ কীভাবে সম্ভব? সূর্য ছাড়াই চারদিক আলোকিত হয়ে যায়, রোদ ছাড়াই তাপ ছড়িয়ে পড়ে, হিংস্র প্রাণিরা পর্যন্ত দূরে সরে যায়। কিন্তু তার সৃষ্টিশীল মন বলে, একে আমার আয়ত্ত করতে হবে। তাহলেই রাতের অন্ধকার দূর করার, শীতের হাত থেকে বাঁচার আর বন্যজন্তুকে ভয় দেখিয়ে দূরে রাখার একটা চমৎকার উপায় হবে। জেগে উঠে মানুষের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, ঝড়ের রাতে গর্তে না লুকিয়ে সে চোখ খোলা রাখে কীভাবে আগুন লাগে সেটা শিখতে। সে দেখে কেবল ঝড়ের সময়েই না, রোদেলা দুপুরে দুটো শুকনো ডালের ঘষাঘষিতেও আগুন লাগে, দুটো পাথর নিয়ে ঠুকাঠুকি করলেও আগুন লাগে।
এই করে আজকে দেখুন মানুষ কয়েকশো উপায়ে আগুন জ্বালাতে পারে।
 
কোনো কিছু অনুকরণ করতে হলে প্রথমে পর্যবেক্ষণ করতে হয়, তারপর এর পেছনের ব্যাখ্যাটা বুঝতে হয়, ব্যাখ্যাটা সঠিক হলে তাকে আমরা বলি জ্ঞান। এই জ্ঞানের প্রয়োগই আমাদের সাহায্য করে প্রকৃতির যথার্থ অনুকরণ করতে। এক সময় মানুষ এ পর্যন্তই সুখী ছিল। কিন্তু যতই তার পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা বাড়ছে, যতই সে বেশি ব্যাখ্যাযোগ্য দৃষ্টিতে পৃথিবীকে দেখতে শিখছে, ততই সে চাচ্ছে ভবিষ্যতকে আরো নিখুঁতভাবে এবং সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করতে।     
 
এ কারণেই আজকে আমরা ড্যান ফকের ‘ইউনিভার্স অন এ টি-শার্ট’  নামের বইটা পড়ে খুব বেশি আশ্চর্য হই না। মনে হয়, এটাই তো স্বাভাবিক। বইটার শুরু হয়েছে পদার্থবিদ লিওন লেডারম্যানের একটা উক্তি দিয়ে, ‘আমার বড় আশা যে জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারবো জগতের সবকিছুই একটিমাত্র সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে -সূত্রটা এত চমৎকার আর এতটাই সাধারণ যে তাকে অনায়াসেই একটা টি-শার্টের বুকে লিখে ফেলা যায়’। এই হলো ‘ইউনিভার্স অন এ টি-শার্ট’। ড্যান এরিস্টটলের সনাতন ভাবনার যুগ থেকে শুরু করে পরবর্তী যত বড় বড় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার যেমন আপেক্ষিকতার সূত্র, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা, এমনকি হালের স্ট্রিং তত্ত্ব পর্যন্ত ভাজাভাজা করে খেয়ে ফেলেছেন। কারণ একটাই– সমসাময়িক পদার্থবিদ্যার রথী-মহারথীরা যে একটিমাত্র সূত্র দিয়ে জগতের সবকিছুকে ব্যাখ্যা করার থিউরি খুঁজছেন তার স্বরূপ উন্মোচন করা।
 
এই করে আদতে লাভ কী? আসলে একটা প্যারাডাইম শিফট হচ্ছে, আমাদের জ্ঞাতিসারে কিংবা অজ্ঞাতে, জানার ভেতরে কিংবা অজান্তে। কৌতূহল নিবারণের যুগ পেরিয়ে প্রকৃতির সন্তান মানুষ এখন প্রকৃতিকেই টেক্কা দিতে চায়। মানুষ বুঝে ফেলেছে যে যা কিছু প্রাকৃতিকভাবে ঘটে তার সাথে তার নিজের ভবিষ্যতকে গড়ে নেয়ার অক্লান্ত প্রচেষ্টার মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্যগত মিল আছে। আর সেই মিলটাই প্রকৃতি আর মানুষ, পরিবেশ ও মানবজাতিকে করে তুলছে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। এভাবে চিন্তাটা এগিয়ে নেয়া যায়। বিজ্ঞানের অনেক শাখাতেই মানুষ আজ একটি পরীক্ষা চালানোর আগেই নিখুঁতভাবে তার ফলাফল বলে দিতে পারে। মানুষ এখন অসংখ্য ঘটনার পুংখানুপুংখ ফলশ্রুতি জানে। এর মানে সে খুব সীমিত পরিসরে হলেও ভবিষ্যতকে একটা নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত করতে পারে যে পথের আগাগোড়া তার জানা। লজিকটা এরকমঃ যা ঘটছে তার সঠিক ব্যাখ্যা সে করতে পারে > সে নতুন জ্ঞান তৈরি করতে পারে > সেই তাত্ত্বিক জ্ঞানকে ফলিত জ্ঞানে রূপান্তর করতে পারে > সে সৃষ্টি করতে পারে > সে স্রষ্টা।
 
