"বিজয় এসেছিল রক্তের স্রোতে ১৬ই ডিসেম্বর।”

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ১১/১২/২০০৯ - ২:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঘুট্ঘুটে অন্ধকার রাত। ঝিঁঝি পোকার বিরামহীন শব্দের সাথে দূর থেকে শিয়ালের হাঁক শুনা যাচ্ছে। এর সাথে দূর থেকে ভেসে আসছে ক্ষণে ক্ষণে গুলির শব্দ। নীরব, নিস্তব্ধ পরিবেশ। এইরকম একটা প্রতিকূল অবস্থার সাথে যোগ হয়েছে সারাদিন গ্রামের লোকের মুখে মুখে ফিসফিসানির ভয়- "পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী দুই গ্রাম পরে বড় গঞ্জে সেনাক্যাম্প করেছে, এইবার কী যে হয়!" একটা অজানা আতঙ্ক চারিদিক্ থেকে মানুষকে অক্টোপাসের মত ঘিরে আছে। তবু শঙ্কিত মানুষের জীবন থেমে নেই।

টিনের ছোট্ট দোচালা ঘরে হারিকেনের টিমটিমে আলোতে খাটের ঠিক মাঝ খানে লাল টুকটুকে শাড়ি পরিধান করে বড় একটা ঘোমটা দিয়ে বসে আছে লিমা। নিশ্চুপ, যেন জীবন্ত একটা মূর্তি। ফুলদানীতে রাখা ফুল যেমন আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ে, ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে মলিন হয়ে যায়, সজীবতা হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে, লিমাকে এখন ঠিক তেমন মনে হচ্ছে। কোন দিকে তাকাচ্ছে না, দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে খাটের চাদরে।

অস্থির মনে ঘরের ভেতর পায়চারি করছে মামুন। ঘরের এপাশ থেকে ওপাশে যাওয়ার সময় মামুনের ছায়া খাটের উপর পড়ায় লিমা একটু নড়ে বসে। ঘোমটা টেনে আরেকটু বড় করে। মামুন খেয়াল করে না। সে নিবিষ্ট মনে পায়চারি করতে থাকে। একটু আগে প্রতিবেশীদের মৃদু আওয়াজ শোনা গিয়েছিল,এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা নিয়ে সবাই হয়তো ঘুমিয়ে গেছে, নয়তবা ঘুমের ভান করে চুপটি মেরে শুয়ে আছে। রাত বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে মামুনের মনের অস্থিরতা। বাবা-মার জোরাজুরিতে সন্ধ্যায় লিমাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার পর থেকে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে যায়।

লিমাকে মামুন পছন্দ করত, তাদের মধ্যে মন দেয়া-নেয়া চলছিল কয়েক মাস ধরে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলেই লিমার টানে গ্রামে চলে আসত মামুন। লিমা তখন কলেজের ছাত্রী। ব্যাপারটা সবাই জেনে যাওয়ায় মামুন বিয়ের আয়োজনে বাধা দিতে পারেনি। প্রথমে দ্বিমত জানিয়েছিল, দেশের পরিস্থিতির কথা বলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল, ভেবেছিল দেশটাকে স্বাধীন করে তবে বিয়ে করবে। পরিবেশ, পরিস্থিতি সেটা হতে দিল না। কিন্তু মনের মধ্যে দেশকে মুক্ত করার বাসনা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর স্পৃহা থেমে থাকল না। তাই কী করবে স্থির করতে পারছিল না। লিমার সান্নিধ্য, ভালোবাসা যেমন প্রবল ভাবে কাছে টানছে, তেমনি দেশ প্রেম আর বর্বর পাকস্তানিদের নির্মম অত্যাচার তাঁকে ডাকছে যুদ্ধক্ষেত্রে। প্রতিশোধ আর প্রতিহিংসা তাঁকে হাতছানি দিচ্ছে। ভালোবাসা আর দেশের প্রতি কর্তব্যবোধের মাঝ খানে দাঁড়িয়ে মামুন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বিবাহের প্রথম রাতটা সব নারী-পুরুষের জন্যই স্বপ্নের এবং রোমাঞ্চের। অনেক রহস্য অনাবৃত করার রহস্যময়তায় ভরা রাত।

সকালেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে আজ তাঁরা কয়েক জন গাঁ ছাড়বে, দেশকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধে যাবে। বর্বর পাকিস্তানিদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেশকে মুক্ত করবে। মা, বোন, বাবার চোখের মাঝে ঘাপটি মেরে বসে থাকা আতঙ্ককে জয় করে নিয়ে আসবে সুখ আর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। সবাই মিলে ঠিক করেছিল রাত ১২টার দিকে বের হবে, যোগ দিবে মুক্তি বাহিনীতে। তাঁরা সবাই জানে তাঁদের গ্রাম থেকে দশ মাইল দূরে একটা মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্প আছে, সেখানে যোগ দিবে। সব কিছু ব্যবস্থা করে এসেছে সালাম। কোন পথ দিয়ে যেতে হবে সেটাও তাঁরা ঠিক করে রেখেছে। কিন্তু এখন কী করবে মামুন সেই নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত।

