একাত্তরে আমার পিতা রাজাকার ছিলেন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ১৯/০২/২০১০ - ৬:০০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার একজন পিতা আছেন
আমি তাকে আব্বা বলে ডাকতাম...
আমার খুব মনে আছে,
তিনি যখন কোরান পড়তেন -
সুবেহ সাদিকের স্বর্গীয় নীরবতার মধ্যে
তার কণ্ঠস্বর অদ্ভুতভাবে বেজে উঠত
তার সৌম্য অবয়ব হতে কোন এক
অন্য ভুবনের আলো ঠিকরে বেরুতে দেখতাম -
আমি, তখন ভুল শুনতাম
আমার দেখায় ভুল ছিল ।

আমার একজন আম্মাও ছিলেন
আমি তাকে কোনদিন হাসতে শুনিনি...
সারাটা বছর থাকতেন রোগাক্রান্ত
পর্দার আড়ালে দুর্বল, শীর্ণ, কালো
কোন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে
আম্মার ফোঁপানো কান্নার শব্দ শুনতে পেতাম,
আমি তাকে বেশিদিন আম্মা ডাকতে পারিনি -
আমার বয়স যখন ছয়,
পিতা দ্বিতীয়বার বিবাহ করলেন...
কিছুদিন পর মারা গেলেন আমার আম্মা,
আমার আম্মা ...

আমার পিতার আরও তিন ছেলে ছিল
তাই বোধহয় তিনি আমাকে -
আদর করার মত যথেষ্ট সময় পাননি
নাকী আমি কালো ব'লে ভ্রু কুঁচকাতেন...
আজও জানি না,
একা একা বড় হয়েছি, খুব একা...

বয়স তখন উনিশ ছুঁই ছুঁই...
শেখ মুজিব মুক্তির ডাক দিলেন,
আগুন জ্বলা তার অনবদ্য ভাষণে...
আমার পিতা এই দেবতার মতন ব্যক্তিকে মোনাফেক, কাফের
এবং ইসলামের ঘোরতর শত্রু হিসেবে সাব্যস্ত করলেন,
পাকিস্তান.. পাকিস্তান.. মাতম শুরু করলেন
এপ্রিলের মাঝামাঝি, পাকসেনারা গ্রামে আসতে লাগল
আমার পিতার সেকী উচ্ছ্বাস,
ভীষণ তৎপর হয়ে উঠলেন তিনি...
পাকসেনাদের সামনে তিনি এমনভাবে গলে গলে পড়তেন যে -
ভ্রম হত.. তারা বোধহয় আল্লাহর পাঠানো ফেরেশতা...
এই ফেরেশতাদের ছিল পিশাচের মতন ক্ষুধা.
সব খেত ওরা, স-ব... যাকে সন্দেহ হত, গুলি করে মারত...
মেয়েদের ধরে ধরে খুবলে খেত...
এক দুপুরে পিতা, আমার ছোটখালাকে নিয়ে গেলেন -
পাকসেনাদের ক্যাম্পে, আমি তাকে আর কোনদিন দেখিনি...
আমার জগতটুকু ভীষণ এক আগুনে পুড়িয়ে দিলো কেউ...
আমি সেই রাতিই পালিয়ে গেলাম... যুদ্ধে গেলাম...

আমি তখন রংপুরের পথে,
লোক মারফত জানতে পারলাম -
মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের শাস্তিস্বরূপ
পিতা আমায় ত্যাজ্য ঘোষণা করেছেন,
আর এই মহান কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ -
পাকসেনারা তাকে আলবদর বাহিনীর কমান্ডার বানিয়েছে
আমার পিতা...

