অণু গল্পঃ একটা প্রতিশোধ নেবার স্বপ্ন।

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২০/০৯/২০০৯ - ১:০৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

লেখক:দলছুট।

"সমর" ছোট বেলা থেকেই নির্জনতা পছন্দ করে। ঝামেলাহীন, কোলাহোল মুক্ত পরিবেশ তার যেন চির আপন। তাই একাকী একটা নির্জন ফ্ল্যাটে বসবাস করে। কিছুটা আত্ম কেন্দ্রিক, কারো সাথে মিশে না, আড্ডায় যায় না, খুব একটা কথাও বলে না। । তার বড় বড় দুটি চোখ যেন নির্লিপ্ত, ভাষাহীন, ছায়াহীন ধু-ধু মরুভূমি। নিস্ফলক চোখ যেন সব সময় কিছু একটা খুঁজে বেড়ায়। সব সময় সতর্ক পদচারণা, সাধারণের মাঝেও যেন কোথায় একটা অস্বাভাবিক ভাব থেকে যায়। খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে যে কেউ বুঝতে পারবে। সব সময় নিজেকে সাধারণ থেকে আলাদা করার প্রবণতা। সেই ছোট বেলা থেকে আজ এই ৩৯ বছর বয়সেও একি আচরণ, একি চোখ, একি তৃষ্ণা, একি দৃঢ়তা। নিজের চারপাশে একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করা । সমরকে এই জাগতিক মায়া, মমতা, স্নেহ, আদর, সোহাগ ও ভালবাসা কোনো কিছুই আর টানতে পারে না।

সমরের বয়স তখন এক বছর। বাবা শিপন যুদ্ধে গেছে, মা শিমুল সমর কে নিয়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে নিরাপত্তার আসায়। ১৯৭১ সালের সম্মুখ যুদ্ধে প্রাণ হারায় জন্মদাতা বাবা আর পাকিস্তানী নরপশুরা স্বামী যুদ্ধে গেছে সেই অপরাধে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় স্ত্রী শিমুলকে। পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারে মারা যায় গর্ভধারিণী জননী। বাবা-মা ছাড়া চাচার কাছে বড় হয় সমর। চাচা আর নানার কাছে বাবা আর মায়ের করুন মৃত্যু কাহিনী শুনে শুনে বেড়ে উঠে সমর। যেই সব রাজাকারেরা সমরের মা কে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল সেনা ক্যাম্পে তাদেরকে সমর চিনেছে চাচার মাধ্যমে। চাচা রতন সব সময় বলতো-"চিনে রাখ এই সব নরপশুদের যারা তোর মাকে হত্যা করেছে, বড় হয়ে এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবি, মায়ের সম্মানহানীর বদলা নিবে।" আজ সেই চাচা পরলোকগত কিন্তু সমর চাচার কথা নীরবে হৃদয়ে ধারন করেছে আর সুযোগ খোঁজছে প্রতিশোধ নেবার। সেই প্রতিশোধ স্পৃহা সমরকে ভিতরে ভিতরে অস্থির করে তুলেছে, আর এই অস্থিরতা তাকে সাধারণ জীবন প্রণালী থেকে ধীরে ধীরে দূরে ঢেলে দিয়েছে। বস্তুগত কোন জিনিস এখন আর সমরের মনে রেখাপাত করে না।

সমর নিজেকে তৈরি করে, নিজে নিজে পরিকল্পনা করে। প্রতিশোধ নেবার লালিত স্বপ্নটাকে পরিচর্যার মাধ্যমে দিনে দিনে সযত্নে বড় করে । নিজেকে দৃত প্রত্যয়ে তৈরি করে শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য। সব চেয়ে বড় শক্তি তার মনের মধ্যে বেড়ে উঠা প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ নেয়ার প্রতিজ্ঞা।

