সরকারী অতিথিশালা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২২/০৬/২০০৯ - ৬:০৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হাওড়াতে যাদুসম্রাট পি সি সরকার একতা ভৌতিক হোটেল খুলবেন |খবরের কাগজে এটা পরেই গল্পটা মনের মধ্যে জেগে উঠলো |
******************************
কোনা এক্সপ্রেস ধরে একটু এগিয়ে গেলেই বাঁহাতে যেখানে বটগাছটা ঝুরি নামিয়ে দাড়িয়ে আছে, তার পরেই ঠগীর মাঠ | এক কালে ওই মাঠে কতো যে নিরীহ লোকের মৃত্যু হয়েছে তার আর লেখাজোখা নেই | খুন করে, লুঠপাট সেরে ওই মাঠেই লাশ পুঁতে রেখে যেতো ডাকাতেরা | বছর কুড়ি আগে যখন জাকির আহমেদ ওখানে ইটভাঁটা করার জন্য আসলো, গাঁয়ের মুরুব্বীরা সবাই মাথা নেড়েছিলো | তেনারা সবাই এতো বছর মাটির তলায় শুয়ে আছেন, বিরক্ত না করাই ভালো | জাকির আহমেদও অবশ্য হাতে হাতেই ফল পেয়েছিলো | যেখানে মাটির কোপ পড়ে, একটা করে কঙ্কাল ওঠে | এতোদিন পর বটগাছের পাতায় পাতায় কারা যেন ফিস্ ফিস্ করতে শুরু করল | রাতের দিকে বটগাছের তলায় তেনাদের কাউকে কাউকে দেখা যেতে লাগল | লোকজন সন্ধ্যের পর বেরোন বন্ধ করে দিল | তারপর যখন ইটভাঁটার একজন মজুর বমি করতে করতে মারা গেল, তখন আর কারো মনে সন্দেহ রইল না, যে তেনারা এবার জেগেছেন | জাকির সবাইকে বোঝাবার চেষ্টা করল যে ও কিছু নয় | লোকটা না বুঝে বিষ মদ খেয়েছিল | তখন কে কার কথা শোনে | সাতদিনের মধ্যে সব মজুর পালিয়ে গেল | কিছুদিন পর জাকিরও কোথায় চলে গেলো |

এতোদিন বাদে মনে হয় সে জমির হাত বদল হচ্ছে | লোকজন মাপামাপি করছে | কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাব দেয় না | বলে - সরকারের কাজ, বলা যাবে না | গাঁয়ের বুড়োরা আবার মাথা নাড়তে থাকে, তবে এবার অন্যদিকে | তেনারা ওই একজনার কাছে জব্দ | সরকারের কাজের ব্যাপারে তেনাদের কোন ট্যাঁ ফো চলবে না |

তবু কিছু কিছু কথা বেরিয়ে আসে | এখানে নাকি হোটেল হবে | ভুতদের হোটেল | সেখানে সবাই ভুত | ভুতেরা রাঁধবে, ভুতেরাই খাবে, ভুতেরা নাচবে, গাইবে | পুরোপুরি ভুতুড়ে কান্ড |

লোকের মুখে মুখে কথা ছড়ায় | সরকার তো সকলেরই | ভুতেদের কথাও তো তাকে ভাবতে হবে | আর এই ঠগীর মাঠ তো ভুতেদেরই আবাসন ছিল | সেখানে ভুতেদের জন্য একটা হোটেল হতেই পারে |

নন্দ বলে, "কিন্তু বে-পাড়ার ভুতেরাও তো এখানে আসবে | অতোগুলো বাড়তি ভুত আমরা সামলাতে পারবো তো? সেই ইটভাঁটার মজুরটার মত আমরাও যদি আবার ... "

কিরণ ওকে কথা শেষ করতে দেয় না | বলে ওঠে, "আরে সরকার তো সবারই | ওদের কথা ভাববে মানে কি আমাদের কথা ভুলে যাবে?"

