কম্প্রোমাইজ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ৩১/১০/২০০৮ - ৩:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অনেক দূর হেঁটেও শেষ পর্যন্ত কোন রিক্সা পেলেন না রতন সাহেব। অগত্যা বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত হেঁটে যাওয়াই স্থির করলেন। এটা নতুন কিছু না, প্রায়ই তাকে এটা করতে হয়। অফিস টাইমে এই কষ্টটা স্বাভাবিক। আর রিক্সা ভাড়াটা বেঁচে যাওয়া তার জন্য লাভজনক। অর্ধেক পথ এসে যদিও “চ্যাম্পিয়ন” নামে কিছু ছোট সাইজের যানবাহন পাওয়া যায়, কিন্তু অফিস টাইমের লম্বা লাইনের কারণে ওটাতে উঠে টাকা বাঁচানোর কথা ভাবা দুরাশা মাত্র। তবে তারপরও হাঁটার কষ্টটা সহ্য করা যায় যদি না আজকের মত কোন ঘটনা ঘটে।

এম্নিতেই রাস্তা খারাপ। তার উপর বর্ষাকাল শুরু হয়েছে। রাস্তার বিভিন্ন গর্তে পানি জমে হাঁটাই দুস্কর। তার উপর যদি পাগলা ঘোড়ার মত চ্যাম্পিয়নেরা টগবগিয়ে চলে, তাহলে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। তবে রতন সাহেবের ক্ষেত্রে যা ঘটল তা খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা। কাঁদা ছিটকে তার পালিশ না করা সু আর হাটু পর্যন্ত প্যান্ট ভরে গেল। হাতে ধরা অফিসের ব্যাগটাতেও খানিকটা লেগেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমটায় থমকে গেলেও দ্রুত সামলে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলেন তিনি। মনকে প্রবোধ দিলেন নানা কথা দিয়ে। এখন এসব ভাবার সময়ও নেই। দ্রুত বাস ধরতে হবে।

বাস স্ট্যান্ড এ যথারীতি অফিস টাইমের ভীড়। দু-চারবার বিফল হওয়ার পর একটাতে কোনরকমে উঠে পরলেন রতন সাহেব। বাসে প্রচন্ড ভীড়। দরজার কাছে নিজের শরীরটাকে যথাসম্ভব সংকুচিত করে দাঁড়িয়ে রইলেন। একটা স্টপেজে এসে বাস থামল। যাত্রীদের নেমে যাওয়ার সুবিধা করে দিতে একটু বেগ পেতে হল তাকে। বাসের দরজার ঠিক পাশের জানালার কাছে সরে দাঁড়ালেন। এমন সময় সবচেয়ে অনাকাঙ্খিত ঘটনাটা ঘটল।

এক মূহুর্তের জন্য একটু অন্যমনস্ক ছিলেন হয়তো। জানালার ধারে রাখা হাতটাতে হঠাৎ টান খেয়ে সম্বিৎ ফিরল তার। কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখেন হাতঘড়িটা হাওয়া! “আরে, আমার ঘড়ি?” - বলে একটা অস্ফুট আওয়াজ বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে। ততক্ষণে বাস কিন্তু ছেড়ে দিয়েছে। কাল্প্রিটটা দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। হেল্পারের দিকে চাওয়াতে সে বেশ নিরীহ একটা মুখ করল। রতন সাহেব কিছুক্ষণ বোকার মত তাঁকিয়ে থাকলেন তার দিকে। কে একজন পাশ থেকে বেশ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “মিয়া, এসব বাসে একটু খেয়াল করে চলতে হয়, হেহ।”

মন-মেজাজ খারাপ করে অফিসে ঢুকতেই সগীর ভাই বলল, “এম.ডি. স্যার আপনারে সালাম দিসেন।” ব্যাগটা রেখে সংকিত চিত্তে এম.ডি. এর রুমের দিকে পা বাড়ালেন রতন সাহেব।

“এই যে, মি. রতন। কি ব্যাপার, এত লেট করে আসেন কেন? অফিসের তো কিছু নিয়ম-কানুন আছে, নাকি? এত ইরেস্পন্সিবল হলে তো আপনাকে আর রাখা যাবে না। নেক্সট টাইম কিন্তূ বেতন থেকে কাটা হবে। যান, কাজ করেন গিয়ে যান।”
আমতা আমতা করে বাসার দুরত্ব আর যাতায়াতের প্রব্লেমের কথা বলতে গিয়েও বলা হল না। কোনরকমে বেরিয়ে এসে যেন হাঁফ ছেড়ে বাচঁলেন। হাজার হোক, বেসরকারী কোম্পানীর চাকরি। আসতে সময় লাগলেও যেতে একদমই সময় লাগে না। সুতরাং যথাসম্ভব সহ্য করে চলতেই হবে।

নিজের ডেস্কে বসে কাগজ-পত্র ঠিক-ঠাক করতে গিয়ে হাতঘড়িটার কথা মনে পড়ল। বিয়ের সময় খুব শখ করে শ্বাশুরী এটা দিয়েছিল। দাম হয়তো খুব বেশী না। কিন্তু অনেক সময় দামের চেয়ে স্মৃতির মূল্য বেশী হয়ে যায়। যাক,কি আর করা যাবে। হাতঘড়িটাই তো শুধু গেছে, পকেটের মোবাইলটাও তো যেতে পারত। মনে মনে স্বান্তনা খোঁজেন।
আজকে অবশ্য এম.ডি. একটু আগে-ভাগেই চলে এসেছে। তানাহলে তাকে এই অনর্থক কথা শুনতে হত না। এম.ডি.-র মত দুয়েকটা গাড়ি থাকলে অবশ্য তার কখনোই দেরি হত না। ব্যাটা মাঝে মধ্যে তো লাঞ্চ এর পরে আসে- রতন সাহেবের মেজাজ আবার খারাপ হতে থাকে।

