সুখ সখিগণ ১

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ১৩/০২/২০১০ - ৫:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সুখ সখিগণ
অরুণ চৌধুরী

প্রতিটি মানুষই এক একটি গ্রহ। প্রতিটি মানুষের ভাবনা, বিশ্বাস, ঘটনা আর জীবনযাপন আলাদা। মানুষকে আবিষ্কারের তাই শেষ নেই। আমাদের বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের সহশিল্পী অভিনেত্রীদের নিয়ে এই ধারাবাহিক রচনা...। যদি সচল পাঠকদের ভালো লাগে, তবে সবার আগে এখানে পোস্ট করেই তবে অন্য কাগজে পাঠাবো।

নাকের পাশে, গালের ওপর আঁচড়। খামচি খাওয়ার মতো। বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে লাল হয়ে আছে।
প্রথমে মনে হয়েছিল জন্মদাগ। ভালো করে চোখ রাখতে বোঝা গেলো, তরতাজা আঁচড়। আজ-কালের মধ্যে ঘটনা ঘটেছে। শুরুর প্রশ্ন ছিলো সেটাই।
কোনো রাখঢাক না করে বললো, ‘মারামরি করছি। গতকাইল। দুপুরের পর।’
‘মারামারি করেছেন?’
‘জি। মারমারিতে যা হয়। কিছু দিতে গেলে কিছু খেতে হয়। চড়-থাপ্পড়। চুল টানাটানি। ভালোই বানাইছি। আরেকটু বানাইতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সে হইতেছে বিলাইয়ের মতো। আমারে খামচায়ে কিছু রাখে নাই।’
‘সে কে? কার সঙ্গে হলো?’
‘কাহিনী আছে।’
‘বলেন শুনি।’
‘বলি। আগে একটু জিরায়ে লই।’
‘জিরান। তার আগে শুধু বলেন, মানুষটা কে? পুরুষ না মহিলা?’
‘মহিলা। আগে আমাগো অফিসে কাম করতো। এখন বেকার।’
‘আপনি অফিসেও চাকরি করেন নাকি?’
‘অফিসেই করি। আইজ নয় মাস। বলতে গেলে ফিলিম লাইন ছাইড়া দিছিলাম।’
‘তো?... ওই মহিলার সঙ্গে মারামারি করলেন কেন?’
সামনে রাখা কাচের গ্লাসটা হাতে তুলে নিলো শাহানা আক্তার। ঢক ঢক করে গ্লাসের পানি এক নিঃশ্বাসের শেষ করলো। পানিতে ভিজে ঠোঁট জোড়া চকমক করছে। ঠোঁটে ইচ্ছামতো হাওয়াই মিঠাই কালারের লিপস্টিক মেখেছে । হলুদ রংয়ের ওড়না টেনে সেই লিপস্টিক বাঁচিয়ে ঠোঁট মুছলো। চোখের তারা কাঁপিয়ে তারপর সামনের দিকে তাকালো।
বলা শুরু করলো শাহানা, ‘তাইলে ভাইঙা কই। আমি যে অফিসে চাকরি করি সেইটা একটা ইংরাজি কাগজ। ডেইলি বাইর হয় না। মাঝে মােেঝ কয়েকশ কপি ছাপায়। কাইন্টের কাছে যায়। ডিএপ্পিতে যায়। আমারে মাসে বেতন দেয় সাড়ে চাইর হাজার। আমার কাজ? বিবিন্ন অপিসে ধন্যা দিয়া অ্যাডভেটাইজ্ আনা। কোনো মাসে বিশ হাজার আনি। কোনো মাসে পাঁচ হাজার। কোনো মাসে পাইও না। আমিও তো একটা মানুষ। তাই না? ম্যালা কষ্ট করি।’
‘তারপর? যার সাথে মারামারি হলো, আপনি তো বললেন, উনি এখন আর সেই অফিসে চাকরি করেন না। তাহলে? উনার সাথে ঝগড়া হলোই বা কেন, দেখাই বা হলো কোথায়?’
‘হ, বস-এর সাথে কী হইছিলো জানি না। চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছিলো।’
