যা তুমি।

জাহিদ হোসেন এর ছবি
লিখেছেন জাহিদ হোসেন (তারিখ: বিষ্যুদ, ২০/১২/২০০৭ - ২:১১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঠিক দরজার কাছে এসে মিরি থামলো। একটু ইতস্ততঃ করে ঘরের ভিতরে তাকালো। তারপর দু পা পিছিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে দোকানের সাইনবোর্ডের লেখা গুলো পড়লো। এরপর ভুরু কুঁচকে পিছনে তাকিয়ে ডাকলো।
"এইটাই তোমার সেই জায়গা?"
ফারুক রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিচ্ছিল। রিকশাওয়ালা তাকে একগাদা খুচরো টাকা পয়সা ফেরত দিয়েছে। সে একমনে সেগুলো গুনছিল। রিকশাওয়ালা তার এতো মনোযোগের সংগে পয়সা গোনা দেখে কিঞ্চিত বিরক্ত সুরে বললো,"এত গুইনা লাভ নাই সার। পয়সা কম দেই নাই। গরীব হইলেই মানুষে সবসময়ে চোর হয়না।"
ফারুক সে কথায় খুব একটা কান দেয়না। মিরি চোখের ইঙ্গিতে রিকশাওয়ালাকে চলে যেতে বললো। সে বিজবিজ করতে করতে চলে গেল।
ফারুক পয়সা গোনা শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।"মানুষকে আজকাল আর একদম বিশ্বাস করা যায়না। ঠিকই কায়দা করে পয়সা কম দিয়ে চলে গেল। অথচ দেখো, লম্বা কথা শুনে মনে হবে যেন সাধু যুধিষ্টির। তুমি ওকে যেতে বললে কেন? ধরতে পারলে কান ধরে উঠবস করাতাম।"
"কত কম দিয়েছে?"
"আশি পয়সা।"
"সামান্য আশি পয়সার জন্য তুমি মরে যাবে?"
"এটার সাথে বাঁচা-মরার কোন সম্পর্ক নেই। জাষ্ট মনটা খারাপ হয়ে গেল। সামান্য আশি পয়সার জন্য লোকটা মিথ্যে কথা বললো! আমাকে বললেই আমি ওকে টাকা দিয়ে দিতাম। বিশ্বাস জিনিষটা দুনিয়া থেকে আজকাল খুব দ্রুত অদৃশ্য যাচ্ছে।"
"থাক, এটা নিয়ে আর কথা বাড়ানোর দরকার নেই। দুনিয়া থেকে প্রতিদিনই বহু কিছু উধাও হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বাস জিনিষটা যে এতদিন টিকে আছে এইইতো বেশী। যাইহোক, এটাই তো তোমার সেই বিখ্যাত জায়গা?"
ফারুক একটু হাসে। "হ্যাঁ, এটাই সেই জায়গা। সাইনবোর্ডটা দেখেছো? প্রথম দিনতো সাইনবোর্ডটা দেখেই ঢুকেছিলাম। তারপর প্রেমে পড়ে গেলাম। এখন একদুইদিন পরপর না এলে ভালো লাগেনা। এবারেই বেশ কয়দিন আসা হয়নি।"

মিরি আবার উপরে তাকায়। কটকটে নীল রঙের জমিনের উপর সিঁদুরে লাল অক্ষরে বড় বড় করে লেখা, "হোটেল পাপ্পু এ্যন্ড রেস্টুরেন্ট"। লেখাটার দিকে বেশীক্ষন তাকালে মাথা ধরে যাবে। যে লোক লিখেছে, তার বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারা যায়না। এই লেখা এক মাইল দুর থেকেও দেখা যাবে। আর কাস্টমারেরা এই লেখার হাত থেকে বাঁচার জন্যেই ঝটপট দোকানে ঢুকে যাবে।

ফারুক উত্সাহী গলায় বলে,"লেখার পাশের ছবিগুলো খেয়াল করেছো? আমার তো হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবার যোগাড়।"

সাইনবোর্ডের একপাশে কাঁচা হাতে আঁকা একটা ছবি। একটা টেবিলের দুপাশে বসে আছে একটা মোটাসোটা ছাগল আর একটা গরু। দুজনেরই মুখ বেশ হাসিহাসি। কেননা টেবিলের উপর একটা বড় প্লেটে রাখা আছে একটা আস্ত মুরগীর রোস্ট এবং তার মুখে একটা বিশাল সাইজের ডিম। তার নিচে লেখা, "এখানে গরু, খাসি এবং মুরগীর মজাদার তরকারী পাওয়া যায়"।
মিরি হেসে ফেলে। "এ রকম উদ্ভট ছবি আমি জীবনে কোনদিন দেখিনি। এ ছবির মানে কি? এটা কি গরু ছাগলের হোটেল নাকি?"
ফারুকও হাসে। "এই হোটেলের মালিকের নাম হচ্ছে জনাব আলহাজ্ব বাবর শিকদার। ওনার ছোট জামাইয়ের বাসের ব্যবসা আছে। সেখানকার খাস পেইন্টার মনতাজ কারিগরের নিজের হাতের কাজ এটা। এদেশের লোকেরা দাম দিলনা বলে বেচারার কোন কদর হোলনা। বিদেশে হলে এই ছবিই হয়তোবা মোনালিসা বা গুয়ের্নিকার চাইতে বেশী দামে বিক্রী হোত।"
"তোমার যে কোন কথা সত্যি আর কোন কথা ঠাট্টা, তা বোঝা মুশকিল।"
"চলো, ভিতরে যাই।"
দোকানে ঢুকবার আগে মিরি শাড়ীর আঁচলে মুখ মুছলো। বিকেল বেলার পড়ন্ত আলো এসে পড়েছে তার মুখে। ফারুক পৃথিবী জয়ের হাসি নিয়ে বললো,"এসো আমার পিছনে পিছনে এসো।"

