হারিয়ে যাওয়া বন্ধু

পাগল মন এর ছবি
লিখেছেন পাগল মন [অতিথি] (তারিখ: রবি, ০১/০৮/২০১০ - ৭:২৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শায়নের “এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধু” গানটা যখন প্রথম শুনেছিলাম সেদিনই মনে হয়েছিল এ জীবনে আমারো অনেক বন্ধু হারিয়ে গেছে কালের স্রোতে। কখনো চিন্তাই করিনি যে ওদের সাথে যোগাযোগ থাকবে না কখনো। বন্ধুদিবসে আমার সেসব বন্ধুদের কথা খুব মনে পড়ছে।

ছোটবেলায় যে বাসায় থাকতাম তার পাশের ফ্ল্যাটেই আমার সমবয়সী একজন থাকতো। আমি বুঝতে শেখার পর হতেই ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব। প্রতিদিনই আমরা একসাথে খেলতাম, ঘুরতাম। আমাদের দুই ফ্যামিলির মধ্যেও বেশ ভাব ছিল। আমরা প্রথমে একই স্কুলেও ভর্তি হলাম। ক্লাস টুতে আমি অন্য স্কুলে চলে যাই কিন্তু মাসুম আগের স্কুলেই থেকে যায়। কেন যে ও ওই স্কুলে রয়ে গিয়েছিল সেটা আমার কাছে আজও রহস্য। ও আর আমি প্রায় একই ধরনের ছাত্র ছিলাম, ও চাইলেই আমার স্কুলে আসতে পারতো তাহলে হয়তো ওর সাথে যোগাযোগটা হারাতো না। মন খারাপ

মাসুমদের বাড়ি ছিল বরিশাল। প্রতি বছর ওরা স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে ওদের গ্রামের বাড়িতে যেত আর আসতো মোটামুটি জানুয়ারী মাস শেষ করে। আর এসে যে কি গল্প, সেই গল্প চলতো প্রায় মাস দুয়েক। ওর এই গল্পের কারনে আমি ওদের গ্রামের বাড়ির ভক্ত হয়ে পরেছিলাম। একবার আমিও ওদের সাথে যাওয়ার বায়না ধরলাম আম্মুর কাছে। আম্মু প্রথমে রাজিও ছিল কিন্তু যাওয়ার আগের দিন আমাকে বললো, আমার যাওয়া লাগবে না। আমি অনেক কান্নাকাটি করেছিলাম সেদিন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। আমার আর বরিশাল যাওয়া হয়নি। এই আফসোস আমার সারাজীবন থাকবে মনে হয়।

মাসুমরা কয়েক বছর পরে বাসা বদলায়। কিন্তু ওদের নতুন বাসাও আমাদের কাছাকাছিই ছিল তাই প্রতিদিন বিকালে ওদের বাসায় যাওয়া আমার একরকম রুটিন ছিল। কিন্তু ক্লাস সেভেন অথবা এইটে ওর বাবা মারা যায় তারপরেই ওদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকে। পরে ওরা ওদের এক মামা না চাচার ওখানে চলে যায়, জায়গাটা মনে হয় কাচপুর ব্রীজের ওপারে। এরপরেই ওর সাথে আমার যোগাযোগ একরকম বন্ধ হয়ে যায়। ওরা চলে যাওয়ার পরে একবার দেখা হয়েছিল, এসএসসি পাশের পরে। তারপরে আর কখনো দেখা হয়নি।ও হচ্ছে আমার প্রথম হারিয়ে যাওয়া বন্ধু।

স্কুলে থাকতে আমার কিছু বন্ধু ছিল যাদের অনেকের সাথে আজও আমার বন্ধুত্ব আছে। এজন্য আমি নিজেকে বেশ সৌভাগ্যবান মনে করি। কিন্তু একই সাথে কিছু বন্ধু আমি হারিয়েছিও। এরকমি একজন হচ্ছে রানা। আমরা একই ক্লাসে পড়তাম, সে সুবাদেই বন্ধুত্বের শুরু। আমার বেশিরভাগ বন্ধুকেই আমার মা চেনে আর তাদের মা’দের সাথে আমার আম্মুর বেশ ভালো সম্পর্ক। রানার ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম ছিলনা, তবে সম্পর্কটা আরো গভীর ছিল। আমরা প্রায়ই ওদের বাসায় যেতাম। ওদের বাসার কাছেই আমার এক মামার বাসা ছিল, এজন্য যাওয়াটা ঘনঘনই হতো। আমি ওর সাথে অনেকগুলা পৌষসংক্রান্তি কাটাইছি। উফ, সেসব দিনগুলা কতই না আনন্দের ছিল। মন খারাপ

ক্লাস এইটে থাকতে রানারা বাসা চেঞ্জ করে রাম্পুরার দিকে নেয়। এজন্য ও স্কুল চেঞ্জ করে। এরপরে ওর সাথে যোগাযোগ কমতে থাকে। তবে এরপরে আমি অবশ্য অনেকদিন ওদের বাসায় গেছি, রাতে ছিলাম। ওদের বাসায় যখনি যেতাম আমরা খুব মজা করতাম। খালাম্মা (রানার মা) আমাকে খুব পছন্দ করতেন, এজন্য তেমন কিছু বলতেন না।