সমর ছোট বেলা থেকে দেখে আসছে এক শ্রেণী স্বার্থপর, ক্ষমতা লোভী, রাজনৈতিক নেতাদের কারণে স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তি, হানাদার, পাকিস্তানীদের দোসর, রাজাকাররা বারবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে। নির্বাচনে জয়ী হয়ে পবিত্র সংসদের সদস্য হয়েছে। এই দেশের জনগণ আবার তাদের সম্মানের সহিত বরণ করে, সংবর্ধনার আয়োজন করে।

আজ সেই রকম এক রাজাকার এমপির সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। সজ্জিত মঞ্চ, সংবর্ধনা দেয়ার বিশাল আয়োজন। একজন রাজাকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবার পর প্রথম এলাকায় আসছেন জনগণের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে, আর বেকুব জনগণ তাকে বরণ করে নেয়ার জন্য, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য আয়োজন করেছে সংবর্ধনা সভার। সেখানে নাকি বিশেষ অতিথি হিসাবে একজন জ্ঞানপাপী, সুবিধাবাদী, নির্লজ্জ মুক্তিযোদ্ধা থাকবে। বিশাল খোলা মাঠে হাজার হাজার মানুষ একজন রাজাকারের গলায় মালা দেবে, স্বর্ণের প্রতীক উপহার দিবে। সমর মনে মনে বেছে নেই আজ সেই মোক্ষম দিন, প্রতিশোধ নেবার মাহেন্দ্রক্ষণ।

সমর কয়দিন ধরে এলাকার নুতন প্রজন্মদের নিয়ে গোপনে সভা করছে। এমপির জনসভা প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাজাকারদের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। আঘাত এলে প্রতিরোধ করার রসদ যোগাচ্ছে। এমপির অতীত ইতিহাস তুলে ধরে লিফলেট বিলি করছে। সে নীরবে তার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নূতন প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পেয়ে সমর আজ উদ্বুদ্ধ। প্রতিশোধ নেবার চেতনায় সংগঠিত।

বিকাল চারটা জনসভা শুরু হবার পূর্বক্ষণ। মাননীয় সংসদ্ সদস্য মঞ্চে আসছেন। দুইধারে মানুষ দাঁড়িয়ে তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানোর জন্য মহা ব্যস্ত, অবুঝ বাচ্চারা, কিছু স্বার্থপর মানুষের হীন স্বার্থ চরিতার্থে পুষ্প বৃষ্টি ঝরানোর জন্য তৈরি। এই উৎসুক জনতার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সমর। তার সাথে আছে একঝাক তরুন। সবাই প্রতিবাদ জানানোর জন্য মুখে কালো কাপড় বেঁধে আছে। সমরের কোমরে গুজা রিভলবার। দুচোখে প্রতিহিংসার অগ্নি বৃষ্টি। হাস্যোজ্জল চেহারায় এগিয়ে আসছেন মঞ্চের দিকে এমপি সাহেব। নিজেদের প্রস্তুত করে নিল সমর। আজ এমপিকে অপমান করে সংবর্ধনা জানাবে। নূতন প্রজন্ম তাঁকে ধ্বিক্কার জানাবে। প্রয়োজনে আজ সে তার মার খুনীকে মৃত্যু দিয়ে সংবর্ধনা জানাবে। সমররা সংঘবদ্ধ হয়েছে মঞ্চের এক পাশে। এমপি এগিয়ে আসছে, এমপির ডান পাশে মুক্তিযোদ্ধা শমসের আলী, বাম পাশে এলাকার কুখ্যাত খুনী , সন্ত্রাসী কুত্তা মুনিম। এমপি দৃঢ় পায়ে এগিয়ে আসছে মঞ্চের দিকে, বাচ্চারা ফুল ছিটাচ্ছে, হ্যাঁ এটাই মোক্ষম সময়। “এমপির আগমন মানি না” বলে শ্লোগান দেয়ার উপযুক্ত সময়। প্রতিশোধ নেবার সুযোগ। যে সুযোগের জন্য সমর অপেক্ষা করছে অনেকদিন ধরে। পকেট থেকে গ্রেনেড বের করে সমর। নিজের দলের তরুনদের শ্লোগান দিতে বলে। সে নিজেকে একটু আড়ালে নিয়ে যায়। প্রস্তুতি নেয় গ্রেনেড ছুঁড়ে মারার, একটা বাচ্চা এমপিকে ফুলের তোড়া দিতে কাছে আসে। বাচ্চাটাকে দেখে সমর থেমে যায়। এমপি সাহেব ফুলের তোড়াটা নিয়ে পাশের একজনের হাতে তুলে দেয়। বাচ্চারা পেছনে পরে গেছে, হ্যাঁ এটাই সময়, সবাই শ্লোগান দিচ্ছে-“রাজাকারের আগমন, মানি না। রাজাকারের বিচার করতে হবে।” পুলিস মিছিল ভঙ্গ করার জন্য লাঠি চার্জ শুরু করছে, এমপি সাহেব সমরে কাছে চলে আসছে, সমর আবার পকেটে হাত দেয়, সাবধানে গ্রেনেডটা হাতে নেয়, ছুঁড়ে মারবে, পেছন থেকে কার ডাক শুনে যেন থেমে যায় ।