মামুনদের গ্রামের দুই গ্রাম পরে বড় গঞ্জে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প, অত্যাচারের ভয়ে আতঙ্কিত গ্রামবাসী। এই দেশের কিছু পাষণ্ড, হারামী বাচ্চাদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রামকে গ্রাম টহল দিচ্ছে আর যুবকদের ধরে নিয়ে অত্যাচার করছে। কোন বাড়ির যুবকের খোঁজ না পেলে বাবা-মা, ভাই-বোন ও আত্মীয়স্বজনের ওপর চলে অমানবিক নির্যাতন। এই হারামীদের দলনেতা হলো গঞ্জের মসজিদের ইমাম কাদের মোল্লা। হিন্দু পরিবার গুলো ইতিমধ্যে গ্রাম ছাড়া হয়ে গেছে। বেশ কিছু বাড়ির লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় ছুটছে আত্মীয়দের বাড়ি। মামুনদের পাশের বাড়ির সবাই চলে গেছে মুন্সীগঞ্জে নানা বাড়িতে। যাওয়ার সময় ওদের যেতে বলেছিল, কিন্তু মামুনের বাবা যেতে রাজী হয়নি। যে কয়টি বাড়ির লোকেরা এখনো আছে তাঁরা সবাই সব সময় আতঙ্কে থাকে, এই বুঝি মিলিটারি বাহিনী এসে আগুন লাগিয়ে দিল, মানুষকে গুলি করে হত্যা করল। নানান দুশ্চিন্তায় স্বাভাবিক জীবন যাত্রা থমকে থাকে।

দরজায় হালকা একটা টোকার শব্দে আতঙ্কে লিমার শরীর কেঁপে উঠে। ঘোমটা টেনে একটু ছোট করে মামুনের দিকে তাকায়। চোখে -মুখে অজানা ভয়, নীরব চোখ দুটিতে অনেক জিজ্ঞাসা। মামুন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর খাটে এসে লিমার পাশে বসল। "ভয় নেই, সালাম ভাই এসেছে।" লিমা সরে এসে মামুনের হাত ধরল। অপলক চোখে মামুনের দিকে চেয়ে রইল। মামুন লিমার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে চোখের দিকে তাকাল। লিমার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। মামুন হাত দিয়ে মুছে দিয়ে বলল-"আমি তোমার মত অসংখ্য মা-বাবা, ভাই বোনের চোখের অশ্রু মুছে দিতে চাই, তুমি কী আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিবে?"

লিমা মামুনের হাত ছেড়ে দিল। নিজের হাতে চোখের অশ্রু মুছে খাট থেমে নেমে এলো। মামুন অবাক্ হয়ে লিমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আস্তে করে হারিকেনের আলো কমিয়ে দরজা খোলে দিয়ে বলল-"যাও, আমি হাতে মেহেদি নিয়ে লাল শাড়ি পরে তোমার অপেক্ষায় থাকব।" মামুন উঠে এসে লিমাকে জরিয়ে ধরল। "মামুন তাড়াতাড়ি করো।" ফিসফিস গলায় ডাক দিল সালাম। মামুন লিমাকে খাটে বসিয়ে, কপালে একটু আদর দিয়ে বলল-"বেঁচে থাকলে দেখা হবে, মা-বাবাকে দেখে রেখো, আমি সময় ও সুযোগ পেলে পত্র দিব।" লিমা খাট থেকে উঠে মামুনকে জরিয়ে ধরল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল-"তুমি ভালো থেকো, তুমি স্বাধীনতা নিয়ে আসলে আমরা স্বাধীন দেশে আবার বাসর সাজাবো।" বাইরে থেকে সালাম আবার একটা কাশি দিল।

অন্ধকারে মেঠো পথ ধরে হাঁটছে পাঁচ জন মামুন, সালাম, সিরাজ, মিন্টু ও সেলিম। কেউ কোন কথা বলছে না। গাঁয়ের মেঠো পথ পেরিয়ে পাকা সড়কে উঠতেই দেখে পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনীর জীপ আসছে। তাঁরা সবাই রাস্তা থেকে নেমে একটা ঝোপের আড়ালে চলে এলো। অক্টোবরের শেষের দিক। হালকা ঠাণ্ডা পড়েছে। কিছু কুয়াশাও পড়ছে মনে হয়। গাড়ি যতই সামনে আসছে আলোটা ততই ছড়াতে থাকল। মামুনের কাছে মনে হল গাড়ির আলোতে তাঁদের দেখে ফেলবে। কী করবে, সবাই জড়াজড়ি হয়ে বসে পড়ল। মিলিটারি জীপটা তাদের কাছাকাছি এসে গতি কমিয়ে দিল। পাঁচজন ভয়ে কুঁচকে গেল। অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখছিল না, সবাই নিথর। নিজেদের আড়াল করার জন্য নিশ্চুপ। জীপের হেড লাইটের আলো কিছুটা ঝোপের মধ্যে এসেছে পড়েছে। জীপটা ঝোপের কাছ থেকে একটু দূরে থামল, আট-দশজন মিলিটারি জীপ থেকে নেমে এল। ঝোপের দিকে আসতে গিয়েও এলো না। খোলা জায়গায় প্রাকৃতিক কাজ করে আবার চলে গেল। সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচল।

