কিছু উপবৃত্তাকার উত্তেজনার গল্প

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ১৫/০৮/২০০৯ - ৭:০৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


আটলান্টিকের পাড়ে দাড়ানো ইউরোপের এক দ্বীপদেশ আয়ারল্যান্ড। এ দেশে আসার পর এ জাতির রাগবীর প্রতি বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসা আমাকেও ধীরেধীরে নাড়া দেয়। উঠতে বসতে, রাস্তাঘাটে, বাসে-প্রান্তরে এদের রাগবী প্রীতি বেশ দারুন লাগে। উপবৃত্তাকার আকৃতির একটা বল যে কত উন্মাদনার সৃষ্ট করতে পারে সেটা এখানে না আসলে হয়তো জানা হতো না। ছোট ছোট বাচ্চাদের টি-শার্টে লেখা দেখেছি - “টু ইয়াং, কান্ট প্লে রাগবী ইয়েট!”। একদিন বড় হলে তারাও খেলবে। সেটারই যেন আগাম হুমকি। গিফট শপগুলোতে গেলে দেখা যায় দুটো জিনিসের খুব চল – ক্যালটিক মিউজিক/প্রোডাক্ট আর রাগবী সংক্রান্ত পোশাক। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের (ট্রিনিটি কলেজ, ইউনিভার্সিটি অব ডাবলিন) রাগবী ক্লাব হচ্ছে এখনও বর্তমান এমন ক্লাবগুলোর মধ্যে পৃথিবীর যে কোন ধরনের ফুটবলের সর্বপ্রাচীন ক্লাব। মাঝে মাঝে ওদের প্র্যাকটিস দেখি। তিব্র শীতে যখন কাঁপতে থাকি, তখন ওরা টি-শার্ট আর শর্টস পরে বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ায়! রাগবী যেন এদের কাছে অন্যরকম অনুভুতি। আর যারা খেলে তারাতো রীতিমত একেকটা অমানুষ!

যাইহোক, ২০০৭ সনে ডাবলিন আসার পর কিছু টুকটাক জিনিস কেনার খুব দরকার হয়ে পড়েছিল। টু-ইউরো শপে গিয়ে কেনাকাটা করার সময় একটা বিশাল সাইজের মাগ খুঁজছিলাম। একটু ঘাটাঘাটির পর একটা মনের মত সাইজ পেয়েও গেলাম। তড়াহুড়ার মধ্যে ছিলাম তাই কেনার সময় কি লেখা ছিল সেটা লক্ষ্য করিনি। পরদিন সকাল বেলা দুধ ভর্তি মাগ হাতে নিয়ে দেখি লেখা - আইরিশ রাগবী। সেই থেকে শুরু। আমার আয়ারল্যান্ড জীবনের দিনগুলোর সূচনা হতে লাগলো রাগবীর 'গুড মর্নিং' উইশ দিয়ে।

তারপর ধীরেধীরে রাগবীর নিয়মকানুন শেখা শুরু করলাম। ২০০৮ এর সিক্স ন্যাশনস চ্যাম্পিয়ানশীপও ফলো করতে শুরু করি। সিক্স নেশনস হচ্ছে রাগবীর ইতিহাসে সবচেয়ে পুরোনো প্রতিযোগীতা; এবার ছিল এর ১১৫তম আসর। ১৮৮৩ সনে যখন চার হোম নেশন অর্থাৎ ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড এবং ওয়েলসকে নিয়ে এর সূচনা হয় তখন নাম ছিল হোম ন্যাশনস চ্যাম্পিয়ানশীপ, পরে ১৯১০ সনে ফ্রান্সের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে দল সংখ্যা পাঁচ হয়ে হয় ফাইভ নেশন্স চ্যাম্পিয়ানশীপ এবং ২০০০ সনে ইটালী আসার পর হয় সিক্স নেশনস চ্যাম্পিয়ানশীপ। উল্লেখ্য যে এই প্রতিযোগীতাকে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ানশীপ হিসেবেও দেখা হয় যেহেতু এখানে ইউরোপের সেরা ছয়টি দল খেলে।