হাবুও কিরণের সাথে একমত, "আজকাল নিশ্চয়ই ঘাড় মটকানো বে-আইনী হয়ে গেছে |"

"হ্যাঁ", নন্দ ভেংচে ওঠে, "সাইন বোর্ড টাঙিয়ে দেবে, এখানে ঘাড় মটকাইবেন না | মটকাইলে সরকারী খরচে গয়াতে পিন্ডি দিয়ে আসা হবে |"

"আর একটা কথা তোরা কেউ ভাবছিস না" ভারী গলায় কমল বলে ওঠে | ওর গলাটা একটু ভারী আর নামটা কমল মিত্র বলে, ও সব সময়েই গলা আরো ভারী করে কমল মিত্র স্টাইলে কথা বলার চেষ্টা করে | "হোটেল হলে তো আমাদেরও কিছু সুবিধা হবে | আমাদের কয়েকজনের চাকরীও তো হয়ে যেতে পারে | তেনাদের তো সুক্ষ দেহ | জিনিস্ পত্র কেনাকাটা করতে, টুকটাক কাজ করতে, নিদেনপক্ষে দারোয়ানের চাকরীটাও তো আমরা আশা করতে পারি | এই বাজারে সেটাই বা মন্দ কী |"

নন্দ হেসে ফেলে |

"কোন চাকরীটা তুই আশা করছিস? ওদের খাবার কিনবি? মড়ার মাথার খুলিতে রক্তের সুপ - কোন দোকানে পাবি? দারোয়ানের কাজ করবি? সন্ধ্যে হলেই তো খাটে উঠে বসে থাকিস | মাঝ রাতে অন্ধকারে একা একা দাঁড়িয়ে যখন দেখবি, একের পর এক মামদো, বেহ্মদত্যি, কন্ধকাটা তোর দিকে এগিয়ে আসছে, ওখানেই মুচ্ছো যাবি | আর টুকটাক কাজ তোকে দেবে কেন? ভুতদের দিয়ে করিয়ে নেবে | আরে এটা ত ওদেরই হোটেল | ভুলে যাচ্ছিস কেন? আর কাজ দিলেও অতোগুলো ভুতের মধ্যে দাঁড়িয়ে কোন কাজটা করতে পারবি শুনি?"

ব্যাপারটা আস্তে আস্তে সবারই মাথায় ঢোকে | চাকরীর আশায় ওরা ভুতের হোটেলের দিকেই তাকিয়ে ছিল | এখন সেটাও যদি না হয়, তাহলে আর ভুতের হোটেল হয়ে ওদের লাভ কি?
"তাহলে তুই কি করতে চাস?" হাবু বলে ওঠে "হোটেলটা যাতে না হয় সেই চেষ্টা করা যাক |"

"আন্দোলন বা ওঝা | হয় হোটেল বন্ধ কর, না হয় ভুতেদের এখান থেকে সরিয়ে দাও" কমল তার মতামত দেয় |

"চুপ চুপ" নন্দ সবাইকে থামিয়ে দেয়, "সে কথাও কি ভাবিনি ভেবেছিস? কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? যাই করতে যাও, তেনাদের কাছে তো কোনো খবর লুকোন থাকবে না | কিছু করার আগেই দেখবি বটগাছের ডালে ঝুলছিস | এ নিয়ে আর একটা কথাও বাড়াস নি | রাম রাম |"

ওই বটগাছের ডালে ঝোলার ভয়েতেই শেষ পর্যন্ত আর কারো কিছু করা হয়ে ওঠে না | হোটেলের কাজও তরতর করে এগিয়ে চলে |

কিন্তু এ আবার কি ধরনের হোটেল! কোথায় সুন্দর বাড়ি হবে, বাইরে গাড়ী রাখার জায়গা, ভেতরে সুইমিং পুল, বাগান, আলোর ফোয়ারা | এ একদম সত্যি ভুতুড়ে হোটেল | বাইরে গাড়ী রাখার জায়গা অবশ্য আছে, কিন্তু ওই পর্যন্তই | পয়সা খরচ করে যে কেউ এ রকম ভাঙ্গা বাড়ী বানাতে পারে, না দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না | বাড়ী তো নয়, বাড়ীর ধ্বংসাবশেষ বললেই ঠিক হয় | আর তার ভেতরে আলো আছে কি নেই কিছুই মালুম হয় না | একটু রাত বাড়লেই যতো রকমের অদ্ভুত শব্দ শোনা যায় | বেড়ালের কান্না, পেত্নির ফোঁপানি, ভুতের নৃত্য, কি নেই সেখানে | পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে বসে গাঁয়ের বুড়োরা আবার মাথা নাড়তে থাকেন, ঘোর কলি রে ভাই ঘোর কলি |