লিমা সারা রাত ঘুমাতে পারল না। ভোরে আজান শোনার সাথে সাথেই উঠে পড়ল। শাড়ি পাল্টিয়ে কাপড় পড়ল। চাপকল পাড়ে গিয়ে ওঁজু করে এসে নামাজ আদায় করল। আল্লাহর কাছে মামুনসহ সবার মঙ্গল কামনা করে প্রার্থনা করল।

গাছে গাছে পাখিদের কলতান, কুয়াশা সরিয়ে সূর্য মামা উঁকি দিচ্ছে। গ্রামের মরুব্বীরা নামাজ আদায় করে মসজিদ থেকে ফিরছে। লিমা জানালা খোলে বাড়ির পাশের রাস্তায় দূরে চেয়ে আছে। মুরুব্বীরা কি যেন কানাঘুষা করছে। লিমা শুনতে পারছে না। সবার মাঝে একটা আতঙ্ক। কারো মুখে হাসি নেই, হাঁটায় গতি নেই, তবু হাঁটছে। যে যার বাড়িতে চলে যাচ্ছে। কেউ কাউকে কিছু বলছে না। লিমা জানালা দিয়ে সব লক্ষ্য করল।

লিমার শ্বশুর মমতাজ সাহেব নামাজ শেষ করে বাড়ির উঠানে এসে দেখে মামুনের ঘরের দরজা খোলা। ছেলে কাল বিয়ে করেছে, আজ এত সকালে ঘরের দরজা খোলা, মনের মাঝে খটকা লাগল। মমতাজ সাহেব কী করবেন, কিছুক্ষণ ভেবে ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে "বউ মা" বলে একটা ডাক দিলেন। লিমা প্রথম ডাক শুনতে পায়নি। মমতাজ সাহেব আবার ডাকলেন, লিমা এইবার শ্বশুরের ডাক শুনে তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে এসে দরজায় দাঁড়াল। "বাবা আমাকে ডাকছেন?" দরজার চৌকাঠে হাত রেখে বলল। মমতাজ সাহেব কথার উত্তর না দিয়ে লিমার দিকে চেয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। সাধারণ কাপড়ে দেখে মমতাজ সাহেব একটু ধাক্কা খেলেন। সাত-পাঁচ না ভেবে বললেন-"মামুন কোথায়?" শ্বশুরের এই প্রশ্নের জন্য লিমা তৈরি ছিল। ঘর থেকে বের হয়ে এসে কাছে দাঁড়াল। মাথার ঘোমটা টেনে নিয়ে আস্তে আস্তে বলল-"বাবা ও কাল রাতে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য চলে গেছে।" মমতাজ সাহেবের কপালে চিন্তার ভাজ পড়ল। ছেলের বউকে কী বলবেন বুঝতে না পেরে বললেন-"যাও মা ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে রাখ।" কথা শেষ করেই নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন।

গ্রামের সবার মুখে মুখে মামুনদের যুদ্ধে যাবার ঘটনা ছড়িয়ে পড়ল। ব্যাপারটা সবার মনে আনন্দ না উদ্বেগ ছড়াল বুঝা গেল না। সবাই আগের চেয়ে আরো চুপচাপ হয়ে গেল। গ্রামের মাতব্বর শ্রেণীর জয়নাল সাহেব সবাইকে ডেকে বলে দিলেন যেন ঘটনাটা সবাই চেপে রাখে। পাশের গাঁয়ের লোকজন যেন কিছুতেই জানতে না পারে। গঞ্জের ইমাম সাহেব যেন না জানে। উনি জানলে গ্রাম শুদ্ধ পুড়িয়ে দেবে। জয়নাল সাহেবের অনুরোধে সবাই বোবা হয়ে গেল।

গঞ্জের ইমাম কাদের মোল্লা মিলিটারি বাহিনী নিয়ে গ্রাম গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। আজ এসেছে মামুনদের গ্রামে। মরুব্বীরা সবাই তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছেন। কাদের মোল্লা ছোবহান সাহেবের বাড়ির উঠানে চেয়ার নিয়ে বসে আছে । তার সাথে আট-দশ জন মিলিটারি। বড় বড় গোঁফ, সুঠাম দেহ, হাতে তাক করা রাইফেল, এলএমজি। সবাই চুপচাপ বসে আছেন। ভয়ে কেউ কিছু বলছেন না। কাদের মোল্লা জানতে চাইল-"গাঁয়ের জোয়ান ছেলেরা কোথায়? একজনওতো দেখতাছি না।" সবাই আগের মত চুপচাপ। মমতাজ সাহেব ভয়ে আরো চুপসে আছেন, অন্য সময় হলে দু'য়েকটা কথা তিনি বলতেন, কিন্তু আজ তাঁর মুখ একদম চুপ। কাদের মোল্লার চামচে ছোবহান বলল-"হুজুর এই ভাবে বললে কী আর কেউ বলবে? দু'য়েকটা লাত্থি-গুতা দিলে জানতে পারবেন।" ছোবহানের এহেন ভূমিকায় সবাই হকচকিয়ে গেল। সবাই হতভম্ব হয়ে একজন আরেক জনের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে মাটির দিকে চেয়ে আল্লাহকে ডাকতে লাগল।