বাসে করে বিশ্ববিদ্যালয় যাবার পথে তখন ফ্রি পত্রিকাগুলোর খেলার পাতায় নিয়মিত চোখ রাখতে শুরু করি। মূল সংবাদ ছাড়াও রাগবীর পাতা খুলে টুকিটাকি সংবাদগুলোও গিলতে লাগলাম। আইরিশদের অবস্থা তখন চরম শোচনীয়। শুধু আয়ারল্যান্ডই নয়, ওয়েলসের তিব্র দাপটে অন্য দলগুলো ছত্রখান হয়ে যাচ্ছিল। সে বছর ওয়েলস অপরাজিত চ্যাম্পিয়ান তথা গ্র্যান্ডস্লাম এবং অন্য তিন হোম নেশনকে পরাজিত করার গৌরব তথা ট্রিপলক্রাউন সহ চ্যাম্পিয়ান হয়। ওয়েলসে যখন শ্যাম্পেইনের বন্যা, অন্য দেশগুলোতে তখন কবরের নিরবতা। রেকর্ড বলে রাগবীতে ইউরোপের সবচেয়ে দাপুটে দল ইংল্যান্ড। অথচ বাস্তবে খেলার মাঠে সেটার লক্ষন দেখা যায়নি। এমনিতে ইংলিশ মিডিয়া তোলার সময় অনেক উপরে তোলে। কিন্তু লবন লাগানোর সময়ও তারা ওস্তাদ। ইচ্ছা মত ইংলিশ টিমের সমালোচনা শুরু করে দেয়। ওদের দেখাদেখি আইরিশ মিডিয়াও শুরু করলো। পত্রিকার পাতায় প্রতিটা খেলোয়াড়কে ধরেধরে ছেলা হচ্ছিল। আহারে বেচারারা। একেক জনের বিধ্বস্ত ছবি ছাপাতো। যেন ভগ্নদশা আইরিশ রাগবী শেক্সপিয়ারের একেকটা ট্র্যাজেডী হয়ে ফিরেফিরে আসতে লাগলো।

তারপর এলো ২০০৯। ৭ ফেব্রুয়ারী ইংল্যান্ড এবং ইটালীর খেলা দিয়ে শুরু হলো এ বছরের আসর। লীগ ভিত্তিক অনুষ্ঠিত এই প্রতিয়োগীতায় সব দল সবার সাথে একবার করে মোকাবেলা করে। তারপর যে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থাকে সে চ্যাম্পিয়ান হয়। অপরাজিত থাকতে পারলে বাড়তি গৌরব গ্র্যান্ডস্লাম আর অন্য সব হোম নেশনকে হারাতে পারলে ট্রিপলক্রাউন। আয়ারল্যান্ড প্রথম ম্যাচে ফ্রান্সকে হারায় ৩০-২১ পয়েন্টে, আর দ্বিতীয় ম্যাচে ইটালকে ৩৮–৯ পয়েন্টে। আইরিশ মিডিয়ার মুখে খানিকটা হাসি ফুটে উঠলো। এবার হয়তো তাদের দল কিছু করতে পারবে - প্রত্যাশার পারদ অনেকটা এ পর্যায়ে তখন।

২৮ ফেব্রুয়ারী ডাবলিনের ক্রোক পার্কে ছিল ইংল্যান্ডের সাথে খেলা। উপচে পড়া জনতার ভীড়ে সেদিন ডাবলিন ছেয়ে গিয়েছিল। বাসে করে সিটি সেন্টারে যাওয়ার সময় শ্যালবার্ন হোটেলের সামনে আয়ারল্যান্ড দলের বাসকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম। খানিক পরেই হয়তো খেলোয়াড়রা মাঠে যাচ্ছিল। নিজের অজান্তেই মনেমনে প্রার্থনা করলাম, ওরা যেন আজ জেতে। পরবর্তিতে তিব্র উত্তেজনাপূর্ন সে খেলায় ১৪-১৩ পয়েন্টে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে আয়ারল্যান্ড সেদিন আরেকটু এগিয়ে গিয়েছিল চ্যাম্পিয়ান হবার পথে।

