হাসিনার বদল, খালেদা অটল!

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ০১/০১/২০০৯ - ৯:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মোস্তফা মামুন: ক্রীড়া লেখক

প্রশ্ন : আপনার বন্ধু কারা?
সম্ভাব্য উত্তর : গণতন্ত্র এবং অসামপ্রদায়িক শক্তিসহ আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতা-কর্মী যারা বিগত সরকারের সময় নানা অত্যাচার সহ্য করেও আমার এবং আমাদের পক্ষে ছিলেন…
বাস্তব উত্তর : এই বাংলাদেশের জনগণ।
প্রশ্ন : আর আপনার শত্রু?
সম্ভাব্য উত্তর : গত জোট সরকারের সময় যারা দুঃশাসন চালিয়ে দেশ ও জনগণকে জিম্মি করে রেখেছিল। এই দেশের যাবতীয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি…
বাস্তব উত্তর : এই দেশের দারিদ্র্য।

বুধবার সকালে চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে এভাবেই বাস্তবতা দিয়ে পুরনো ঘরানাকে একের পর এক দুমড়ে মুচড়ে দিলেন শেখ হাসিনা। জানালেন, পরিবর্তনের যে স্বপ্ন তিনি বা তার দল নির্বাচনের আগে দেখিয়েছিল বড় জয়ের ঘোর তা থেকে তাকে এখনও বিচ্যূত করেনি। আর এই প্রথমবারের মতো শেখ হাসিনার ভেতরের যে মানুষ তা তার আটপৌরে সৌন্দর্যের সবটা নিয়ে প্রকাশিত হলো। এত বড় জয়, এত বিশাল আশার প্রতীক তিনি, তাই সংবাদ সম্মেলন মোটামুটি জনসমাবেশ। শুধু বাংলাদেশী সাংবাদিকরা হলে স’তিই চলত শুধু, তার কিছু ইঙ্গিত দুয়েকজন দিয়েও দিলেন, কিন্তু পোড় খাওয়া বিদেশীরা তো আর আপ্লুত নন। পেশাগত জায়গা থেকে জটিল আর কঠিন প্রশ্ন এল। শেখ হাসিনা যেভাবে সামলালেন ক্রিকেটের ভাষায় তাকে বলে বাউন্সারে হুক করে ছয় মারা। মোটের ওপর আমাদের চেনা নেতাদের চেহারা ঝেড়ে ফেলে শেখ হাসিনা যেন এই এক ঘণ্টায় একের পর হাইজাম্পে উঁচু থেকে উঁচুতে উঠতে লাগলেন আর অনুচ্চারে শুনিয়ে দিলেন দিনবদলের গান। কিছু বেসুরো ব্যাপার অবশ্য তবু থাকল। কিছু কিছু জায়গায় হাওয়াই বক্তব্যের পুরনো ছায়া এবং ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। আর কর্মীদের কারণে-অকারণে হাততালি, যে হাততালি বছরের পর বছর আমাদের নেতা-নেত্রীদের ভুল বিশ্বাস জুগিয়েছে। আত্মপ্রসাদ ঠেলে দিয়েছে আত্মাহুতির দিকে।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা একটা পর্দার ভেতরেই থাকেন। সেই আড়ালের মানুষটা কেমন সেটা আর কেউ দেখতে পায় না। আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ট এবং সেই সূত্রে শেখ হাসিনা পর্যন- যাওয়া কিছু লোকের অভিজ্ঞতা থেকে জানি ব্যক্তিগত জীবনে শেখ হাসিনা ভীষণ আটপৌরে। একান্ত ঘরোয়া; আমাদের মা-খালা বা বড় বোনরা যেমন হয়ে থাকেন। তিনি নিজ হাতে রান্না করেন, অতিথিদের পরিবেশন করে খাওয়াতে ভালোবাসেন, বঙ্গবন্ধুর রক্তের ধারা ধরে রেখে পরিচিতদের খুব মনে রাখতে পারেন। কিন্তু মনে করতে পারছি না যে কোনো প্রকাশ্য জায়গায় তার এই অবয়বের ছিটে-ফোঁটা দেখা গেছে। মেঠো রাজনীতিতে তিনি চিরন্তন বাংলাদেশের নেত্রী; যিনি গৎবাধা রাজনৈতিক বক্তৃতা দেন, বিপক্ষকে যত্রতত্র হুংকার দিয়ে চলেন অবিরাম এবং অতিরিক্ত বলতে গিয়ে প্রতিপক্ষের হাতে তুলে দেন রাজনৈতিক অস্ত্র । জয়জনিত অন্তর্গত উল্লাস যেন কাল পর্দা ছিড়ে ভেতরের মানুষটাকে টেনে নিয়ে এল। সংবাদ সম্মেলনে ‘ভাই তুমি একটু চুপ করো তো!’ ‘মুরুব্বীকে বলতে দাও’ ‘… ভাই আপনি বলুন’ এই ঘরোয়া এবং আন্তরিক চেহারা নিয়ে এ যেন এক অন্য শেখ হাসিনা। যে বদলানোর স্বপ্ন সত্য করতে গিয়ে আগে নিজেকেই বদলাতে চাইছে। এই শেখ হাসিনাকে তো মানুষের পছন্দ হওয়ারই কথা, যেমন মানুষ পছন্দ করেছে পর্দাহীন সত্যিকারের আওয়ামী লীগকে। ১৯৯৬তেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়েছিল, কিন্তু সেই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার জন্য চরিত্র হারাতে হয়েছিল। শেখ হাসিনাকে হাতে তসবিহ নিয়ে জানাতে হয়েছিল যে তারা ক্ষমতায় গেলে ধার্মিকদের কোনো সমস্যা হবে না। ‘‘অতীত ভুল-ত্রুটির ক্ষমা চাই। নৌকায় ভোট চাই’’- এই ছিল নির্বাচনী স্লোগান। এবং ২২ জানুয়ারির নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ সেই কৌশলেই এগোচ্ছিল। কিন্তু ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন করেছে সত্যিকারের আওয়ামী লীগ। মৌলবাদীদের সঙ্গে যাদের কৌশলগত কোনো ঐক্য নেই, যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে অকপট, যারা অর্থনৈতিক উন্নতির বিষয়ে অনেক সুনির্দিষ্ট, ব্যাপকহারে নারীদের মনোনয়ন দিয়ে ও নারীনীতির পক্ষে থেকে নারী স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখায় এবং পুরনো আমলের চর্বিতচর্বনের বাইরে এসে যাদের মুখে তারুণ্যের গান। মানুষ তো এসবের পক্ষেই রায় দিয়েছে। কাজেই এবার আর রাজনীতির সুযোগ নেই। এবার কাজ। আওয়ামী লীগের কাজ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক-আধুনিক দেশ আর অর্থনৈতিক মুক্তির কাজ।