যুদ্ধের সেই দিনগুলো আজও চোখের সামনে জ্বলজ্বল...
রক্তের মহাসমুদ্র সাঁতরে আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হ'ল ।

আট মাস পর.. ডিসেম্বরের আঠারো তারিখ..
গ্রামে ফিরলাম আমি,
দেখলাম আমাদের বাড়িটাকে পোড়ানো হয়েছে,
শুনলাম পিতার দ্বিতীয় স্ত্রী, তিন পুত্র কেউ-ই আর বেঁচে নেই,
পিতাকে বেঁধে রাখা হয়েছে.. মেরে ফেলা হবে হয়তো...
পিতা আমায় দেখে চমকে উঠলেন...
তার সমগ্র শরীর কোন এক উচ্ছ্বাসে কেঁপে কেঁপে উঠছিল,
আমি পিঠ সোজা করে দাঁড়ালাম,
ভাবলাম মেরেই ফেলুক.. এই পশুটার শাস্তি হওয়া উচিত...
পরে আর পারিনি...

পিতা স-ব ভুলে গিয়ে আমায় গ্রহণ করতে চাইলেন
কিন্তু আমি তার কাছে আর ফিরে যেতে পারিনি...
আমি এখন এক সুতার কলে কাজ করি,
ভয় এবং দুশ্চিন্তার বিষয় এই, পিতা এখন
মস্ত এক নেতা হয়েছেন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে
তার এখন বিলাসী জীবন...
মন্ত্রীও নাকি হয়ে যেতে পারেন সামনের নির্বাচনে...
কী করেছি আমি... কত বড় পাপ...
অপরাধবোধে, এখন নিজের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারিনা,
পারিনা...

আমার পিতা এখনও আছেন -
আমি ভুলেও তাকে আব্বা বলে ডাকিনা...


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগল।
অতিথি লেখকের নাম নেই কেন?

কৌস্তুভ

অতিথি লেখক এর ছবি

নিয়ম কানুনন জানতাম না.. ভুল হয়ে গেছে...

________________________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

কবিতা নয়, গল্পের (বর্ণনার) মত লাগলো।

নাম পরিচয় না দিলে বুঝবো কিভাবে যে এটা কার লেখা? সচলায়তনে প্রথম লেখা হলে স্বাগতম জানাই।

অতিথি লেখক এর ছবি

হ্যা.. এটা প্রথম লেখা ছিল... অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী...
________________________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ

মূলত পাঠক এর ছবি

অসাধারণ!!

আপনার নামটা লেখায় দিতে ভুলে গেছেন বোধ হয়, মন্তব্যে দিয়ে দিন। আরো লেখা আসুক।

আলমগীর এর ছবি

আপনি আবার মূলত পাঠক হয়ে গেছেন।
ওৎ পেতে বসে থাকেন পড়ার জন্য, লেখার কোন বালাই নাই।

রাগরাগিনীর সিরিজটা আবার কবে দিবেন?

অতিথি লেখক এর ছবি

হ্যা.. এটা প্রথম লেখা ছিল... অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী...
________________________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ

আলমগীর এর ছবি

অসাধারণ! কী বলব?
একটা বানান পর্যন্ত ভুল নেই।

কনফুসিয়াস এর ছবি

ডাকিনা, পারিনা... হাসি
-----------------------------------
আমার জানলা দিয়ে একটু খানি আকাশ দেখা যায়-

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ
________________________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ

অতিথি লেখক এর ছবি

সুন্দর, আবেগীক প্রকাশকে বেশ দক্ষতার সাথে তুলে ধরেছেন। দারুণ।

---- মনজুর এলাহী ----

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ
________________________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ

নীল রোদ্দুর এর ছবি

আপনি যেই হোন না কেন, এটা আপনার নিজের জীবনের গল্প হোক বা না হোক, আপনাকে আমার সহস্র সালাম... এমন অকপট সত্যকে তুলে ধরার জন্য।

ভুল শুধু আপনি একা করেন নি। করেছিল সেদিন পুরো জাতি। মুক্তিযুদ্ধের এতোদিন পর আমরা বুঝি, কি ভুল করেছি আমরা সেদিন। এই ভুলের মাসুল আমাদের আর কতদিন দিয়ে যেতে হবে জানিনা।