১৪ মার্চ সিটি সেন্টারের সুপারম্যাক রেস্টুরেন্টে একটা মিল নিয়ে বসলাম স্কটল্যান্ড বনাম আয়ারল্যান্ডের খেলা দেখতে। খেলাটা হচ্ছিল স্কটল্যান্ডের রাজধানী শহর এডিনবরায়। স্কটিশ ফ্যানে পুরো মাঠ ছেয়ে গিয়েছিল। ফ্যানদের চিৎকার আর স্কটিশ দলের আক্রমনে আইরিশরা বারবার ভেঙ্গে পড়ছিল। সুযোগটা কাজেও লাগালো তারা। চোখের পলকে খেলায় লিড নিয়ে ফেললো। তারপর সেই লিড ধীরেধীরে বড় করার পালা। ৪০ মিনিটের প্রথমার্ধ শেষ হলে আয়ারল্যান্ড পিছিয়ে থাকলো ৯-১২ পয়েন্টে। কিন্তু খেলার দ্বিতীয়ার্ধ যখন শুরু হলো তখন দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করলো। আয়ারল্যান্ড ক্রমেই চড়াও হতে লাগলো আর পয়েন্ট আদায় করতে শুরু করলো। স্কটল্যান্ড ১২ থেকে ১৫ পর্যন্ত যেতে আয়ারল্যান্ড ৯-কে নিয়ে গেলো ২২-এ। ফলে ৮০ মিনিটের লড়াই শেষ হলো ২২-১৫তে আয়ারল্যান্ডের বিজয়ের মধ্য দিয়ে।

আর মাত্র একটা খেলা বাকি। এটা জিততে পারলেই আয়ারল্যান্ড এবারের আসরের চ্যাম্পিয়ান হয়ে যাবে। সাথে ৬১ বছর পর গ্র্যান্ডস্লাম এবং বাড়তি যোগ হবে ট্রিপলক্রাউনও – অবস্থাটা যখন এরকম তখন খোদ আইরিশরাও ভরসা পাচ্ছিল না। কারন শেষ লড়াইয়ে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ান ওয়েলসের বিপক্ষে নামতে হতো আইরিশ দলকে, তাও আবার খোদ ওয়েলসের রাজধানী কার্ডিফে। যদিও সিক্স নেশনস চ্যাম্পিয়শীপ লীগ ফরমেটে হয় তবে কাকতালীয় ভাবে এবারের আসরের শেষ ম্যাচটাই হয়ে গিয়েছিল অনেকটা ফাইনালের মত। ওয়েলসকে একমাত্র পরাজয়টা উপহার দিয়েছিল ফ্রান্স, যা তাদের পয়েন্ট টেবিলে দ্বিতীয় অবস্থানে রেখেছিল। ফলে তাদের জন্য হিসেবটা ছিল এরকম - চ্যাম্পিয়ান হতে হলে জিততেই হবে এবং সেটা ১৩ পয়েন্টের ব্যবধানে। দলটা যখন ওয়েলস তখন সেটা একেবারে অসম্ভবও নয়। অন্তত একটা টানটান উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচ হবে সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে গেলাম। নাফিস এবং ধ্রুবকেও বললাম ২১ মার্চ যেন ফ্রি থাকে। আমরা এক সাথে খেলা দেখবো। তারপর শুরু হলো প্রতিক্ষার পালা। একটা একটা করে দিন কেটে অবশেষে এসে দাড়ালো ২১ মার্চ; মহার্ঘ্য সময়।

২১ মার্চ সকাল থেকে খেলা দেখতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। শনিবার হওয়াতে বাস পাওয়া কিছুটা কঠিন ছিল। প্রায় ঘন্টায় একটা বাস। সব কিছু পরিকল্পনা মত না করলে সময় নিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলার সমূহসম্ভাবনা থাকে। আমি দ্রুত ধ্রুবকে ফোন দিয়ে জানালাম আমি সুপারম্যাকে থাকবো, নাফিস সহ চলে আসতে। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের যে তিনজন প্রাক্তন ছাত্র আমরা ট্রিনিটিতে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়ছি ধ্রুব এবং নাফিস তাদের অন্য দুজন। যাইহোক, ধ্রুবর ফোন রেখে শাওয়ার নিয়ে, হালকা কিছু খেয়েই বের হয়ে পড়লাম। যথারীতি একটা বাস মিস করলাম; আরেকটা দৌড়ে গিয়ে ধরে সিটি সেন্টারে যখন পৌছাই তখন ঘড়িতে সাড়ে চারটার বেশি বাজে।

