মিথ: সৃষ্টি রহস্য ২

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২১/০৬/২০১০ - ২:৫৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

http://www.sachalayatan.com/guest_writer/33028

পাখিরা উড়তে উড়তে সৃষ্টিকর্তা কালো হ্যাক্ট্‌সিনের কাছে এসে বলল "আমরা খাব কি?" এ কথা শুনেই কালো হ্যাক্ট্‌সিন তার হাত উপরে তুলে ধরে চারদিকে ঘুরাতেই হাত ভরে গেল নানা প্রকার শস্যে। সবগুলোকে চারদিকে ছড়িয়ে দিল। পাখিরা সব হুমড়ি খেয়ে পড়লো। কিন্তু ইতিমধ্যে শস্যগুলো সব কীটপতঙ্গ, কেচো অথবা ঘাসফড়িং হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে যেতে থাকলো, কেউ কেউ বা লাফাতে থাকলো।প্রথম প্রথম তাদের ধরতে পারছিল না পাখিরা। পাখিদের হিটানোর চেষ্টা করে হ্যাক্ট্‌সিন। বলে "হুম এসব পতঙ্গ ও ঘাসফড়িং ধরা কঠিন কিন্তু তোমরা পারবে"। সেই থেকে আজ অবধি পাখিরা সকাল সন্ধ্যা ব্যস্ত থাকে খাবার শিকারে।

সকল জীবের প্রতিবেশের সাথে সরাসরি মিথষ্কিয়া ঘটে এই খাবারের মাধ্যমে।অন্য সব জীবেরা প্রকৃতির জন্য কখনই কোন হুমকি তৈরি করে নি অথচ মানুষ তার মৌলিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে তছনছ করেছে সারা দুনিয়াকে। আজও অবধি নিশ্চিত হয়নি মানুষের অন্ন। এখন থেকে আঃ ২৫০০ বছর আগে গৌতম বুদ্ধ বলেছিল পাখির মতো জীবন ধারণ করতে। যেখান থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা গ্রহন করে তাদের জীবনাচরণ। সে সময়কার কথা ভাবলে কেমন লাগে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে থালা হাতে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে যা কিছু খাবার জুটত তাতেই সই। যদি না থাকতো গ্রাম তবে হয়তো পুরো পাখিদের মতোই খাবারের খোঁজে বেরুতো বনে বাদারে।শিল্প সভ্যতার এই যুগে এমন মান্ধাত্তা আমলের কথা বলেই বা কি লাভ! ঊনিশ শতকে রোমান্টিসিজমের যৎযামান্য বুদ বুদ দেখা গেলেও পুঁজির তোড়ে ভেসে যায় সবকিছু।কৃষি ও শিল্পের বাড়তি হাতের যোগান দাতা মজুরদের যারা আবার দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষ খাবারের হক আজও আদায় করতে পারে নি আমাদের এই সভ্যতা। প্রতুলের গানে সেই আফ্রিকার লোক কবিতার যে কথা ' ছোকরা চাঁদ জোয়ান চাঁদ হেহহ..হে হে খবর শোনাও একটা খবরতো শোনাও.....কেমন করে কিছু খেতে পাই? এমন সহজ প্রশ্নের সমাধান আজও হয়নি।এসব মানবীয় দানবীয় কর্ম, দেখি কি করছে আমাদের হ্যাক্ট্‌সিন ও পাখিরা?

সব পশুপাখি এসে কালো হ্যাক্ট্‌সিনকে ঘিরে ধরলো, দাবী জানালো সঙ্গী হিসেবে তারা মানুষকে চায়। খুবই সহজ যুক্তি ' তুমিতো সবসময় আর আমাদের পাশে থাকবে না'। কালো হ্যাক্ট্‌সিন বলল " হ্যা এমন তো হতেই পারে, কখনও আমি এমন কোথাও যেতে পারি যে তোমরা আর আমাকে দেখতে পারছ না।" সে হুকুম দিল ছড়িয়ে পড় চারদিকে, যোগাড় কর সবকিছু।যেই কথা সেই কাজ একে একে জড়ো হতে থাকলো বিভিন্ন গাছের রেণু, লাল ও লোহিত বর্ণের খনিজ ধাতু, সাদা কাদামাটি, সাদা লাল সবুজাভ পাথর, জেল জাতীয় পদার্থের জন্য সামুদ্রিক বিভিন্ন শামুক ঝিনুক, মণি মুক্তা সহ বিভিন্ন সব দামী দামী পাথর। যোগাড় যন্ত শেষ হলে কালো হ্যাক্ট্‌সিন গম্ভীর কণ্ঠে বলল "তোমরা সকলে সরে দাঁড়াও"।