দোকানের মুখের কাছেই একটা টেবিল পেতে বসে আছে একজন। বোধহয় ম্যানেজার। লোকটির বয়েস পয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে হবে। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মাথার চুল লম্বা এবং এলোমেলো। স্বাস্থ্য মাঝারী। সে ফারুককে দেখে একগাল হাসলো।
"সালাম আলাইকুম, সার। ভাল আছেন?"
তারপর তার দৃষ্টি পড়লো মিরির দিকে। প্রথমে সে একটু থতমত খেয়ে গেল, তারপর মুখে একটা বোকার মত হাসি নিয়ে বললো,"আপাকে নিয়া আসছেন, তা একটা খবর দিবেন তো আগে। একটু বসেন, আমি মোজাম্মেলকে ডাকি।"
"মোজাম্মেলকে ডাকা লাগবে না। আমরাই নিজে গিয়ে বসছি।"
"ঠিক দুই মিনিট লাগবে সার, একটু বসেন।"
তারপর সে টেবিলের উপর রাখা ঘন্টাটা প্রায় পাগলের মত জোরে জোরে বাজানো শুরু করে দেয়। এবং সেই সাথে বাঁজখাই গলায় হুংকার দিয়ে ডাকে, "মোজাম্মেল, ওই মোজাম্মেল! ফারুক সারের টেবিলটা রেডী কইরা দে তাড়াতাড়ি।"
ভিতর থেকে অত্যন্ত বিরক্ত মুখে চোদ্দ-পনেরো বছরের একটি ছেলে বেরিয়ে আসে। কাঁধের গামছায় মুখ মুছতে মুছতে সে পালটা গলায় বলে," কাজের সময় এতো দিকদারী করেন ক্যান কনতো? কি হইছে?"
ম্যানেজার লোকটি চোখের ইংগিতে ফারুককে দেখায়। মুহুর্তের মধ্যে মোজাম্মেলের গোটা চেহারাই বদলে যায়। সে একগাল হাসে। "সালাম আলাইকুম সার।" তারপর অনুযোগের সুরে ম্যানেজারকে বলে,"ফারুক সারে আসছে সেটা কইতে কি হয়? খামাখা এনারে দাঁড় করাইয়া রাখছেন। এখুনি টেবিল রেডী করতাছি।"

মোজাম্মেল বীরদর্পে দোকানের কোণার টেবিলের দিকে হেঁটে যায়। সেখানে দুজন শ্রমিক শ্রেণীর লোক বসে খাচ্ছিল। তাদেরকে কি যেন বলতেই তারা টেবিল ছেড়ে পাশের টেবিলে চলে যায়। মোজাম্মেল গামছা দিয়ে টেবিল মোছে, চেয়ার ঝাড়ে। মিরি ফারুকের দিকে তাকায়। ফারুক স্মিত হাসিমুখে বলে,"কি করবো বলো? এরা একটার চেয়ে আর একটা বেশী পাগল। আমার কোন কথাই শোনেনা।"
মিরি বোঝে যে গোটা ব্যাপারটা ফারুক বেশ উপভোগ করছে।
মোজাম্মেল কাজ করে ফিরে আসে। "আসেন সার, আসেন আপা। আমি পরিস্কার গেলাসে পানি আনতাছি।"
চেয়ারে বসবার পর ফারুক জিজ্ঞেস করে, "বলো, কি খাবে?"
"এই অবেলায় আমি কিচ্ছু খাবো না। আমি তো শুধু তোমার এত গল্প শুনে শুধু দোকানটা দেখতে এসেছিলাম।"
"খাবার না খেলে রেস্টুরেন্টের কিই বা তুমি বুঝবে? একটা কিছু খাও, এখন তো কেবল পাঁচটা বাজে, রাতের খাবার খেতে বহু দেরী আছে।"
"বাইরের খাবার আমার তেমন সহ্য হয়না। একমাত্র চাইনিজটাই কেবল খেতে পারি।"
"এখানে তো চাইনিজ নেই, বাংগিজ কিছু একটা খাও। এরা কিমা পরোটাটা দুর্দান্ত বানায়। একবার খেলে জীবনে আর অন্য কিছু মুখে দিতে পারবে না।"
"আচ্ছা তাইই দিতে বলো। আমি হয়তো পুরোটা শেষ করতে পারবো না।"
ফারুক হাসে।"‘একবার মুখে দিয়ে তারপর ও কথা বলো। মোজাম্মেল, দুইটা কিমা পরোটা। ভাল দেখে আনবি, না হলে কিন্তু আপার সামনে আমার বদনাম হয়ে যাবে।"
টেবিলে পানির গ্লাস রেখে মোজাম্মেল বলে,"একদম চুলার উপর থেইকা নিয়া আসুম সার। বদি ভাই কেবল ভাজা শুরু করছে। গরম গরম খাইলে এ জিনিষের ভাল টেস্ট পাইবেন।"

চেয়ারে বসে মিরি চারপাশে তাকিয়ে দেখে। হোটেল পাপ্পু এ্যন্ড রেষ্টুরেন্ট একটি তৃতীয় শেণীর ভোজনাগার। মিরিদের বাড়ীর অবস্থা উচ্চ মধ্যবিত্ত। সে বা তার পরিবারের কেউ এ জাতীয় জায়গায় ঢোকেনা সচরাচর। দোকানের ভিতরে অল্প পাওয়ারের বাতি জ্বলছে। চেয়ার-টেবিল গুলো ভাল করে মোছার পরেও তেলতেলে হয়ে আছে। আশপাশে বসা লোকেরা প্রায় সবাই দেখে গরীব এবং অশিক্ষিত বলে মনে হয়। মিরি ঠিক ভাবেনি যে ফারুক তাকে এই রকম একটি দোকানে নিয়ে আসবে। সে আরও একটু ভাল জায়গা আশা করেছিল।
ফারুকের মুখে এখনো পৃথিবীজয়ীর হাসিটি লেগে আছে। সে অল্প পানি খায় আয়েশ করে।
"কি মিরি বেগম, কেমন লাগছে তোমার জায়গাটা?"
"তার জবাব পরে দেব। আগে বলো, কি আছে এই দোকানের মধ্যে যে তুমি আমাকে জোর করে দেখাতে নিয়ে এলে? তুমি এর গল্প বহুদিন করেছো কিন্তু কেন ভাল লাগে তা কখনো বলোনি।"
"বলতে পারতাম, কিন্তু তুমি এখানে না এলে পুরোটা বুঝতে না।"
"কি জিনিষ তাইই জানিনা, কাজেই সেটা বোঝারও প্রশ্ন ওঠেনা। এই দোকানে তুমি কেন আসো সেটাই আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি এখনো। তবে একটা জিনিষ বুঝেছি, এর তোমাকে খুব খাতির করে।"
ফারুক মৃদু হাসে।"দোকানটা বেশ সস্তা, আমাদের মত ছাত্রদের জন্য তাই এটা প্রেফারেবল। আর আমাদের হলের কাছেই, তাই বেশ কনভেনিয়েন্ট। এদের রান্নাটাও বেশ চমত্কার। ঢাকাকে সবাই বলে মসজিদের শহর, কিন্তু আমার কাছে মনে হয় আসলে ঢাকা হচ্ছে রেস্টুরেন্টের শহর। কতরকম দোকান, কতরকম রান্না। শীত পড়লে তোমাকে একদিন ইসলামপুরে নিয়ে যাবো। সেখানে রাস্তার পাশে ভুলু পাগলা বলে এক অন্ধলোক আগুনে পোড়ানো ভুট্টা বিক্রী করে। তার সাথে তেঁতুলের টক। সেখানে বসে খাওয়ার কোন জায়গা নেই। কিনে হাঁটতে হাঁটতে খেতে হবে। তোমার মনে হবে তুমি যেন বেহেশতী খাবার খাচ্ছো।"