একটা উদাহরণ দেয়া যায়। ভবিষ্যতের মানুষ কি পারবে প্রকৃতির মত প্রাণের জন্ম দিতে, তার বিকাশ ঘটাতে এবং তাকে একটা সুনির্দিষ্ট ভবিতব্যের পথে পরিচালিত করতে? সাম্প্রতিককালে ক্রেগ ভেন্টরের নাম আপনারা অনেকেই শুনেছেন, যাকে জিনোমিক গবেষণাক্ষেত্রে একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম দিকপাল হিসেবে ভাবা হয়। তিনি ও তার গবেষক দল ল্যাবরেটরিতে তৈরি করেছেন জগতের প্রথম কৃত্রিম সত্তা (synthetic life form)। যেহেতু এই বিষয়ে গবেষণা আমার জানাশোনার বাইরে, তাই বিশদ ব্যাখ্যায় যাবো না। শুধু তার ঘোষণার কয়েকটা লাইন তুলে ধরছি – ‘...প্রথম সিনথেটিক বা কৃত্রিম কোষ, একটা কোষ যার সৃষ্টির শুরুতে শুধু ছিল কম্পিউটারে লেখা কয়েকটা কোড এবং যার ক্রোমোজোম তৈরি করা হয়েছে চার বোতল রাসায়নিক পদার্থ থেকে। তারপর ছত্রাকের দেহে সেই ক্রোমোজোমকে সাজানো হয়েছে এবং সাজানো শেষে তাকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে একটা ব্যাকটেরিয়া কোষে, পরিশেষে যেখান থেকে উদ্ভব হয়েছে একটা নতুন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়াএটাই পৃথিবীর বুকে প্রথম সেলফ রেপ্লিকেটিং ক্ষমতা সম্পন্ন প্রজাতি, যার জন্মদাতা (parent) হচ্ছে একটা কম্পিউটার।
 
ব্যাকটেরিয়ার মত এত নীচুস্তরের এককোষী জীবন ছেড়ে হয়তো সত্যিকারের একটা প্রাণি যে শ্বাস নেয়, প্রশ্বাস ছাড়ে, খায়, ঘুমায় এরকম প্রাণ তৈরি করতে ক্রেগ ভেন্টরদের আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে কিন্তু একবার ভেবে দেখুন, এককালের গুহাবাসী মানুষ আজ নতুন প্রাণ প্রতিষ্ঠার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে!
 
‘জলছাপ’ বলে একটা মজার ব্যাপার আছে এই গবেষণায়। একটা কৃত্রিমভাবে তৈরি ডিএনএ অণুকে আলাদা করে বোঝার জন্য এর গঠনের কিছু জায়গায় মূল ডিএনএর গঠন থেকে ইচ্ছাকৃত পরিবর্তন করা হয় আর এটাই হচ্ছে জলছাপ। ব্যাপারটা অনেকটা আসল টাকাকে জাল টাকা থেকে আলাদা করতে যে জলছাপ দেয়া হয় তার মতই। শুধু জলছাপই নয়, আপনার যদি কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে এবং আপনি যদি জানেন কোন পরিবর্তনটি করলে ডিএনএকে বাধ্য করা যায় সেই লক্ষ্য অর্জনে- তাহলে তো কেল্লা ফতে! স্বয়ং ক্রেগ ভেন্টরের কথাই ধরুন। বর্তমানে তার লক্ষ্য হচ্ছে এমন ধরণের কোষ কিংবা অণুজীব তৈরি যে নিজে থেকে মানুষের জন্য জ্বালানি সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। ভেবে দেখুন, যদি সেটা সম্ভব হয় তাহলে আমাদের আর জ্বালানি তেল পোড়াতে হবে না, বিদ্যুতের জন্য যে হাহুতাশ তা দূর হয়ে যাবে চিরতরে, কলকারখানা চলবে এইসব কৃত্রিম কোষ থেকে সরবরাহকৃত শক্তি থেকে। দুনিয়ার চেহারাটাই বদলে যাবে তাহলে।
 
মানুষ এখানে আবির্ভূত হচ্ছে স্রষ্টা হিসেবে যে কিনা প্রকৃতিকে হুবহু অনুকরণ না করে নিজের সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ ঘটাচ্ছে। লক্ষ কোটি বছর ধরে যে কাজটি ছিল প্রকৃতির একচেটিয়া অধিকার কিংবা গর্ব, নগন্য মানুষ সেই অধিকারে, সেই গর্বে প্রথমবারের মত ভাগ বসাচ্ছে। এইসব কাজ, চিন্তাভাবনা কিংবা স্বপ্ন মানুষের শক্তিকে কি প্রকৃতির শক্তির সমকক্ষ করেই তুলছে না? এর ফলে মানুষ কি প্রকৃতির খেয়ালকেই চ্যালেঞ্জ করছে না? চ্যালেঞ্জটা যে খারাপ সেটা আমি বলব না। মানুষ এখন অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল নয় এবং থাকতে চায়ও না। কারণটা বোধগম্য। সুনামি, ভূমিকম্প, অগ্ন্যৎপাত, সাইক্লোন, বন্যা, খরা – এইসব প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মানুষ আগে থেকে অনুমান করতে চায় যাতে সে নিজের ক্ষয়ক্ষতিকে ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারে। ভবিষ্যতে হয়ত এমন দিন আসবে যখন মানুষ এদেরকে  নিয়ন্ত্রণ করতেও শিখে যাবে। সেটা কি প্রকৃতির সাথে মানুষের লড়াইই নয়? এই লড়াই মহাকালের, আপাত অসম এই লড়াইতে এক সময় টিকে থাকাই ছিল যার একমাত্র আরাধ্য সেই মানুষের এমন দিনও আসবে যখন সে জয়ী হয়ে উঠে আসবে, হয়ত আমরা কেউই সেই সময় থাকবো না কিন্তু সবকিছুই থাকবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতের মুঠোয়।
 