সে প্রথমে পূর্ব দিকে মুখ করে দাঁড়ালো তারপর দক্ষিণ, পশ্চিম সবশেষ উত্তর দিকে।হাত ভরে রেণু নিয়ে মাটিতে নিজের অবয়ব আঁকলো প্রথমে।তারপর সকল মূল্যবান ধাতু ও পাথর রাখলো দাগের ভিতরে।যা পরবর্তীতে পরিণত হয় মাংস ও হাড়ে। মুক্তার দাঁত, সাদা কাদামাটির অস্থিমজ্জা, প্রবালের চামড়া এভাবে নানা অঙ্গ তৈরি হলো নানান কিছু দিয়ে। শেষে লম্বা হাত বাড়িয়ে দিয়ে ধরে আনলো কালো মেঘ, মাথায় লাগিয়ে দিলো হয়ে উঠলো কালো চুল বৃদ্ধকালে তা পরিণত হবে সাদা মেঘে।

কালো হ্যাক্ট্‌সিন বাতাস চালনা করে সদ্য তৈরি এই মানব দেহকে প্রাণ দান করলো। জীবনের প্রথম এই প্রাণবায়ু হাতের আঙ্গুলের আগা দিয়ে প্রবেশ করে বলেই নাকি হাতের আঙ্গুলের মাথায় চক্রাকার এমন অসংখ্য দাগ (Whorl) । টিপসই দিলে পরিস্কার বুঝা যায়।আর মরার কালে এই প্রাণবা্য়ু পায়ের পাতা দিয়ে বের হবে যার জন্য অগুণতি সব রেখা চক্রে ভরা পায়ের পাতা।সদ্যজাত এই মানুষটিকে মুখ নিচের দিকে করে হাত দু'টি পিঠের উপর করে রাখা হয়েছে। কৌতুহলী পাখিরা নানা ভাবে উঁকি মারার চেষ্টা করছে কিন্তু কড়া নিষেধাজ্ঞা কালো হ্যাক্ট্‌সিনের।শান্ত ও মোটা গলায় কালো হ্যাক্ট্‌সিন মানুষটিকে বলল ''উঠে বসো"। তারপর সে তাকে কথা বলা, হাসা, চিল্লানো, হাঁটা ও দৌঁড়ানো শিখালো।পাখিরা এ সব দেখে শুনে খুশীতে গান গাওয়া শুরু করে দিলো যা তারা এখনো করে প্রত্যেহ সকালে।

কিন্তু অন্যান্য প্রাণিরা বায়না ধরলো একা একা এই মানুষের একজন সঙ্গী দরকার কালো হ্যাক্ট্‌সিন।কালো হ্যাক্ট্‌সিন ভাবলো তাইতো। সে মানুষটিকে আবার গভীর ঘুমে পাঠিয়ে দিলো। এক সময় মানুষটি স্বপ্নে দেখলো তার পাশে বসে আছে একটি সুন্দর নারী।ঘুম থেকে উঠার পরও দেখলো সে নারী বসেই আছে।সে কথা বললে সেও কথা বলে। সে হাসলে সেও হাসে।পুরুষটি বলল 'চল উঠে দাঁড়াই'। তারা উঠে দাঁড়ালো।সে প্রথম চার কদম হাঁটা দেখিয়ে দিল ডান, বাম, ডান, বাম।এর পর দু'জনে একসাথে দিল দৌঁড়। পাখিরা আবার গান গেয়ে উঠলো মধুর কলকাকলিতে ভরে উঠলো চারপাশ।