মিরি অপলকে ফারুকের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে যেন এই মানুষটিকে ঠিক চিনে উঠতে পারছেনা। একে সে দেখেছে তুখোড় বিতর্ক করতে, দেখেছে উদাত্ত গলায় জীবনানন্দ দাশের কবিতা আবৃত্তি করতে, দেখেছে লাইব্রেরীতে ঘন্টার পর ঘন্টা বইয়ের পাতায় আবদ্ধ থাকতে। ভালোবাসাময় একটি মানুষকে মিরি হাত ধরে নিয়ে এসেছিল তার হূদয়ের অন্তঃপুরে, সে মানুষটিই এখন তার সামনে বসে ভুট্টা খাওয়ার কথা বলছে।

ফারুক বোধহয় মিরির অস্বস্তি টের পায়। সে বলে, "দাঁড়াও, বলছি কেন এর আমাকে এতো খাতির করে। ঐ যে ম্যানেজার বসে আছে, ওর নাম হচ্ছে রমজান আলী। ওর বাড়ী ঝিনাইদহের দামুকদিয়া গ্রামে। আমার রুমমেট সামাদ ওর নাম দিয়েছে বিরহী নায়ক। কেন জানো? বেচারার বৌ থাকে গ্রামে, এবং তাকে ঢাকায় এনে রাখবার মত সামর্থ্য নেই রমজান আলীর। বৌয়ের বিরহে তাই আমাদের নায়ক সবসময় বিষন্ন থাকেন। ঢাকা শহরে এই জাতীয় হোটেলে সচরাচর ফুল ভল্যুমে পুরনো হিন্দী গান বাজে। তুমি কি খেয়াল করেছো এখানে কি গান বাজছে?"

মিরি ব্যাপারটা আগে লক্ষ্য করেনি। দোকানের লোকজনের কথাবার্তার মধ্যে গানটা ঢাকা পড়ে গেছে। মন দিয়ে শুনলো মিরি, মান্না দে'র একটি পুরনো গান বাজছে।
"শুধু একদিন ভালবাসা, মৃত্যু যে তারপর
তাও যদি পাই, আমি তাই চাই
চাইনা বাঁচতে আমি প্রেমহীন হাজার বছর।"
মিরির বেশ অবাক লাগে। সাধারণতঃ রমজান আলীর শ্রেণীর লোকেরা মান্না দে'র গান পছন্দ করেনা।
ফারুক আবার কথা বলে। "আগে কিন্তু এই দোকানে হিন্দী গানই বাজতো। তারপর আমি আর সামাদ একদিন এলাম এখানে। সামাদ আবার হিন্দী গান দুচোখে দেখতে পারেনা। সে ভিতরে ঢুকেই ঘোষণা দিয়েছিল, ম্যানেজার সাব অন্য গান দেন। সাধারণতঃ সামাদের কথা শুনে অন্য দোকানের ম্যানেজারেরা বলে, আর কোন গান নাই সার, লোকেরা হিন্দী গানই পছন্দ করে। কিন্তু সেদিন হোটেল পাপ্পুতে তেমন কিছু হোলনা, বরং বেজে উঠলো ফরিদা পারভীনের গাওয়া লালন গীতি। সামাদ আর আমি দুজনেই অবাক। খাওয়া শেষের দাম দিতে গিয়ে আরেক সমস্যা, রমজান আলী কিছুতেই দাম নেবেনা।"
"ওমা কেন?"
"সামাদের মত রমজান আলীও হিন্দী গান দুচোখে দেখতে পারেনা, কিন্তু জনগণের দাবীতে বেচারাকে সেটাই বাজাতে হয়। আমরা আসাতে সে সেদিন মনের সুখে বাংলা গান বাজাতে পেরেছিল। তার মনের আনন্দের দাম হিসেবে আমাদের খাওয়ার পয়সা মাফ। হিসেব মেলানোর জন্যে সে পকেট থেকে পয়সা দিতেও প্রস্তুত।"
"ভারী আশ্চর্য্য লোকতো।"
"রমজান আলীকে দেখে তুমি বুঝতেই পারবেনা যে তার মত একজন গ্রাম্য লোকের মধ্যে একটা সাংঘাতিক রুচিবান মানুষ বাস করে। পড়াশুনা করলে আজ তাকে সামান্য ম্যনেজারীর চাকরী করতে হোতনা। সেইদিনের পর থেকেই আমি বা সামাদ হোটেলে ঢুকলেই রমজান আলী সাথেসাথেই গান বদলে দেয়। তার গানের কালেকশান কিন্তু বেশ ভাল। যেহেতু হাজী বাবর আলী সাহেব বাংলা গান পছন্দ করেন না, অতএব সে পকেটের পয়সা দিয়েই নতুন নতুন বাংলা গান কিনে আনে দোকানের জন্যে। তার পছন্দ গুলো অবশ্য একটু পুরনো আর বিরহঘেঁষা। তবুও খারাপ লাগেনা।"
মিরি আনমনে একটু হাসে।"সত্যিই মানুষকে বাইরে থেকে দেখে ভিতরটা বোঝা খুবই মুশকিল।"
"রমজান আলী মানুষটা খুব বেশী কথা বলেনা আমাদের সাথে। কিন্তু বুঝি যে সে খুবই পছন্দ করে আমাদের। সাধারণতঃ ছাত্ররা এই জাতীয় দোকানে এসে খামাখা হাঙ্গামা-হুজ্জোত করে, খেয়ে পয়সা দেয়না, রাগারাগি করে দু’চারটে চড়-থাপ্পড় লাগায় মোজাম্মেলদের মতোন লোকদের। আমি আর সামাদ সেই তুলনায় ফেরেশতার সমান। সে কারণেও বোধহয় এরা আমাদের খাতির করে। এখন তো আমরা ওদেরই একজন হয়ে গেছি। মাঝেমাঝে স্টাফ তরকারীও খেতে দেয় আমাদের।"
"স্টাফ তরকারী জিনিসটা আবার কি?"
"এই জাতীয় দোকানগুলোতে কর্মচারীদের জন্য আলাদা রান্না হয়। শাক-পাতা, ছোট মাছ এই জাতীয় খাবার আর কি। কিন্তু তার সে কি স্বাদ। বিশেষ করে কুমড়ো ফুল ভাজা আর কেঁচকি মাছের চচ্চড়িটা রীতিমত অসাধারণ হয়। যেদিন আমাদের প্রিয় খাবার গুলো রান্না হয়,সেদিন রমজান আলী পারলে লোক পাঠিয়ে আমাদের ডেকে আনে। খাওয়ার সময়ে সে পাশে বসে থাকে। বড় খুশী হয়। সেদিন একটু কথা-টথা বলে।"
মিরি আবার আনমনে হাসে। "সত্যিই মানুষকে চেনা খুবই কঠিন ব্যাপার।"
ফারুক পানি খায় একটু।"এটা তুমি ঠিকই বলেছো। কত রকম মানুষ আছে এই দুনিয়ায়। কার ভিতরে যে কি আছে বোঝা কঠিন। একজন মানুষকে বুঝতে সারা জীবন কেটে যায়। কত রমজান আলী আমাদের চারপাশে ঘোরাফেরা করে। তার কয়জনকে আমরা চিনতে পারি বলো?"
মিরি মাথা নামিয়ে ফেলে। আঙ্গুল দিয়ে টেবিলে আঁকিবুঁকি কাটে। তারপর সে ইতস্ততঃ করে বলে," আমি রমজান আলীর কথা বলছিনা আমি আসলে তোমার কথা বলছিলাম।"
ফারুক একটু অবাক হয়। "আমার কথা মানে? এর মধ্যে আমি আবার কোথথেকে এলাম?"
মিরি মুখ তোলে। জানালা দিয়ে সূর্যের শেষ লালচে আলো এসে পড়েছে তার মাথায়। রুক্ষ চুলে প্রতিফলিত হচ্ছে সে আলো। ফারুকের মনে হোল মিরির মুখের চতুর্দিকে ঘিরে রয়েছে এক অদ্ভুত দ্যুতি। মিরি যেন এই ভুবনের কেউ নয়। মাথার পিছনটি আলোকিত হবার জন্যে মিরির মুখখানিকে কিছুটা অস্পষ্ট লাগে।

