মিথ: সৃষ্টি রহস্য

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১৫/০৬/২০১০ - ৫:২৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দুনিয়া এখন যে জায়গায় এখানে কিছুই ছিলনা। এমন কি মাটিও না, ছিল শুধু অন্ধকার, জল আর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। না ছিল মানুষ, পাখি, মাছ এমন কী হেন কোন জীব। নির্জন এই জায়গায় শুধু থাকতো হ্যাক্টসিনরা। অনাদি কাল থেকে তারা আছে। তাদের কাছেই ছিল জগত সৃষ্টির সকল বস্তু। এই ব্রহ্মাণ্ড তৈরীর পর পরম যত্নে তৈরী করে পৃথিবী পাতালপুরী তারপর ঢেকে দেয় আকাশ দিয়ে।উর্ধমূখী জীবন্ত রমণীর অবয়বে তৈরী করা এই ধরণীকে তারা বলতো মা। নিন্মমুখী পুরুষাকার আকাশ তৈরী করে তারা ডাকতো বাবা।

হ্যাক্টসিনদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাধর হলো কালো হ্যাক্টসিন। কালো হ্যাক্টসিন কাদামাটি দিয়ে বানালো এক চার পেয়ে জন্তু, গম্ভীর কন্ঠে বলল "একটু হেঁটে দেখাও তো"।" খুব সুন্দর ! খুব সুন্দর! তোমার দ্বারাই হবে" বলল কালো হ্যাক্টসিন।তুমি বড় একা, আমি তোমার দেহ থেকে অন্য প্রাণিও বানাবো যারা হবে তোমার সঙ্গীসাথী।কালো হ্যাক্টসিন যে কোন কিছু করতে পারে। সে একটি প্রাণির দেহ থেকে তৈরী করলো অপরাপর সকল প্রাণি। সেই সময় সব প্রাণিই কথা বলতে পারতো, তারা কথা বলতো জিকারিল্লা অ্যাপাচি ভাষায়।

সৃষ্টিকর্তা কালো হ্যাক্টসিন বাইরে হাত প্রসারিত করে, এক ফোঁটা বৃষ্টির জল পড়লো তার তালুতে।মাটির সাথে মিশিয়ে তৈরী করে কাদা। তারপর সুন্দর একটি পাখি বানিয়ে বলে "দেখাও দেখি তুমি উড়তে গিয়ে কীভাবে ব্যবহার কর তোমার পাখা"। কাদার পাখি জীবন্ত পাখি হয়ে আশেপাশে উড়তে থাকলো। চার পেয়ে জন্তুর সাথে এর পার্থক্য উপভোগ করতে করতে কালো হ্যাক্টসিন বলল" সাব্বাস! সাব্বাস"। সে বলল ,আমার মনে হয় তোমার সাথী দরকার। এ কথা বলেই পাখিটিকে ধরে জোরে এক চক্কর মেরে দিল।চক্কর খেতে খেতে যখন মাথা ঘুরাচ্ছিল তখন সে অনেক পাখির ছায়া দেখতে পাচ্ছিল। পাখিটি ধাতস্ত হলে দেখল সত্যি সব পাখিরাই সেখানে। আকাশ থেকে পড়া বৃষ্টির পানিতে যেহেতু পাখিরা তৈরী তাই এরা আকাশে থাকতে ভালবাসে।

সৃষ্টিকর্তা কালো হ্যাক্টসিনের কর্মকান্ডের মূল গল্প আপাততঃ ক্ষেমা দিয়ে এবার আমরা ঢুকি গল্পের কানাগলিতে।গল্পের খেই অবশ্য আমাদের সৃষ্টিকর্তারই লীলা খেলা। ঐ যে পাখিকে ধরে চক্কর মেরে দে'য়ার ঘটনা। মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করি ছবিটির দিকে।ডানাবর্তে ঘুর্ণনরত এই পাখির ছবিটি আমেরিকার প্রাগৈতিহাসিক কালের বিভিন্ন পুরাকীর্তিতে পাওয়া গেছে।এই চিহ্নটি খুবই পরিচিত।আমরা একে 'স্বোয়াস্তিকা' নামে চিনি।শব্দটি সংস্কৃত স্বস্তিকের ইংরেজী রূপ। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে পুরাণ যে স্বোয়াস্তিকাটির খোঁজ আমরা জানি তা হলো নবপ্রস্তর যুগের ( আঃ ৪৫০০-৩৫০০ খ্রিষ্টপূর্ব)।মেসোপোটেমিয়ার সামারা মৃৎশিল্প বহন করছে এর সাক্ষ্য। দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে একই থিম বা চিহ্ন কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল তা নিয়ে পণ্ডিতরা এখনও তর্কে লিপ্ত। কিন্তু একথা স্পষ্ট যে স্বোয়াস্তিকা প্রস্তর যুগেও ব্যবহৃত হতো জগতের সর্বত্রে।