এক বন্ধু প্রায়ই রসিকতা করে বলে, বাংলাদেশে আসলে নির্বাচনের কোনো দরকারই নেই।
কেন?
৫ বছর এই দলকে এবং ৫ বছর ঐ দলকে দিয়ে দিলেই তো হয়! এটা নিয়ম থাকলে বিরোধী দল আর হরতাল-অবরোধ করবে না। সরকারী দলও নির্বাচনে জেতার জন্য অতিরিক্ত রাজনীতি করবে না! বিরোধী দলকে দমন-পীড়ন করবে না। দলীয়করণ হবে না।
কথাটা হাস্যকর, কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় বিশ্লেষণের দাবী রাখে কিন্তু। গত চার নির্বাচনেই তো মানুষ সরকার বদলেছে। এর ক্ষতিকারক দিক আছে, ভারতের কেরালা রাজ্যে একসময় মানুষ ভালো-মন্দ সব সরকারকে নির্বিচারে বদলে ফেলত বলে সরকারগুলো ভালো কাজ করাই প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল। যাই হোক, নির্বাচনের পর আবার সেই বন্ধুর ফোন পেলাম। এবং সে মনে করে এবারের ফলে তার মতামত আরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশে নিকট অতীতে সরকারী দল কখনও ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবে না। কাজেই তার দেখিয়ে দেয়া পথে সমঝোতা করে ফেলাই ভালো! ঠিক যে বাংলাদেশে সরকারবিরোধী মানসিকতা প্রবল, মানুষ দরিদ্র এবং সমস্যাগ্রস’ বলে সবকিছুতেই সরকারের দোষ খুঁজে পায় এবং সরকারগুলো এমন কাজ করে রাখে যে পরের বার ভোট চাইতে গিয়ে আগে দিতে হয় কৈফিয়ত। কেন ওটা হলো না, ঐ কাজটা কেন করেছিলে! তাহলে কি সত্যিই এক সরকার দুইবার থাকতে পারবে না। কঠিন, কিন্তু সম্ভব। সম্ভব সেদিন যেদিন কোনো একটা সরকার ক্ষমতায় এসে পরের নির্বাচন জেতার কথা ভাববে না। যে সরকার এই ভাবনাটা বাদ দেবে তারাই ফিরে আসবে।

