ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পর্ব-পৌনে তিন।

জাহিদ হোসেন এর ছবি
লিখেছেন জাহিদ হোসেন (তারিখ: রবি, ১১/১১/২০০৭ - ২:১৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(এই পর্বের আগের অংশটুকুর জন্য আমার "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পর্ব-আড়াই" টি পড়তে হবে।)

যাই হোক, স্ট্র্যাটেজী তো ঠিক হোল, এখন সেটার এক্সিকিউশন করা হবে কিভাবে? আবার শুরু হোল মাথা ঘামানো।

আমার রুমমেটদের মধ্যে মিজানের একটা ছোটখাটো ক্যামেরা ছিল। সেটাকেই আমাদের আক্রমণের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করা হোল। প্রথমে একটা রোমান্টিক ব্যাপার-স্যাপার তৈরী করতে হবে। তার জন্যে পরিবেশ দরকার, লোকজন দরকার, জিনিসপত্র দরকার।

সেই আমলে (আগেই বলেছি কাহিনীটি সুদূর অতীতের যখন আরবের লোকেরা গুহায় বাস করিত) ছবি তোলাটা বেশ একটা স্পেশ্যাল ব্যাপার ছিল। রঙীন ছবি কিছু লোকে তুলতো বটে, তবে সেগুলো বেশ ব্যয়বহুল ছিল। সাদা-কালো ছবিও আমাদের (ছাত্রদের) জন্য বেশ খরচের জিনিস ছিল। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে মিজান তার ক্যামেরায় জহির এবং লুনার বেশ কিছু কাব্যময় ছবি তুলবে, এবং আমাদের আশা এই যে সে ছবি দেখলেই লুনা জহিরকে ফিরিয়ে দিতে পারবেনা।

কিন্ত লুনা আর জহিরকে এক জায়গায় করা যায় কিভাবে? এবং ছবিগুলো তোলা হবে কোথায়?

সেই সময়ে কাছাকাছি সুন্দর জায়গা একটাই ছিল, মীরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন। সেখানেই যেতে হবে তাহলে। কিন্তু লুনা তো জহিরের সাথে একা সেখানে যেতে রাজী হবে না। বিশ্বাসযোগ্য একটা গল্প তৈরী করতে হবে।

শেষ পর্যন্ত প্ল্যানটা হোল এই রকম।
জহির লুনাকে বলবে যে জহিরের কিছু বন্ধু (অর্থাত্ আমরা) একটা ছোট পিকনিক করতে যাচ্ছে বোটানিক্যাল গার্ডেনে। এই ছেলেগুলো ভাল ছেলে (যেহেতু তারা সায়েন্সে পড়ে), অতএব এরা কোনরকম পোংটামী করবে না। এরা বোটানিক্যাল গার্ডেনে গিয়ে একটু গল্পগুজব করবে, ছবি-টবি তুলবে। এই ছেলেদের ভিতরে একজন আবার দুর্দান্ত ফটোগ্রাফার।
যেহেতু জহির যাচ্ছে, অতএব লুনাও যেতে পারে। আর লুনা যদি একা যেতে ভয় পায়, তাহলে সে তার পরিচিত আরো দু-একটা মেয়েকে যেতে বলতে পারে।
আমাদের পরামর্শ অনুযায়ী জহির কথাটা খুবই ক্যাজুয়ালি বলবে লুনাকে, যেন লুনা না গেলে জহিরের কিছু যায় আসেনা। বারকয়েক সে আমাদের সামনে কিভাবে কথাটি বলবে তার রিহার্সেলও দিলো।