দুপুরের দিকে লাঞ্চ করতে যথারীতি হোটেল “বাংলা ক্যাফে”-তে আসতে হল। অফিসে কাটারিং সার্ভিস থাকলেও খরচ বাঁচাতে উনি বাইরেই খান। রুই মাছ দিয়ে মোটামুটি কম খরচেই খাওয়া যায়। প্রতিদিনকার মত তরকারীর বাটিটা থেকে এক্সট্রা ঝোল ঢালতে গিয়ে কালোমত একটা বস্তু চোখে পড়ল তার। দু-আঙুল দিয়ে তুলে বুঝলেন একটা মরা পোকা। তেলাপোকার বাচ্চাও হতে পারে। খাওয়া তখন তার শেষের দিকে। একটা বমি বমি ভাব চলে আসল। খাওয়া সে অবস্থায় রেখেই উঠে পড়লেন। ঝগড়া করা তার স্বভাব না। অনর্থক কথা না বলাই শ্রেয় মনে করলেন। নতুন হোটেল খুজতে হবে, বিল দিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে মনে মনে ভাবলেন।

লাঞ্চ থেকে ফিরতেই সগীর ভাই বলল, গেস্ট আছে। গিয়ে দেখেন তার চাচাতো ভাই ফরিদ। দেশের বাড়ি থেকে এসেছে। বলল তার ছোট মেয়ের নাকি টাইফয়েড, হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। রতন সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, চল, দেখে আসি।
পকেটে পাঁচশ ছিল, সেখান থেকে তিনশ টাকা ফরিদের হাতে দিয়ে রতন সাহেব যখন বাসার দিকে রওনা দিয়েছেন, সূর্য তার অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। অফিস থেকে অর্ধ-দিবস ছুটি নিতে হয়েছে এজন্য তাকে। আবার সেই তিন পরতের জার্নি করে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হল।

বাসায় ঢুকতেই তার স্ত্রী অফিসের ব্যাগটা রাখতে রাখতে বলল, বড় মেয়ের কোচিং এর জন্য টাকা লাগবে। হাতঘড়িটার কথা আর বললেন না স্ত্রীকে। হাত-মুখ ধুয়ে চিন্তিত মুখে খেতে বসলেন। ছোট ছেলেটা নাকি এখনো খায়নি। বায়না ধরেছে সাইকেল কিনে দিতে হবে। পাশের বাড়ির মন্টুকে নাকি তার বাবা কিনে দিয়েছে। অতএব তারও সাইকেল চাই।
সম্ভব-অসম্ভব অনেক প্রতিজ্ঞা করতে হল ছেলেটাকে খাওয়াতে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রতন সাহেব আরাম করে একটু বসলেন ড্রয়িং রুমে। তখনি দরজায় টোকা।

আজকে মাসের বার তারিখ। বাড়িওয়ালা এসেছে ভাড়া চাইতে।
“ভাই সাহেব, বেতনের টাকাটা এখনো পাইনি। পেলেই আপনাকে দিয়ে আসব”, রতন সাহেব কাচুমাচু করলেন।
“প্রতি মাসেই তো দেখি আপনি একই কথা বলেন। থাকতে যদি না চান তো বাসা ছেড়ে দিন। জিনিসপত্রের এখন যা দাম। আপনাকে তো আমি অনেক কম ভাড়ায় থাকতে দিয়েছি। নেক্সট মাস থেকে ভাড়া পাঁচশ টাকা বাড়িয়ে দেবেন বুঝলেন, নাহলে ছেড়ে দিন।”

বাড়িওয়ালা চলে গেলে রতন সাহেব গম্ভীর মুখে দরজা লাগালেন। পেছন থেকে কে যেন তার কাঁধে হাত রাখল। তাঁকিয়ে দেখেন তার স্ত্রী মিলি। এতক্ষণ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিল। হঠাৎ মিলির হাতের দিকে চোখ পড়ল তার। একটাও চুরি নেই। পরনের কাপড়টাও অনেক পুরনো হয়ে গেছে।
রতন সাহেব মিলির মুখের দিকে তাঁকালেন। সাদামাটা চেহারায় কোন রাগ নেই, অভিমান নেই। মায়াভরা চোখ দুটো যেন শুধু বলতে চাইছে, আমি তোমার পাশে আছি।

রতন সাহেবের মনটা ভাল হয়ে গেল হঠাৎ। অন্তত একটা ব্যাপারে তাকে কম্প্রোমাইজ করতে হয়নি।

মিলির মত স্ত্রী কজনের ভাগ্যে জোটে?

-
নিবন্ধন নামঃ বনফুল


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

লেখকের ব্লগে পূর্ব প্রকাশিত
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

রাফি এর ছবি

ভাল....

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

মাহবুব লীলেন এর ছবি

প্রথম পড়লাম আপনার লেখা
অভিনন্দন

০২

বাংলা সাহিত্যে বনফুল একটা প্রতিষ্ঠিত নাম
অন্য কোনো নিক নেয়া যায় কি না একটু ভেবে দেখবেন

অতিথি লেখক [বনফুল] এর ছবি

বনফুল আমার প্রিয় লেখক। এজন্য নামটি নেয়া।
তবু আপনার কথা ভাবলাম এবং নিকটি ফিরিয়ে নিচ্ছি।
ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।