চায়ের কাপে চুমুক দিলো শাহানা, ‘হেরপরেও সেই মাগী অপিসে আসবে ক্যান, আমারে বোঝান?..আইসা কান্নাকাটি, হইচই, কাউমাউ করে। বিবিন্ন রকম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। সেইটা ক্যান্ করে? আমাকে বোঝান?’
‘আমি কীভাবে বোঝাবো? আমি শুধু শুনবো। সবকিছু খুলে বলুন। কান্নাকাটি, হইচই, কাউমাউ সে কার বিরুদ্ধে করে, আপনার বিরুদ্ধে না বসের বিরুদ্ধে?’
‘বসের বিরুদ্ধে করে। তার লেনদেন আছে। তার অধিকার আছে। এসব কথা বলে।’
‘সেটা তে আপনার আপত্তি কেন?’
‘বলতেছি। আমারে এফডিসিতে একদিন এক এসিস্টেন ছেমড়া বললো, আপা, আপনের কষ্ট দেইখা মায়া লাগে। একদিন কাজ পান তো, দশ দিন পান না। এইভাবে কী চলে? একটা পেপার অফিসে কাজ করবেন? আমার খালাতো ভাই চালায়। অ্যাড্ভেটাইজ আনবেন। কমিশন পাইবেন। মাসে মাসে ফিস্ট্ কিছু বেতনও পাইবেন। আপনে রাজি হইলে ভাইরে কইয়া দেখতে পারি।...
‘এসিস্টেন ছেমড়াকে বললাম, তুমি যে আমারে সাইধ্যা উপকার করতে চাচ্ছ, তোমার মতলবটা কী? বলে, চাকরি হয়া গেলে পরথম মাসের বেতন থেকে আমারে কিছু দিয়েন। ওইটুকুই স্বার্থ। আমার ভাই একদিন কথায় কথায় কইছিল, তোগো এফডিসিতে ম্যালা মানুষ। আমার এক দুইজন লাগবো।... পারলে পাঠায়ে দিস।’
‘ওইভাবে চাকরিতে ঢুকলেন?’
মাথা নাড়লো শাহানা, ‘ভাবলাম, শুক্কুর-শনি ছুটি। যদি ছুটির দিনে কাম পাই, তাইলে এফডিসিতে খ্যাপ মারুম। আর মাসে সাড়ে চাইর হাজার ফিসট্। খারাপ কী?’
‘তারপর? মারামারির ঘটনায় আসুন।’
‘সবুর সয় না আপনার ? মনে হয় য্যান, এক্ষুণি ট্রেনে উঠবেন?! কথা শুনতে ডাকছেন, আস্তে আস্তে শোনেন।’
‘আস্তে আস্তে বলুন।’
‘মিরপুরে এক বাসায় ভাড়া থাকি। ওইখান থেকে রোজ অপিসে যাই দশটায়। কুনো-কুনো দিন বাস খালি পাই। কুনোদিন কুস্তাকুস্তি কইরা আসি। অপিসে এসে প্রথমে টিফিনকারিটা রাখি। দুপুরের খাওয়া । তারপর বাইর হই। বিজ্ঞাপন কালেকশনের ধান্দা। এই অপিস, ওই অপিস। সহজে কেউ কি আর কিছু দেয়? দুনিয়াটা কতো কঠিন সেতো আপনে জানেনই। সবজায়গায় গিভ এন্ টেক।
‘পড়ালেখা কদ্দুর করেছেন?’
‘নাইন পাশ দিয়ে টেনে উঠছিলাম। মেট্রিক দিতে পারি নাই। তার আগেই ফিলিমে হান্দাইছি। ফিলিমে পাঠের নেশা, ভয়ঙ্কর নেশা। সে কথায় পরে আসি।’
‘ঠিক আছে পরে আসুন।’
কাহানার চেহারায় হঠাত চিন্তার ছায়া পড়লো, ‘আপনি যে কী লিখতে লিখবেন আল্লায় জানে। তয় আমি একে একে সব বলি। আপনি গুছায়ে নিয়েন।’
‘জি। তাই নেবো।’
‘তারপর হইছে কী শোনেন, রোজ দশটায় আসি, কাম শেষে ঘরে ফিরি সাতটা-আটটায়। অপিসে গত দুই দিন সপ্তা ধরে দেখি, দুপুরে যখনই খেতে আসি, ওই ম্যায়া মানুষটা বসের ঘরে বসে তুলু-পুলু করে। কী বিষয়? আবার চাকরি করতে চায়। বস তারে আর নিবে না। তাই দুইদিন পরপর আইসা কান্নাকাটি করে। যাওনের সময় কাক্তি-মিন্তি করে দুইচাইর পাঁচশ টাকা নিয়া যায়। এই ঘনঘন যাওয়া-আসা যহন বাড়তে লাগল আমার মাথায় আগুন চড়লো।’