মিরি সরাসরি ফারুকের দিকে তাকায়। তার চোখে দ্বিধা। একমাত্র প্রিয়জনদের সামনে সত্যকথনের পুর্বেই মানুষের চোখে এমনি ক্ষণস্থায়ী দ্বিধা দেখা যায়।

"আজকে আমি বারবার তোমাকেই দেখছি। আমি সবসময়েই ভাবতাম যে আমি খুব ভাল মানুষ চিনতে পারি। আজকে অত্যন্ত দুঃখের সাথে বুঝতে পারলাম যে সেটা কত বড় ভুল ধারণা। তুমি আজকে একটা খুব বড় একটা সত্যি কথা বলেছো। একটা মানুষ চিনতে সারা জীবন কেটে যায়। অতিচেনা মানুষের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে হীরের ঝলকানি, লুকিয়ে থাকে পাতালের অন্ধকার।"

ফারুক হাসে। "আজকে তুমি কি নতুন জিনিষ দেখলে আমার ভিতর? তাড়াতাড়ি বলো। না শুনলে আজকে আমার ঘুম হবেনা।"
মিরি ম্লান হাসে। সে একটু ধরা গলায় বলে, "পাগল! মানুষচরিত্র বিশ্লেষন আমি এত তাড়াতাড়ি আর করছিনা। শুধু এইটুকু বলতে পারি যে আজকে আমার অনেক রাত অবধি ঘুম আসবেনা। এবং আজকে রাতে আমি অনেক কাঁদবো।"

মোজাম্মেল টেবিলে দুটো বড় প্লেটে করে কিমা পরোটা নামিয়ে রাখলো। সেগুলো থেকে ধোঁয়া উঠছে। একটা ছোট প্লেটে কুচিকুচি করে কাটা শশা-টমেটোর সালাদ। দেখলেই জিভে পানি আসে।
"তাড়াতাড়ি খাইতে হইবো কিন্তু আপা। ঠান্ডা হইয়া গেলে মজা পাইবেন না।"
ফারুক বলে,"যতটকু পারো খাও। কষ্ট করে পুরোটা খেতে হবেনা।"
"তোমার কি মাথা খারাপ? আমি একটুও ফেলে রাখবোনা।"