অবশেষে একদিন হোটেলের উদবোধন হল | কৌতূহলে পাড়ার সবাই নিজের নিজের বাড়ির জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলো | ভূতেরা কি গাড়ী চড়ে আসে? একের পর এক গাড়ী লাইন দিয়ে ঢুকছে | সুন্দর সুন্দর পোষাক, খিল খিল হাসি | সেন্টের গন্ধ পাড়ার ও মাথা পর্যন্ত পৌঁছে গেলো | কিরণ, হাবু, কমলরা রাগে গজগজ করতে লাগলো | নন্দটার কথায় ভয় না পেয়ে চাকরীর চেষ্টাটা করলেই হত | সব লোকজনই তো ঢুকছে | কাউকে দেখে তো ভূত মনে হচ্ছে না | এরা নিশ্চয়ই মড়ার মাথার খুলিতে রক্তের সুপ খাবে না | পরশুদিন থেকে সাপ্লায়ারদের গাড়ী আসছে | মাছ, মাংস, সব্জী - সব কিছুই আসছে |

********************

আজ অমাবস্যা | দিন সাতেক হল ভূতুড়ে হোটেল চালু হয়েছে | রমরম করে ব্যবসা চলছে | ভিড় লেগেই আছে | মালিক ছোটকর্তা খুশী খুশী মুখে তাঁর ঘরে বসে আছেন | হোটেলের সর্বত্র টিভি ক্যামেরা বসানো | ছোটকর্তা তাঁর ঘরে বসেই সবকিছু দেখতে পান | উনি অবশ্য বেশিদিন থাকবেন না | চিরটাকালই আজ জাপান, কাল রাশিয়া করে এসেছেন | হোটেলটা মোটামুটি চালু হয়ে গেলেই আবার নিজের কাজে বেড়িয়ে পড়বেন | একটাই দুঃখ | উদবোধনের দিন বড় মেয়েটা আসতে পারেনি | সে এখন সিঙ্গাপুরে শো করছে | দুয়েক দিনের মধ্যেই তার এসে পড়ার কথা |

বড়মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতে আর সামনের মনিটরগুলোর দিকে দেখতে দেখতে একটু বোধ হয় তন্দ্রা এসে গিয়েছিল | হাঁপাতে হাঁপাতে মদন এসে ঢুকল ঘরে - "ছোটকর্তা"

একটু বিরক্তই হলেন ছোটকর্তা | এমনিতে তাঁর ঘরে যে কেউ যখন খুশী ঢুকতে পারে | সে অনুমতি তাঁর দেওয়া আছে | কিন্তু একটা নক করে তো ঢুকবে | কতদিন ধরে এগুলো উনি এদের শিখিয়ে আসছেন | বাইরের কেউ থাকলে কি মনে করতো? হোটেলের লোকগুলো একটু ভব্যতাও জানে না!

যাই হোক | বহুদিনের চেষ্টায় ক্রোধ দমন করতে শিখেছেন তিনি | এটা পরে আবার বোঝাতে হবে | শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, "কি হয়েছে রে মদন? অতো ঘাবড়ে গেছিস কেন?"

"ওই নতুন কাষ্টমার | ও ... ও ... মানুষ নয়, নিশ্চয় ভূত ... মানে ... মানে পেত্নী |"

হেসেই ফেললেন ছোটকর্তা, "আমার সঙ্গে এতোদিন কাজ করার পর আজ বুঝি তোর নতুন করে ভূতের ভয় ধরল রে মদন? গত দশ বছর ধরে তুই আমার সাথে আছিস | কম সে কম বারোটা দেশে আমার ভূত নামানো খেলার তুই প্রধান শাগরেদ | এই গোটা হোটেল জুড়ে যতো ভূতুড়ে কান্ড হয়, সেতো তোদের চোখের সামনেই | লেজার বীম, সাউন্ড এফেক্ট, হ্যালুসিনেশন - আমরা তো সবাই মিলে ভূত নামাই রে এই হোটেলে | সেই তুই ভূতেদের সর্দার আজ নিজেই ভুতের ভয়ে পেটের মধ্যে হাত-পা ঢুকিয়ে বসে আছিস?"

