ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পর্ব-১।

জাহিদ হোসেন এর ছবি
লিখেছেন জাহিদ হোসেন (তারিখ: বুধ, ০৭/১১/২০০৭ - ৪:১৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এদিক সেদিকে লিখিত কয়েকটি পোস্ট দেখে মনে হোল যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কিছু একটা লেখা দরকার। এটা এক ধরণের ঋণ-স্বীকার বলতে পারেন। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে।

আজকের পর্বের শুরুটা করি আশির দশকের মাঝামাঝি একটি সময়ে। ততদিনে আমার ঢাকার পড়াশুনার পাট শেষ এবং তখন আমি আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট। সেই সেমেস্টারে একটা কঠিন কোর্স নিয়েছি। বিষয়টা ছিল ডিএনএ অণুর গঠনমালার বিভিন্ন দিক। পুরো ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি। যিনি পড়াচ্ছিলেন তিনি (আজ তিনি বেঁচে নেই) ছিলেন কিছুটা সাধু প্রকৃতির মানুষ। শুনেছি তাঁর নাকি এক ভারতীয় গুরুও ছিল। সেভেন হান্ড্রেড লেভেল ক্লাশ, ছাত্র সংখ্যা বেশী নয়, গোটা বারো হয়তো হবে। আমি কাউলা বাদে সবাই সাদা আমেরিকান।

যাই হোক, ক্লাশের প্রথম দিনেই টের পেলাম কোর্সটি ভয়াবহ রকমের কঠিন। কিন্তু কি আর করা? পীর-মুর্শিদের নাম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। গরীব দেশের অশিক্ষিত মানুষ বলে ক্লাশের অন্য ছাত্ররা বেশী পাত্তা দেয়না আমাকে। কবিগুরুর "একলা চলো রে" গানই তখন সকাল-সন্ধ্যার বীজমন্ত্র। সেই ভরসায় চলতে শুরু করলাম। কিছুদিন পর দেখি, প্রফেসর যা পড়াচ্ছেন তা আমি বেশ ভালই বুঝতে পারছি। অন্যদের মুখের দিকে তাকানো যায়না। এমনই করুণ অবস্থা। আমি মনেমনে মিটিমিটি হাসি। এখন কেমন বুঝতাছেন, ভাইজান?

ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বার হ'বার পর কান্নাকাটি অবস্থা। আমিই একমাত্র 'এ' পেয়েছি, অনেকেই পাশ করতে পারেনি। বোঝা গেল সাধুবাবার লেকচার সবারই মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে। পরে মেকআপ টেস্ট দিয়ে কোনমতে মান বাঁচলো সবার।

তারপর বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে। একদিন আমি আর আমার এক আমেরিকান বন্ধু বব ডিপার্টমেন্টের করিডরে হাঁটছি। বব বললো যে সে একটু ঐ প্রফেসরের সাথে কথা বলতে চায়। কেন, জানতে চাইলাম। উত্তরে বব একটু মুচকি হেসে বললো যে প্রফেসরের নাকি একটা সুন্দরী মেয়ে আছে, এবং বব মেয়েটির প্রতি একটু দুর্বল। তাই সে সুযোগ পেলেই প্রফেসরের সাথে নানান বাহানায় খেজুরে আলাপ করে থাকে। অতএব তার সাথে গেলাম।

একথা সেকথার পর বব বললো, 'তা তোমার মেয়ের খবর কি?'
প্রফেসর বললো,'ভালই। তবে সে কোন কলেজে পড়বে সেটা নিয়েই বেশ টেনশনে আছে।'
'কোথায় তাকে পাঠাতে চাও তুমি?' প্রেমিকার সম্ভাব্য অন্তর্ধানের আশংকায় ববের মুখ শুকিয়ে আসে।
'আমি যেখানে তাকে পাঠাতে চাই সেখানে কি আর ও চান্স পাবে?'
'কি বলো? ও এতো ভাল ছাত্রী। কি এমন স্কুল যেখানে সে চান্সই পাবেনা?'
প্রফেসর মৃদু হাসেন। তারপর আমার দিকে আংগুল তুলে বললেন, 'ও যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছে, আমার খুব ইচছা মেয়েটিকে সেখানে পাঠানোর। নির্বাসিত, তোমার কি মনে হয় তোমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেবে আমার মেয়েটিকে?'