----------XXXXXXXXXXXX----------

"কি রে তুই এত চুপচাপ কেন আজকে?"
"কেন জানি কথা বলতে ভাল লাগছে না।"
দুপুর বেলার সূর্য্য ঠিক মাথার উপর। গত ক'দিন ধরে ঢাকা শহরে প্রচন্ড গরম পড়েছে। ফারুক পকেট থেকে রুমাল বার করে চশমার কাঁচ মুছলো, তারপর মুখের ঘাম মুছলো। সে আর সামাদ কার্জন হল থেকে হেঁটে শাহবাগ যাচ্ছে। ফারুকের পকেটে পয়সা ছিল, সে বলেছিল রিকশা নিতে। সামাদ তার জবাবে বলেছিল,"কেন একদিন এইটুকু পথ হাঁটলে কি তুই গরমে গলে যাবি নাকি? চল্‌ হেঁটেই যাই।"
অথচ এখন মনে হচ্ছে গরমে সামাদই বেশী কাবু হয়ে পড়েছে। সে ইতিমধ্যেই তিনবার "এই শালার গরমের দেশে আর থাকা যাবে না" জাতীয় মন্তব্য করেছে। ফারুক মনেমনে হাসে। এখন কেমন লাগছে চান্দু?
সামাদ আবার কথা বলে," কেন তোর কথা বলতে ভাল লাগছে না কেন?"
"দু' দিন পর একটা বড় পরীক্ষা আছে। সেটা নিয়ে চিন্তায় আছি।"
সামাদ ভুরু কুচকে বলে, "তোর কথাটা বিশ্বাস করতে পারলাম না। মিথ্যে কথা বলার চেষ্টা করিস কেন খামাখা?"
"এতে বিশ্বাস না করার কি আছে? তুই আমার সাথে এখন ডিপার্টমেন্টে চল, তোকে নোটিশ বোর্ডে পরীক্ষার ঘোষনা দেখিয়ে দিচ্ছি।"
"দু দিন পর যে তোর পরীক্ষা আছে সেটাতো আমি অবিশ্বাস করছি না।"
"তাহলে?"
"পরীক্ষার কারণে তোর কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা এটা আমি বিশ্বাস করছিনা।"
"কেন? আমি পরীক্ষা নিয়ে চিন্তা করতে পারিনা?"
সামাদ রুমাল দিয়ে ঘাড়-মুখ মোছে। তারপর একটা সিগারেট ধরায়।"মিরির খবর কি?"
"ভালই।"
"তাকে তোর পাপ্পু রেস্টুরেন্টে সেদিন নিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি। ওইসব জায়গায় কোন ভদ্রঘরের লোকেরা যায়? এতদিন প্রেম করার পরেও তোর এই আক্কেলটা হোলনা।"
"মিরিকে রেস্টুরেন্ট দেখাতে নিয়ে যাইনি। রমজান আলীকে দেখানোর জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম।"
সামাদ এই কথায় হাসে। "বেশী বই পড়ে পড়ে তোর ব্রেনে শর্ট সার্কিট হয়ে গেছে। প্রেম করবার সময় মেয়েদেরকে ভাল ভাল জিনিস দেখাতে হয়। তুই কিনা দেখালি রমজান আলীর মত একটা ভূতকে। তোর কপালে দুঃখ আছে।"

রমজান আলী খেতে বসেছিল। গোটা রেস্টুরেন্ট প্রায় ফাঁকা, শুধু কোণার টেবিলে বসে একটি পত্রিকার হকার বসে ভাত খাচ্ছে। তাদেরকে দেখে রমজান আলীর মুখ উজ্বল হয়ে উঠলো। মুখের খাবার দ্রুত গিলে সে উঠে দাঁড়ালো, "সার বসেন, আজকা ভাল খাবার কিন্তুক সব শেষ। শুধু রুই মাছের কয়টা পিস আছে।"
সামাদ ধপ্‌ করে চেয়ারে বসে পড়ে। "খাওয়ার কথা পরে হবে রমজান মিয়া। আগে ফ্যানটার স্পিড বাড়াইয়া দেন। একটু ঠান্ডা হইয়া নেই আগে। আর ঠান্ডা পানি লাগবে তিনশো গ্লাস।"
রমজান আলী হাসে। "মোজাম্মেল পানি আনতাছে।"
ফারুক হাত ধোয়ার বেসিনে গিয়ে ঘাড়ে মাথায় পানি ছিটায়। রুমালে মুখ মুছে সে জিজ্ঞেস করে, "আজ স্টাফ তরকারী কি হয়েছে রমজান মিয়া?"

লালশাকের সাথে মাছের কাটাঁর চচ্চড়ি, সজনেডাঁটা দিয়ে মসুরের ডাল। খিদের পেটে তাইই অমৃতের মত লাগছে। সামাদ খেতে খেতে মোজাম্মেলকে ডেকে বললো,"লেবু-টেবু থাকলে কাইটা আন্‌।"
ফারুক হাসে।"তোর মাথা ঠান্ডা হয়েছে এখন? তোকে দেখে মনে হচ্ছে যেন ফাঁসির আসামী। এটাই যেন তোর জীবনের শেষ খাওয়া। আস্তে আস্তে খা।"
"অত হাসিস না। খিদার সময়ে ভাত সামনে দেখলে মাথার ঠিক থাকেনা। শালার বাপ-দাদা ছিল কামলা। তিন পুরুষ ধইরা ভাত ছাড়া আর কিছু খায় নাই আমাদের বংশের লোকরা।"
লেবু নিয়ে মোজাম্মেল আসে। "সার, ম্যানেজার সাবে একটা কথা জিগাইতে কইছে।"
"কি কথা?"
"ম্যানেজার সাবে নতুন পূজার বাংলা গানের ক্যাসেট কিনছে। সেই গানগুলা আপনাদের একটু শুনাইতে চায়।"
সামাদ খেতে খেতে মাথা নাড়ে। "ক্যাসেট লাগাইতে ক'। তবে গান জানি ভাল হয়। ফারুক সারের মন খারাপ আইজকা। ভাল গান শুনলে মনটা ভাল হইতে পারে। আর আমারে আর এক বাটি ডাইল দিয়া যা।"

প্রথম গানটি লতা মঙ্গেশকারের। একটি জনপ্রিয় হিন্দী গানের বাংলা অনুবাদ। সামাদ মুখ বাঁকায়," শালার এই বিহারী গলায় বাংলা গান শুনলেই মেজাজটা খাট্টা হয়। দেশে কি আর শিল্পী নাই?"
ফারুকের খাওয়া শেষ। সে মৌরী চিবায়। "তুই সব সময় এত খ্যাঁচখ্যাঁচ করিস কেন বলতো? প্রতিদিন পেট পরিষ্কার হয়তো?"
"আরে বাংলা গান গাইতে গেলে দরদ লাগে, মনটা হওয়া লাগে পলিমাটির মতোন নরম। এইসব খোট্টা-মোট্টা দিয়া কি আর বাংলা গান গাওয়া যায়? রমজান মিয়া, একটা ভাল গান লাগান।"

দ্বিতীয় গানটি শুরু হয় হাল্কা বেহালা দিয়ে, সেটার রেশ মেলানোর সাথে সাথেই করুন সুরে বাঁশী বেজে ওঠে। বনশ্রী সেনগুপ্তর গান। "যা তুমি নিজের হাতে ভাংলে, সেতো আর লাগবে নাকো জোড়া/ যে ফুল ভাসিয়ে দিলে জলে, সে ফুলে বাঁধবে কে আর তোড়া।"
সামাদ উঠে দাঁড়ায়। "এই শুরু হইলো ছ্যাঁক খাওয়া সমিতির গান। দুনিয়ায় শান্তি নাই কোন জায়গায়।"
"কেন, ভালইতো লাগছিল শুনতে।"
"ওঠ তাড়তাড়ি। এর চেয়ে ঢাকার গরম হাওয়াও ভাল।"