‘তাই?’
‘হ, তোর চাকরি নাই, চাকরি ছাড়ছস নিজের আক্কলে, বস এখন তোরে নিবে না। তাইলে তোর ঘন ঘন আসার দরকার কী? আইসা টাকা-পয়সা নিয়া যাইতে তোর শরম করে না? টাকা নিতে আছে তো, নিতেই আছে। মাঝে মইদ্যে দেখি, বসের ঘরের দরজা লাগায়েও সে কথা বলে।’
‘আপনি এর প্রতিবাদে ওনার সাথে হাতাহাতি করেছেন?’
মাথা নাড়লো শাহানা, ‘মারামারি পর্যন্ত যাওনের ইচ্ছা আছিলো না। বাইধ্য হইয়া করছি। কাইল বসের ঘর থিকে বাহির হয়ে আসতেছি, কি একটা কমেন্ট করলো। আমিও ঘাড় বেঁকা করে একটা কথা বললাম। ব্যস। এক কথা দুই কথার পর দেখি বসের সামনেই ছুটে আসলো আমার দিকে। দশ ঘাট ভাইজ্যা খাওয়া ম্যাইয়া আমি। আর ছেড়ে দেওন যায়?’
‘কে বেশি মার খেলো? আপনি? না উনি?’
‘আমি। হেই বেটির পাহড়ের মতো ফিগার। আমি দিছি ঠিকই। তয় হে বেশি দিছে।’
‘তো বস?’
‘মারামারি স্টাট হওয়ার পর বস তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজা আটকায়ে দিলো। অপিসে তার একটা পেস্টিজ আছে! তারপর আমাদের মইধ্যে ঢুইকা দুইজনকে দুইপাশে সরায়ে দিলো। তারপর আমারে ঠা-া গলায় বললো, এই মাসের আর তিনদিন আছে। আগামী মাস থেকে আর অপিসে আসবা না তুমি। তোমার চাকরি নট।’
‘ওই মহিলাকে কিছু বললেন না? সব দোষ আপনারই হলো?’
‘হেরে তখন-তখন আমার সামনে একটা চটকনা মাইরা বাইর কইর দিছে। ব্যাপারটা আমারে দেখানোর জন্যেও হতে পারে। সাজানো নাটক।’
দম নিলো শাহানা আক্তার। কাপের ঠা-া চা-এর বাকিটা শেষ করলো।
‘আমাকে এবার বলুন তো, বসের কাছ থেকে কেউ যদি কান্নাকাটি করে, তার কষ্টের কথা বলে টাকা নেয়, তাতে আপনার মাথায় আগুন জ্বলবে কেন? আপনার প্রোবলেম কী?’
প্রশ্ন শুনে থমকে গেলো যেন শাহানা।
‘আমার কী সমিস্যা?’
কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ করে থাকলো। মাথা নাড়লো ‘তাও তো কথা। তারে দিলে আমার সমিস্যা কী’।
একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলাম শাহানার দিকে। আর প্রশ্ন করলাম না। অপেক্ষা করতে থাকলাম উত্তরের জন্য।
‘শোনেন ভাই, নয় মাস বেশি সময় না। কিন্তু এর মইধ্যে বুঝছি, আমার বসের মতো মানুষ হয় না। আমারে মিরপুরের বাসাটা তো উনিই ভাড়া করে দিয়েছেন। বেতনের বাইরে ওই বাড়িভাড়াটা উনিই দিয়া দেন। অপিসে জানাজানি হলে সব ইস্টাফ বাড়িভাড়া চেয়ে বসতে পারে, সে জন্যে ভাড়াটা গোপনে দেন। মানুষটার ওপর এতোদিনে আমার কেমন মায়া পড়ে গেছে। ফিলিম লাইনে অনেক দুষ্ট প্রকৃতির মানুষ দেখছি তো । সে জন্যে হেরে আমার দেবতার মতো মনে হয়।’
‘উনি আপনার ওই মিরপুরের বাসায় যান?’