ভারতবর্ষ হলো স্বোয়াস্তিকার ব্যাপক বিস্তারের জায়গা। চক্রাকারে ঘুরতে থাকলে সচেতনতা লোপ পেতে থাকে এবং একটা ঘোরের ভিতর থেকে স্বপ্নের মতো ফুটে উঠে অসংখ্য চিত্র।যা ঘটেছিল আমাদের পাখিটির ক্ষেত্রে। যা মূলত রূপান্তর।জগতের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দার্শনিক বুদ্ধ নির্বাণের লক্ষ্যে দুনিয়ার সাথে যে স্বাপ্নিক বন্ধনের সচেতনতা তা দূর করে শুন্যে মিলার যোগ সাধন করতেন। তিনি মনে করতেন শুন্য থেকেই সবকিছর সৃষ্টি।ফলে শুন্যে মিলনেই মুক্তি।জীবন একটা স্বপ্ন। হিন্দু ধর্ম মতে বিষ্ণু এক মহাজাগতিক সাগরে ভাসমান মহাজাগতিক সাপের কুন্ডলীর উপর ঘুমাচ্ছেন এবং স্বপ্নে দেখছেন তার নাভি থেকে পদ্ম ফুল ফুটছে। জগতের সবকিছুই তার অংশ। এসব চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত শেক্সপিয়ার বলছেন "আমরা এমন একটি বস্তু যা স্বপ্ন দিয়ে তৈরী, আমাদের এ ছোট্ট জীবন ঘুমে ঘেরা"।

স্বোয়াস্তিকার আরও নানাবিধ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে। এর চার কোনা দ্বারা চারদিক বা হিন্দুদের মতে জীবনের চার লক্ষ্য: ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ; অথবা জীবনের চার স্তর ব্রহ্মাচর্য, গৃহস্থ, বানপ্রস্থ ও সন্যাস । অনেকে মনে করেন খ্রিষ্টানদের ক্রুস বা হলি ক্রস স্বোয়াস্তিকারই একটি রূপ। বিংশ শতকের জনপ্রিয় কসমোলজিস্ট কার্ল স্যাগানের ধারণা বলেই আজকে শেষ করব। চীনাদের বিভিন্ন রকম আঁকর গ্রন্থ ঘেঁটে তিনি নানা ধরণের ধুমকেতুর লেজের বর্ণনা পেয়েছেন। তার মধ্যে একটির লেজ স্বোয়াস্তিকার মতো।কার্ল স্যাগান বলতে চাচ্ছেন, নব প্রস্তর যুগে হয়তো ঐ ধুমকতুটি পৃথিবীর খুব কাছাকাছি ছিল যার ফলে আকাশে দৃশ্যমান এই চিহ্নটি সকলের খুব চেনা।

পরবর্তি পর্বে আবার ফিরে যাব কালো হ্যাক্টসিনের লীলাখেলায়।

তথ্যসূত্র : প্রিমিটিভ মিথলজি, দ্যা মাস্কস অফ গড; জোসেফ ক্যাম্পবেল।
অন্তরজালীয় বিভিন্ন শাখা
মোমেন


মন্তব্য

মূলত পাঠক এর ছবি

খুবই আকর্ষক বিষয়, পড়ে ভালো লাগলো। আরো লিখুন নানা মিথ নিয়ে।

স্বস্তিকা যেহেতু সংস্কৃত/বাংলা শব্দ, বাংলায় একে স্বোয়াস্তিকা বলার দরকার নেই বলেই মনে হয়।

অল্প কিছু বানান ভুল চোখে পড়লো: আকর গ্রন্থ, ধূমকেতু, পরবর্তী ইত্যাদি।

অতিথি লেখক এর ছবি

অতিথি লেখক হওয়ার কারণে আপনি বলে দেওয়ার পরও ভুল বানানগুলো শুধরাতে পারলাম না। দুঃখিত।
আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ।

মোমেন

পারী এর ছবি

কি অদ্ভুত !!!!