সুপারম্যাকের দোতালায় একটা মিল আর ড্রিংস নিয়ে বসে পড়লাম খেলা দেখতে। কার্ডিফের মিলেনিয়াম স্টেডিয়ামে তখন সাজসাজ রব। খেলা শুরু হতে কিছুটা সময় বাকি ছিল। তাই স্টেডিয়ামের চারপাশে বিশেষ ব্যবস্থায় চলছিল হুসহুস করে বেরিয়ে আসা আগুনের খেলা। ৬১ বছর পর গ্র্যান্ডস্লাম জেতার সম্ভাবনার উত্তেজনায় আইরিশ সমর্থকরা তখন কাঁপছিল। অল্প কিছুসময় পর নাফিস এবং ধ্রুবও এসে যোগ দিল আমার সাথে। ধ্রুব নিয়মকানুনের একটা প্রথমিক পাঠ ওর আয়ারল্যান্ড প্রবাসী মেঝ ভাইয়ার কাছ থেকে নিয়ে এসেছিল। আমি আরো বিস্তারিত ভাবে জানালাম টেকনিকাল নিয়মগুলো।

এ লেখার সাসপেন্সগুলো বোঝার সুবিধার্থে শুধু স্কোরিং-এর নিয়মগুলো আপনাদের জন্য তুলে ধরছি। রাগবীতে গোল রয়েছে প্রধানত চার ধরনের – ট্রাই, কনভার্সন, পেনাল্টি এবং ড্রপ গোল। ট্রাই হচ্ছে হাত দিয়ে ধরে দৌড়ে প্রতিপক্ষের গোল লাইন বা তার পেছনের এলাকায় বলকে মাটি স্পর্শ করানো। উল্লেখ্য যে রাগবীতে গোল লাইন বলতে দুই গোল পোস্টের মাঝের অংশটুকুকেই শুধু বোঝানো হয় না বরং পোস্ট দুটো যে লাইনের উপর বসানো থাকে সেই পুরো ৭০ মিটার লাইনটাকেই বোঝায়। ট্রাই করতে পারলে দল পাবে ৫ পয়েন্ট এবং একটি কনভার্সনের সুযোগ। কনভার্সন অনেকটা ফুটবলের পেনাল্টির মত তবে পার্থক্য এতটুকু যে এখানে বলটা দুই পোস্টের ঠিক মাঝামাঝি না বসিয়ে যেখানে ট্রাই করা হয়েছে সেই বরাবর মাঠের ভেতরে বসানো হয়। ফলে কেউ যদি গোলপোস্ট থেকে দূরে গিয়ে ট্রাই করে, তাহলে কনভার্সনের সময় গোল করা কঠিন হয়ে যায়। কনভার্সনের জন্য দল পায় ২ পয়েন্ট। রাগবীতে পেনাল্টি গোলকে ফুটবলের ফ্রি কিকের সাথে তুলনা করা যায়। যদি কেউ ফাউল করে বা ইচ্ছাকৃত অফসাইড হয় তখন সাধারনত রেফারী পেনাল্টি দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে যেখানে যেখানে অপরাধ সংঘটিত হবে, সেখান থেকে কিক নিয়ে গোল করতে হয়। পেনাল্টি গোলের জন্য বরাদ্দ থাকে ৩ পয়েন্ট। আরেক ধরনের গোল হলো ড্রপ গোল। খেলা চলার সময় কোন খেলোয়াড় চাইলে বল মাটিতে ছুড়ে, বাউন্স করে উপরে ওঠার সময় কিক নিয়েও গোল দিতে পারে। এক্ষেত্রেও ৩ পয়েন্ট পাবে দল। উল্লেখ্য যে কনভার্সন, পেনাল্টি এবং ড্রপ গোলের সময় বল অবশ্যই দুই পোস্টের মাঝ দিয়ে এবং ক্রসবারের উপর দিয়ে যেতে হবে।