----------XXXXXXXXXXXXXXXXXXXX----------

পরপর চারদিন মিরি ক্লাশে আসেনি। পঞ্চম দিনে তার চিঠি এলো ফারুকের হলের ঠিকানায়।

ফারুক,
সবকথা সামনা সামনি বলা যায়না। বললেও তুমি বুঝতে না। বুঝলেও উলটো যুক্তি দিতে। তোমার যুক্তির সামনে আমি হেরে যেতাম। তোমার চোখের দিকে তাকিয়েই আমি গলে যেতাম।
গত কয়েকদিন ধরে বাসায় আমার বিয়ের কথা চলছে। এখন বিয়েতে আমার ইচ্ছে নেই সেটা বলেছি কয়েকবার। তার পরেও তিনদিন আগে আমাকে দেখতে এসেছিল ছেলেপক্ষ। গতকাল নিউমার্কেটে গিয়েছিলাম মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে, সেখানে হঠাত্ করেই দেখা হোল ভদ্রলোকের সাথে। দু'একটা এলোমেলো কথার পর যখন উনি কোথাও বসে কফি খাবার প্রস্তাব দিলেন, তখন বুঝলাম দেখা হওয়াটা নিছক কাকতালীয় ছিলনা। প্রায় একঘন্টার মত কথা বলেছি আমরা। ভদ্রলোক বুদ্ধিমান, শান্ত এবং সবচেয়ে বড়কথা, প্রেডিক্‌টেবল্‌। তিনি হয়তো আমাকে স্বপ্ন দেখাবেননা কিন্তু তাকে আমি বিশ্বাস করতে পারি, তার উপর ভরসা করতে পারি। আমার মত একটি সাধারণ মেয়ের জন্য এর চেয়ে বেশী আর কিই বা চাওয়ার থাকতে পারে বলো?
সেদিন তোমার সাথে রেস্টুরেন্টে বসে হঠাত্ করে একটা জিনিস বুঝতে পারলাম। তুমি ভিন্ন একটি পৃথিবীতে থাকো। সেখানে তোমার প্রিয় মানুষেরা থাকে। তাদের অনেককেই আমি চিনিনা। তারপরও তোমার হাত ধরে আমি সেখানে যেতে চাই, সেই পৃথিবীতে আমি তোমার সাথে বসবাস করতে চাই। কিন্তু আমি জানি একদিন সেখানে আমি হাঁপিয়ে উঠবো, আমার দমবদ্ধ হয়ে আসবে। আমি সেইদিনটির মুখোমুখি হতে চাইনা। তোমার পৃথিবী চিরদিন আমাকে দূরবর্তী একটি নক্ষত্রের মত হাতছানি দেবে। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকবো, কিন্তু তাকে কোন দিনও ছুঁতে পারবো না।
তুমি হয়তো আমার এই অকস্মাত্ সিদ্ধান্তে দূঃখ পাবে, অবাক হবে। কিন্তু আমি জানি, তুমি এই দুঃখকে সামলে নিতে পারবে, ক্রোধকে জয় করতে পারবে। আমি নিজেই হয়তো তা পারবো না। এ তোমার পরাজয় নয়, আমারই ব্যর্থতা। বৃষ্টি দেখলে তোমার কথা মনে পড়বে, কাউকে জোরে হাসতে দেখলে তোমার কথা মনে পড়বে।
ভাল থেকো। আমি সম্ভবতঃ আর ক্লাসে আসবো না।

চিঠিটির নীচে কোন স্বাক্ষর নেই। কোন প্রমান নেই এই চিঠি কার লেখা। কে জানে কবে, কোথায়, কার হাতে এই চিঠি পড়বে। মাঝেমাঝে মেয়েরা বড় সতর্ক হয়।
ফারুক অল্প হাসলো। চিঠিটা যত্ন করে ভাঁজ করলো সে। তারপর কুটিকুটি করে ছিঁড়লো। ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে বাতাসে উড়িয়ে দিল কাগজের টুকরোগুলো। একটি ভালবাসাময় সম্পর্কের আর কোন স্মৃতি অবশিষ্ট রইলো না।
ধীরপায়ে পড়ার টেবিলে ফিরে এল সে। আজকে বিকেলে তার একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা আছে।

----------XXXXXXXXXXXXX-----------

রিকশাওয়ালা এত রাতে এদিকে আসতে চায়নি। বেশী ভাড়া দিতে রাজী হওয়ার পরই সে এসেছে। হোটেল পাপ্পুর ঝাঁপ বন্ধ, কিন্তু ভিতরে আলো জ্বলছে। খেয়াল করলে মৃদু স্বরের আলাপ ও শোনা যায়।
ফারুক দরজার সামনে এসে কয়েকবার টোকা দিল। ভিতরের কথাবার্তা মুহুর্তের মধ্যে থেমে গেল।
ফারুক ডাকলো,"রমজান মিয়া, মোজাম্মেল। আমি ফারুক। তোমরা কি জেগে আছো?"
রমজান মিয়া সাড়া দিল,"ফারুক সারে নাকি? এতো রাইতে।"
"হ্যাঁ রমজান মিয়া। আমি ফারুক। একটু দরকারে এসেছি।"

ভিতরে খুটখাট চেয়ার-টেবিল টানার শব্দ হয়। একটু পর হোটেলের ঝাঁপ খোলে। সামনে রমজান আলী দাঁড়িয়ে। ভিতরে একটা মৃদু পাওয়ারের বালব জ্বলছে। দোকানের সব টেবিল গুলো এক করে বড় বিছানা পাতা হয়েছে। সেখানে সারি সারি কিছু লোক ঘুমাচ্ছে।