"আমি জানি ছোটকর্তা | আপনি তো আমায় হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছেন | প্রথম প্রথম তো কি ভয়টাই না পেতাম | কিন্তু এ মেয়েটা বোধ হয় সাত্যিকারের পেত্নী | হারাধন, রঞ্জিত - কেউ আর ওই টেবিলের দিকে ঘেঁষছে না | আর যা দেখেছি, আমারও আর ওদিকে যাবার সাহস নেই |"

"কেন কি হয়েছে শুনি?" আশি ভাগ কৌতূহলের সাথে কুড়ি ভাগ বিরক্তি মিশিয়ে বলেন তিনি | বিরক্তিটা নিজের ওপরেই | ঘুমিয়ে না পড়লে পুরো ব্যাপারটা নিজের চোখেই দেখতে পেতেন, আর কন্ট্রোলের বাইরে যাওয়ার আগেই সামলে নেওয়া যেত |

"শোনেন ছোটকর্তা", এতক্ষণে ধাতস্থ হয়েছে মদন | কিংবা ভূতেদের সামলানোর ব্যাপারে ছোটকর্তার অতুলনীয় ক্ষমতার ওপরে বিশ্বাসের জন্যই বোধ হয় সে এখন দম নিতে পারছে | ধীরে ধীরে পুরো গল্পটা বলতে শুরু করে সে |

কিছুক্ষণ আগে একটি মেয়ে একা একাই গাড়ী চালিয়ে এই হোটেলে আসে | সাধারণত এই ভূতুড়ে হোটেলে কেউই একা আসে না | যতোই সাহস দেখাক না, সবারই তো ভেতরে ভেতরে ভয় আছে | তার ওপর মহিলা, গুপী কঙ্কালের তখনই কেমন যেন সন্দেহ হয়েছিল | গাড়ী রাখার জায়গায় এসে মেয়েটি একটু থামলো, তারপর কাচ নামাতেই গুপী জানালা দিয়ে তার মুন্ডু মানে নরকরোটিটা ঢুকিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, "ম্যাডাম, চাবিটা আমায় দিন | দেখেশুনে রেখে দেব |" মেয়েটি একটুও না ঘাবড়ে ওর বাড়ানো হাতের হাড়্গুলোর মধ্যে চাবিটা দিয়ে একটু হাসলো | মেয়েটার হাত দুধের মত সাদা আর গুপীর হাড্ডিগুলোর থেকেও ঠান্ডা |

"তারপর?" বেশ মজাই লাগছে ছোটকর্তার | মেয়েটা নিশ্চয় সাদা দস্তানা পরে এসেছিল আর এদের ভয় দেখাবে বলে দস্তানাটাকে বরফে চুবিয়ে রেখেছিল অনেকক্ষণ | তাহলে ভূতেদেরও ভয় দেখানোর কথা ভাবতে পারে কেউ কেউ | এইজন্যই তো এই হোটেল খুলেছেন তিনি | জনসাধারণকে বুঝিয়ে দেবেন, ভূত বলে কিছু নেই | সবই ম্যাজিকের খেলা | আলো, শব্দ আর পরিবেশনা দিয়ে মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিতে পারলেই ভূতের সৃষ্টি | সেই ভয়টা জিতে নিতে পারলেই অনেক কুসংস্কার থেকে মুক্তি |

তারপর দরজার কাছে আসতেই ফটিক দরজার পাশের ফুটোটা দিয়ে স্পেশ্যাল ধোয়াঁটা ছাড়ল | ধোয়াঁটা সাদা বেড়ালের আকার নেওয়া মাত্র সে খোনা গলায় বলতে সুরু করল, "সরকারী অতিথিনিবাসে সুস্বাগতম |" উদবোধনের দিন এই বেড়ালকে দেখেই মন্ত্রীমশাই তিন পা পিছিয়ে গিয়েছিলেন মনে করে এই অবস্থার মধ্যেও মদনের হাসি পেল | কিন্তু এটা হাসার সময় নয় | বরং পেত্নীটার আগমন মনে করে তার ভেতরের ভয়টা আবার চাগাড় দিয়ে উঠল |

মেয়েটাও এক পা পিছিয়ে গেলো | বেড়ালটার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো | ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে সিগারেট বের করে একটা জবাবী ধোয়াঁর রিং ছেড়ে বললো, "ধন্যবাদ" | রিংটা তখন একদম সামনের বেড়ালটার মতোই দেখতে আরেকটা বেড়াল | যেন দুটো হুলো মুখোমুখি হাওয়ায় ভাসছে |