প্রকৃতির পায়ে নত প্রকৃতির সন্তান এক সময় প্রকৃতিরই ঈশ্বর হয়ে আবির্ভূত হবে।

 


মন্তব্য

স্বাধীন এর ছবি

প্রাকৃতিক নিয়মগুলো মানুষ যতবেশি করে জানতে ও বুঝতে শুরু করবে ততবেশি সে ঈশ্বর হয়ে উঠার কাছাকাছি যাবে। লেখাটি ভাল লেগেছে। আগের লেখাগুলোও পড়া হয়েছিল, কিন্তু আলস্যে মন্তব্য করা হয়ে উঠেনি।

ফারুক হাসান এর ছবি

এক কথায় পোস্টের মূলসুরটা বলে দিয়েছেন। আপনার মন্তব্য পেলে ভালো লাগবে।

অতিথি লেখক এর ছবি

খুবই ভালো লেগেছে লেখাটা।
কিন্তু প্রকৃতির সাথে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে কিন্তু মানুষ নিজেরই সর্বনাশ করছে। আমি ব্যাক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, প্রকৃতির সাথে লড়াই করে জেতা সম্ভব না। স্বল্প সময়ের জন্য হয়তো মনে হবে জিতে গেছি কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সেটা মানুষ এবং এই পৃথিবীর জন্য ভালো হবে বলে মনে হয় না।

পাগল মন

ফারুক হাসান এর ছবি

কিন্তু প্রকৃতির সাথে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে কিন্তু মানুষ নিজেরই সর্বনাশ করছে।
তা কেন হবে?

খুব গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপার তা হচ্ছে মানুষের শুভবুদ্ধিকে সবসময় সামনে আনতে হবে। খারাপ যা কিছু ঘটছে তার পেছনে মূলত মানুষের লোভ এবং স্বেচ্ছাচারিতা দায়ী। এদেরকে জয় করতে পারলেই মানুষের পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব। নয়ত বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী।

এই পোস্টে আমি ধরে নিয়েছি যে মানুষের শুভবুদ্ধিরই জয় হবে। সুতরাং জ্ঞান বিজ্ঞানে মানুষ যত অগ্রসর হবে ততই সে পৃথিবীকে নিয়ে ভাববে, এমনকি যে প্রকৃতির সাথে তার লড়াই তাকে নিয়েও। আর সেটাই তো সত্যিকারের জয়। আমি প্রকৃতিকে ধ্বংস করে তারপর জয়ী হবার কথা বলি নি।

অতিথি লেখক এর ছবি

মানুষ কোথা থেকে এলো, কেন এলো, মরার পর কই যাবে, দুনিয়া কেম্নে চলছে, এইসব বিভ্রান্তির ব্যাখ্যা করার জন্যই তৈরি করেছে ঈশ্বর, তার সাথে সাথে ধর্ম। জ্ঞান যত বাড়বে, বিভ্রান্তি যত কমবে, ঈশ্বরের ক্ষমতাও ততো কমে থাকবে।
এত জ্ঞান আবার ভালো না। সবকিছু যদি এত ডিটেইলস ডিফাইনড থাকে, তাহলে গাজাখুরি গল্প বানানোর জায়গা থাকবে না।

-শিশিরকণা-

ফারুক হাসান এর ছবি

বেশি জ্ঞান ভালো না মন্দ তা বুঝবো কীভাবে? আগে তো নদীর দুই তীরই দেখতে হবে, তার পরে না হয় বলা যাবে কোন তীরে সর্বসুখ!

আর মানুষ যে পরিমাণ সৃষ্টিশীল তাতে গল্প বানানো তার পক্ষে কোন ব্যাপারই না। এই বিষয়ে আপ্নে টেনশন নিয়েন না। গাজাখোররা বেঁচে থাকলে তাদের গল্পও বেঁচে থাকবে। হাসি

বুমবুম এর ছবি

মানুষ অনেক অনেক এগোচ্ছে। তবে একটা বিষয়, এই যে ধীরে ধীরে বিরতিহীন ভাবে মানুষ শারীরিক ভাবে ক্ষুদ্র ও আরও জীর্ণ হচ্ছে এ ব্যপারে বিজ্ঞানের কি কোনো গবেষণার উন্নতি বা আশার খবর আছে?