দরজায় ধরাম ধরাম শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল সমরের। জেগেই দেখে ঘামে ভিজে গেছে, কিছু বুঝে উঠার আগেই আবার দরজায় শব্দ। অপরিচিত এক কণ্ঠ বলল-"সমর সাহেব দরজা খুলুন, তানাহলে আমরা দরজা ভেঙ্গে ঢুকতে বাধ্য হব।" সমর কি করবে বুঝতে পারছিল না। সে ঘুম কাতর কণ্ঠে বলল-"একটু অপেক্ষা করুন, খুলছি।" সমর বালিশের নিচ থেকে রিভলবারটা কোমরে গুজে নিল। টি-শার্ট পড়ে চোখ ঢলতে ঢলতে দরজায় এলো। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখল, পুলিস। ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। কি করবে ভাবতে লাগল। পুলিস দলের নেতৃত্বদানকারী অফিসার আবার বলল-"সমর সাহেব আমরা কিন্তু এবার দরজা ভাঙতে বাধ্য হব। " সমর ঝট্পট্ নিজেকে সাম্লে নিয়ে বলল-" খুলছি"।

পুলিস দল ঘরে ঢুকেই বলল-" সমর সাহেব আমরা গোপন সূত্রে খবর পেলাম আপনার বাসায় অনেক গ্রেনেড এবং বিস্ফোরক দ্রব্য আছে। আমরা সার্চ করতে চাই।" সমর পুলিস অফিসার কে বলল-"ভালো, আপনারা সার্চ করুন আমার কোন আপত্তি নেই।" বলে কোমর থেকে রিভলবারটা বের করে দিয়ে বলল-"এটা আমার লাইসেন্সকৃত, এছাড়া আপনারা যদি অন্যকিছু পান দেখতে পারেন। "

পুলিস দল সারা বাসা তন্ন তন্ন করে খোঁজে অবৈধ কিছুই পেল না। টানা তিন ঘণ্টা সার্চ করার পর পুলিস দল হতাশ হয়ে বলল-"সমর সাহেব আমরা অত্যন্ত দুঃখিত। আসলে জানেন তো উচ্চ পর্যায়ে নির্দেশে আমাদের কর্তব্য পালন করতে হয়।" সমর ধন্যবাদ দিয়ে পুলিস অফিসারের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। পুলিস অফিসার হ্যান্ডশ্যাক করার জন্য হাত বাড়াতেই পকেটের মোবাইল বেজে উঠল।, অফিসার এক্সকিউজ মি বলে ফোনটা রিসিভ করল। ওপাশ থেকে কি বলল বুঝা গেল না, পুলিস অফিসার শুধুমাত্র হ্যাঁ হ্যাঁ বলে যাচ্ছিল। ফোন কেটে পুলিস অফিসার সমরকে বলল-"সমর সাহেব আমি আন্তরিক দুঃখিত, আপনাকে আমার সাথে থানায় যেতে হবে।" সমর জানতে চাইল-"কেন? আমার বিরুদ্ধে কোন ওয়ারেন্ট?" পুলিস অফিসার আমতা আমতা করে বলল-"আগামীকালের এমপি সাহেবের সংবর্ধনা সভায় নাশকতা করতে পারেন এই সন্দেহে আপনাকে গ্রেফতার করা হল।"