মিলিটারি বাহিনীর ছোট্ট দলটার দলনেতা কাদের মোল্লার কানে কানে কী যেন বলল। উর্দুতে বলায় কেউ বুঝতে পারল না। গঞ্জের ইমাম কাদের মোল্লা চেয়ার থেকে উঠে মমতাজ সাহেবের কাছে এলো। মমতাজ সাহেব ভয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। কাদের মোল্লা বড় বড় চোখ করে বলল-"আপনার পোলা নাকি কাল বিয়ে করছে? আজ কই? এখানেতো দেখতাছি না? সন্ধ্যায় আমাগো ক্যাম্পে দেখা করতে বলবেন।" মমতাজ সাহেব ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে গেলেন, ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলেন। কিছু বলতে পারলেন না। ভয়ে ভয়ে কোন রকমে মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলেন। কাদের মোল্লা তাঁর দলবল নিয়ে চলে গেল।

তাঁরা সাত দিন কোন রকম অস্ত্র চালানো শিখেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মামুন আর সালাম একদলে আর বাকি তিনজন গেল অন্য দলে । মামুনরা বাড়ি থেকে বের হয়েছে আট দশ দিন। বাড়ির কোন খবর কেউ জানে না। গ্রামের কী হাল তাঁদের জানা নেই। মামুন সব সময় একটা চিন্তার মধ্যে থাকে। বাড়ির ভাবনায় মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। মামুনদের দলের কমান্ডার সুলতান। সেনা বাহিনীর ক্যাপটেন, ২৫/২৬ বছর হবে। অনেক তীক্ষ্ন, উদ্যমী, এবং আত্বপ্রত্যয়ী। সবাইকে সব সময় চনমনে রাখার চেষ্টা করে। সময় পেলেই গান বাজনা নিয়ে মেতে উঠে। উদ্দেশ্য বাড়ির দুশ্চিন্তা থেকে সবাইকে মুক্ত রাখা।

সেদিন একটা সফল অপারেশনের পর সবাই মিলে গোল হয়ে গান ধরেছিল। দলের কমান্ডার ক্যাপটেন সুলতান একটা চেয়ারে বসা। বাকি সবাই মাটিতে বসে কোরাস গান গাইছে-"মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি-------।" সবাই জোড়ে গলা ছেড়ে গাইছিল। মামুন চুপচাপ বসে ছিল। ব্যাপারটা ক্যাপটেন সুলতানকে এড়িয়ে যেতে পারল না। সে হঠাৎ গান বন্ধ করতে বলল। সবাই গান বন্ধ করে সতর্ক হয়ে গেল, যার যার অস্ত্র হাতে তুলে নিল। মামুন নিশ্চুপ ও অন্যমনস্ক, অস্ত্র হাতে না নিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল। ক্যাপটেন সুলতান চেয়ার থেকে উঠে মামুনের কাছে এলো। মামুনের ঘাড়ে হাত রেখে বলল-"মামুন তোমার কী হয়েছে? সবাই চুপ বলতেই সতর্ক হয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিল আর তুমি চুপচাপ, অন্যমনস্ক।" মামুন কিছু বলতে পারল না। চোখ দিয়ে টপাটপ্ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। পাশেই বসা ছিল সালাম, দাঁড়িয়ে বলল-"বস আমরা যেই রাতে যুদ্ধে যোগ দেয়ের জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে আসি, সেই দিন সন্ধ্যায় মামুনের বিয়ে হয়েছিল, বিয়ের রাতেই বউকে একা রেখে চলে এসেছে, তাই মন খারাপ।" ক্যাপটেন সুলতান মামুনের আবেগটা বুঝতে পারল। কী বলবে কিছুক্ষণ ভেবে, তারপর চোখের জল মুছে দিতে দিতে বলল-"মামুন তোমার মত অনেক ভাই প্রিয়তম স্ত্রীর শয্যা রেখে আজ রণক্ষেত্রে। তোমাদের এই আত্মত্যাগ জন্যই আমরা স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনার পথে একটু একটু করে অগ্রসর হচ্ছি। এই ভাবে বিষণ্ণ হয়ে পড়লে, বিমর্ষ হয়ে গেলে যে বিপদ হবে। একটু বেখেয়ালে, নিজের এবং নিজের সহযোদ্ধাদের জীবন বিপন্ন হতে পারে এটা কী বুঝ? শান্ত হও। সেই দিন আর দূরে নেই, যেদিন আমরা সবাই মা-বাবা, ভাই-বোন ও প্রিয়তম স্ত্রীর কাছে ফিরে যাব। সব দিক থেকে আমাদের বিজয়ের খবর আসছে। কাল আমরা কী সুন্দর ভাবে কোন প্রকার হতাহত ছাড়াই ওদের পরাজিত করলাম। ইনশাল্লাহ জয় আমাদের হবেই।" মামুন বসের কথায় চোখের জল মুছে নিল। সবাই আবার বসে কোরাস গাইতে লাগল-"মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি-----।"