ফারুক হাসান এর ছবি

মানুষের শারীরবৃত্তিক গবেষণা তো অবশ্যই হচ্ছে। তবে আমি যেহেতু এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই তাই বিশেষ কিছু বলতে পারবো না। হয়তো সচলদের কেউ ভাল বলতে পারবেন।

আপনাকে ধন্যবাদ মন্তব্য করার জন্য।

কৌস্তুভ এর ছবি

এককালের গুহাবাসী মানুষ আজ নতুন প্রাণ প্রতিষ্ঠার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে!

এই যে বিজ্ঞানী মশায়, এত প্রাণ প্রতিষ্ঠা প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে লাফায়েন না। মানুষ তো গুহার যুগ থেকেই, ইসে, গুহ্যকর্ম করে করে নতুন প্রাণ বানিয়ে আসছে, নইলে আমরা আসতুম কোত্থেকে? আর সেসব কাম ওই ইতর প্রাণীরাও করে না বুঝি?

যদি বলেন, সে হল প্রাণ সৃষ্টি, প্রাণ প্রতিষ্ঠা নয়, তাহলে বলব, হক্কলই ব্যাদে আসে... এই যে বোধনের সময় আমরা দুর্গামূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করি, তা কি ফেলনা? শোনেন নি, দুগ্‌গামুত্তির চোখে জল, মাকালীর হাতে খাঁড়া মারলে রক্ত বেরিয়ে আসে, গণেশ দুদু খায়... সে কি মাগনা নাকি? কত খেটেখুটে মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা বলেই না?

ও সব বিজ্ঞান-টিজ্ঞান ছাড়েন, আসেন জুলিয়া রবার্টসের পথ অনুসরণ করেন...
চোখ টিপি

ফারুক হাসান এর ছবি

আপ্নি ভাই কই আছিলেন এদ্দিন? আগে কইবেন না!

সিরাত এর ছবি

পাঁচ!!

সিরাত এর ছবি

আপনার কি মনে হয়, মানুষের আগে এই বিশাল মহাবিশ্বের, বা আমাদের গ্যালাক্সিরই, আর কোন সভ্যতা 'সাবলাইম' করেনি? তাদের পরে কি হয়েছে? যৌক্তিকভাবে জিনিসটা অসম্ভব মনে হয়। একটা হাইপোথিসিস আছে যে একটা পর্যায়ে সভ্যতা একটা থ্রেশোল্ড অতিক্রম করলে কেউ বা কারা সেটাকে ধ্বংস করে দেয়।

সাবলাইমেশন নিয়ে লিখবেন নাকি?

প্রকৃতিকে জয় করা আনন্দের ব্যাপার যেমন, তেমন দুঃখেরও। চ্যালেঞ্জ কমে যায়, চেনা মনুষ্যত্ব কমে যায়। যেমন থোরুর মত আমরা আর বসবাস করতে পারি না; মানে, টেম্পটেশন প্রতিরোধের হার অনেক বেশি হতে হয় আর কি। এ জন্য শেষ লাইনটা পরে দুঃখই লাগলো।

ব্যাপক গোলমালের মধ্যে লিখলাম। অসংলগ্ন লাগতে পারে।

ফারুক হাসান এর ছবি

সাবলাইমেশন নিয়ে তো আপনার লেখার কথা! ফাঁকি মারতে চান ক্যান?

আম্রিকা ভ্রমণ আগে ভালো মতন সেরে নেন। তারপর বাড়ী ফিরে গোসল দিয়ে শিং মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে লিখতে বসেন সাবলাইমেশন নিয়ে।

স্পর্শ এর ছবি

ভাল্লাগসে চলুক


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

দূরের তেপান্তর [অতিথি] এর ছবি

আমাগো জ্ঞান আর চাহিদার চাপে দুনিয়ার সব বরফ গইলা যাইতাছে। আবার কানামাছিরা খুশি, দুনিয়া ধ্বংশ হইল বলে! গুরুরা নাকি সব লেইখা গেছে। কোন্দিকে যাই?

লেখা ভাল লেগেছে।

দূরের তেপান্তর

ফারুক হাসান এর ছবি

বেশি টেনশন নিয়েন না। বরফ যেমন গলতেছে, তেমনি সেইটা ঠেকানোর কাজেও গবেষণা চলতেছে।

গুরুরা যা লেইখ্যা গেছে সেইগুলো সবই সত্য কিনা সেইটা দেইখা যাইতে পারলে মন্দ হৈত না। আফসুস, গুরুরা এত বেশি বৈলা গেছে যে সবগুলান দেইখা যাওনের সময় পাবো না।

লেখা ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগলো।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

চিন্তার লাইনে আপনার সাথে একমত।... কোথায় যেন পড়েছিলাম, সৃষ্টিজগতে আসলে মস্তিষ্কের পরিমাণ সবচে বেশি ডলফিনের- দেহের অনুপাতে আর কী। কিন্তু ডলফিন মার খেয়ে গেছে তাদের মানুষের মত বুড়া আঙ্গুল নাই বলে দেঁতো হাসি

'ইউনিভার্স অন এ টি-শার্ট' বইটার ধারণা পড়েও ভাল্লাগ্লো। আপনি পড়েছেন নাকি ?? তাহলে একটা রিভিউ দেন- স্বাদ মেটাই...

