গোল পাচিলের আশ্রিত পুকুর

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ১১/১১/২০০৯ - ১০:৩৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সেতু গ্লাভসের মত লাল নকশার এক জোড়া আল্পনা পরেছে দুই হাতে, সঙ্গে এক থোকা মানানসই লাল চুড়ি। মেহেদীর রঙ-সর্বস্ব প্রলেপের নিচে তার চামড়া কতোখানি মসৃণ ভাবতে থাকেন রেদওয়ান সাহেব। সেতুর চুলগুলো বাতাসে এদিক সেদিক উড়ছে, টানটান বাতাসে নৌকার পালের মত। রিক্সায় বসেও রেদওয়ান সাহেব সেই ছৈয়ের দোল খেতে থাকেন। রেদওয়ান সাহেবের চোখ, সেতুর চুলের লতাগুলো বেয়ে নিচে নামতে থাকে। অনেকটা নেমে কানের লম্বা দুল ছাড়িয়ে চুলের গোড়া যেখানে ঢেকেছে পিঠের দুই একটা তিল, সেখানে চামড়াটা অনেক নবিন। সেতুও বটে।

রেদওয়ান সাহেব দীর্ঘশ্বাসের অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড গুম করে ফেলেন নিঃশব্দে। সেতু পাশে বসে কিছুই টের পায়না। তার থেকে বয়সে পনের বছর বড়োই হবেন রেজওয়ান সাহেব। এই দুই ফিতা ঝুটির মেয়েটাকে তিনি বিয়ে করতে নিয়ে যাচ্ছেন, ভাবতেই অবাক লাগে! অফিসের ফাঁকে ফাঁকে এ কেমন ঘোরের খেলায় তিনি মেতেছেন! ন্যায় অন্যায়ের প্রশ্ন নয় বরং তার মধ্যে ভীষণ একটা বিষ্ময় কাজ করছে- হচ্ছেটা কী?

ঘড়ির কাটা অনেকটাই অলস। বার বার ঘড়ি দেখছেন রেদওয়ান সাহেব। বারোতলা বাড়ির উপরে- আকাশ দিয়ে পাখির মত উড়ন্ত একটা অতীত তার মনোযোগ কেড়ে নিয়ে যায়। তিনি এখন অতীতের কোন স্তরে বুঝে উঠতে কিছুটা সময় কেটে যায়। ঐতো তার স্ত্রী রিমা সূঁচে সুতা ঢোকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে মুখটাকে যাচ্ছেতাই অসহায় বানিয়ে বসে আছে! ওই অসহায়ত্ব এতো মায়া লাগানিয়া যে হৃদয়ের গভীরে গিয়ে বিধে যায়! রিমার বয়স তখন কতোই বা হবে, খুব জোর তেইশ! ওই মায়া লাগানিয়া আর ওভাবে টানে না কেনো? অতীত থেকে ছিটকে আছড়ে পড়েন আবার সেই রিক্সায়, সেতুর গা ঘেঁষা এক নিরন্তর দূরত্বে, এক আশ্চর্য বাস্তবে! তিনি ডানে বামে তাকান। সব মুখগুলো নির্লিপ্ত মনে হচ্ছে। রিমার সাথে তার বিবাদ হয়নি কখনো, তাদের বিচ্ছেদও হয়নি, তাহলে এই মেয়ের সাথে তিনি একই রিক্সায় কেনো? নারীর শরীরের কোন রেখা কোথায় কীভাবে বেঁকেছে সবই তো তার জানা। কীসের লোভ তবে, নাকি ক্লান্তি? জীবনের কোনো এক পর্যায়ে সবাই কি ক্লান্ত হয়ে যায়? হাফ ছেড়ে বাঁচতে চায়? রিক্সার চাকা গড়াচ্ছে, সাথে সমস্ত পৃথিবীও। রাস্তায় বিরাট কটকটে লাল বাতি, রিক্সা থেমে গেছে, তবু গড়াচ্ছে রেদওয়ান সাহেবের বিভ্রান্ত মনোযোগ।