গঞ্জের মসজিদের ইমাম কাদের মোল্লা আর তাঁর চামচে গ্রামের ছোবহান একদল মিলিটারি নিয়ে মমতাজ সাহেবের বাড়িতে হাজির। মমতাজ সাহেব একটা চেয়ার নিয়ে রোদে বসে ছিলেন। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল ছেলের বউ লিমা। মিলিটারিদের আসতে দেখে লিমা মাথায় ঘোমটা টেনে ভেতরে চলে গেল। সবাই মমতাজ সাহেবকে মাঝ খানে রেখে গোল হয়ে দাঁড়াল। কাদের মোল্লা সামনে এগিয়ে এলো। মমতাজ সাহেব চেয়ার থেকে ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়ালেন। শয়তান কাদের মোল্লা মুখটা বিকৃত করে মমতাজ সাহেবের মুখের কাছে নিয়ে বলল-"সেদিন আপনেরে বললাম ছেলেটাকে ক্যাম্পে পাঠাতে, তা কী ভুলে গেছেন?" মমতাজ সাহেবের গলা শুকিয়ে গেছে। ভয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। কিছুটা সামনে ঝোঁকে নিচের দিকে চেয়ে আছেন। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ছেলের বউ আর স্ত্রী। লিমা উৎকণ্ঠা নিয়ে শাশুড়ির দিকে তাকাল, শাশুড়ি চুপচাপ, কিছু বলছে না। কাদের মোল্লা মমতাজ সাহেবের জামার কলারটা টেনে ধরে হুঙ্কার দিয়ে বলল-"হারামজাদা, পোলারে মুক্তি বাহিনীতে পাঠাইছস, স্বাধীনতা চাছ, পাকিস্তানিরা খারাপ, মুসলমানদের দ্বিখণ্ডিত করে বিধর্মীগো সাথে থাকতে চাছ, চল আজ তোর স্বাধীনতার স্বাদ মিটায় দিমু।" মমতাজ সাহেব কিছু বলার আগেই পেছনে রাইফেলের বাট দিয়ে একটা বাড়ি দিল এক পাকিস্তানি সৈন্য। গুলি করতে উদ্যত হতেই দলনেতা নিষেধ করল। কাদের মোল্লা দাঁতে দাঁত চেপে বলল-"ওরে মারলে যে ওর পোলারে ধরা যাইব না। ওকে বাঁচিয়ে রেখে ওর গুণ্ডা পোলারে শায়েস্তা করতে হবে, ক্যাম্পে নিয়ে চল।"

মমতাজ সাহেবকে টেনে হেঁচড়ে বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়ার আগেই ঘর থেকে লিমা আর স্ত্রী রহিমা চিৎকার দিয়ে বের হয়ে এলো। সাথে সাথে পাকিস্তানি জোয়ানরা পেছন ফিরে রাইফেল তাক করে গুলি করল, গুলি গিয়ে লাগল রহিমা বেগমের বুকে, মুহূর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। লিমা শাশুড়িকে জরিয়ে ধরল, "মা, ও মা আপনার কী হলো, আমি এখন-----" কথা শেষ করতে পারল না। দেখল কে যেন পেছন থেকে তার চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলছে। লিমা সোজা হয়ে দাঁড়াল। দু'হাত দিয়ে চুলের মুঠি ধরা হাতটা ছুটানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। ঘুরে তাকিয়ে দেখে তার দু'পাশে কিছু হায়েনার রক্ত চোখ, তাঁকে চিবিয়ে খেতে উদ্যত। এক জোয়ান উর্দুতে বলল (যার বাংলা)-"হুজুর খুব সুন্দর মেয়ে মানুষ!" দলনেতা গোঁফে হাত বুলিয়ে একটা হাসি দিয়ে বলল (যার বাংলা)-"হুম, ক্যাম্পে নিয়ে চল।"