_________________________________________

সেরিওজা

ফারুক হাসান এর ছবি

ডলফিন কিন্তু আসলেই অনেক বুদ্ধিমান।

হ্যা, 'ইউনিভার্স অন এ টি-শার্ট' বইটা পড়েছি। তবে তা প্রায় বছর খানেক আগে। সেভাবে রিভিউ লিখতে গেলে আমার আবার বইটা পড়তে হবে। তবে তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই, শুধু সময়ের বড়ই অভাব। তবে চেষ্টা করবো।

এই অবসরে আপনি কিন্তু বইটা পড়ে ফেলতে পারেন, কারণ দেখলাম গুগল বুকসে বইটা আছে। এই নিন লিংক

বইটা সত্যি খুব চমৎকার, অনেকটাই গল্প বলার ঢংয়ে লেখা। আলাদা আলাদা চ্যাপ্টারগুলো অনায়াসে ব্লগ হিসেবে চালিয়ে দিতে পারত লেখক।

পেলে আরেকটা চমৎকার বই পড়তে পারেন- "The God particle : if the universe is the answer, what is the question?" লেখক ঐ লিওন লেডারম্যান (বিখ্যাত উক্তিটা এই লোকেরই করা), সাথে ডিক টেরেসি। পড়লে ঠকবেন না হাসি

দ্রোহী এর ছবি

চমৎকার লেগেছে। চলুক


কি মাঝি, ডরাইলা?

নৈষাদ এর ছবি

খুব ভাল লাগল আপনার বিশ্লেষণ। আপনি যেটাকে 'বিভ্রান্তি' বলছেন সেটাই কি-ওয়ার্ড। (যদিও আমার মনে হয়েছে ব্যাপারটা আসলে 'ব্যাখ্যা করার চেষ্টা', জানিনা একই অর্থ কিনা। অবশ্য তাহলে আপনার ভোটের উদাহরণটা ব্যাখ্যা করা যায়না।)

মজার ব্যাপার হল এই প্রকৃতিকে বশে আনার ব্যার্থতা থেকেই কিন্তু এই আধ্যাত্বিক থিওরী গুলি হালে পানি পায়। আমি ছোট বেলায় চা বাগানে দেখেছি শ্রমিকরা পক্সের জন্য বিশাল পূজার ব্যবস্থা করছে। অথচ দেখুন স্মল পক্স তো নির্মুল করা হয়েছেই (যখনকার কথা বলছি তখনও কিন্তু স্মল পক্স অলরেডি নির্মুল করা হয়ে গেছে), এখন চিকেন পক্সেরও টিকা চলে এসেছে।

পাগল মন যেমনটি বলল, প্রকৃতিকে বশে আনার চেষ্টা করে মানুষ নিজের ক্ষতি করছে। এমন একটা স্কুল অভ থট অবশ্যই আছে। আসলে এটা ব্যাপারটা প্রকৃতিকে বশে এনে এর অপব্যবহার এটার কথাই বলা হয়েছে।

ফারুক হাসান এর ছবি

মজার ব্যাপার হল এই প্রকৃতিকে বশে আনার ব্যার্থতা থেকেই কিন্তু এই আধ্যাত্বিক থিওরী গুলি হালে পানি পায়।

একদম ঠিক বলেছেন। এই দিকটা আসলেই ভেবে দেখার মত। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, যদি বাই ডিফল্ট মানুষ শুরু থেকেই সব জ্ঞানের অধিকারী হত তাহলে কি জগতে এত আধ্যাত্বিকতার প্রয়োজন থাকত?

অতিথি লেখক এর ছবি

একটা মজার ব্যাপার হল,অনেক প্রাণিই প্রকৃতির ইশারা আগেভাগেই ঠাহর করতে পারে, এই ব্যাপারটা মনে হয় এখনো কুহকাচ্ছন্ন থেকে গেছে।

অদ্রোহ।

ওডিন এর ছবি

বিভ্রান্ত হলে মানুষের সৃষ্টিশীলতা বেড়ে যায়।

লেখাটা চমৎকার লাগলো! প্রিয় লেখার তালিকায় ঝুলিয়ে দিলাম। হাসি
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না

ফারুক হাসান এর ছবি

হাসি

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

লেখাটা ভালো লাগলো। আপনি জ্ঞানের প্রেডিক্টিভ ভিউকে কাজে লাগিয়ে আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে কন্ট্রোল আর গোল (goal) পর্যন্ত চলে যেতে পেরেছেন দেখে ভালো লেগেছে।

এই মডেলটা কিন্তু অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সত্যিকার অর্থে, এই সংক্রান্ত অধিকাংশ পরীক্ষাগুলো কিন্তু করা হয়েছে মানুষ ভিন্ন অন্য প্রাণীর উপর।

বাঘ প্রেডিক্ট করে ঠিক কোন মুহূর্তে লাফ দিলে দাঁতের ফাঁকে হরিণের ঘাড়টা পড়বে। অর্থাৎ, শর্তাধীন প্রেডিকশান। সকল না হলে প্রাণীর অন্তত অধিকাংশ প্রেডিকশান হলো ক্রিয়া (action) শর্তাধীন। আর দাঁতের ফাঁকে হরিণের ঘাড় থাকাটা বাঘের লক্ষ্যের (goal) অংশ।

ফলে প্রত্যেকটা প্রাণীর প্রদত্ত লক্ষ্য থাকে। এখানে দুটি প্রশ্ন, লক্ষ্যটা কি? লক্ষ্যটা কে দিল?