দু'দিন জহিরের হাসিমুখে আগমন। লুনা যেতে রাজী হয়েছে। তবে একা নয়, সাথে তার এক বান্ধবীও যাবে। তার নাম রোজী, জহিরও তাকে চেনে। আমরা আশ্বস্ত হলাম। ফাঁদের প্রথম পর্ব কমপ্লিট।
এরপর আমাদের রুমে শুরু হোল প্রস্তুতি। জহিরকে বলা হোল যে সে যেন সব সময় লুনার কাছাকাছি থাকে। কথা-টথা বলে। হাসাহাসি করে।
মিজানের কাজ হবে সর্বক্ষণ ক্যামেরায় চোখ রাখা। না বলে জহির আর লুনার ছবি তোলা (যতটা কাব্যময় করা সম্ভব)। নিসর্গের বুকে একজোড়া মানব-মানবী, এই থীম বজায় রেখে। আলোছায়ার খেলা যেন থাকে ছবিগুলোতে।
"কামার স্ট্র্যাটেজী"র সাফল্য (বা ব্যর্থতা) নির্ভর করছে এই ছবি গুলোর উপর। টেনশনে মিজানের রাতের ঘুম হারাম হলো। সে ঘুমের ঘোরে "প্রেমের নাম বেদনা" জাতীয় গান গাওয়া শুরু করলো।
অন্য দুই রুমমেট তারেক আর আসাদের কাজ হচ্ছে রোজীকে ব্যস্ত রাখা। কিন্ত কোনভাবেই যেন আমাদের তথাকথিত "ভাল ছেলে"র ইমেজ যেন নষ্ট না হয়। তাহলে আসল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। আমাদের ইমেজ নষ্ট হলে জহিরের প্রেমের বারোটা বাজবে। রোজীকে আমরা আবার যেন চিপায় নিয়ে প্রেম নিবেদন না করে বসি। শরতচন্দ্রের "বড় প্রেম শুধু কাছেই টানেনা, দূরেও ঠেলিয়া দেয়" লাইনটি কয়েক বার আউড়ে নিলাম সবাই।
আমি থাকবো ওভারঅল সুপারভিশনে (যেহেতু আমার তেমন আর কোন যোগ্যতা নেই)। ছাগলের তিন নাম্বার বাচচা। আমার কাজ হবে সবাই সবাই তার নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে সেটা নিশ্চিত করা।

ঘটনার দিনটি ছিল একটি সুন্দর হালকা শীতের দিন।
একটু আগেই আমরা চলে গেলাম বোটানিক্যাল গার্ডেনে। জহির পরে তেনাদের নিয়ে আসবে। আমাদের তথাকথিত পিকনিকের খাবারটিও নিয়ে আসবে সে। যেহেতু আমরা তেমন কোন ফি নিচ্ছিনা, এবং হ্রদয়ের ঢুকবার পথটি সর্বদাই পাকস্থলীর উপর দিয়ে যায়, ভাল খাবার ছাড়া আমাদের মাস্টার প্ল্যান কার্যকরী হবেনা। জহির প্রথমে একটু গজগজ করলেও পরে সে সেই আমলের বিখ্যাত "পূর্ণিমা"র প্যাকেট বিরিয়ানী আনতে রাজী হয়েছে। সাথে টুকটাক স্ন্যাক্সও সে আনবে।
মিজান বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঢুকেই ছবি তোলার জন্য কিছু কিছু জুতসই লোকেশন ঠিক করায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমরা এদিক সেদিক ঘুরছি।
প্রায় একঘন্টা জহিরের সখীসহ আগমন ঘটিল।
আমরা কেউই আগে লুনাকে (বা রোজীকে) দেখিনি। লুনা একটু শান্ত প্রকৃতির, কথা কম বলে। সে তুলনায় রোজী অনেক ছটফটে, প্রতি কথায় সে হেসে ওঠে। আমরা কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছি (মেয়েদের সাথে কথা বলার তো অভ্যেস নেই) দেখে সেইই আগ বাড়িয়ে কথা বলা শুরু করলো আমাদের সাথে।