‘মাঝে মাঝে। সপ্তায় একদিন কি দুইদিন।’
‘সেটাও গোপনে?’
‘হু।’
‘আপনার চাকরিটা যদি এখন সত্যিই খেয়ে ফেলেন, আপনাকে আবারও এফডিসির অনিশ্চিত জীবনে নামতে হবে। কখনও কামাই হবে। কখনও হবে না।’
‘সেইটাও ঠিক।’
‘সেজন্যে তার প্রতিশোধ নিতে আপনি বসের বাড়ি গিয়ে আবার হাজির হবেন না তো? তাঁর বউকে কিছু বলে দেবেন নাকি?’
‘সে তো বিবাহ করে নাই!’
‘ও। সেজন্যেই এতো বেশি মায়া পড়ে গেছে আপনার? একা মানুষ। নিঃসঙ্গ।’
‘না। এইডা ঠিক কন নাই। এফডিসিতে এক্সট্রা মেয়ের অভিনয় করি বিশ বছর প্রায়। বিশ বছরে এমন বহু আউল-বাউল একলা মানুষের সাক্ষাৎ হইছে। কারও ওপর মায়া পড়ে নাই। আমার ওপরেও কারও পড়ে নাই। আমাদের ফিলিম লাইনে ‘মায়া’ জিনিসটা হইতাছে কচু পাতার পানি। ধইরা রাখা কষ্ট। এই থাকে তো এই থাকে না। সব গিভ এন্ টেইক।’
এফডিসি চত্বরে ওই নিষ্ঠুর কঠিন জায়গাটার বাইরে, ওই চাকরিটাতে ঢুকে শাহানা আক্তার জেনেছিলো, দেওয়া-নেওয়ার বাইরে আরেকটা পৃথিবী আজ। সেই পৃথিবীটাতে স্বার্থপরতা আছে, নিষ্ঠুরতাও আছে। তারপরও সে পৃথিবী এতো কাঠখোট্টা নয়। সেজন্যে বসের সাথে থাকতে থাকতে তাঁর ওপর মায়া পড়ে গেছিলো। বসের ভালো কিছু হলে ওর মন খুশি হয়। বসের মন্দ কিছু হলে ওর বুক পোড়ে। এখন সেই জিনিসটা ওর শিক্ষিত বসে ভালো লাগছে না। কারণ ওনার একটা ‘উন্নত’ সমাজ আছে।
‘শাহানা, একটা জীবনে এতো কিছু দেখলেন, তারপরও আপনার মনে হয় পৃথিবীর সব পুরুষরাই খারাপ নয়?’
‘সব পুরুষরাই খারাপ না।’
‘আপনার বস্ ভালো মানুষ?’
‘খারাপ মানুষ না। মারামারি না করলে, হঠাৎ ওই রকম মাথা গরম না করলে সে তো আমারে চাকরি ছাড়তে কখনো বলতো না।’
শাহানার সারল্যে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে।
‘চাকরিটা তবে ছেড়ে দিচ্ছেন?’
‘আমি মাপ চাইবো। মাপ না করলে আবার এফডিসির চুলায় ঝাঁপ দিবো। অসুবিধা নাই। এখন কষ্টরে ভয় পাই না। মানুষের তকদীরে যা আছে তারে কেউ ঠেকায়ে রাখতে পারে না। আল্লাপাক চাইলে আমার এরচে ভালো পজিশন হইতে পারে।’
রাগ লাগলো আমার। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বললাম, ‘আপনার বস আপনার সাথে এতদিন যে আচরণ করেছেন, সেটাও কিন্তু একধরনের এক্সপ্লোয়েটেশন।’
‘বুঝলাম না।’
‘মানে, এক ধরনের ব্যবহার। এ ‘ব্যবহার’টায় যে গোপন নিষ্ঠুরতা আছে, চট করে বাইরে থেকে সেটা চোখে পড়ে না। কিন্তু শোষণ তো শোষণই। পুরুষদের শোষণ। ঠকবাজি বোঝেন? এটাও ভদ্রবেশী বড়লোকদের ঠকবাজি।’
চাবুক খেলো যেন শাহানা! মেরুদ- সোজা করে বসলো।
চোখের তারায় আগুন জ্বলে উঠলো কয়েক মুহূর্তের জন্য। কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলো। বললো না।
ঠোঁটের কোণায় শুধু অদ্ভুত একটা তাচ্ছিল্যের হাসির রেখা ঝুলিয়ে রাখলো।