রিমা কথা বলতে বলতে হঠাৎ অন্যমনষ্ক হয়ে যেতো, ও কী ভাবতো কে জানে! কোনোদিন জানতেও ইচ্ছে হয়নি। রিমা এখন কী করছে? ও কি এখন বারান্দায় কাপড় মেলছে? নাকি আয়নার সামনে বসে লুকিয়ে টিপগুলো ট্রায়াল দিয়ে দেখছে, সেই কপালে হয়তো উঠছে কতোই না রঙ্গিন চাঁদ! হয়তো রিমা এখন কিছুই করছে না। ভাবছে। হয়তো তারা একই ভাবনায়। ফোনে কথোপকথনের মতো!
“রিমা, তুমি কি শুনছো!”
“হুঁ!”
“কী করছো?”
“মেঘেদের পিঠ চুলকে দিচ্ছি।”
“হা হা, হেমন্তে মেঘ পেলে কই?”
“এতোদিন যতো মেঘ লুকিয়ে রেখেছিলাম, সেগুলো দিয়ে কাজল বানিয়েছি। আজ খুব করে সাজব। তারপর সেই কাজল চোখে মাখবো। সেই বৃষ্টি আজ আর ভেজাবে না তোমার প্যান্ট, শার্ট, কোটপিন। তোমার হাতে এখন দেয়ালের মতো কোনো আমব্রেলা।”
“কী যা তা বলছো!”
কিছুক্ষণ নীরবতার পর। রেদওয়ান সাহেব আবার টেলিপ্যাথির স্পিকার দিয়ে ঝড়ো কম্পনের তরঙ্গ ছুঁড়ে দেন, “শুনছো?”
না, ওপাশে কেউ নেই।
আচমকাই রেদওয়ান সাহেব রিক্সাওয়ালাকে বলেন, “রিক্সা থামাও।”
সেতু, “আরে কই যাও? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো?”

রেদওয়ান সাহেব কিছু না বলেই অদ্ভূত এক প্রাণ শক্তিতে রিক্সা থেকে নেমে দৌড়াতে লাগলেন। কেন দৌড়াচ্ছেন তিনি যানেন না। অনেক বার ভাবলেন, দৌড়ে কোথায় যাবেন। মাথাটা পুরা ফাঁকা লাগছে। দৌড়াচ্ছেন। যেন কতোদিনের গেছো জড়তা ভাঙ্গল আজ। রাস্তার সব আগ্রহী উৎসুক চোখগুলো বাতাসের ঘনত্ব যেন আরও অনেক বাড়িয়ে দিল। তিনি তাও প্রাণপণ দৌড়াচ্ছেন। অনেক দিন পর হুলস্থুল ভালো লাগছে তার। যদিও নিঃশ্বাস নেতিয়ে পরছিল, তবুও এ দৌড় যে থামার জন্য না। সেগুনবাগিচার নিরিবিলি গলির ভেতরে ঢুকে যেখন নিজের বাড়ির সামনে এসে পৌছলনে। রিমা তখন বারান্দায় বসে জলপাইয়ের আচার খাচ্ছিল। অনেক অনেক দিন, হয়ত কয়েক লক্ষ শহস্র বছর পর রিমাকে দেখে সেই প্রথমবারের মত তার হৃদপিন্ড কামড়ে ধরল এক আবেগী হাঙ্গর!

যদিও একটা পাখি প্রতিদিনের মত তারের উপর বসেছিল সামনের বাড়ির দোতলার বারান্দার লেবু গাছের টবটার দিকে মুখ করে, যদিও একটা ভ্যানওয়ালা বিড়ি টানছিল অভ্যাসজনিত কারণে, যদিও একটা পাতা ঝড়েছিল স্বাভাবিক বাতাসে- তবু রেদওয়ান সাহেবের কাছে দিনটাকে একদম অন্যরকম মনে হল। মনে হল হঠাৎ করে কেউ চুপিচুপি ম্যাজিক দিয়ে তাকে অন্য কোন পৃথিবীতে নিয়ে এসেছে। তিনি ধরা গলায় চেঁচিয়ে উঠেন, “রিমা শুনছ?”

