কেউ কথা রাখে নি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ০১/০৭/২০১০ - ১:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

==নিশা==

কেউ কথা রাখেনি ।

সাড়ে সতের বছর কেটে গেলো কেউ কথা রাখে নি।

ক্লাস এইটে পড়াকালে বাবা মা বলেছিলেন, "শুধু সাধারণ গ্রেডেই বৃত্তি পাও মা-মণি, তোমাকে কিবোর্ড আর ক্যামেরা মোবাইল কিনে দিবো।"

পরীক্ষা দিলাম।

সাধারণ গ্রেডে নয়, ট্যালেন্টপুলে নয়, বৃত্তি পেলাম মেধাতালিকায়।

কিন্তু কিবোর্ড তো দূরের কথা, একটা স্লেট বোর্ডও পেলাম না।

আর ক্যামেরা মোবাইল?

বৃত্তির টাকা দিয়ে কিনলাম নোকিয়া ১১১০i!

পাড়াপ্রতিবেশিকে দশ কেজি মিষ্টি বিতরণ করেই বাবা মা দায়িত্ব শেষ করে দিলেন।

আর আমি পেলাম সাড়ে ছয়শ টাকা দামের একটা সাদা বিশালের থ্রি পিস (গুষ্টি কিলাই থ্রি পিসের !)

ছোট মামা দিলেন একটা সৌদি বোরকা। (শালার পুত ছোট মামা !!)

গানের তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা।

গানের স্যার বললেন, "ছয়টা বিষয়ের মধ্যে অন্তত তিনটাতে প্রথম পাঁচ জনের মধ্যে থাকলে তোকে টপ্পার তালিম দেবো।"

লিখিত পরীক্ষায় তৃতীয় হলাম।

লোক সংগীতে দ্বিতীয় হলাম।

শাস্ত্রীয়, নজরুল, আধুনিক আর রবীন্দ্র সংগীতে হলাম প্রথম।

ধ্রুব পরিষদের শ্রেষ্ঠ সংগীত মুকুল হলাম।

গানের স্যার কেবল আশীর্বাদ করলেন। মন খারাপ

টপ্পা শেখার জন্য নাকি আরও পাঁচ বছর সাধনা করে কণ্ঠ তৈরি করতে হবে।

টেনের প্রথম সাময়িক পরীক্ষার পর মা নিয়ে গেলেন বান্দরবানে এক হিন্দু পীরের কাছে। ওই ব্যাটা নাকি লক্ষণ দেখে সকল অতীত ভবিষ্যত্‍ বলতে পারে।

আমার জন্ম তাং, সন ইত্যাদি বৃত্তান্ত জেনে ব্যাটা বললো, "এ হলো খাঁটি বামুন রাশির মেয়ে। সুলক্ষী ও পয়া। কিন্তু এ সংসারধর্ম করবে না। সারাজীবন ভবঘুরে থাকবে। ছটফইট্যা বাউল পাখিকে শিকলে বাঁধতে চাইলে প্রতিদিন এই মন্ত্রপড়া ডাবগুলো খাওয়াবেন। এই অষ্টধাতুর তাবিজটা সবসময় গলায় যেন থাকে। আর পূর্ণিমার আগের দিন এর দুই কান ফুটো করে সোনার রিং পড়ায় দেন। এতো বড় মেয়ের কান ফুটা ছাড়া কেন?"

তিন হাজার টাকা দিয়ে মা তাঁর কন্যাকে সংসারী করার জন্য ডাব তাবিজ শেকড় কিনলেন ।

কানের দুল পড়বার খায়েশ কখনও জাগেনি গুরুর মুখে অলংকারের ইতিহাস শোনার পর।

মা লোভ দেখালেন, "হ্যারি পটারের সবগুলো বই কিনে দেবো।"

আমার এত্তো কিউট ছোট ছোট কানের মাঝে খুঁত সৃষ্টি হলো।

হ্যারিকে পেলাম না।

দুলও পড়ি না।

নানার দাদার ভাই ছিলেন পীর। সেই পীর বংশের পোলা হয়ে আমার ব্যবসায়ী খালাতো ভাই প্রেমে পড়লো। খালা অন্যত্র বিয়ে ঠিক করে রেখেছে। উপায়ান্তর না দেখে খালার ছেলে আমার সাহায্য চাইলো।