কথাটা শুনবার পর বুকের মধ্যে কি যেন একটা আটকে গিয়েছিল। কান্না পাচ্ছিল কেন যেন। আর কোন কিছুই কানে যাচ্ছিলনা তখন।

শুধু মনে পড়ছিল লাল ইঁটের কার্জন হল। কৃতগ্গতার সাথে স্মরণ করলাম আমার শিক্ষকদের। কত কষ্ট করে তাঁরা আমাকে এইসব শিখিয়েছেন। ভাল বই ছিলনা, জার্নাল ছিলনা, ল্যাবে কেমিক্যালস ছিলনা। ব্ল্যাকবোর্ডে টানা ইকুয়েশন লিখতে লিখতে চকের গুঁড়োয় ভরে গেছে তাঁদের গায়ের জামা। তবুও একটু একটু করে হাতে ধরে কত না মায়ায় শিখিয়েছেন আমাদের।

সেদিন আমার আমেরিকান প্রফেসর তার একটি ছোট্ট কথায় আমার প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর তার শিক্ষকদের মাথায় এমন একটি মুকুট পরিয়ে দিলেন, যার হীরক-দ্যুতি চিরটা কাল আমার মনে আলো ছড়াবে।

আমি আমার সমস্ত শিক্ষকদের মনেমনে কদমবুসি করলাম।

স্যারেরা, অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাকে শিক্ষাদানের জন্য।


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

প্রিয় অতিথি লেখক,

আপনার কোন লেখা সংরক্ষণের পর সেটি মডারেশনের জন্য সংরক্ষিত হয়। তাই একটি লেখা একাধিকবার পোস্ট করার প্রয়োজন নেই। অনুগ্রহ করে লেখা সংরক্ষণের পর একটু অপেক্ষা করবেন।

ধন্যবাদ।


হাঁটুপানির জলদস্যু

সবজান্তা এর ছবি

অসাধারণ। এত অপ্রাপ্তি, কষ্টের মাঝেও যে কোন প্রাপ্তি থাকতে পারে, তা মাঝে মধ্যে খেয়াল থাকে না। কিছু অসাধু শিক্ষকের জন্য হয়ত অনেক দুর্দান্ত শিক্ষক আলোর বাইরে চলে যান।

শ্রদ্ধাবনত মস্তকে সম্মান জানাই আমাদের সেইসব দ্রোনাচার্যদের, যাদের জন্য আমরা , তথাকথিত আনস্মার্ট,গেঁয়োরা কিছুটা পড়াশোনা শিখতে পারছি।
-----------------------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব ভালো লাগলো আপনার লেখা পড়ে। আপনার আমেরিকান প্রফেসরের তার নিজের মেয়েকে ঢাবিতে পড়াতে পাঠানোর ইচ্ছার কারন কিনতু আপনি। কোর্সে A পেয়ে আপনি ঢাবির সম্মান বাড়ানোর পাশাপাশি ঢাবির শিক্ষকদেরও মাথা উচু করেছেন। আপনাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।

হরেকৃষ্ন এর ছবি

প্রিয় জাহিদ সাহেব,

লেখাটির জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে পারছি না। এতোদিন আমার বর্তমান অবস্থার জন্যে যে শিক্ষকদের কাছে ঋণী সেটা কখনো কখনো মনে হলেও সেই ঋণ শোধ করার অপারগাতার জন্যেই হোক বা কার্পণ্যতার জন্যেই হোক সব সময় ভুলে থাকার চেষ্টা করেছি। আপনার লেখা পড়ে মনে হল আমার ঋণের বোঝা অনেক ভারী! কিন্তু সমস্যা সেটা না, সমস্যা হল সারা জীবণ সে বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে যা কিনা আমার ক্ষয়িষ্নু শরীরে কুলোবে না; আমাদের স্কুলের হেডমাষ্টার সাহেব এখনো বেঁচে আছেন কিনা সেটা জানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

চমৎকার এই লেখাটি পড়ে আপনার সাথে আমারও চোখে জল এসে গেল। লেখাটি সত্যিই খুব ভাল লেগেছে। আপনি মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে মাতৃভুমির যে সম্মান বাড়িয়ে চলেছেন বিদেশীদের কাছে সেটাই কি ঋণ শোধের উত্তম বাহন নয়? সব চেয়ে বড় কথা এর ভেতর দিয়ে বাংগালি হিসেবে আমাদের গর্ব যে হাযার গুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন তার জন্য আমি কৃ্তজ্ঞ।

সাইফ তাহসিন এর ছবি

খুব ভালো লাগল, আপনার লেখার লিংক ধরে সামুতে পড়েছিলাম, পরে দেখলাম এখানেও আছে, তাই ফিরে এলাম এখানে মন্তব্য করার জন্যে। খুব ছুয়ে গেল আপনার স্মৃতিচারণ
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদ্বপি গরীয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।