শাহানা আক্তারের বয়স তখন পনেরো। ফ্রক পরতো। হাল্কা-পাতলা, শুকনো শরীর। বিনা টিকিটে বরিশাল থেকে ঢাকার লঞ্চে উঠে বসেছিল। ফার্মগেটে দুর্সম্পর্কের এক বোনের বাড়িতে এসে উঠলো। চোখে স্বপ্ন একটাই। সিনেমায় নামবে। শরীরে-মনে তখনও সে পাকা হয়নি। নাখালপাড়ায় সেই আত্মীয়ের বাসার পাশে প্রতিবেশী এক ছেলের সঙ্গে ভাব হলো। সেই ছেলেকে নিয়ে একদিন এফডিসির পুরোনো গেটে হাজির হলো সে।
প্রথম দিনেই ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। এলাকার ছেলে। দারোয়ান আটকায়নি। শুটিং-টুটিং দেখে ঘরে ফিরলো। অভিনয়ের ব্যবস্থা হলো না। আত্মীয় বোন অবস্থা গড়বড় বুঝে বরিশাল খবর পাঠালো। শাহানার বাবা এসে মেয়েকে ধরে নিয়ে চলে গেলো।
প্রথমবার বেদম মার মেরেছিলো বাবা।
তিন ভাই এক বোনের অভাবী সংসার। বাবার মুদি দোকান। ভাইরা কৃষিকাজ করে। কিছুদিন ভাইয়েরা পর্যন্ত ওর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলো। মা খিটখিট করতো। কিন্তু যে মেয়ের রক্তের মধ্যে সর্বনাশা নেশা, তাকে আটকে রাখে কে?
আবার পালালো বাড়ি থেকে।
আবারও ধরে আনলো বাবা। এবার আর মারধর হলো না। বোঝানো হলো। শাহানা না শুনলো ধর্মের কাহিনী।
আবার পালালো। দানে দানে তিন দান।
এবার আর কোনো আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে না। পরিচিত কোনো পাড়াতেও না। নাখালপাড়ার সেই ছেলেবন্ধুর সূত্র ধরে এক খালার বাসায়। খালা এফডিসিতে আর্টিস্ট সাপ্লায়ার। সালটা ১৯৯১।
শুরু হলো নতুন জীবন। এফডিসির জীবন। গ্রামের আড়ষ্টতা, লজ্জা, সারল্য, সংস্কার সব ছেঁড়া-ময়লা কাপড়ের মতো একে একে খসে পড়ে গেলো। গায়ে-গতরে রূপ ফুটলো। নাদুস-নুদুস হলো। লিপস্টিক-সেন্ট-রূজ-পাওডার মাখা, চুল ফেটিং করা সব আয়ত্তে এসে গেলো পানির মতো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে দেখে চমৎকৃত হতো তখন। এতো সুন্দর সে?
একানব্বই থেকে পঁচানব্বই। ষোল-সতেরোটা ছবিতে পাঠ করা হয়ে গেছে। ব্যাগে টাকা জমছে একটু একটু করে। ছিয়ানব্বইয়ের শুরুতে এক প্রযোজকের ছোট ভাইয়ের সাথে খাতির জমলো। তার সাথে ফূর্তিফার্তা করে। একসাথে থাকে।
শাহানা বুঝলো, ওর রূপে নয়, টাকাতেই ছিলো ছেলেটির গোপন চোখ। ততোদিনে প্রচুর দেরি হয়ে গেছে। পার হয়ে গেছে তিন বছর। প্রায় ছয় লাখ টাকা গায়েব করে দিয়ে ছেলেটি ভাগলো। একসঙ্গে বাবুবাজারে, আর নীলক্ষেতে দুটি ফলের দোকান দিয়েছিলো ওরা। নতুন একটা পার্লার দেবে ঠিক ছিলো। শাহানা জানলো, ফিফটি-ফিফটি বিজনেসে লিখিত-পড়িত ভাবে ওর কোথায়ও কোনো নাম রাখেনি ছেলেটি। অতএব, সব বেচেবুচে ছেলেটি যখন গায়েব, তখন ওর কাজ থাকলো একটাই। আঙুল চোষা।
দ্বিতীয় ধাক্কা খেলো আটানব্বইয়ের শেষে।
এবারের মানুষটা প্রযোজকের ভাই স্থানীয় কেউ নয়। অন্য এক প্রযোজকের লন্ডনি বন্ধু।
লোকটি উত্তরায় বাড়িভাড়া করে ওকে রাখলো। লন্ডনে তার পরিবার আছে। ছেলেমেয়ে আছে।
উত্তরার ফ্যাট সাজিয়ে দিলো। দেওয়া থোওয়া ভালোই ছিলো। মাসে মাসে টাকাপয়সা দিয়েছে প্রচুর। তবে বিয়ে করতে চায়নি। লন্ডনে সংসার আছে। বলতো, এভাবে থাকতে সমস্যা কী। সময় হলে নায়িকা বানাবো।
কিন্তু আম্মা একদিন বরিশাল থেকে ঢাকা এলেন। সব দেখেশুনে জানালেন, ‘এটা কেমন কথা? তুমি মুসলমানের মেয়ে। আমাদের একটা সমাজ আছে। থাকতে হইলে বিয়া করে থাকতে হবে।’
মানুষটা বাধ্য হয়ে শাহানাকে কলমা পড়ে বিয়ে করলো। কিন্তু সিনেমায় টাকা লগ্নি করে আর ওকে নায়িকা বানালো না। লন্ডনেও নিলো না।
বছরের একদুবার ঢাকা আসে। ফিলিম লাইনের বন্ধু-বান্ধবের সাথে উড়াধুরা টাকা খরচ করে। আবার প্লেনে উঠে চলে যায়। কখনও কখনও ঢাকায় আসে গোপনে। শাহানাকে জানায় না। অন্য কারো সাথে থেকে চলে যায়। এ নিয়ে গত দু-তিন বছর মন কালাকালি যাচ্ছে। টাকা-পয়সাও কমিয়ে দিয়েছ্।েএ সংসারে এর মধ্যে দুই সন্তান এসেছে। দুটিই মেয়ে। নানীর কাছে বরিশাল থাকে। স্কুলে পড়ে। ওই সন্তানদের একবারও দেখতে যায়নি ওই লন্ডনি পুরুষ।
শাহানার ঠোঁটে তখনও তাচ্ছিল্যের হাসি লেগে আছে। অদ্ভুত ভঙ্গিতে ভুরু দুটো বেঁকিয়ে বললো, ‘ঠকবাজ পুরুষদের চিনাতে আসবেন না। এতো বছর ঘাস ছিঁড়ি নাই। আপনার কাছ থেকে জ্ঞান নিয়ে পুরুষ মানুষ চিনতে হবে আমার? উঠলাম। ভালো থাইকেন।’