"সার, ভিতরে আসেন। খাইছেন কিছু?"
"আমি খেতে আসিনি রমজান মিয়া। একটা ছোট্ট কাজে এসেছি।"
রমজান আলী সে কথায় কান দেয়না। সে তার পুরনো প্রশ্নটাই আবার করে,"আপনে খাইছেন কিছু?"
"আমার খিদে নাই রমজান মিয়া।"
রমজান আলী একটি চেয়ার এগিয়ে দেয়। "এইখানে বসেন সার। মোজাম্মেল খাবার গরম করতে গেছে। হাতে প্লেট নিয়াই খাইতে হইবে সার। টেবিলগুলায় বিছানা কইরা ফালাইছি। এইগুলার যা ঘুম, ঘরে আগুন লাগলেও ঘুম ভাংবোনা।"
"তুমি ব্যস্ত হয়োনা রমজান মিয়া। খাবার গরম করার কোন দরকার ছিলনা।"
মোজাম্মেল একটি প্লেটে করে খাবার নিয়ে এলো। ফারুকের হাতে প্লেটটি দিয়ে সে হাত কচলে বললো,"আর কিছু নাই সার। আপনার খাইতে অসুবিধা হইবো।"
প্লেটে করে সে এনেছে লাল রঙা মোটা চালের ভাত, এককোণায় পড়ে আছে এক থাবড়া মিষ্টিকুমড়া ভর্তা, অন্যকোণায় চিংড়ি পুঁইশাকের তরকারী। স্বল্প আলোয় এগুলোই শুধু দেখা গেল। ভালবাসাটাই চোখে দেখা গেলনা। ফারুকের চোখে জল এলো। সে মুখ মোছার ছলনা করে চোখ মুছলো।
রমজান আলী মোজাম্মেলকে মৃদু বকুনি দিল,"একটা ডিম ভাইজাও তো আনতে পারতি। এইটুক তরকারী দিয়া কি ভাত খাওন যায়?"
মোজাম্মেলের মুখ আরো কাঁচুমাঁচু হয়ে যায়।"ডিম একটাও নাই রমজান ভাই। কাছে ধারে একটা দোকান খোলা থাকলেও দৌড় দিয়া নিয়া আসতে পারতাম। তাও সব বন্ধ হইয়া গেছে।"
রমজান আলী একটা চেয়ার হাতে নিয়ে বললো,"সার, এইহানে আপনের গরম লাগবে। আসেন, বাইরে আসেন। আমি দোকানের সামনের বাতিডা জ্বালাইয়া দিতাছি।"
ফারুক উঠে দাড়ালো। মোজাম্মেলও সাথে সাথে আসছিল। রমজান আলী তাকে আবারও মৃদু ধমক লাগালো,"তুই আবার কই যাস? যা -চুপ কইরা ঘুমা। কাইল সক্কালে আবার উঠতে হইবো না?"
রেস্টুরেন্টের সামনে চেয়ার পেতে ফারুক বসলো। রমজান আলী বসলো পাশের পানের দোকানের ছোট্ট বেঞ্চিতে। ভিতরের স্বল্প আলো থেকে বেরিয়ে উজ্জ্বল আলো ফারুকের চোখে লাগছিল। সে বললো,"আলোটা বরঞ্চ বন্ধ করে দাও রমজান মিয়া। চোখে লাগছে।"
লাইট নিভিয়ে রমজান আলী ভিতরে চলে গেল।
রাস্তার লাইটপোস্টের এক চিলতে আলো এসে পড়ছে ফারুকের হাতে। মঞ্চের কোন এক দক্ষ আলোকসম্পাত কারিগরের অদৃশ্য হাতের কারসাজি যেন। গভীর রাতের ঢাকা শহরের নির্জনতার মধ্যে ফারুক খেতে বসলো।
এতক্ষন তার কোন খিদে ছিলনা। এখন খাবার দেখে হঠাত্ করে মনে হচ্ছে যেন সে পুরো পৃথিবীটাই খেয়ে ফেলতে পারবে। হোটেলের প্রধান কুক বদির রান্না সাধারণতঃ বেশ ভালই হয়। আজকে খিদে পেটে মনে হচ্ছে যেন অমৃত। সে রাজা-বাদশা হলে গলা থেকে মুক্তোর মালা খুলে উপহার দিত বদিকে।

রমজান আলী ফিরে এলো। তার হাতে কি যেন একটা রয়েছে। সেটা সে নীচে নামিয়ে রাখলো। অন্ধকার বলে বোঝা গেলনা। ফারুকের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে চুপচাপ বসে থাকলো। রাস্তার উপরেই গ্লাসের পানি দিয়ে হাত ধুলো ফারুক। পকেট থেকে রুমাল বার করে হাত মুছতে মুছতে সে বললো,"খাবারটা খেয়ে খুব আনন্দ পেলাম, রমজান মিয়া। বদিকে কাল এসে আমি বলে যাবো।"
রমজান আলী আবছা হাসলো।"ঠিক আছে সার। বদি তাইলে খুবই খুশী হইবো।"
"এবার তাহলে কাজের কথাটা বলি, রমজান মিয়া। আমি--"
রমজান আলী কথাটা শেষ করতে দিলনা।"একটু বসেন সার। খাওয়ার পর একটু চুপ কইরা বইসা থাকা শরীরের জইন্য ভাল।"

ফারুক চেয়ার টেনে বসলো। রমজান আলী একটা বিড়ি ধরায়। অন্ধকারের মধ্যে শুধু আগুনটি জ্বলে জ্বলে ওঠে।

অকস্মাত্ দূরে একটি কুকুর করুন স্বরে কেঁদে ওঠে। ফারুক চমকে যায়। সুনসান নির্জনতার মধ্যে কান্নার শব্দটি বেদনা ছড়িয়ে দেয়। এই মুহুর্তে কত মানুষ দুঃখ বুকে নিয়ে বেঁচে আছে?