এবার আবার ফিরে আসছি খেলার বর্ননায়। সেদিন শুরু থেকেই আয়ারল্যান্ডকে একটু এলোমেলো দেখাচ্ছিল। তাছাড়া ফাউল করার প্রবণতাও আয়ারল্যান্ডের মধ্যে খুব বেশি দেখা যাচ্ছিল। তবে প্রথম দিকে চাপটা আয়ারল্যান্ডই তৈরী করেছিল। এ সময় একটা প্রায় নিশ্চিত ট্রাইয়ের সুযোগ মিস করে বসে আইরিশ দল। যতই ওয়েলসের ভেতরে ঢুকছিল আইরিশরা ততই যেন দুর্গম হয়ে উঠছিল ওয়েলশদের ডিফেন্স। ফলে বারবার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত ব্যার্থ হতে বাধ্য হয় আইরিশরা। নাফিস তখন রীতিমত বিরক্ত। বারবার বলছে এই জায়গা থেকে ট্রাই করতে না পরলে কিছু বলার নাই। এর একটু পরই ধীরেধীরে ওয়েলস জ্বলে উঠতে শুরু করে আর আইরিশরা কেমন যেন ম্রিয়মান হয়ে যায়। ওয়েলসের রবার্তো কার্লস তথা সেটপিস স্পেশিয়ালিস্ট স্টিফেন জোন্স ৩৩ এবং ৩৯ মিনিটে দুটো পেনাল্টি থেকে গোল করে ওয়েলসকে নিয়ে যায় ৬ – ০ লিডে। আমি তখন চিৎকার করছি, ও' গারা কোথায়? ও' গারা হচ্ছে আইরিশ বেকহ্যাম। কনভার্সন, পেনাল্টি কিম্বা ড্রপগোল – তিনটাতেই ও' গারার রয়েছে অসাধারন দক্ষতা। অন্য খেলোয়াড়তের মত ষাড়ের শরীর নেই, কিন্তু রয়েছে পায়ের নিঁখুত নিশানা। আইরিশ দলে ও' গারার মূল কাজই হচ্ছে সেটপিস দিয়ে প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করা। অথচ সেই ও' গারার ঝলকই দেখা যাচ্ছিল না মাঠে। প্রধমার্ধে একটা পেনাল্টি পেয়েছিল আয়ারল্যান্ড যেখান থেকে গোল করা খুবই কঠিন ছিল। ও' গারা তবুও চেষ্টা করেছিল কিন্তু সফল হয়নি সেই প্রয়াশ। আইরিশ বেকহ্যামের ঝলক ওতটুকুই ছিল প্রথমার্ধে। ফলে ০ – ৬ পয়েন্টে পিছিয়ে থেকে আয়ারল্যান্ড বিরতীতে যায়।

বিরতীর সময় টিভির একেবারে প্রথম সারির সিটে, যেখানে একজোড়া কৃষ্ণ কপত-কপতী অসময়ে এবং অস্থানে ডেটিং করছিল, কেটে পড়ে। আমরা দ্রুত সেই সিটগুলো দখল করে আরাম করে বসি। তখন আস্তে আস্তে রেস্টুরেন্টে খেলা দেখার জন্য আসা মানুষের ভীড়ও বাড়তে থাকে। দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই আইরিশ দলকে খানিকটা গোছানো মনে হতে লাগলো। আমি, ধ্রুব এবং নাফিস তখন রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছি ট্রাইয়ের জন্য। বারবার আক্রমন করতে লাগলো আয়ারল্যান্ড আর সাথে চলতে লাগলো আমাদের তুমুল চিৎকার। নাফিস তখন বলেই চলেছে সেই কথা - “এখান থেকে ট্রাই করতে না পারলে....”। চার মিনিট যেতে না যেতেই আইরিশ ক্যাপ্টেন ও' ড্রিসকল বল নিয়ে প্রায় ছুঁয়ে দেয় ওয়েলসের গোল লাইন। কিন্তু ভীড়ের কারনে ঠিক মত বোঝা যায়নি বল আসলে মাটি স্পর্শ করেছে কিনা। অতএব রেফারী স্বীদ্ধান্তের জন্য আমন্ত্রন জানায় টিএমও তথা টেলিভিশন ম্যাচ অফিশিয়ালকে। রাগবীর টিএমও আর ক্রিকেটের থার্ড আম্পায়ার আসলে একই জিনিস। বারবার রিপ্লে দেখে টিএমও শেষ পর্যন্ত জানায় এটা ট্রাই হয়েছে। আর যায় কোথায়! পুরো সুপারম্যাক যেন চিৎকারে ভেঙ্গে পড়লো। ও' ড্রিসকলের ট্রাইয়ের ৫ পয়েন্ট এবং ও' গারার নির্ভুল কনভার্সনের ২ পয়েন্ট মিলে ৭ – ৬ এ তখন আয়ারল্যান্ডের লিড। ওয়েলসের পতাকায় প্রায় পুরো লাল হয়ে থাকা কার্ডিফের মিলেনিয়ম স্টেডিয়ামে তখন চরম নিরবতা।