কে দিল প্রশ্নে evolutionary psychology এর উত্তর হলো বিবর্তন। লক্ষ্য নির্ধারণে বিবর্তনের হাতটা আশা করি অনুধাবন যোগ্য। প্রাকৃতিক কারণে যেভাবে উঁচু আর নিচু ভূমি তৈরী হয়, ঝর্ণা তৈরী হয়, বা আগ্নেয়গিরি, কিন্তু আমরা প্রশ্ন করি না কে তৈরী করলো, একইভাবে প্রাণীর লক্ষ্যও প্রাকৃতিকভাবে তৈরী। এর বিশেষ নিয়ামককে আমরা বিবর্তন বলি। এবং সংগত কারণেই ঝর্ণার উত্পত্তির ব্যাখ্যার চেয়ে এর ব্যাখ্যা কঠিন।

কিন্তু লক্ষ্যটা কি, সেটা হয়ত আরো কঠিন বের করা। অন্তত মানুষের ক্ষেত্রে। মানুষের DNA একটা বড় অংশ নির্ধারণ করে। মস্তিষ্কের বিশেষ কিছু ফাংশন এটাকে নির্ধারণ করে, যেমন ডোপামিন নিঃস্বরণ, যা কিনা আবার জীবনযাপনকালে পরিবর্তনযোগ্য।

এই লক্ষ্যটা প্রাণীভেদে ভিন্ন। সত্তা ভেদেও ভিন্ন। একই প্রজাতিতে অনেক মিল অবশ্যই আছে।

বিবর্তনে উপরের কাতারের প্রাণী হওয়ার কারণে মানুষের লক্ষ্য দৃশ্যত ব্যাপকতর আর সেটা অর্জনের সরঞ্জামও (প্রেডিকশান করার ক্ষমতা, মস্তিষ্কে নিউরনের সংখ্যা) মানুষের অনেক বেশি। আর শারীরিক-গঠনগত কিছু সুবিধাও আছে।

আশেপাশের পরিপার্শ্বকে নিজের লক্ষ্যের অনুকূল করে তোলা (যেটাকে অনেক গবেষণা ক্ষেত্রে বলে কন্ট্রোল) হলো প্রতিটি প্রাণীর প্রচেষ্টা। মানুষের আশেপাশের পরিপার্শ্বটা একটু বেশি বড়।

এই ধারায় আপনার আগামী লেখার পরিকল্পনা কি নিয়ে জানতে ইচ্ছে করছে। যদি এটুকু পর্যন্ত আপনি আর আমি একমত থাকি, তাহলে একটা নেক্সট গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হতে পারে, কোন লক্ষ্যটা অধিকতর ভালো?

এটা দুটো প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ। এক হলো, আগামীতে মানুষ তার প্রদত্ত লক্ষ্যকে নিজেই পরিবর্তন করতে পারবে, মস্তিষ্কের যে স্থানটা জাজমেন্ট দেয়, সেখানে পরিবর্তন সাধন করে। তখন আমাদের লক্ষ্য কোনটা গ্রহণ করা উচিত হবে?

আরেকটা ক্ষেত্র হলো রোবট। যদি রোবটকে স্বাধীন প্রাণী হিসেবে বানাতে চাই, তাকে লক্ষ্য প্রদান করতে হবে। তখন তাকে কোন লক্ষ্য দেব?

একটু খেয়াল করলে দেখবেন, মানুষের চিন্তার উপায়, নীতিবোধ, ভালো-মন্দ বোধ, রাজনীতি, পক্ষ, সব এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।

কোন রাষ্ট্র-শাসন ব্যবস্থা কাম্য, অনেকটা এই ধরনের প্রশ্নের মত। এমন কি এই প্রশ্নটাও এখানে রিলেটেড।

ফারুক হাসান এর ছবি

ফলে প্রত্যেকটা প্রাণীর প্রদত্ত লক্ষ্য থাকে। এখানে দুটি প্রশ্ন, লক্ষ্যটা কি? লক্ষ্যটা কে দিল?

বিবর্তনই কি এই প্রশ্নের একমাত্র উত্তর? হতে পারে। মানুষ বাদে অন্য সব প্রাণির লক্ষ্য খুব একমুখী - টিকে থাকা। মানুষ সেই সময়টা পেরিয়ে এসেছে। ইন্ডিভিজুয়াল মানুষের লক্ষ্য ভিন্ন হতে পারে, অনেক সময় খুব অস্বাভাবিকও হয়, কিন্তু অন্য প্রাণিদের সেটা দেখা যায় না। বলতে পারেন সেটা আমাদের মস্তিষ্কের বিবর্তনেরই ফল।

আবার খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই, মানুষের লক্ষ্য কি - এই ধরণের আধ্যাত্বিক প্রশ্ন কিন্তু ধর্মচর্চায় হর হামেশা চলে আসে। তাই বলে ধর্ম কি মানুষের বিবর্তনের ফসল?