যাইহোক, আজ এতদিন পর অনেক কিছুই আর মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে খুব সুন্দর কেটেছিল দিনটি। একটা জিনিস সেদিন শিখেছিলাম। মনের ভিতরে যদি প্রেমে পড়ার ইচ্ছে না থাকে তাহলে ছেলেমেয়েরা খুব সহজেই একে অন্যের বন্ধু হতে পারে। এবং তারা খুব ভাল আড্ডা দিতে পারে।

আমরা বসে অনেক গল্প করেছিলাম, "উদ্যানে ছিল বরষা-পীড়িত ফুল"। মিজান এর ক্যামেরায় "ক্লিক-ক্লিক" শব্দে ছবি উঠতে থাকে। আমরা কেউ তেমন পোজ দিয়ে ছবি তুলিনি সেদিন। মিজান যখন ভাল মনে করেছে, ছবি তুলে ফেলেছে।

সন্ধ্যার আগে "মিলনমেলা ভাংলো"। রোজী আর লুনা চলে গেল একসাথে। তারা কাছের কোন আত্মীয় বাড়ীতে যাবে।

আমরা সবাই সিগারেট খাচ্ছি। জহির বললো, "একটা নতুন সমস্যা হয়েছে।"
"আবার কি হলো?"
"লুনার বাবার শরীর একটু খারাপ। সিরিয়াস কিছু না, তবে সে পরশুদিন রাতের ট্রেনে চলে যাচছে। বাড়িটা তার আগেই মারতে হবে।"
দুদিনের মধ্যে ছবি ডেভেলপ করা, প্রিন্ট করা শেষ করতে হবে তাহলে। টাইট, খুবই টাইট।
মিজান বললো,"ওসতাদের কাছে যেতে হবে তাহলে। চাপাচাপি করলে হয়তো পারা যাবে।"
জহির বললো,"এটা কিন্তু আমার জিন্দেগীর সাওয়াল। ডুবাইয়েন না আমারে আবার শেষমেশ।"
জহির উঠে দূরের বাথরুমে গেল। আমরা চুপচাপ সিগারেট খাচ্ছি।
মিজান আস্তে আস্তে বললো,"আমারও একটা সমস্যা আছে।"
সবাই মিজানের দিকে তাকাই। "তোর আবার কি হোল? এখন কি তুই আবার রোজীর প্রেমে পড়লি নাকি?"
"প্রেম-ট্রেম না। তার থেকেও সিরিয়াস।"
"বল।"
"কথাটা জহিরের সামনে বলতে চাইনি। আমি ঠিক শিওর না, তবে কেন জানি মনে হচ্ছে টেনশনে ক্যামেরার লেন্স ক্যাপ খুলতে ভুলে গিয়েছিলাম আজকে।"
মেরুদন্ড দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায় সবার।
"তার মানে কি?"
"তার মানে আজকে তোলা একটা ছবিও না উঠতে পারে। জহিরকে বলিস না প্লিজ। সে হয়তো আমাকে খুনই করে ফেলতে পারে।"
আমরা বোকার মত তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি।

(বাকী অংশ পরের কিস্তিতে। আগে বুঝতে পারিনি যে কিসসা টা আরব্য-উপন্যাসের মত এত লম্বা হয়ে যাবে। )


মন্তব্য

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

হায় হায়, সেইযুগে বুঝি এসএলআর ছিলনা!

অতিথি লেখক এর ছবি

ছাত্র মানুষ ভাই। এস এল আর ক্যামেরা কেনার প্য়সা ছিলনা। ক্যামেরা যে ছিল এইতো বেশী।

অমিত আহমেদ এর ছবি
সাইফ তাহসিন এর ছবি

হো হো হো হো হো হো

ক্যামেরার খাপ না খোলা, ক্যামেরায় ফিল্ম না থাকা, থাকলেও লোড না হওয়া, বিয়াপক গিয়ান্জামের দিনগুলার কথা মনে পড়ে গেল। হেব্বি মজা পাইলাম!
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।