লিমা ছোবহান সাহেবের দিকে তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগল-"চাচা আমারে বাঁচান, আমি আপনার মেয়ে।" সোবহান সাহেব দাঁড়িয়ে ছিল। কী করবে বুঝতে পারছিল না। এক মাত্র মামাতো ভাইয়ের মেয়ে, নিজের মেয়ের মত ছোট বেলা আদর করেছে, কোলে নিয়ে ঘুরেছে, আজ নিজের চোখের সামনে তাঁর বেইজ্জতি দেখতে হবে। আর ভাবতে পারল না। দৌড়ে এসে কমান্ডারের পা জরিয়ে ধরল। "হুজুর, এ আমার মেয়ে, একে মাফ করেন, আমি এর চেয়ে খুবসুরত আদমী আপনার কাছে পাঠিয়ে দিব, ওকে ছেড়ে দিন।" কাদের মোল্লা ছোবহান সাহেবের কাছে এসে হাত দিয়ে টেনে তুলল। ছোবহান সাহেব উঠে দাঁড়াল, কাদের মোল্লা বলল-"ছোবহান সাহেব হুজুরের আরাম আয়েশের জন্য রাতে মেয়ে পাঠাতে পারবেনতো? তাইলে ব্যবস্থা করতে পারি।" চামচে ছোবহান বলল-"হুজুর পারুম। সব ব্যবস্থা করে দিমু, আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দিন।" কাদের মোল্লা ইশারা দিতেই জোয়ানরা লিমা কে ছেড়ে দিল। লিমা নিজেকে সামলে নিয়ে কাপড় ঠিক করে শ্বশুরের জন্য ছোবহান সাহেবের পা জরিয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল-"চাচা, আমার বাবাকে বাঁচান। " ছোবহান সাহেব হাত দিয়ে লিমা কে ছাড়িয়ে দিয়ে সোজা অন্যদিকে হাঁটতে শুরু করল। মমতাজ সাহেব নিশ্চুপ, কিছু বলছেন না। হানাদার বাহিনীর সাথে পা মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। লিমা দৌড় দিয়ে ঘরে গেল। একটা দা নিয়ে দৌড়ে এসে পেছন থেকে কমান্ডারের ঘাড়ে কোপ দিতেই কমান্ডারের ঘাড়ের অর্ধেক ফাঁক হয়ে গেল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগল। কমান্ডারের চিৎকারের সাথে সাথে আটজন এক সাথে ঘুরে লিমার বুকে গুলি চালিয়ে বুক ঝাঁজরা করে দিল। মুহূর্তে লিমা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সদ্য কাটা মুরগির মত কিছুক্ষণ ছটফট করে নিস্তেজ হয়ে গেল। মমতাজ সাহেব ধস্তাধস্তি করে নিজেকে মুক্ত করে লিমার দিকে ছুটতেই গুলি, পিঠ ঝাঁজরা হয়ে গেল এলএমজির গুলিতে। মাটির উঠান তিনটি মানুষের শরীরের রক্তে লাল হয়ে গেল। উঠানে থাকা মুরগি গুলো নিজেদের খুপরিতে ঢুকে গেল। গাছের ডালে বসে থাকা পাখি গুলো গুলির শব্দে আকাশে উড়ে গেল। নিথর তিনটি লাশ পড়ে থাকল উঠানে।

কিছুদিন ধরে একটার পর একটা অপারেশন চলার কারণে বাড়িতে চিঠি লিখতে পারছে না মামুন। মন ভীষণ খারাপ। কাল সম্মুখ যুদ্ধে একজন মারা গেছে। তাঁর বুক পকেটে একটা চিঠি পাওয়া গেছে, চিঠিটা ওর মাকে লিখেছিল । আগামী দিনের সুন্দর স্বপ্নের কথা জানিয়ে মাকে মুক্তির কথা লিখেছিল। লিখেছিল "আর কয়েকটা দিন মা, তারপর আমরা বিজয় ছিনিয়ে আনবো, তোমার হাতে লাল-সবুজ পতাকা তুলে দেব । আমাদের জন্য দোয়া কর।" চিঠিটা পড়ে কমান্ডার সুলতানও চোখের জল ফেলে ছিলেন। সবাই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিল। মামুন একটু বেশি বিষণ্ণ ছিল। কাল অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। গুলিটা মামুনের শরীরেও লাগতে পারত, কিন্তু ছেলেটা মামুনকে সরিয়ে দিয়ে বলেছিল-"মামুন ভাই, আপনি ওই দিকটা দেখেন, আমি এই দিকটা দেখছি।" এই কথা বলার একটু পরেই একটা গুলি ছেলেটার বুকে লাগে, তাড়াতাড়ি ক্যাম্পে এনেও আর বাঁচানো যায় নি। মামুনের মনটা তাই একটু বিক্ষিপ্ত। বাড়ির কথা মনে পড়ল। লিমার কথা মনে পড়ল। ক্যাপটেন সুলতান সবাইকে সব সময় সতর্ক থাকতে বললেন। বেশী বললেন মামুনকে। এরিমধ্যে মামুন নিজেকে বুদ্ধি সম্পন্ন এবং সাহসী হিসেবে প্রমাণ দিয়েছে, তাই মামুনকে একটু অন্যভাবে দেখেন ক্যাপটেন সুলতান।

বাড়ির খবরের জন্য অস্থির হয়ে উঠছিল মামুন। চিঠিপত্র লিখতে পারছে না, প্রিয়জনদের খবর নিতে পারছে না। শুনেছে ওদের পাশের গাঁয়ে বড় গঞ্জে যে ক্যাম্পটা আছে, ঐ হারামজাদারা গ্রামকে গ্রাম ধরে মানুষকে অত্যাচার করছে। ক্যাম্পে একপাশে একা বসে ছিল মামুন। সবাই ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, তার উপর ক্ষুধা। রান্নার আয়োজন করছিল সাজিদ নামে এক সহযোদ্ধা। সবাই একটু শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। মামুন দেখতে পেল একটা ১০/১২ বছরের ছেলে দৌড়ে ক্যাম্পের দিকে আসছে। মামুন দেখতে পেয়ে সতর্ক হয়ে, রাইফেলটা কাঁধে আটকিয়ে এগিয়ে যায় ছেলেটার দিকে। ছেলেটা হাঁপাতে হাঁপাতে বলে-" আপনারা চলে যান, এই দিকে অনেক গুলো পাকিস্তানিদের জীপ আসতাছে, ওরা অনেক লোক, আপনারা পারবেন না।" মামুন ছেলেটাকে কোলে তুলে নিয়ে ক্যাম্পে নিয়ে আসে। ক্যাপটেন সুলতান সব শুনে বলেন-"আমাদের যা আছে তা নিয়েই ওদের সাথে এখন পারা যাবে না। এর চেয়ে আমরা পিছিয়ে ধলেশ্বরী তীরে যে দলটি আছে তার সাথে যোগ দেই।" সবাই সব কিছু গুছিয়ে দ্রুত সরে পড়ল।