আইন কর্তা ব্যক্তিদের নির্দেশে চলে এটা সমরের জানা। একটু আগে দেখা নিজের স্বপ্নটা ভেবে মৃদু হাসল। অগত্যা পুলিস অফিসারকে বলল-"আমি কি পাঁচ মিনিট সময় পেতে পারি? একটু ফ্রেস হব।" পুলিস অফিসার সদয় ভাব দেখিয়ে বললেন- "ঠিক আছে, তবে কোন চালাকি করার চেষ্টা করবেন না, পুলিস সারা বাড়ি ঘিরে আছে।"

সমর ভিতর রুমে গেল, মোবাইলটা নিয়ে ম্যানেজারকে ব্যাপারটা জানিয়ে একটা সর্ট এসএমএস পাঠিয়ে ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়, পোষাক পরিবর্তন করে বসার রুমে এসে-"চলুন অফিসার"।

সমর পুলিসের সাথে রাতের আঁধারে ছুটে চলে থানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠের দিকে। প্রতিশোধের স্বপ্নটা চোখের ভিতর রক্তক্ষরণ ঘটায়, চোখ বেয়ে নেমে আসে দু’ফোটা অশ্রু। ভেঙ্গে পড়ে না, নূতন স্বপের আশায় বুক বাঁধে, অপেক্ষা করে সোনালী ভোরের। স্বপ্ন দেখে সেদিনের যেদিন রাজাকারের বিচার হবে।
======


মন্তব্য

মৃত্তিকা এর ছবি

গল্পের থীমটা ভালো লাগলো। আরেকটু সময় নিয়ে লিখলে মনে হয় আরও ভালো হতো।
ঈদের শুভেচ্ছা।

অতিথি লেখক এর ছবি

যারা পড়েছেন সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
প্রিয় পাঠক লেখা সম্পর্কে আপনাদের মতামত, সমালোচনা, নির্দেশনা পেলে খুশি হব। আশা করি কষ্ট করে দুই লাইন লিখে মনের ভাবটা জানাবেন। পক্ষে-বিপক্ষে যেটা হোক। আপনাদের মন্তব্য আমার জন্য আশীর্বাদ।

দলছুট।
==============
বন্ধু হব যদি হাত বাড়াও।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। আপনার মতামতের জন্য। লেখা বড় হয়ে যায় ভেবে একটু ছোট করে লেখার চেষ্টা করেছিলাম। মূল বক্তব্যটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
দলছুট।
=========
বন্ধু হব যদি হাত বাড়াও।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভালো লাগলো গল্পটা
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

নজরুল ভাই ঈদ মুবারক।

আপনার ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগল। আমি আপনার মতামতের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমার "একটা শর্ট মেসেজ" গল্পটা পড়েন, আশা করি আপনার আরো ভালো লাগবে। ধন্যবাদ।

আমি আপনার সমালোচনা আশা করছিলাম। ভুল গুলো ধরিয়ে দিলে বেশি খুশি হ্তাম। আপনি আমাকে যেভাবে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, তা আমি ভুলবো না। আপনার অনুপ্রেরণা পেয়েই আমি এখনো লিখি। ভালো করার চেষ্টা করি।

ধন্যবাদ।

দলছুট।
=============
বন্ধু হব যদি হাত বাড়াও।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।