এতক্ষণ যাবত যত ঘটনা ঘটতেছে তা আমরা এখন যেখানে বাস করি সেখানে নয়। এ সব ঘটতেছিল এই পৃথিবীর গর্ভে।সবকিছু অন্ধকারাচ্ছন্ন।চাঁদ সূর্য কিচ্ছু ছিল না। সাদা ও কালো হ্যাক্ট্‌সিনরা মিলে তাদের থলে থেকে ছোট্ট একটি চাঁদ ও একটি সূর্য বের করে। এরা ধীরে ধীরে বড় হয় তারপর হ্যাক্ট্‌সিনরা তাদেরকে উপরে পাঠিয়ে দেয় যেখানে তারা উত্তর দক্ষিণে ঘুরতে থাকে এবং চতুর্দিকে ছড়াতে থাকে আলো।এতে মানুষ পশুপাখিদের মাঝে দেখা দেয় ব্যাপক উত্তেজনা। কিন্তু এই সময় অনেক শ্যামন ছিল যারা বলাবলি করতে লাগলো এ কাজ তারাও করতে পারতো।হ্যাক্ট্‌সিনরা এমন কিছুই করেনি যা নিয়া এমন লাফালাফি করা যায়।কেউ কেউ এমনও দাবী করলো যে 'আমি বানিয়েছি এই সূর্য'।অন্য শ্যামনরা বলল 'না আমি বানিয়েছি'।এমন কি তারা ঝগড়া পর্যন্ত বাঁধিয়ে দিল। হ্যাক্ট্‌সিন রেগে গিয়ে আদেশ জারি করলো এমন আজে বাজে কথা বন্ধ করার জন্য। কিন্তু কে শুনে কার কথা। শ্যামনরা যে যার মতো করে উল্টাপাল্টা বলতে থাকলো। কে্উ বলল 'আমি সূর্যকে মাঝ পথে থামিয়ে দেব তাহলে থাকবে না কোন রাত'। কেউ বলল ' চাঁদের আসলে দরকার নাই, রাতের আলোর কি দরকার আছে! পরদিন আবার যখন সূর্য উঠলো তখন পশুপাখিরা পূর্ববত আনন্দফূর্তিতে মেতে উঠলো।একই ভাবে তৃতীয় দিন কেটে গেল।চতুর্থদিন দুপুরে ছিল সূর্য গ্রহন, যা একই ভাবে এখনও ঘটে।
হ্যাক্ট্‌সিনরা সব দাম্ভিক শ্যামনদের ডেকে বলল 'তোমাদের যদি এতই ক্ষমতা তবে এবার ফেরাও দেখি সূর্যকে'।

সব শ্যামনরা এক লাইনে এবং সব পশুপাখিরা আলাদা আর এক লাইনে দাঁড়ালো। শ্যামনরা তাদের গান ও উৎসবের মধ্যদিয়ে কেরামতি প্রদর্শন শুরু করলো।তাদের সব ক্ষমতাই তারা দেখাতে লাগলো। কেউ কেউ গান গাইতে গাইতে বিলীন হয়ে গেল রেখে গেলো শুধু চোখ জোড়া, ফেরত এল কিন্তু সূর্য আর এল না। কেউ তীর গিলে ফেলে তা আবার টেনে বের করলো, কেউ পুরো একটি স্প্রুস গাছ খেয়ে উগলে দিল আরও নানা কিছু। এসব কিছুই বৃথাই ক্ষমতার প্রদর্শন। কাজের কাজ হলো না, রাহুর গ্রাস থেকে ফিরলো না রবি।হ্যাক্ট্‌সিন দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলো তোমরা অনেক কারিস্‌মা দেখিয়েছ এখন তোমাদের সময় শেষ।পশুপাখিদের লাইনের দিকে মাথা ঘুরিয়ে বলল 'এবার তোমাদের পালা'। হকচকিয়ে গিয়ে তারা একে অপরের সাথে অত্যন্ত শান্ত ভাবে কথা বলতে থাকে।হ্যাক্ট্‌সিন আবার বলে 'শুধু কথা বললে চলবে না কিছু করে দেখাতে হবে, উঠে দাঁড়াও তোমাদের সামর্থ্যের মধ্যে যা আছে করে দেখাও'।