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ে মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।

মোমেন

মাহবুব লীলেন এর ছবি

পুরাণ আমার সবচে প্রিয় বিষয়

০২

খুব অল্পতেই শেষ হয়ে গেলো মনে হয়?

অতিথি লেখক এর ছবি

আমরা জগৎ সম্পর্কে খুবই কম জানি। মাত্র ২৫০০ বছরের মোটামুটি লিখিত ইতিহাস আছে।তাও মূলত অর্থের হিসাব নিকাশ অথবা রাজ রাজরাদের কাহিনী। আমরা যদি আরদি থেকেও মানুষের ইতিহাস ধরি তবুও প্রায় ৪০ লক্ষ বছর। পুরাণে অনেক গল্প আছে যা আমাদেরকে সেই সব দিনের হাতছানি দেখায়।
পুরাণই আমাদের অতীতের 'অন্ধের যষ্ঠী'।

আপনার কথায় অনুপ্রাণিত হলাম। ধন্যবাদ।

মোমেন

অতিথি লেখক এর ছবি

মিথ সম্পর্কে আগ্রহ আছে অনকেরই । সাহিত্যের সাথে মি থে র যোগসুত্র রয়ে ছে । সাহিত্য বু ঝতে হলে মিথ সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরী । পরবর্তী পোস্টের প্রত্যাশায় রইলাম ।
ওলি

অতিথি লেখক এর ছবি

মিথের যোগসূত্র সর্বত্রই।

ধন্যবাদ

মোমেন

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

চলুক

মিথ আমার খুব পছন্দের একটা বিষয়।

জোসেফ সাহেবের বইটার বহু নাম শুনেছি- মনে হচ্ছে পড়া দরকার।

_________________________________________

সেরিওজা

অতিথি লেখক এর ছবি

জ্বী জোসেফ ক্যাম্পবেলের বইগুলা খুব মজার। পড়ে ফেলেন। ভাল লাগবে।

ধন্যবাদ।

মোমেন

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুণ.. শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ...

______________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব খুশী হলাম।

মোমেন

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

দারুণ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

মোমেন

বোহেমিয়ান এর ছবি

মিথ পড়ার সময় যেন সেই ছোটবেলায় কল্পরাজ্যে ফিরে যাই এমন একটা অনুভূতি হয় ।
_________________________________________

_________________________________________
ওরে! কত কথা বলে রে!

অতিথি লেখক এর ছবি

তাইতো অনেক মিথলোজস্ট বলেন-ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই নাকি সারা জীবনকে তাড়িত করে।

মোমেন

নাশতারান এর ছবি

খুব ভালো লাগলো। মিথোলজি আমার ভীষণ প্রিয়। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

কিছু শব্দের ব্যাপারে বলার ছিলো। সময় পেলে এখান থেকে দেখে নেবেন।

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।
মোমেন

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার লাগলো। এই নিয়ে তেমন একটা ঘাটাঘাতি করা হয়নি, তবে ইচ্ছা জাগলো পড়ে।

পলাশ রঞ্জন সান্যাল

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লেগেছে জেনে খুশী হলাম।

মোমেন

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

মিথোলজি খুব প্রিয় বিষয়। আগ্রহ নিয়ে পড়লাম।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ।

মোমেন

তুলিরেখা এর ছবি

মিথোলজি আমার খুব প্রিয় বিষয়। আরো লিখুন, সাগ্রহ অপেক্ষায় রইলাম।

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার আগ্রহে অনুপ্রাণিত হলাম। ধন্যবাদ।

মোমেন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।