চার মাইল পেছনে এসে ধলেশ্বরী তীরের মুক্তিযোদ্ধার দলটির সাথে যোগ দিল। এই অঞ্চলটি এরিমধ্যে মুক্ত হয়েছে এবং এখানে সদস্য সংখ্যা বেশী। কীভাবে আক্রমণ করা যায় তাই নিয়ে রাতে সবাই বসল । লোক মুখে খবর এলো পাকিস্তানিরা ও ওদের দোসর রাজাকারের বাচ্চারা ছেলেটিকে মেরে ফেলেছে। সবাই অঝরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। ক্যাপটেন সুলতান সবাই উদ্দেশ্য করে বলল-"যে আমাদের জীবন বাঁচাতে গিয়ে শহীদ হয়েছে ওর হত্যাকারীদের আমরা রেহাই দিব না। রাতেই পরিকল্পনা হলো, ঐ অঞ্চলটি মুক্ত করবেই। যেই পরিকল্পনা সেই মোতাবেক কাজ। সবার অন্তরে মাসুম বাচ্চাটির হত্যাকারীদের নিঃশেষ করার সংকল্প।

রাত বারটা, সবাই দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে থাকল, মামুন ১৫জনের একটি দলকে দক্ষিণ দিকে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ক্যাপটেন সুলতান আর মেজর রফিক আছেন মূল দল নিয়ে পাকা রাস্তায়। উত্তর দিক থেকে ২০জনের আরো একটি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে সালাম। ধান ক্ষেত, ছোট খাল, জঙ্গল পেরিয়ে সবাই সতর্ক ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। সবার চোখে প্রতিশোধের আগুন। দ্রুত পায়ে হাঁটছে সবাই। সৈয়দপুর স্কুলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা আস্তানা পেতেছে, তিন দিক থেকে সবাই কাছাকাছি চলে এসেছে। রাত ২টা, পাকিস্তানী সৈন্যরা অধিকাংশ ঘুমিয়ে পড়েছে। কয়েক জন হারিকেন ঝালিয়ে রাইফেল কাঁদে নিয়ে পাহারার নামে ঝিমচ্ছে। তিন দিক থেকে সবাই প্রস্তুত। একটা ছোট সংকেত, দক্ষিণ দিক থেকে প্রথম মামুন আক্রমণ করল। সাথে সাথে তিন দিক থেকে গুলি, অগুছালো পাকিস্তানিরা কী করবে বুঝতে পারছিল না। একটার পর একটা গুলি, হাত বোমা, তছনছ পাকিস্তানি ক্যাম্পে। তিন দিক থেকে সমান তালে আক্রমণ করতে করতে এগিয়ে আসতে থাকে মুক্তিযোদ্ধারা। পাকিস্তানিরা কোন প্রকার সুবিধা করতে না পেরে গুলি ছুড়তে ছুড়তে পশ্চিম দিক দিয়ে পালিয়ে যায়। মুক্ত হয় সৈয়দপুর।

অপারেশন শেষ করে সবাই উল্লাসে ফেটে পড়ে। বিশ জন পাকিস্তানী সেই দিন মেরেছে মুক্তিযোদ্ধারা। নিজেদের হারানো ক্যাম্প উদ্ধার করেছে। নিজেদের সবাই ছিল অক্ষত। এই অঞ্চলের নির্যাতিত স্বাধীনতাকামী মানুষের মুখে হাসি ফুটে উঠে। সবাই জয় বাংলা শ্লোগানে বিজয় উল্লাস করে।

কিছুদিনের মধ্যেই মেজর রফিক আর ক্যাপটেন সুলতানের নেতৃত্বে তাঁরা শহরের দিকে আগাতে থাকে। আস্তে আস্তে সব অঞ্চল মুক্ত হতে থাকে। তাঁরা ঢাকা শহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে শুনে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর তাঁদের দোসররা আত্মসমর্পণ করেছে। চারদিক থেকে আনন্দ মিছিল আর জয় বাংলা শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত। সবাই আনন্দে কোলাকুলি করে। সময় ব্যয় না করে ছুটে নিজের প্রিয়জনদের খোঁজে ।