এইচএসসি পর্যন্ত ভালোই যোগাযোগ ছিল, আমি বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পরে হলে চলে আসি। আস্তে আস্তে যোগাযোগ কমতে কমতে শুন্যের কোঠায় নেমে আসে, ও পরিণত হয় আরেকজন হারিয়ে যাওয়া বন্ধুতে।

স্কুলের আরো কিছু বন্ধু আমার হারিয়ে গেছে, তাদেরই একজন মহিন। আমরা প্রায় প্রতিদিন স্কুলে একসাথে খেলতাম। ক্লাস এইট থেকে ক্রিকেট খেলা শুরু করি। আমাদের স্কুলে তেমন খেলার জায়গা ছিলনা। এজন্য আমর স্কুলে বাইরে একটা জায়গায় গিয়ে খেলতাম। ক্লাস নাইন থেকে টেন পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন চার/পাঁচ পিরিয়ড পরেই আমরা স্কুল পালাতাম আর খেলতে যেতাম। আমরা আরো কয়েকজন (মানিক, শাহিন, শ্যামল, সোহাগ, সন্জিত আর মনে পড়ছে না) একসাথে খেলতে যেতাম। এসএসসির পরে আমি অন্য কলেজে ভর্তি হলাম, আর ওদের সাথে যোগাযোগ কমে গেল। এইচএসসির পরে সেটা নাই হয়ে গেল একেবা্রে, বাড়ালো ওরা হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সংখ্যা।

কলেজে আমার তেমন বন্ধু ছিলনা। একেতো কলেজ আমার বাসা থেকে অনেক দূরে ছিল আর আমি সব কোচিং পড়তাম আমার এলাকার কাছাকাছি, আমার কিছু স্কুল ফ্রেন্ডের সাথে। শুধু কলেজে থাকার সময়টা ছাড়া কলেজের কারো সাথে মেশা হয়নি। একমাত্র ব্যাতিক্রম ছিল মনজু। ওর সীট ছিল আমার সাথেই আর কুইজ, পরীক্ষা সব সময়ই ও বসতো আমার পেছনে। একসাথে বসার কারনেই ওর সাথে পরিচয়। পরে কুইজে দেখাদেখি, ল্যাবে একসাথে বসা, ল্যাব করা ইত্যাদি থেকে বন্ধুত্বের সূত্রপাত। সেকেন্ড ইয়ারে উঠে আমরা হয়ে গেলাম সিনেমাপ্রেমী। কাছেই ছিল মধুমিতা, প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আমরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখতে লাগলাম। এছাড়া তখন সাইবার ক্যাফে নতুন নতুন খুলছে, নতুন একটা জিনিস, ইন্টারনেট। আমরা প্রায়ই সাইবার ক্যাফেতে যেতাম। এই করে করে আমাদের সেকেন্ড ইয়ারে উপস্থিতির হার আশংকাজনক অবস্থায় পৌছে গিয়েছিল, আরেকটু হলেই গার্জিয়ান ডাকে এঅবস্থা আরকি।

এইচএসসি পরীক্ষার সময় মনজুর সীট আমার পাশেই পরে। আর আমাদের সীট পরছিল বিজ্ঞান কলেজে। আমরাতো ধুমায়ে দেখাদেখি করে পরীক্ষা দিছি। দুইটা কি তিনটা পরীক্ষা পরেই মনজুর হলো প্রচন্ড জন্ডিস। ওতো ভয়ই পেয়ে গেল যে এবার মনে হয় পাশ করতে পারবে না। আমি বললাম, কোন চিন্তা নাই, তুই খালি পরীক্ষা দিতে আয় তারপরে আমি আছি। এভাবেই পরীক্ষা শেষ হয়। মনজু বেশ ভালোভাবেই পাশ করে। পরীক্ষার পরে ওর সাথে আমার অনেকদিন দেখা হয়নি। পরে আমি যখন বুয়েট ভর্তি কোচিং এ যাই তখন আবার দেখা হয়। কিন্তু বুয়েটে ভর্তির পরে আর যোগাযোগ হয়নি। কলেজ লাইফের একমাত্র বন্ধু আমার কিন্তু সেও হারিয়ে গেছে।

স্কুল শেষে আরো কিছু বন্ধুর সাথে যোগাযোগ হারিয়ে গেছিল। কিন্তু ফেসবুকের কল্যাণে আবার তাদের সাথে যোগাযোগ শুরু হইছে। এই চান্সে যুকারবার্গকে একটা ধন্যবাদ জানায়ে দিচ্ছি। চোখ টিপি
সবশেষে শায়নের গানটা শেয়ার করতে চাই যেটা এই লেখাটার অনুপ্রেরণা আর ওর সাথে তাল মিলিয়ে বলতে চাইঃ


"শোন বন্ধু কখনো কোন বন্ধুকে বোলনা যেন বিদায়"

পাগল মন

Ek Hariye Jawa Bo...


মন্তব্য

মুস্তাফিজ এর ছবি

হারিয়ে যাওয়া বন্ধু। আহারে...

...........................
Every Picture Tells a Story

অতিথি লেখক এর ছবি

বন্ধু কখনো হারায় না।চোখের আড়াল হয়।
__________
ত্রিমাত্রিক কবি

অতিথি লেখক এর ছবি

হায়! সবার জন্যই যদি কথাটা সত্যি হতো। মন খারাপ

পাগল মন

তিথীডোর এর ছবি

কখনো কোন বন্ধুকে বলোনা যেন বিদায়....

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।