বিন্ধ্যসুন্দর

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৬/০৪/২০০৯ - ১:৩৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চুনার থেকে আমরা রওনা দিয়েছি বিন্ধ্যাচলের দিকে । বারাণসী থেকে চুনার প্রায় ৪০ কিলোমিটার আর বিন্ধ্যাচল প্রায় ৬০ কিলোমিটারের ওপর । ২ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে সোজা যাওয়া যায় । বিন্ধ্যাচলে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলে হাতে সারাটা দিন রাখুন । আর হাতব্যাগে রাখুন খাবার দাবার । অনেকটা পথ । মাঝখানে খাওয়ার খুব একটা সুবিধে নেই । এই জাতীয় সড়ক ধরে লম্বা পথের সাথী সেই চিরপরিচিত গঙ্গা আর রেললাইন । তবে চুনার আর বিন্ধ্যাচলের মধ্যে একটা তফাত হচ্ছে আপনি বিন্ধ্যাচলের দিকে যত এগোবেন তত লোকালয় কমতে থাকবে । যারা গাড়ি চালাতে ভালোবাসেন তাদের জন্য এই রাস্তা স্বপ্নময় । আমরা শীতকালে গেছিলাম তাই রাস্তার পাশে সবুজের সমারোহ খুব একটা পাইনি , তবে ঠিক সময়ে গেলে পাবেন দুপাশে সবুজের কার্পেট আর মুখে ভিজে হাওয়ার হাতছানি । মাঝে মাঝে আপনার গাড়ির গতিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সমান্তরাল ভাবে ছুটে যাবে ট্রেন । যৌবন এ পথের বাঁকে বাঁকে । গরমেও কষ্ট নেই , প্রচুর গাছ দুপাশে । শান্ত শীতল ছায়া । বিন্ধ্যাচলের রাস্তা ধ্রূপদী সঙ্গীত , প্রথমে এই পথে চলবে বিলম্বিত আলাপ , তারপর দিগন্তে যখন হাল্কা নীল রঙের বিন্ধ্যপর্বত স্বয়ং দেখা দেবেন তখন দ্রুত লয় । তখন রাস্তা প্রায় উলঙ্গ । রোদ পড়ে ঠিকরে বেরোচ্ছে । গরম হাওয়ার ভাপ লাগছে মুখে । প্রচণ্ড গরমে এসব জায়গায় না আসাই ভালো । উত্তরপ্রদেশের গরম নিয়ে না খেলাই উচিৎ। এখানে রাস্তার আর একটা মজা আছে , মসৃণ রাস্তা অথচ মাঝে মাঝে চড়াই উৎরাই আছে । খুব বড় বড় নয় , ড্রাইভারের পাশের সীটে বসে দেখবেন রাস্তা সোজা ঢালু হয়ে গেছে নীচের দিকে । বুঝবেন এতক্ষন উঁচুতে ছিলেন ।
বিন্ধ্যাচলের মূল আকর্ষণ বিন্ধ্যবাসিনীর মন্দির আর মা আনন্দময়ীর আশ্রম । প্রথমটি সমতলে আর দ্বিতীয়টি পাহাড়ের ওপর । বিন্ধ্যবাসিনীর মন্দির বিখ্যাত জায়গা । এর সংলগ্ন গলি অবিকল কাশী বিশ্বনাথের গলির মতো । তবে একটু ঊঁচুনীচু জমি , আর লাল রঙের কাপড়ের উপস্থিতি চোখে পড়ার মত। মন্দিরের চেহারাও একরকম । বড় বড় পাথরের থাম , কালো রঙ করা । মেঝে জলে জলময় , তাতে ভেসে বেড়াচ্ছে প্রচুর গাঁদাফুল । কালো রঙে সেই হলুদ কমলা বাহার দারুণ খুলেছে । অবিরত ঘন্টা বেজে চলেছে । একজনের বাজানোর অনুনাদ থামার আগেই আরেকজনের হাত পড়ছে তাতে । যেভাবে এই বিশ্বাস আর ভক্তি যুগযুগ ধরে এক পুরুষ থেকে আরেক প্রজন্মে চলে এসেছে । এমনিতেই সরু রাস্তা বলে আলো ঢোকে কম , কালো ঝুলের মত অন্ধকার জমে রয়েছে মন্দিরের সিলিঙে । এই রহস্য কিন্তু ভক্তিকে বেশ খানিকটা ভয়ের মিশেল খাইয়ে পোক্ত করে তোলে । সেটা ভালো না খারাপ সেই তর্কে আমি যাব না । তবে এখানে ঈশ্বর ভক্তের সাথে বেশ খানিকটা দূরত্ব বজায় রাখেন । সারনাথের জাপানী বৌদ্ধমন্দিরে কিন্তু মূর্তির সাথে নৈকট্য আমার অনেক স্বস্তিদায়ক লেগেছে । যতটুকু বুঝি তাতে মনে হয় এই নৈকট্য ধর্ম আচরণকে অনেক সহজ করে তোলে । অবশ্য এ আমার একান্ত ব্যক্তিগত মতামত ।