কথা ছিলো, তার সমস্যার সমাধান হলে সে আমার এক শত্রুকে এমন ছ্যাঁচা দিবে যাতে তার ঠ্যাং ভাঙ্গে। তিন মাস ধরে এই আমার রচিত ও পরিচালিত বহু নাটক মঞ্চায়নের পর খালাতো ভাই তার প্রেমিকাকে বউ করলো। কিন্তু, সেই হারামজাদা এখনও তার লম্বা ঠ্যাং নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ।

বাবা মা আশ্বাস দিলেন, "এস.এস.সি তে গোল্ডেন পাও সোনা, রবীন্দ্র রচনাবলি উপহার দেবো। আর কম্পিউটার ও ইন্টারনেট তো লেখাপড়ারই একটা অংশ। এটা তো অবশ্যই পাবে।"

ছোট মামা বললো, "অসাধারণ সারপ্রাইজ দিবো যা পেয়ে খুশিতে চিল্লাবি।"

কেবল গোল্ডেন পেলেই হতো। কিন্তু না, আমি চট্টগ্রাম কলেজে চান্স পেলাম। মেধাতালিকায় প্রথম দেড়শ জনের মধ্যে এলাম। বোর্ড বৃত্তি পেলাম।

বাবা মা এবার ত্রিশ কেজি মিষ্টি বিলালেন।

আমি পেলাম উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের বই সমগ্র।

এপ্রোন।

হাই সানের ব্যাগ।

দুইটা খাদির পাঞ্জাবি।

একটা নতুন জিন্স চেয়েছিলাম, পাই নি।

আমার রবির সাহিত্য সমগ্রও আমার কপালে জোটে নি।

কম্পিউটার???

হুম !

ছোট মামা দিলেন তফসীর ও তর্জমা সহ কোরআন শরীফ। (অশ্রাব্য গালিটা আর না দিই !)

জিয়া স্যার বলেছিলেন, আমার আঠারো বছর হলে তাঁর ছেলের সাথে আমার বিবাহ দিবেন।

কত স্বপ্ন দেখেছি। তিন বছর ধরে স্যারকে শ্বশুরআব্বা ডেকেছি।

আঠারো হতে আর পাঁচ মাস বাকি।

জিয়া স্যার এখনও বিয়ে করেন নি।

কেবল বলেন, "I HATE GIRLS."

আমার পোলা আমার মাথায় হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করেছিলো, পহেলা জানুয়ারি থেকে আর সিগারেট খাবে না।

কিন্তু সাতাশে ফেব্রুয়ারিতেও তার শার্টে লেগে ছিলো সিগারেটের গন্ধ।

খুব কান্না পেলো।

কথা বলা বন্ধ করে দিলাম।

এখন নাকি সে সত্যিই আর সিগারেট খায় না, বার বার শপথ করে বলেছে।

বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় বৈকি!

ইকরি বললো, "সামনে পরীক্ষা। তাই দুই মাস আইসক্রিম খাবি না। আমি তোকে পয়লা মে তিনটা কোন আইসক্রিম খাওয়াবো। তুই আমার বোন হলে আমার কথা রাখবি।"

কোন আইসক্রিমের লোভে না।

ভাইকে দেয়া কথা রাখতেই কত ইগলু, চকবার, চকলেট আইসক্রিমের হাতছানি করেছি উপেক্ষা এই কাঠফাটা গরমের মাঝেও।

কত কষ্ট সংযম পালন করেছি তা ইতিহাসের পাতায় স্থান পাওয়ার যোগ্য।

আমার চোখের সামনে ছোট বোনদ্বয় মজাসে খেয়েছে আইসক্রিম।

আমি চেয়ে চেয়ে দেখেছি।

পয়লা মে এলো।

বিশ্বাসঘাতকটা আমাকে আর কোন আইসক্রিম খাওয়ায় নি।

মে মাসের দুই তারিখ আমি একদিনেই তেরটা আইসক্রিম খেয়ে জ্বর বাধিয়েছি।

সতের ফেব্রুয়ারিতে গুরুদেব বলেছিলেন....থাকগে!

হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগিয়ে কাজ নেই।

আমিই সবার কথা রেখেছি।

আমার কথা...কেউ রাখেনি।

অ.ট.: সচলের শুভ জন্মদিনে শুভেচ্ছা। সচল আরো সচল আর সুন্দর হোক।


মন্তব্য

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

সাড়ে সতেরোতেই এতো হাহাকার?
সর্বনাশ!

শান্ত [অতিথি] এর ছবি

খুব ভালো লাগলো আপনার লেখাটা পড়ে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।