রমজান আলী হঠাত্ কথা বলে,"একটা কথা জিগাই সার? ছোটমুখে বড় কথা। বেয়াদবী নিয়েন না।"
"বলো।"
"আপনে কি আইজ অনেক বেশী দুঃখ পাইছেন?"
ফারুক চমকে ওঠে। "একথা কেন জিজ্ঞেস করলে রমজান মিয়া?"
রমজান আলী সে প্রশ্নের জবাব দেয়না। সে আনমনা ভাবে বলে,"মানুষের জীবনডা বড় কষ্টের সার। গহীন রাইতে দুঃখী মানুষ ছাড়া আর কেউ জাইগা থাকেনা। ছেলেবেলায় বাপজানের হাত ধইরা মেলায় যাইতাম। সেহানে শুকুর আলী বয়াতীর গান শুনছিলাম একবার। সেই গান শুনলে সীমারের চোক্ষেও পানি আসে। তখন গানের কথা ভালো বুঝি নাই, শুধু গানের সুর শুইনাই সারা রাইত কাঁদছি। কষ্টে ঘুম আসে নাই। যেদিন আমার বৌডা যেদিন আর একজনের সাথে সংসার ছাইড়া চইলা গেল, সেই রাইতেও আমার ঘুম আসে নাই।"
"তোমার কথাটা শুনে খারাপ লাগছে রমজান মিয়া। এটা আমি জানতাম না।"
"এর মইধ্যে ভাল খারাপের কিছু নাই সার। যার যাওনের কথা, সেতো যাইবই। কষ্টডাই আসল, বাকি সব ফাঁকি। কান্দনটুক না থাকলে বাঁইচা থাকতাম কেমনে?"
ফারুক চুপ করে কথা শোনে।
"সার, পুরুষ মানুষের কান্দন মানুষেরে দেখাইতে নাই। পুরুষ মানুষ কান্দে মইধ্য রাতের পর। যখন কেউ জাইগা নাই, আছে শুধু আসমানের চান্দ-তারা, আর আছে পায়ের তলার মাটি। মরণের পর মানুষের একভাগ উইড়া যায় সাত আসমানে, আরেকভাগ মাটির সাথে মিশা যায়। এই দুইজনে হইলো পুরুষের কষ্টের সাক্ষী।"
ফারুক একটা সিগারেট ধরায়। "তুমি ঠিকই ধরেছো রমজান মিয়া। আজকে আমার মন ভাল নেই। চুপচাপ ঘরে শুয়েছিলাম অনেকক্ষন। তারপর আর ভাল লাগছিল না বলে তোমার এখানে এলাম। সেদিন তুমি একটা গান বাজিয়ে ছিলে। হঠাত্ করে কেন জানি সেই গানটা শুনতে বড় ইচ্ছে হোল।"

হাত বাড়িয়ে নিঃশব্দে পিছন থেকে রমজান আলী কি যেন একটা নিয়ে আসে। তার হাতে ছোট্ট ক্যাসেট প্লেয়ারটা দেখে ফারুক অবাক হোলনা। যেন সে জানতো যে এমনটিই হবে।

রাতের বাতাস বনশ্রী সেনগুপ্তের গানের করুন সুরে ভারী হয়ে আসে।
"যা তুমি নিজের হাতে ভাংলে, সেতো আর লাগবে নাকো জোড়া
যে ফুল ভাসিয়ে দিলে জলে, সে ফুলে বাঁধবে কে আর তোড়া।"

ফারুক মাথা নীচু করে বসে থাকে। যে জীবনটির স্বপ্ন সে দেখেছিল, সে স্বপ্নটি আজ আর নেই। সদ্য ঘুমভাঙ্গা মানুষের মত উদভ্রান্ত চোখে সে কোনকিছু ঠাহর পায়না। হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে সিগারেটটি নিঃশব্দে পুড়তে থাকে।

রমজান আলীর চোখে অশ্রু চিকচিক করে। তার হঠাত্ বুক ভেঙ্গে কান্না পায়।

গহীন রাইতে দুঃখী মানুষ ছাড়া আর কেউ জাইগা থাকেনা।

(গল্পটি একট‌ি পত্রিকায় আগে ছাপা হয়েছিল। -নির্বাসিত)


মন্তব্য

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

অসাধারণ ... খুব ভাল লাগছে ...

অতিথি লেখক এর ছবি

গোটা লেখাটি পড়ার মত ধৈর্য্যকে সালাম। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

কনফুসিয়াস এর ছবি

দারুন লেগেছে পড়ে।
মিরি-কে পছন্দ হয় নি, ভালোবাসা ব্যপারটায় সাহসী হবার একটা গোপন শর্ত জুড়ে দেয়া থাকে। মিরি একেবারেই ভীতু।
ফারুকের জন্যে খারাপ লাগছে। তবে এমন সুন্দর মনের একটা মানুষ, হয়তো শেষমেষ ভালই থাকবে।

-----------------------------------
যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

পুরুজিত এর ছবি

আজকে আমি বারবার তোমাকেই দেখছি। আমি সবসময়েই ভাবতাম যে আমি খুব ভাল মানুষ চিনতে পারি। আজকে অত্যন্ত দুঃখের সাথে বুঝতে পারলাম যে সেটা কত বড় ভুল ধারণা। তুমি আজকে একটা খুব বড় একটা সত্যি কথা বলেছো। একটা মানুষ চিনতে সারা জীবন কেটে যায়। অতিচেনা মানুষের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে হীরের ঝলকানি, লুকিয়ে থাকে পাতালের অন্ধকার।

কথোপকথন গুলো একটু অবাস্তব, তবে লিখতে লিখতে আরো ভালো হবে। শুভ কামনা রইলো।

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

আমার মতে মিরা ফারুককে ভালো আদৌ বাসে নি। বড়জোড় পছন্দ করেছে - অনেকটা দূরের নক্ষত্রের মতোই।

অসাধারণ লেখা। ধৈর্যটা লেখাই জোগায়, ভূতে না!

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনাদের মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আসলে আমি এই গল্পটিতে দু'জন ব্যথিত মানুষের একটি বিন্দুতে এক হয়ে যাওয়াটা দেখাতে চেয়েছিলাম (তাতে সফল যে হয়নি তা বোঝাই যাচ্ছে)।
মিরির চরিত্র বা সিদ্ধান্ত এখানে গৌণ।

-নির্বাসিত

আরাশি এর ছবি

উদ্ধৃতি-
"যার যাওনের কথা, সেতো যাইবই। কষ্টডাই আসল, বাকি সব ফাঁকি। কান্দনটুক না থাকলে বাঁইচা থাকতাম কেমনে?"

যার যাওয়ার কথা সে যাবেই, এই কথাটুকুই সবচে' বড় সত্য মনে হয়। বাস্তবতার সাথে যে তাল মেলাতে পারেনা, যে থাকবার নয়, যাওয়াই উচিত তার ।

অতিথি লেখক এর ছবি

অলৌকিক হাসান-- আপনার সাপোর্টের জন্য ধন্যবাদ।
হয়তো কোন একদিন সচলতা পাবো আমিও।

-নির্বাসিত

সাইফ তাহসিন এর ছবি

লেখার প্রথম অর্ধেক পড়েই বুঝেছিলাম, এর পরিণতি ভালো দিকে যাবে না, তবে শেষটা খুব করুণ হয়েছে, কোন এক অদৃশ্য তার ছুয়ে যায়
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।