দরজা খুলে হন হন করে বেরিয়ে গেলো মেয়েটি। ফিরেও তাকালো না।

arun.chowdhury@hotmail.com


মন্তব্য

আলমগীর এর ছবি

সচলে শুভাগমন।
আপনি কি নাট্যকার/পরিচালক অরুণ চৌধুরি নাকি?

অরুণ চেৌধুরি এর ছবি

জি ।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

ভালো লাগছে। চলুক
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

অরুণ চেৌধুরি এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ

জুয়েইরিযাহ মউ এর ছবি

লেখাটি পড়তে ভালো লাগলো।
ধারাবাহিকভাবে পরবর্তী পর্বটি আসবে সচলের নীড়পাতায়
এ প্রত্যাশা রইলো হাসি

--------------------------------------------------------
জানতে হলে পথেই এসো, গৃহী হয়ে কে কবে কি পেয়েছে বলো....


-----------------------------------------------------------------------------------------------------

" ছেলেবেলা থেকেই আমি নিজেকে শুধু নষ্ট হতে দিয়েছি, ভেসে যেতে দিয়েছি, উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে চেয়েছি নিজেকে। দ্বিধা আর শঙ্কা, এই নিয়েই আমি এক বিতিকিচ্ছিরি

অরুণ চেৌধুরি এর ছবি

সে ইচ্ছা আছে

রাহিন হায়দার এর ছবি

স্বাগতম। আসুক আরো।
________________________________
তবু ধুলোর সাথে মিশে যাওয়া মানা

অরুণ চেৌধুরি এর ছবি

আসবে আরো।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

ভালো লাগলো লেখাটা।
আলমগীর ভাইয়ের প্রশ্নটা আমারো।
আপনিই কি সেই অরুণ চৌধুরী?