রোদ একটু পড়লে পাহাড়ে ওঠার চেষ্টা করাই ভালো । ন্যাড়া পাথরের পাহাড় , গরম রোদে আগুন হয়ে থাকে । পাহাড়ের একদম ওপরে দুটি বাড়ি , একটির কথা আগে বলেছি , মা আনন্দময়ীর আশ্রম । আরেকটি বাড়ি আছে যার কথা না বললেই নয় । সেটির নাম “মহেশ ভবন” । কলকাতার মহেশ ভট্টাচার্য্য হোমিওপ্যাথি ওষুধের ব্যবসা করেন অত্যন্ত সফলভাবে । বারাণসী এবং কলকাতায় এম ভট্টাচার্য্য এণ্ড কোম্পানীর ওষুধের দোকান হয়ত আপনাদের চোখে পড়েছে । এই ভদ্রলোক অত্যন্ত মহৎ ও দানশীল ছিলেন । স্ত্রীবিয়োগের পর বিন্ধ্যাচলের এই বাড়িটিতে তিনি আসতেন সাধন ভজন করার জন্য । শোনা যায় এই বাড়িটিতে মাটির নীচে একটি ঘর আছে যেখানে তিনি সাধনা করতেন । একটা কথা মনে রাখা দরকার , এটা যে সময়ের কথা সে সময় বিন্ধ্যাচলের পথ ছিল দূর্গম আর বিপদসঙ্কুল । এখনও এখানে ডাকাতের বেশ ভয় । খুনজখমও প্রায়ই হয় বলে শুনলাম । এই বাড়ির ছাদ থেকে তোলা একটি ছবি এখানে দিলাম । এখানে রাতে একা থাকার সাহস অন্তত আমার হত না যদিও আগের তুলনায় লোকসমাগম এখন অনেক বেশী । জায়গাটি ভারী সুন্দর । পেছনে পাহাড় , বড় বড় কালো পাথরে ভর্তি । “শিলাসন” বলা যায় । হাতে এক এক ভাঁড় চা আর জ্ঞাতিগুষ্ঠি নিয়ে আড্ডা মারার এমন জায়গা কলকাতাতেও নেই । সেসব পাথরের নানা রকম আকার । চোখ মেলে দেখেশুনে নিলেই মোষ , হাতি , মানুষ এসব দেখতে পাবেন । এই অংশে গাছপালা প্রায় নেই । তবে মা আনন্দময়ীর আশ্রমের পাশে বেশ কিছু গাছপালা রয়েছে । লোকশ্রুতি অনুযায়ী মা আনন্দময়ীও এখানে সাধনা করবার জন্যই এসেছিলেন । একটা ব্যাপার খুব অদ্ভুত লাগে , এই একই জায়গাতে খানিক দূরে পাহাড়ের নীচে বিন্ধ্যবাসিনীর মন্দিরে ধর্মসাধনার আরেক রূপ । সেখানে উপচারের আতিশয্য , এখানে নির্জনতার সহবাস । সেখানে দেবতা আঁধার ঘরে সোনার সিংহাসনে সোনার অলংকারে বন্দিনী , এখানে তিনি পথের ধুলোয় খেয়ালের ছবি আঁকেন । মোটকথা আপনি যে পথের পথিকই হোন না কেন , কোন না কোন পথ এখানে পাবেনই । পাহাড়ের একেবারে ধারে এসে দাঁড়ান । দুঃখী ভারতবর্ষ , সহজ ভারতবর্ষ আকাশের পটে আঁকা একখানি ছবির মত ফুটে উঠবে আপনার সামনে । ডানহাতে তাকিয়ে দেখুন , বিন্ধ্যপর্বত একখানি হাত বাড়িয়ে রয়েছে , দু চারটি মেয়ে পুরুষ পাথর ভাঙা কি কাঠ কাটার কাজ করছে । একেবারে বাঁহাতে আকাশ মিশেছে রেললাইনে , সেখান দিয়ে প্রায়ই ছুটে যায় লালরঙা মালগাড়ি । তার পাশে গঙ্গার কি অপূর্ব একখানি টান ! তাতে নীল আকাশের ছায়া এতদূর থেকেও আপনি দেখতে পাবেন । আর একদম সোজাসুজি তাকান , দেখবেন চারখানি রঙ , আসমানি নীল , সবুজ , ঘন সবুজ আর মেটে সবুজ । তার মাঝে ছোট ছোট পুকুর আর ঘরবাড়ি । দেখবেন বেখেয়ালি এক ধুলোভরা পথের বাঁক । ঘাসজমির কাছে ধমক খেয়ে সোজা হয়েছে সে । অনেক ওপর থেকে দেখছেন তো , বহুদূর অবধি অনায়াসে চোখে পড়বে আপনার । আর আমার দেশ চোখে আঙুল দিয়ে আপনাকে দেখিয়ে দেবে ধর্মের কাঠিন্য , সাধনার কৃচ্ছসাধন , সভ্যতার মহাকাশ ছোঁয়া অগ্রগতিকে হেলায় তুচ্ছ করে মেরুদণ্ড নুয়ে পড়া এক সাধারণ চাষী কেমন করে একবোঝা ফসল নিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যেতে ঘরে ফিরে আসে ।
আমরা যখন নেমে আসছি ছোট পাহাড়টি থেকে তখন সূর্যাস্তের সময় । বিন্ধ্যাচলের পাথর ভর্তি আদিম রুক্ষ সৌন্দর্যে তখন কমলা আলোর সিক্ত চুম্বন । বড় করুণ সে আলো ।