বেশ ভালো জাতের ম্যাজিশিয়ান তো, ভাবলেন ছোটকর্তা | এই ধোয়াঁর ম্যাজিকটা তিনি প্রথম দেখান ফ্রান্সে, আজ থেকে প্রায় পনের বছর আগে | সামনের সারির দুজন মহিলা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন | তারপর থেকে এই ম্যাজিক দেখানোর আগে উনি সবাইকে সাবধান করে দিতেন |

গুপী আর ফটিকের অবস্থা দেখে অনেকেই বেশ খেপে গেছে তখন | কোথায় হোটেল খোলা হয়েছে লোককে ভয় দেখানোর জন্য, একটা বাচ্চা মেয়ে উলটে ওদেরকেই মুখের ওপর জবাব দিয়ে যাচ্ছে | নেহাত ছোটকর্তার সাথে এতোদিন থেকে ওরা আর ভূতে বিশ্বাস করে না, না হলে এতোক্ষণে সব্বাই দৌড় লাগাতো, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা বলে | তখনো যদি বুঝতে পারা যেত তাহলে হারাধন আর ওই ভুল করে বসে?

"হারাধনটা আবার কি করলো?" ছোটকর্তা জিজ্ঞেস করলেন |

"জানেনই তো ওটা একটু গোয়াঁর আছে | আজকে আবার সে কন্ধকাটা সেজেছে | মাঝে মাঝেই মুন্ডুটা ঘাড়ের ওপর থেকে ডাইনে-বায়েঁ লটপট করে ঝুলে পড়ে | ওই রকম লটপট করতে করতে সে এগিয়ে এল, "আসুন দিদিমণি |" ওই লটপটানি দেখে গত সাতদিনে কত লোক হাটুঁ ভেঙ্গে মুচ্ছো গেছে, আর মেয়েটা একটু হেসে, "এস তোমার মুন্ডুটা আটকে দি" বলে ব্যাগ থেকে সেলোটেপ বের করেছে | যেইনা মেয়েটা হারাধনের মুখের কাছে আঙ্গুল তুলেছে, হারাধন দিয়েছে এক কামড় |

"কামড়ে দিয়েছে? মানে? বলেছি না যতো ভয় দেখাবি বাইরে থেকে? কাউকে ছোয়াঁ চলবে না? কারো কোন ক্ষতি করব না আমরা |" রেগে ওঠেন ছোটকর্তা |

"না না | জোরে কামড়ায়নি | শুধু একটু দাঁতের ছোয়াঁ মাত্র | তার ওপর গুপী আর ফটিকের দুর্দশা দেখে সবাই একটু 'দেখে নেব' ভাবছিল তো" সামাল দেয় মদন, "কিন্তু ওখানেই তো হল যতো গন্ডগোল | দাঁত ছোয়ান মাত্র আঙ্গুলটা খুলে চলে এলো হারাধনের মুখে | হারাধন ঘাবড়ে গিয়ে মুখ থেকে আঙ্গুলটা বের করে দেখে একটা গাজরের টুকরো |

"বাঃ বাঃ !", বেশ খুশী হয়ে উঠলেন ছোটকর্তা | উপয়ুক্ত প্রতিপক্ষ পেলে যেমন খেলার মজা বাড়ে, উনিও তেমনি উত্তেজনা বোধ করছিলেন | অনেকদিন পর এক দুঃসাহসী যাদুকরী তাঁকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে |

আলো আঁধারিতে হলঘরটায় কেমন যেন গা ছমছম করে | ঢুকলেই মনে হয় শ্মশানে এসেছি | চারধারে গাছগাছালিতে ঢাকা | একটুদূরে একটা মড়া পুড়ছে | গত সাতদিন ধরে ওই চিতাটা জ্বলছে | মদনরা রসিকতা করে বলে রাবণের চিতা | চারিধারে ঝিঁঝিঁর ডাক | মাঝে মাঝে শেয়ালের ডাক, বাদুরের ছানার কান্না, হায়নার হাসি | মেঝেতে এখানে ওখানে মড়ার খুলি, হাড় ছড়ানো | সেগুলো আবার হঠাত হঠাত নিজের থেকেই নড়েচড়ে বেড়ায় |