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অরুণ চেৌধুরি এর ছবি

জি।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

@ আলমগীর ভাই, শিমুল আপা...
জ্বী, আপনাদের অনুমান ঠিকাছে। উনিই নাট্যকার পরিচালক অরুণ চৌধুরী।

অরুণদা গত কয়েকমাস ধরে নিয়মিতই সচলায়তন পড়েন। কারিগরী দিকটাতে অভ্যাস কম থাকায় মন্তব্য বা লেখালেখি করতে পারেন না সচলে। আশাকরি এখন থেকে ধীরে ধীরে অভ্যাস তৈরি হবে।

এই সিরিজটা বাংলাদেশের একটা জনপ্রিয় পাক্ষিকে নিয়মিতই প্রকাশিত হচ্ছে। তবে এটা একেবারে নতুন। এখন থেকে অরুণদা লেখাটা আগে সচলায়তনে দিবেন, তারপর ছাপা হবে পত্রিকায়। ধন্যবাদ দাদা...

অরুণদাকে সচলায়তনে স্বাগতম।

নতুনগুলো লেখার ফাঁকে ফাঁকে এখানে এই সিরিজের পুরনো লেখাগুলোও দেওয়ার অনুরোধ রইলো...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

অরুণদা... আরেকটা কথা...
পত্রিকায় অনেক কিছুই বলা যায় না... সেন্সর করতে হয়। কিন্তু ব্লগে সেই জটিলতা নেই। ব্লগ এখানেই অনেক এগিয়ে। শাহানাদের জীবনে এরকম অনেক কিছুই আছে, যা পত্রিকায় বলা যাবে না হয়তো। আপনার কাছে অনুরোধ, প্রয়োজনে আলাদা নোটে হলেও সব কথাই বলুন... সত্যটাই শুনতে চাই আমরা... প্রয়োজনে ছদ্মনাম ব্যবহার করা যেতে পারে...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অরুণ চেৌধুরি এর ছবি

পত্রিকায় সব সময় সব কিছু লেখা যায় না, এটা কি ঠিক?
পত্রিকায় সব সময় সব কিছু লেখা ঠিক নয় বলে মনে করি।
এটা পত্রিকা'র নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
যেমন, যদি প্রথম পাতায় অ্যাসিড দগ্ধ কোনো অসহায় একটি মেয়ের বিভত্স ছবি বিশাল করে ছাপা হয়, তবে ঘুম থেকে উঠেই দেখতে ভালো লাগে না।
নর্দমার নোংরা দুর্গন্ধ নাক ডুবিয়ে বোঝার প্রয়োজন পড়ে না বলেই আমার ধারণা।
আমাদের সিনেমা জগতের এক্সট্রা মেয়েদের দগদগে কষ্টের জীবনের কথা বেশি খুলেমেলে বলার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই, বৈশিষ্ট্য-ো নেই।
আমি কি কিছু বোঝাতে পারলাম?

মনামী এর ছবি

ছায়ামানুষদের কন্ঠ হয়ে ওঠার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। খুব ভালো লাগলো। দ্রুত আসতে থাকুক পর্বগুলো। পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।

অরুণ চেৌধুরি এর ছবি

ভালো লাগলে আবারো লিখবো।

দময়ন্তী এর ছবি

বা: বা: বেশ লাগল৷
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

অরুণ চেৌধুরি এর ছবি

বেশ লাগলো জেনে বেশ লাগলো।

নাশতারান এর ছবি

সচলায়তনে স্বাগতম, অরুণদা।
পরবর্তী কিস্তির অপেক্ষায় রইলাম।

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

অরুণ চেৌধুরি এর ছবি

সচলায়তনের পাতা দেখছি খুব বেশিদিন নয়।
নিয়মিত দেখারো সুযোগ হয় না জীবনের বিরক্তিকর ব্যস্ততায়।
তবু এরই মাঝে বুঝে গেছি, সচলের পাঠক, লেখক, মন্তব্যকারীর মানসিক উচ্চতা অসাধারণ।
এমন এক ভুবনে নিয়মিত লিখতে পারা গেলে ধন্য হবো আমি নিজেই।
এতে সন্দেহ নেই কোনো।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

আপনাকে এখানে দেখে ভালো লাগছে। হাসি

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অরুণ চেৌধুরি এর ছবি

আবারো ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।