আমি, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের একজন বাংলাদেশী, নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবতী মনে করে, আমি জন্মেই একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি, যা আমার আত্ম পরিচয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমার দেশ যেমনি হোক, আমি বলতে পারি, আমি বাংলাদেশী! কিন্তু সেই সাথে এটা ভাবতেও খারাপ লাগে, কতগুলো রাজাকারও পরিচয় দেয়, তারাও বাংলাদেশী, বুক ফুলিয়ে এদেশের বুকে ঘুরে বেড়ায়। এটা ভয়াবহ!.
--------------------------------------------------------
যখন প্রাণের সব ঢেউ
জেগে ওঠে, কথা বলে, রক্তের আশ্চর্য কলরবে
বৃষ্টির দুপুরে মনে পড়ে
বর্ষার মতন গাঢ় চোখ মেলে তুমি আছ দু'দিনের ঘরে।।
[শামসুর রাহমান]

-----------------------------------------------------------------------------
বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ
________________________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্পের মত !
ভাল লেগেছে , হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে ।

বোহেমিয়ান

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ
________________________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ

তিথীডোর এর ছবি

দ্বিতীয় পোস্টে নাম জানাতে ভুলবেন না হে অতিথি,
সেটা হোক জলদিই...

--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ তিথীপু...
________________________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ

আরিফ [অতিথি] এর ছবি

বেশ ভাল লাগল।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভালো লাগলো খুব
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ
________________________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ

অনিন্দিতা চৌধুরী এর ছবি

চমৎকার লাগল।

নন্দিনী [অতিথি] এর ছবি

আসলে কি বলব বুঝে উঠতে পারছি না । অসাধারণ বল্লেও কম বলা হয় !

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ
________________________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

চমৎকার। দারুণ একটা গল্প লিখে ফেলতে পারেন ইচ্ছে করলে।

==============================
ঢাকার মৌন ঘ্রাণে বকুলফুলের নাভি
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ
________________________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ

রেনেট এর ছবি

অনবদ্য!
এমন অসাধারণ কবির নাম গোপন রাখা ভারী অন্যায়।
---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

অতিথি লেখক এর ছবি

তোমার কবিতাটা পড়ে আগে যে মন্তব্যটা দিছিলাম, এইখানেও একই মন্তব্য দেই, গদ্য কবিতা সব সময় ভাল্লাগে না, তোমারটা ভাল্লাগ্ছে। চাইলেই এইটা একটা গল্প হইতে পারত, সেটা না করে কবিতা আকারে দিছ, তোমার ভাবনার প্রশংসা করতে হয়। একটা ভিন্ন প্যাটার্ন নিয়ে কাজ করার সাহস দেখাইছ, অভিনন্দন।

অ:ট: নিক টা নিচে উল্লেখ করে দিও। হাসি

- মুক্ত বয়ান।

কনফুসিয়াস এর ছবি

আরেকটু কবিতা হয়ে উঠতে পারলে আরও বেশি ভাল লাগত।
বক্তব্যে পাঁচ তারা।

-----------------------------------
আমার জানলা দিয়ে একটু খানি আকাশ দেখা যায়-

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

সুন্দর লেখা।
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

বিলীন অরণ্য [অতিথি] এর ছবি

খুবই উপভোগ্য লেখা। আগামীতে নামসহ লিখবেন আশা করি।

অতিথি লেখক এর ছবি

খুবই সুন্দর লাগল। অতি প্রাকৃতিক কবিতা।

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ
________________________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ

পৃথিবী [অতিথি] এর ছবি

মন মাতানো একটা লেখা

শংখ [অতিথি] এর ছবি

ভাল লিখেছেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

সত্যি নাকি.. ওয়াও...

________________________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

চলুক
দারুন লাগল।

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।