আমাদের সরকারগুলো ক্ষমতায় এসে প্রথম দিন থেকেই ভোট কমানো শুরু করে। প্রথম কাজ হলো নির্বাচনে হেরে যাওয়াদের উপর অত্যাচার। তাতে কিছু লোকের জিঘাংসা চরিতার্থ হয় হয়ত, কিন্তু ভোটটা এক দফা কমে। দ্বিতীয় কাজ দলীয়করণ, এজন্য যে এরা পরে ভোটের সময় তাদের সাহায্য করবে। এবারের শিক্ষায় আমরা জানলাম তারা পারে না, কিন্তু এই চেষ্টাটা ভোট কমায়। তৃতীয় কাজ মাস্তান পোষা, তাতে এলাকায় শক্তি প্রতিষ্ঠা করে পরের নির্বাচনে সেটাকে কাজে লাগানো যায়। এবারের শিক্ষা হলো তারা পারে না, কিন্তু তাদের পোষার জন্য যে ভাবমূর্তির ক্ষতি হয় তারও প্রভাব পড়ে ভোটের বাক্সে। কোনোটাতে লাভ হয় না, কিন্তু প্রতিটাতে ক্ষতি হয়। লাভ হয় সেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রেখে সাধারণ-অতি সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করলে (আওয়ামী লীগ ৯৬-২০০১ এর কৃতিত্বের ফল পেল ২০০৮-এ)। লাভ হয় কাউকে বিপক্ষ বানিয়ে তলোয়ার না চালিয়ে ভবিষ্যতের কথা বললে (আওয়ামী লীগ যেটা তুলনামূলক কম করেছে এবং বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে)। লাভ হয় রাজনীতির কথা কম বলে অর্থনীতিকে আগে রাখলে। এসবের পক্ষে ভোটাররা নিরঙ্কুশ রায় দিয়ে জানিয়ে দিল তারা বদলে গেছে। শেখ হাসিনা ইঙ্গিত দিলেন তিনিও বদলাতে চাইছেন।

একজন কিন্তু এখনও বদলাচ্ছেন না। খালেদা জিয়া। নিজের আপোষহীন চরিত্রে অটল থেকে তার গলায় ‘নজীরবিহীন কারচুপি’ ‘নীলনক্সার নির্বাচন’-এর সেই পুরনো রেকর্ড। এমনভাবে হেরে গেলে সেটা মেনে নেয়া কঠিন, হয়ত এসবই তাৎক্ষনিক হতাশাজনিত প্রতিক্রিয়া, সময়ে তারাও বদলের হাওয়াটা টের পেয়ে যাবেন। কারণ বিরোধী দলকেও এখন বদলাতে হবে। এতদিন তাদের তেমন কিছু করতে হয়নি, সরকারই ভুল করে করে তাদের জিতিয়েছে, কিন’ এবার তো সরকারের মধ্যে বদলের আভাস। সরকারী দল যদি বদলে যায় আর বিরোধী দল পুরনো থেকে যায় তাহলে ৫ বছরের হিসাবও গোলমাল হয়ে যাবে।

খালেদা জিয়া আর বিএনপিকে বুঝতে হবে এখন তারা যত প্যাঁচাবেন ততই পেছাবেন।


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

প্রিয় মোস্তফা মামুন, আপনি কি সচলে নিবন্ধন করেছেন? যদি না করে থাকেন, অনুগ্রহ করে নিবন্ধন করে নিন। ধন্যবাদ।


হাঁটুপানির জলদস্যু

রণদীপম বসু এর ছবি

চমৎকার পোস্ট দিলেন ভাই। সচলাতয়নে আপনাকে স্বাগত জানাতে অপেক্ষায় রইলাম... চলুক

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

অমিত আহমেদ এর ছবি

হাসিনা আসলেই বদলেছেন কিনা তা বোঝা যাবে আগামী কয়দিন তিনি ছাত্রলীগের হিরোদেরকে কিভাবে সামলান তা দেখে।

লেখার বক্তব্যের সাথে একমত।

সচলায়তনে স্বাগতম।


ওয়েবসাইট | ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল

অনিন্দিতা চৌধুরী এর ছবি

আপনার বিশ্লেষণটা খুব ভাল লাগল।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।