( পার্থসারথি মুখার্জী )


মন্তব্য

দিগন্ত এর ছবি

আপনি আরো কিছু ছবি দিলে আরো ভাল লাগত। জায়গাটায় যাইনি বলে লেখাটা পড়েও খুব ভাল লাগল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

নজমুল আলবাব এর ছবি

আপনার লেখাটা দারুণ। পড়েই মন ছুটতে চাইছে। সচল থাকুন। আরও লিখুন।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

সিরাত এর ছবি

আপনি লেখাটাকে আরো কিছু প্যারাগ্রাফে ভাগ করলে মনে হয় পড়তে আরো ভাল লাগবে। ভৌগোলিক বর্ননাগুলো আমার বেশি পছন্দ, আর ওখানকার জীবনযাত্রা, ওগুলি আরো একটু হাইলাইট করুন।

ধন্যবাদ, লিখতে থাকুন!

পার্থসারথি মুখার্জী এর ছবি

সুন্দর গঠনমূলক মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ । লেখাটা অন্য জায়গায় লিখে কপি-পেস্ট করেছি বলে প্যারাগ্রাফ ফরম্যাটিং টা উড়ে গেছে । আর ওখানকার জীবনযাত্রা একটু কাছ থেকে দেখার ভীষণ ইচ্ছে ছিল , সময়ের অভাবে সেটা হয়নি । আপনার মন্তব্যে সেই দুঃখ আরেকবার জেগে উঠল । বুদ্ধদেব গুহকে উদ্ধৃত করে বলি - সময় না দিলে শিকার বা প্রেম কোনোটাই ঠিকমত হয় না । ভালো থাকুন । শুভ নববর্ষ ।

মূলত পাঠক এর ছবি

ভালো লাগছে, মানসভ্রমণ হয়ে যাচ্ছে দিব্বি। চলুক!

সুপর্ণা  এর ছবি

আপনার লেখা পড়ে সবারই একবার অন্তত এই জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার কথা মাথায়ে আসবে ।বর্ণনা গুলো আমার ভাল লাগেছে।

পার্থসারথি মুখার্জী এর ছবি

সকলে ভালো থাকুন । আনন্দে থাকুন । শুভ নববর্ষ ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।