রিমা কিছুটা বিরক্ত নিয়েই দায়সাড়া উঁকি দেয় বারান্দার জং ধরা দুটি রেলিঙ্গের ফাঁক দিয়ে। নিচে তার স্বামীর সারা শরীর বেয়ে জবজব করে ঝড়ছে ঘাম, সার্টের উপরের বুতাম খোলা আর ফুঁপিয়ে কাঁদছেন রেজওয়ান সাহেব। রিমা দৌড়ে নিচে নেমে আসে। তার এক পায়ে স্যান্ডেল আরেক পার নগ্নতা রাস্তার খুদে ময়লাগুলো তোয়াক্কা না করেই দৌড়াচ্ছে। রিমা এসে রেদওয়ান সাহেবকে জড়িয়ে ধরেন। রিমা ফুঁপিয়ে বলেন, “তোমার কী হয়েছে?”
“রিমা আমার কোন আম্ব্রেলা নাই।”
“কী বলছ যা তা!”
রেদওয়ান সাহেব কিছু না বলেই রিমাকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। জল গড়াচ্ছে তার চিবুকের বাঁক ঘেঁষে, ধূলোগুলো জলের পথ চেয়ে আছে কাদা হবে বলে। অদ্ভূত মায়ালাগানিয়া এই প্রাচীন সঞ্চয়ের জল। সে জল ভেঙ্গে দিয়েছে এতোদিনকার গাম্ভীর্যের প্রতিরোধ।

রিমা খেয়ালও করেননি কখন তার ডান হাতের আঙ্গুলের জল্পাইয়ের আঁচারের তেলে মাখামাখি হয়ে গেছে রেদওয়ান সাহেবের সার্ট। কী অদ্ভূত সুন্দর ভালবাসার এইসব ছিটে ফোঁটা দাগ! রেদওয়ান সাহেব ভাবেন এতোদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল এইসব দাগ, চোখেই পড়েনি!


মন্তব্য

নিবিড় এর ছবি

গল্পটা ভাল লাগল চলুক তবে লেখকের নামটা জানতে পারলে আর ভাল লাগত। আশা করি মন্তব্যে নিকটা জানাবেন


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

স্নিগ্ধা এর ছবি

অদ্ভূত মায়ালাগানিয়া এই প্রাচীন সঞ্চয়ের জল।

"প্রাচীণ সঞ্চয়ের জল" কথাটা খুব সুন্দর লাগলো! কথাটা সত্যিও, খুব!

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

এই কাহিনীটা যদি ১০ জনকে লেখককে জানান হত এবং তারপরে যদি সবাই গল্পটা লিখে এখানে জমা দিত, আমি বলতাম আপনারটাই সেরা হয়েছে!

খুব সাধারন প্লটের অসম্ভব ভাল একটা গল্প। ভাল থাকুন।
কিন্তু আপনাকে চিনলাম না। নামটা জানিয়েন হাসি

নুহিন এর ছবি

ভাবলাম এখন থেকে আবার অতিথি লেখক হিসেবেই লিখব। আমার নামটা অতটা জরুরী মনে হয়নি বলেই নাম দেই নাই। ভবিষ্যতেও হয়ত নাম ছাড়াই লিখব।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

নানা ধরণের কাব্যি উপমায় সন্দেহ হয়েছিলো এটা একজন কবির লেখা গল্প...

সে সন্দেহের নিরসন ঘটলো নুহিন ...

______________________________________________________

মধ্যরাতের কী-বোর্ড চালক

মৃত্তিকা এর ছবি

ভালো লাগলো গল্প।

অতিথি লেখক এর ছবি

একটা মায়াজাগানিয়া গল্প পড়লাম। তারা দেবার ক্ষমতা নাই, থাকলে দাগিয়ে ঘুমুতে যেতাম।

স্বপ্নদ্রোহ

অতিথি লেখক এর ছবি

পুরোনো গন্তব্যে অসীম ভালবাসায় আবারো ফিরে যাওয়া! দারুণ লাগলো....*তিথীডোর

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুণ লাগলো....

বইখাতা এর ছবি

চমৎকার।

রানা মেহের এর ছবি

ভালো লাগলো
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

হরেকৃষ্ন এর ছবি

[কী অদ্ভূত সুন্দর ভালবাসার এইসব ছিটে ফোঁটা দাগ!]

চমৎকার ব্যান্জন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।