খেলা ঠিক মত শুরুও হতে পারেনি তখন; আমি ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম – হঠাত্ ধ্রুব চিৎকার দিল, দেখেন দেখেন! তাকিয়ে দেখি ও' গারার চমৎকার পাস প্রায় হাত ফসকে বের হতে হতে ধরে ফেললো জন বোয়ে। তারপর অসাধারন ভাবে ওয়েলসের খেলোয়াড়দের কাটিয়ে সে ঢুকে পড়লো একেবারে ভেতরে। সামনে তখন একজনও খেলোয়াড় নেই তাকে আটকানোর। মাত্র এক মিনিটের ব্যবধানে দুইদুইটা ট্রাই সাথে সফল কনভার্সন আয়ারল্যান্ডকে নিয়ে গেলো ১৪ – ৬ উচ্চতায়।

কিন্তু বড় ব্যবধানে এগিয়ে যাওয়াটা যেন আয়ারল্যান্ডের জন্য কাল হয়ে দাড়ালো। ওয়েলসের স্টিফেন জোন্স ৫১ এবং ৫৬ মিনিটে পেনাল্টি থেকে দুটো গোল করে খেলায় নিয়ে আসলো টানটান উত্তেজনা। ১২ – ১৪ পয়েন্টে তখন ওয়েলস পিছিয়ে আছে। কিন্তু আক্রমনের ধার দেখে মনে হচ্ছিল আরেকটা গোল বা ট্রাই করে ফেলা ওদের জন্য কঠিন কিছু হবে না। আমরা শ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছি কি হয় দেখার জন্য। খেলার বাকি পাঁচ মিনিট। ধ্রুব বারবার বলতে লাগলো বল আউট করে সময়টা পার করে দিলেই হয়। কিন্তু সে সুযোগ আয়ারল্যান্ড পাচ্ছিলই না। ওয়েলসের আক্রমনে ওরা তখন রীতিমত দিশেহারা। নাফিসকে বললাম রাগবীর মত খেলাও যে ফুটবল বা ক্রিকেটের মত উত্তেজনাপূর্ণ হতে পারে সেটা কি আমরা আগে কোন দিন অনুভব করেছি? নাফিস হাসলো। আসলে টেনশনে তখন আমরা ঘামাচ্ছি। কথা বলারও যেন শক্তি নেই। হায়! আমরা কি তখন জানতাম, আমাদের স্নায়ুর আসল পরীক্ষা কেবল শুরু হতে যাচ্ছে তখন!

৮০ মিনিটের খেলার ৪ মিনিট বাকি থাকতে, ৭৬তম মিনিটে ওয়েলসের ফরোয়ার্ডরা তিব্র আক্রমনে থাকা অবস্থায় একটা ট্রাইয়ের সুযোগকে হঠাৎ করে বাদ দিয়ে বল ব্যাকপাস দিয়ে দেয় প্রায় আনমার্কড স্টিফেন জোন্সকে। আইরিশরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই জোন্স বলটা মাটিতে ছুড়ে মারে, তারপর ফিরতি বাউন্সে কিক। চোখের পলকে বল দুই পোস্টের মাঝ দিয়ে গোলে আর এই ড্রপ গোল ওয়েলসকে নিয়ে যায় ১৫ – ১৪ লিডে। প্রায় নিশ্চিত জিতে যাওয়া ম্যাচটা এভাবে একদম শেষ মুহূর্তে এসে হাত ছাড়া হয়ে যাবে, আয়ারল্যান্ড যেন ভাবতেই পারছিল না। বাকরুদ্ধ ধারাভাষ্যকাররাও তখন হতাশ। আর চার মিনিটে কি আয়ারল্যান্ড পারবে খেলায় ফিরে আসতে?