"দ্বিতীয় সারির প্রথম টেবিল বেছে নিল মেয়েটা", মদন বলে চলে, "টেবিলটা একটা কফিনের মতো দেখতে | মেয়েটা একটু বসেছে সেখানে | হঠাত কফিনের ঢাকাটা নড়ে উঠলো | আধখানা ঢাকা সরিয়ে ফটিক উঠে বসে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে খল খল করে হাসতে লাগলো | ওর ডানদিকের চোখটা গলে গেছে, বাঁদিকের গালে একটা লম্বা কাটা দাগ | মেয়েটা গম্ভীর হয়ে বলল, "ব্যাকরণে ভুল হল যে | সেজেছ মুসলমান, এদিকে এটাও জানো না যে মুসলমানদের গোর দেওয়ার সময় কফিন থেকে শরীরটা বের করে শুধু শরীরটাকেই গোর দেওয়া হয় | খৃশ্চানদের অবশ্য কফিন সমেত কবর দেওয়া হয় | কফিন থেকে উঠলে পরেরবার খৃশ্চান ভূত সেজো |" ফটিক সেই যে চিতপাত শুয়ে পড়ে কফিনের ঢাকা টেনে দিল, তাকে আর বের করাই মুশকিল | দশ মিনিট পরেও ঠক ঠক করে কাঁপছে | কথা বলার সময় সে মেয়েটার চোখের দিকে একবার তাকিয়েছিল | মানুষের চোখ নয়, দুটো লাল টুনি বাল্ব জ্বলছিল |

এঃ হে ! একটা বোকার মতো ভুল হয়ে গেছে | আজকেই এই ভুলটা শুধরে নিতে হবে | সাত নম্বর আলমারীতে খৃশ্চান ভূতের ড্রেস আছে, বের করে নিতে হবে | তবে এই অল্প বয়সেই মেয়েটা ভালই সম্মোহনবিদ্যা শিখেছে, মনে মনে তারিফ করেন ছোটকর্তা |

এরপর অশোকের পালা | সে স্পেশ্যাল জামাটা পরে অর্ডার নিতে এলো | ওই জামাটা পরলে তার মাথাটা দেখা যায় না, চোখ আর মুখ পেটের ওখানে মনে হয় | ছোটকর্তা জামার মুখের (মানে অশোকের পেটের) কাছে স্পীকারটা বসিয়ে দিয়েছেন | সেখান থেকেই কথাগুলো বেরিয়ে এলো, "কি খাবেন ম্যাডাম?" মেয়েটা হেসে ওঠে, আর অশোক ছিটকে পিছিয়ে যায় | মেয়েটার জিবটা ঠিক সাপের জিবের মত, মাঝখানে চেরা | কোনমতে অর্ডার নিয়েই পালিয়ে আসে অশোক |

খাবার সময় বিরক্ত করা কণিকার কাজ | পাশের ফটো থেকে হঠাত যেন জ্যান্ত হয়ে বেরিয়ে আসে | সাদা কাপড় পড়া পেত্নী সেজে আলতো করে মেয়েটির কাঁধে টোকা দেয় সে | কুকুরের দাঁতের মত শ্বদন্ত বিকশিত করে জিজ্ঞেস করে, "নাম কি?" মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়, "ভাসিলিসা, যাদুকরী ভাসিলিসা |" কণিকা হঠাতই যেন তাড়াহুড়ো করে আবার ফটোতে মিশে যায় | ভাসিলিসার শ্বদন্তগুলো যেন আরো বেশি তীক্ষ্ণ |

"মেয়েটা কি এখনো বসে আছে?", জিজ্ঞেস করলেন ছোটকর্তা | দেখতেই হচ্ছে মেয়েটাকে | এত কম বয়সে হাত-সাফাই, সম্মোহন - সব কিছু শিখেছে সে | তার ওপর ভীষণ শক্ত নার্ভ | ছোটকর্তার দশ বছরের পুরোন দলটাকে একাই ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দিল |

মদন জবাব দেওয়ার আগেই ঢুকলো রঞ্জিত | ঢুকলো ঠিক বলা উচিত নয়, সবাই মিলে ওকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে এলো | যদি কোন কাষ্টমার কখনো হঠাত অজ্ঞান হয়ে যায়, তাই ছোটকর্তা স্ট্রেচারের ব্যবস্থা রেেছেন | কিন্তু তাতে যে কোনদিন তাঁরই এক অভিজ্ঞ কর্মচারীকে বয়ে নিয়ে আসতে হবে, এ তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি | রঞ্জিতের মুখের ওপর একটা কাপড় চাপা | সবাই সেই কাপড়ের টুকরোটার দিকে ভীতি-বিহবল দৃষ্টিতে চেয়ে আছে |

কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে হয় না | হারাধনই নিজের থেকে বলতে শুরু করে | খাওয়া শেষ হলে রঞ্জিত বিল নিয়ে যায় | ও সাজে কন্ধকাটা | মেয়েটা বিল মিটিয়ে হেসে বলে "টিপস নেবে না? তোমার তো আবার মাথাই নেই | চলো আমার মাথাটাই তোমাকে বখশিস দিয়ে যাই" এই বলে নিজের মাথাটা খুলে রঞ্জিতের কাঁধের ওপর চাপিয়ে দিয়ে চলে যায় সে | রঞ্জিত ওখানেই অজ্ঞান |

একটু অস্বস্তির সঙ্গেই কাপড়টা তোলেন ছোটকর্তা | চুল ধরে মেয়েটির মাথাটা তুলে ধরেই হেসে ফেলেন তিনি | নিজের টেবিলের ওপর রেখে জিজ্ঞেস করলেন, "তোর জাহাজের না পরশু পৌঁছনোর কথা?" মুন্ডুটাও এবার হেসে ওঠে, "জাহাজ পরশু আসছে, আমি সিঙ্গাপুর থেকে ফ্লাইটে চলে এসেছি | হোটেলটা কিন্তু জব্বর করেছ বাপি |"

"আর জব্বর | তুইতো আজ সবার রাতের ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছিস | সোজা আমার ঘরে চলে আয় | একজন অজ্ঞান, বাকিরা অর্ধমুর্চ্ছা | সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দি | নাহলে আজকেই আমার হোটেল লাটে উঠবে | ভাগ্যিস এখনো আর কোন গেস্ট আসেনি |"

দরজা খুলে একটা প্রজাপতির মত নাচতে নাচতে ঢুকলো রাজশ্রী | কে বলবে, এই মেয়েই সিঙ্গাপুরে পনেরো দিনের ম্যাজিক শো নামিয়ে ফিরেছে | দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে গেলেন যাদুসম্রাট শ্রী সরকার | পুত্রী আর শিষ্যার হাতে পরাজয়ই কাম্য |


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

দয়া করে আপনার নাম আর ইমেইল ঠিকানা লেখার শেষে যোগ করে দেবেন। অতিথিরা পোস্ট সম্পাদনা করতে পারেন না, আপাতত মন্তব্যে জুড়ে দিতে পারেন। ধন্যবাদ।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

অতিথি লেখক এর ছবি

একদম ভুলে গেছি
নাম : শঙ্কর
ইমেইল :

খেকশিয়াল এর ছবি

অসাধারণ দাদা অসাধারণ! আরো কয়েকটা ছাড়ুন তো!

------------------------------
'..দ্রিমু য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

হাহাহাহাহা...লাইক করসি...

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

সাইফ তাহসিন এর ছবি

শঙ্করদা, চরম ফাটাফাটি, অনেকদিন পর এমন একটা ভৌতিক রম্যরচনা পড়লাম, ভারী মজার !!!

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

রেনেট এর ছবি

চমৎকার! প্রথম গল্পতেই বাজিমাত করলেন মশাই চলুক
সচলায়তনে স্বাগতম হাসি
---------------------------------------------------------------------------
No one can save me
The damage is done

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

শঙ্কর এর ছবি

কাল সকাল বেলা পোস্ট করে গালে হাত দিয়ে বসে আছি। ৫০ জন মতো পরে ফেললো। কেউ কিছু বলে না। মনের দূঃখে বাড়ী চলে গেলুম। আজ সকালে লগিন করেই দেখি প্রচুর পরিমাণে উতসাহ বর্ধক (খন্ড ত কি করে লিখবো?) মন্তব্য। খুব ভালো লাগলো।
শঙ্কর

তানবীরা এর ছবি

হাবুও কিরণের সাথে একমত, "আজকাল নিশ্চয়ই ঘাড় মটকানো বে-আইনী হয়ে গেছে |"

"হ্যাঁ", নন্দ ভেংচে ওঠে, "সাইন বোর্ড টাঙিয়ে দেবে, এখানে ঘাড় মটকাইবেন না | মটকাইলে সরকারী খরচে গয়াতে পিন্ডি দিয়ে আসা হবে |"

হাহাহাহাহা, খুব আনন্দ নিয়ে পড়লাম।

---------------------------------------------------------
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।