একটা জীপ করে সালাম, মামুন, সেলিম আরো কয়েকজন ফিরছিল নিজের গাঁয়ে। রাস্তায় হাজার নারী-পুরুষের বিজয় মিছিল ওদেরকে আবেগে আপ্লুত করে তুলে। মামুনের চোখে ভেসে উঠে লিমার হাস্যোজ্জল মুখ, লাল শাড়ি, মেহেদি রাঙ্গা হাত। ভেসে উঠে বাবার স্নেহ মাখা মুখ আর মায়ের মমতা জরানো হাসি। মামুন ভাবতে থাকে ফুলশয্যার কথা, লিমার কথা মনে পড়ে "তুমি ভালো থেকো, তুমি স্বাধীনতা নিয়ে আসলে আমরা স্বাধীন দেশে আবার বাসর সাজাবো।" মামুন হাসে, গাড়ি চলতে চলতে গ্রামের পথে চলে আসে। জীপ থেকে নেমে এক দৌড়ে বাড়িতে যায়, বাড়ি খালি, উঠানে শুকিয়ে যাওয়া চাপ চাপ রক্তের দাগ। দরজা খোলা। মুরগি গুলো ঘরের দরজার চৌকাঠে চুপচাপ বসা। গাছের পাতা ঝরে পড়ে বাড়ির উঠানে স্তূপ হয়ে আছে। কোনো মানুষের সাড়া শব্দ নেই। দৌড়ে মায়ের রুমে ঢুকে, খাটের উপর জায়নামাজ পাতা, কোরআন শরিফ রেহালের উপর রাখা। বাবার চশমটা টেবিলের উপর। ঘর ভরা ধুলা আর মাকড়সার জাল। পাগলের মত ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরে ঢুকে। খাটের উপর লিমার চুলের ক্লীপ, মেহেদি পাতা শুকিয়ে পড়ে আছে, বিয়ের লাল শাড়িটা আলনায় ঝুলানো। মামুন আস্তে আস্তে আলনার কাছে যায়, শাড়িটা নিয়ে পাগলের মত লিমার গায়ের গন্ধ নিতে থাকে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে-"লিমা, আমি স্বাধীনতা নিয়ে এসেছি, তোমার জন্য, দেখ আজ বাহিরে আনন্দের মিছিল, বিজয়ের শ্লোগান। শান্তির সুবাতাস। আজ যে আমাদের বাসর হবে, তুমি আসবে না, বলো আসবে না?" আর বলতে পারে না, গলা জরিয়ে আসে, কণ্ঠ শুকিয়ে আসে, খাটের উপর শুয়ে পড়ে।
====
বিঃ দ্রঃ স্বাধীন বাংলাদেশে আমার জন্ম। মহান মুক্তিযুদ্ধ দেখার সৌভাগ্য তাই হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের লেখা চিঠি নিয়ে সংকলন "একাত্তরের চিঠি", স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি অনেক নাটক, সিনমা দেখে, অনেক গল্প, উপন্যাস ও কবিতা পড়ে আমার মনের কল্পনা ও ভাবনা দিয়ে এই লেখাটা সাজানোর চেষ্টা করেছি, জানি না কতটুকু ভালো করতে পেরেছি। মডুদের ছারপত্র পেয়ে যদি লেখাটা সচলায়তনে প্রকাশিত হয়, তাহলেই কেবল বুঝতে পারব লেখাটা কেমন হয়েছে। সচল ভাইদের মন্তব্য আর আমার মত অতিথি ভাইদের মন্তব্য থেকে লেখার মান সম্পর্কে জানতে পারব। আমি চেষ্টা করেছি ভালো করার এবং বানান সঠিক রেখে লিখার, তারপরও যদি বানান ভুল থাকে তাহলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে আশা করি। যে কোন ধরনের ভুল সংশোধনের জন্য মতামত আমাকে সাহায্য করবে। সামনে বিজয় দিবস, লেখাটা বাংলাদেশের সকল শহীদদের প্রতি উৎসর্গ করলাম। ধন্যবাদ। -অতিথি লেখক।


মন্তব্য

সাবিহ ওমর এর ছবি

যেসব জিনিস ভাল লাগলো --
> বানান ভুল কম
> খুঁটিনাটি বর্ণনার চেষ্টা
> বোঝা যায় আপনি লিখতে পারেন...

যেসব জিনিস ভাল লাগে নাই --
> অনেকবার শোনা গল্প...(কিছু হাল্কা-পাতলা টুইস্টসহ)
> অতি সরলীকরণ...
> আনরিয়ালিস্টিক সংলাপ...

লিখতে থাকুন। ধন্যবাদ।

সাফি এর ছবি

নাটকীয় উপমা, সিনেমাটিক সংলাপ আর লেখার শেষে ডিস্ক্লেইমার চেনা একজন লেখককে মনে করিয়ে দেয়। ভাই অতিথি লেখক, লেখার শেষে নামটা দিয়েন।

অতিথি লেখক এর ছবি

thanks
আশমএরশাদ

সাবিহ ওমর এর ছবি

নামটা চেনা চেনা লাগে হে হে...

প্রবাসিনী এর ছবি

পরিচিত গল্প, কিন্তু ভাল লেগেছে পড়তে।
________________________________________________

হইয়া আমি দেশান্তরী, দেশ-বিদেশে ভিড়াই তরী রে

________________________________________________

হইয়া আমি দেশান্তরী, দেশ-বিদেশে ভিড়াই তরী রে

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লিখেছেন।

স্পার্টাকাস

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আপনি আপনার আশেপাশে বা চেনা পরিচিত কোনো মুক্তিযোদ্ধার বা সেই সময়ের মানুষদের কাছ থেকে গল্প শুনে নিন। আপনার কল্পনার গল্পে নাটকের মুক্তিযুদ্ধ ঢুকে গেছে বেশি।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।