আশেপাশের পরিপার্শ্বকে নিজের লক্ষ্যের অনুকূল করে তোলা (যেটাকে অনেক গবেষণা ক্ষেত্রে বলে কন্ট্রোল) হলো প্রতিটি প্রাণীর প্রচেষ্টা।

আমার একটু দ্বিমত আছে। বেশিরভাগ প্রাণিই নিজেকে পরিবেশের সাথে অভিযোজিত করে, পরিপার্শ্বকে নিজের অনুকূলে আনার বদলে মানিয়ে নেয়। যে যত বেশি মানাতে পারে সে তত বেশি টিকে যায়। কন্ট্রোলটা খুব সীমিত আকারে দেখা যায়। কারণ সেটা কঠিন। তার জন্য সৃষ্টিশীল হতে হয়।

আর সে কারণে মানুষই সেই চেষ্টা চালাতে পারে এবং আমার ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু সেটাই - মানুষের মানিয়ে নেয়ার যুগ থেকে নিয়ন্ত্রণের যুগে প্রবেশ।

এই ধারায় আপনার আগামী লেখার পরিকল্পনা কি নিয়ে জানতে ইচ্ছে করছে। যদি এটুকু পর্যন্ত আপনি আর আমি একমত থাকি, তাহলে একটা নেক্সট গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হতে পারে, কোন লক্ষ্যটা অধিকতর ভালো?

এখনো সে রকম কিছু গুছিয়ে উঠতে পারি নাই, কিন্তু মাথায় আছে। দেখা যাক।

কোন লক্ষ্যটা অধিকতর ভাল সেটা বিশ্লেষণ করতে পারলে ভাল হত। আপনার চিন্তাভাবনাগুলো নিয়ে পোস্ট দিন না!

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

মানুষ আর অন্য প্রাণীর এই যে পার্থক্যটা, এটা কিন্তু কন্ট্রোল থাকা না থাকার না, কন্ট্রোল বেশি থাকা আর কম থাকার। আপনি অবশ্য সেটা উল্লেখই করেছেন:

কন্ট্রোলটা খুব সীমিত আকারে দেখা যায়

এই সীমিত আকারে কন্ট্রোল এমনকি ভাইরাসে আছে বলেও কল্পনা করা যায়।

কগনিটিভ নিউরোসাইন্সের বিখ‍্যাত গবেষক Michael S. Gazzaniga তার এই বইতে (Human: The Science Behind What Makes Us Unique) দেখানোর চেষ্টা করেছেন, মানুষের সাথে অন্য প্রাণীর এই পার্থক্য মূলত তার গণনা সরঞ্জামের ব্যাপক পার্থক্যে। অর্থাৎ তার মস্তিষ্কে। আর মানুষের সবচেয়ে কাছের প্রাণীটির সাথে মানুষের মস্তিষ্কের যে পার্থক্য, তার অনেকগুলোই পরিমাণগত, গুণগত নয়। অর্থাৎ একই ধরনের অনেকগুলো গণনা সরঞ্জাম শিম্পাঞ্জিরও আছে। কিন্তু মানুষের সেটা এই পরিমাণে যথেষ্ট আছে যে তা মানুষের অপরিমেয় জটিল চিন্তাসাধনকে সম্ভব করেছে।

আপনার ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুর সাথে বইটার বিষয়বস্তুর অনেক সম্পর্ক আছে।

মানুষের মস্তিষ্কের লক্ষ্য অংশকে নির্দিষ্টভাবে পরিবর্তন কিন্তু "মানুষের মানিয়ে নেয়ার যুগ থেকে নিয়ন্ত্রণের যুগে প্রবেশ" এরই একটি চরম রূপ।

মানুষের এই নিয়ন্ত্রণের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে যদি আমরা কৌতুহলী হই, যদি জানতে চাই মানুষ আগামীতে ঠিক আর কি কি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে। জগতকে যদি একাধিক ভিন্ন উপায়ে পরিবর্তন করা যায়, মানুষ তার মধ্যে কোন উপায়টি বেছে নিবে, তাহলে আমাদের বুঝতে হবে মানুষের প্রদত্ত লক্ষ্যের স্বরূপ কি।

আর একটা পর্যায় মানুষ যদি তার প্রদত্ত লক্ষ্যটাই পরিবর্তন করে ফেলে, তখন সেটা হবে মানুষের এই নিয়ন্ত্রণের গতিপ্রকৃতিটা নিয়ন্ত্রণের নামান্তর। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণটা চলে যাবে মেটা লেভেলে।