অনেক উৎকন্ঠার মধ্য দিয়ে আবার খেলা শুরু হলো। কিন্তু আয়ারল্যান্ড যেন আর গুছিয়ে উঠতে পারছিল না। ধ্রুবর বলা সেই বুদ্ধিটা, অর্থাৎ লাইন আউট করে সময় পার করে দেয়া, সেটা ওয়েলস তখন পুরোপুরি ব্যবহার করছে। দুই মিনিট কাটিয়ে দিয়েছে ওয়েলস। মনে হচ্ছে এই ম্যাচ তাদেরই হতে যাচ্ছে। এরকম সময়ে একটা ট্রাইয়ের সুযোগ সৃষ্টি হলো আয়ারল্যান্ডের পক্ষে। কিন্তু হঠাৎ ব্যাকপাস! ঠিক যেমনটা ওয়েলস করেছিল। স্ববিস্ময়ে আমরা তাকালাম, কার কাছে গেলো বলটা? মানুষটাকে দেখে সবাই এক সাথে চিৎকার করে উঠলো। পাসটা গিয়ে পড়েছে আইরিশ ব্যাকহাম ও' গারার হাতে।ও' গারা বলটা ধরেই প্রথমে মাটিতে নিক্ষেপ করলো, তারপর কিক। সোজা গোলে। ৭৮ মিনিটে খেলা আবার চলে আসলো আয়ারল্যান্ডের পক্ষে, ১৭ – ১৫। নাফিস তখন আমার পাশে রীতিমত উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে বলছে, "আমি এখনও নিশ্চিত না। আবার কিছু একটা ঘটে যেতে পারে।" আসলেই তাই, এক খেলা শেষ পাঁচ মিনিটে যেভাবে রুপ বদলাচ্ছে। তাতে মনে হচ্ছে টেনশনের চুড়ান্ত পরীক্ষা দিতে বসেছি।

ওয়েলস এমন এক দল যারা যতই পিছিয়ে পড়ুক, বারবার খেলায় ফিরে আসার ক্ষমতা রাখে। দুই মিনিট সময়কেও তারা এমন কার্যকর ভাবে ব্যবহার করলো যে আয়ারল্যান্ড অস্থির হয়ে গেলো এবং আক্রমনের তিব্রতায় এলোমেলো হয়ে ফাউল করে বসলো খেলার ঠিক ৮০ তম মিনিটে। ফলস্বরুপ ওয়েলস পেয়ে গেলো পেনাল্টি, ৪৮ মিটার দূরে কিন্তু ঠিক গোল পোস্টের সামনে থেকে। স্টিফেন জোন্স বীরদর্পে এগিয়ে এসে বল বসালো। চারদিকে তখন আইরিশ কান্নার মাতম। এভাবে স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে, সেটা মেনে নেয়া সত্যি অনেক কষ্টের। আইরিশ চ্যানেলের ধারাভাষ্যকারদের গলাও ধরে এসেছে। দূরত্বটা যদিও একটু বেশি, কিন্তু এখান থেকে গোল মিস হবার প্রশ্নই আসে না। তার উপর মানুষটা যখন স্টিফেন জোন্স; যে কিনা এরকম দূরত্ব কিন্তু আরো জটিল এ্যাঙ্গেল থেকে প্রথমার্ধেই গোল করে তার সামর্থের প্রমান রেখেছিল। যেহেতু নির্ধারিত ৮০ মিনিটের খেলা ততক্ষণে শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাই এই শর্টের পরপরই খেলার সমাপ্তি ঘটবে - অবস্থাটা এরকম।