প্রথম উঠে দাঁড়ালো ঘাসফড়িং। সে তার হাত প্রসারিত করে চারদিকে যা কিছু পেল নিয়ে আসার চেষ্টা করলো। যখন সবকিছু কাছে এল দেখলো হাতে এসেছে রুটি।ঘাসফড়িং এর দেখাদেখি হরিণও একই কাজ করলো সে পেল উক্কা ফল।এভাবে ভাল্লুক পেল চেরী, শুয়োর পেল বেরী, টার্কি পেল ভুট্টা আরও আরও নানান কিছু।হ্যাক্ট্‌সিনরা এই উপহারে অনেক খুশী হলো কিন্তু এখনও এল না চাঁদ সূর্য।

এবার হ্যাক্ট্‌সিনরা নিজেই কাজে লেগে গেল।চার রংয়ের ঝড় বানিয়ে পাঠিয়ে দিল চারদিকে। এরা নিয়ে এল চার রংয়ের মেঘ যেখান থেকে বৃষ্টিপাত হয়। হ্যাক্ট্‌সিনরা বালুর দাগ দিয়ে চার রংয়ের চারটি ঢিবি বানালো মানুষেরা যে বীজ বপন করে সে বীজ বপন করলো আর মেঘকে বলল রংধনু হয়ে শোভা বর্ধন করতে।পশপাখিরা গান শুরু করলো এবং ঢিবি গুলো বড় হতে লাগলো,বীজ অঙ্কুরিত হতে লাগলো, চার রং মিলে এক রং হলো এবং একটি পাহাড়ে পরিণত হতে থাকলো, বেড়ে চলল ক্রমাগত।

হ্যাক্ট্‌সিনরা খুবই পারঙ্গম ১২ জন শ্যামন নির্বাচিত করলো বিশেষত সূর্যকে ফেরত আনার জন্য তারা যে কেরামতি প্রদর্শন করে তার ভিত্তিতে।৬ জনকে সারা গায়ে নীল রং মেখে দিয়ে গরম কালের প্রতিনিধি আর ৬ জনকে সাদা রং মেখে শীতের প্রতিনিধি ঠিক করে এবং এদের কেই বলা হয় সনাতি। জিকারিল্লা অ্যাপাচি আমেরিণ্ডিয়ানদের যে সনাতি নাচ তার মূল কাহিনী এটি।এর পর আরও ৬ জন সং তৈরী করে হ্যাক্ট্‌সিনরা। তারপর সকলে মিলে নাচ গানের মাধ্যমে পাহাড়কে বড় করে তোলে এবং ফিরিয়ে নিয়ে আসে চাঁদ ও সূর্যকে।

মোমেন

দোহাই

প্রিমিটিভ মিথলজি, দ্যা মাস্কস অফ গড; জোসেফ ক্যাম্পবেল।
আন্তরজালীয় বিভিন্ন শাখা


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

শিল্প সভ্যতার এই যুগে এমন মান্ধাত্তা আমলের কথা বলেই বা কি লাভ! ঊনিশ শতকে রোমান্টিসিজমের যৎযামান্য বুদ বুদ দেখা গেলেও পুঁজির তোড়ে ভেসে যায় সবকিছু।কৃষি ও শিল্পের বাড়তি হাতের যোগান দাতা মজুরদের যারা আবার দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষ খাবারের হক আজও আদায় করতে পারে নি আমাদের এই সভ্যতা ....আবার তার সাথে যোগ হয়েছে জলবায়ু পরবির্তন ।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাদ্য নিরাপত্তা আরো হুমকির মুখে পড়বে ।
লেখাটি ভাল লেগেছে আগেরটির মতই ।
ওলি
oli

অতিথি লেখক এর ছবি

জলবায়ু বা প্রতিবেশ রক্ষার আন্দোনল আর গরীব মানুষের মুক্তির আন্দোলন আজ এক সূত্রে বাঁধা।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

মোমেন।

প্রখর-রোদ্দুর এর ছবি

পড়লাম । মিথ নিয়ে আমার অনেক পড়ার শখ । আপনাকে ধন্যবাদ

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ।

মোমেন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।