আমি সময় পেলেই লক্ষ্য নিয়ে বড় আকারে লিখব।

ব্যাপার হচ্ছে গিয়ে, আগের মন্তব্যে আমি যে মডেলের কথা বলেছি, সেটা মনোবিজ্ঞানের একটা গুরুত্বপূর্ণ মডেল। চর্চিত বিষয়। কিন্তু কোন লক্ষ্য শ্রেয়, এ সংক্রান্ত ফর্মাল আলোচনা বিজ্ঞানের কোনো শাখায় হয়েছে বলে আমার জানা নেই।

কেন নেই, সেটাও কিছুটা আঁচ করতে পারি। তবে যেহেতু বিজ্ঞানে নেই, কোন লক্ষ্য শ্রেয় সেটা নিয়ে আমার নিজস্ব ধারণা থাকলেও, সুনিশ্চিত নই সে সম্পর্কে।

তাই ব্যাপারটা নিয়ে আপনার আগ্রহ জাগানোর বা মতামত জানার একটা অপচেষ্টা করলাম মাত্র। হাসি

ফারুক হাসান এর ছবি

বইটা উল্লেখ করার জন্য ধন্যবাদ। পড়ার শখ ছিল, কিন্তু ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে খোঁজ দিয়ে দেখলাম, বইটা নাই।

কন্ট্রোল বিষয়টা একটা ভাল টপিক হতে আলোচনার। তবে তার জন্য একটু পড়াশোনা করা দরকার।

কিছুটা অটঃ একটা প্রশ্ন মনে আসলো। মনোবিজ্ঞান বিজ্ঞান হিসেবে নিউরোসায়েন্সের দিকে ঝুকছে বলে আমার ভালো লাগছে। তবে, নিউরোসায়েন্স কি এখনো ততোটা পরিপক্ক যতটা হলে ক্ল্যাসিকাল সাইকোলজির মডেলগুলো যাচাই বাছাই করতে পারে? আপনার কী মত?

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

নতুন বই, আমার লাইব্রেরীতেও ছিল না। সাজেস্ট দেয়ার সুযোগ থাকলে সাজেস্ট করে দেন লাইব্রেরীকে।

খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সত্যিকার অর্থে, আমি যদ্দুর বুঝি, নিউর-সাইন্সের পর্যবেক্ষণগুলো সাইকোলজির মডেলগুলোকে অলরেডি যাচাই-বাছাই আর পরিমার্জন করছে। আবার পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করতেও এবং নতুন পর্যবেক্ষণ অনুমান করতে সাহায্য করছে।

অর্থাৎ একসাথে এগোচ্ছে।

যেমন সাইকোলজিতে প্রেডিকশান কেন্দ্রিক আইডিয়াগুলো যেমন Association, classical conditioning, ইত্যাদি, তৈরী হয় গত শতকের শুরুর দিকে প্রাণীর আচরণের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে। এবং আইডিয়াগুলো সাইন্টিফিক কারণ, প্রাণীর আচরণকে একটা লেভেলে প্রেডিক্ট করতে পারে। কিন্তু এর পিছনে ব্রেইনের কি ফাংশন দায়ী তা বোঝার ক্ষমতা মানুষের তখনও ছিল না।

আর গত শতকের শেষের দিকে বিপ্লবের মত তৈরী হয়, যখন ব্রেইনে সাইকোলজির আইডিয়াগুলোর সাথে সম্পর্কিত ফাংশন পাওয়া যেতে শুরু করে। সেরকম বিপ্লবী একটা পেপার

ফলে আমার মত, নিউরসাইন্স এখন ওই লেভেলের খুব কাছে চলে গেছে।

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

কন্ট্রোল নিয়ে প্রাথমিক ধারণার জন্য এখানে কিছু পেতে পারেন

কন্ট্রোল বলতে ঠিক আমাদের সেন্সে পরিপার্শ্ব নিয়ন্ত্রণ বলতে আমরা যা বুঝি সেটা না বরং প্রদত্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য উপযুক্ত ক্রিয়া বাছাই বোঝানো হয়।

সেটাকেই আমি বলতে চাচ্ছিলাম:

আশেপাশের পরিপার্শ্বকে নিজের লক্ষ্যের অনুকূল করে তোলা (যেটাকে অনেক গবেষণা ক্ষেত্রে বলে কন্ট্রোল) হলো প্রতিটি প্রাণীর প্রচেষ্টা

কিন্তু আমার বাক্যের অর্থটা সম্ভবত পরিষ্কার না হয়ে বরং কন্ট্রোলের ব্যাপারে আমাদের প্রচলিত ধারণার সাথে মিশে গেছে। মাই ফল্ট।

দেবোত্তম দাশ এর ছবি

দিলেন তো টেনশন ঢুকিয়ে, এখন বললে শুধু বলবেন দাদা টেনশন কইরেন না। যান করলাম না টেনশন। খুব ভালো হয়েছে পোষ্টটা
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

ফারুক হাসান এর ছবি

টেনশন না দাদা, আপনার মধ্যে যা ঢুকেছে তা হলো বিভ্রান্তি চোখ টিপি

অতিথি লেখক এর ছবি

এত সুন্দর করে লিখেন কিভাবে? খুব হিংসা হচ্ছে! না, আমি হিংসুক না। অভিনন্দন আপনাকে। আপনার পদ্য, গদ্য সবই অসাধারন। হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।