তারপর জোন্স শর্ট নিল। বল উড়ে গিয়ে দুই পোস্টের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করলো। কিন্তু তাতে আইরিশ শিবিরে কান্নার পরিবর্তে আনন্দের বন্যা শুরু হলো। কেননা বল ঠিকই পোস্টে ঢুকেছে, কিন্তু ক্রসবারের নিচ দিয়ে। ফুটবলে যেমন গোল হয় ক্রসবারের নিচ দিয়ে গেলে - রাগবীতে ঠিক উল্টাটা। গোল হতে হলে ক্রসবারের উপর দিয়ে যেতে হবে। অতএব সারা ম্যাচে হিরো থেকেও শেষ মিনিটে এসে জিরো হয়ে গেলো জোন্স। নিজের কপালে হাত দিয়ে বাড়ি দিয়ে সম্ভবত তারই প্রতিফলন দেখালো সে।

এ জয়ের মধ্য দিয়ে আয়ারল্যান্ড জিতলো ৬১ বছর পর গ্র্যান্ডস্লাম। সেই ১৯৪৮ সনে জেতা আগের গ্র্যান্ডস্লামটার কথা কি এখন আর কারো মনে আছে? যারা সে সময় খেলা দেখার বয়সী ছিলেন, তাদের অনেকেইতো এখন পরপারে! ওদের নুতন প্রজন্মের জন্য তাই এটা ছিল নিতান্তই অন্যরকম এক অনুভুতি।

সুপারম্যাকে আমার চারপাশে তাকিয়ে দেখি রীতিমত আনন্দের বন্যা বইছে। আমি নিজেও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছি। ধ্রুব, নাফিসও উল্লসিত। হঠাৎ দুটো মেয়েকে অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম। ওরা সম্ভবত এশিয়ান কোন ছেলেকে রাগবী নিয়ে এরকম উল্লাস করতে দেখেনি আগে। আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। মনেমনে মোবাইল ফোন কোম্পানীর বিজ্ঞাপনের ভাষায় বললাম, “সেই দিন কি আর আছে? দিন বদলাইছে না?” (সমাপ্ত)

নাম - নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী
নিক - নিয়াজ
মেইল - notredamean এ্যাট gmail ডট com
ওয়েব - http://www.niaz.co.uk


মন্তব্য

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

মাকু-আকৃতির-বল-নিয়ে-খেলা বিষয়ে আপনার ব্যাপক আগ্রহ লক্ষণীয়। এটাই কি আপনার প্রথম লেখা? স্বাগতম। আপনার কয়েকটা মন্তব্য পড়েছি অবশ্য।

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

এর আগে গল্প লিখেছিলাম। ব্লগ বলতে এটাই প্রথম। একটু আগে অতিথি সচল হলাম। আশা করি আগামী কাল নিজের একাউন্ট থেকে প্রথম পোস্টটা দেব। এখানে এখন রাত ৩ টা। তাই আজ আর লিখলাম না।

রাগবী এখন আমার অন্যতম প্রিয় খেলা। চেষ্টা করি নিয়মিত ফলো করতে। হাসি

শুভেচ্ছা রইলো।

এনকিদু এর ছবি

লেখা দারুন লাগল । সচলে স্বাগতম, আরো লিখুন হাসি

হঠাৎ দুটো মেয়েকে অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম। ওরা সম্ভবত এশিয়ান কোন ছেলেকে রাগবী নিয়ে এরকম উল্লাস করতে দেখেনি আগে। আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। মনেমনে মোবাইল ফোন কোম্পানীর বিজ্ঞাপনের ভাষায় বললাম, “সেই দিন কি আর আছে? দিন বদলাইছে না?”

তারপর কী হল ? ফোন নম্বর বিনিময় করলেন ? চোখ টিপি


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

ঠিক সেই মুহূর্তে আইডিয়াটা মাথায় আসে নি। নেক্সট টাইম করবো চোখ টিপি

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

অসাধারন লাগলো পড়তে। পুরো দৃশ্যায়নটা কল্পনা করতে পারছিলাম যেন। চলুক

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা আপনাকে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।