সূর্যকুমারী

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২১/০৮/২০১০ - ৯:২২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সুধী,

এই প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগেও বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করাটা আমাদের রীতি ছিল, তার মধ্যে, মধ্য আমেরিকার বিলুপ্ত সাম্রাজ্যের ইতিহাস এবং রোমান্স অন্যতম।

ওইসব দূরবর্তী দিনগুলোর স্মরণে আপনি কি একটি উপাখ্যান গ্রহণ করবেন, যা পেরুর সেই অসামান্য ইনকাদের একজনকে নিয়ে রচিত; তার সাথে সেই কিংবদন্তিও—স্প্যানিশ আগ্রাসনকারীদের লুটতরাজ এবং ধ্বংস শুরু হওয়ার অনেক আগে, সেই অনাবিষ্কৃত ভূমিতে বাস করত এবং চিরনিদ্রায় শায়িত আছে একজন সাদা ঈশ্বর যে কিনা উত্থিত হয়েছিল সমুদ্র থেকে?

হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড
অক্টেবার ২৪, ১৯২১

ভূমিকা ॥

কিছু লোককে এটা খুব টানে, এমনকি হয়তো সান্ত্বনাও দেয়, অতীতের ছাইভষ্ম যে দুশ্চিন্তা জমিয়ে তোলে আমাদের দেহমনে তার থেকে মুক্তি দেয় সেইসব গুপ্ত সম্পদের খোঁজ, যা সময়ের স্রোতে আমাদের আধুনিক জীবন থেকে হারিয়ে গেছে।

বড় সংগ্রাহকরা এই শ্রেণীর নয়। এদের লেনদেনে মোটা অঙ্ক বিনিময় হয়। এরা বাজারে আসা দুর্লভ যেকোনো কিছুর দখল নেয়। সেগুলো রেখে দেয়া হয় যথাসময়ে বিক্রি করার জন্য, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর মালিকের মৃত্যুর অব্যবহিত পরপর, অথবা বাজারের অন্য সমঝদারদের কাছে পেশ করা হয়। সেইসব ডিলাররা, যারা বেচা-কেনা করে ধনি হয়ে ওঠে তারাও এই শ্রেণীর নয়। বিভিন্ন দেশের জাদুঘরগুলোর দালালরাও নয়, যারা জাতীয় স্বার্থে কেনে এবং বড় বড় সংগ্রহশালাগুলোয় জড়ো করে রাখে; কোনো একদিন, যদিও চিন্তাটা কাঁপুনি তুলে দেয় অনেকের মনে, এসব লুট অথবা ধ্বংস হয়ে যাবে হয় শত্রু নয় ভয়ংকর লুটেরাদের হাতে।

ওইসব কিছু যা এই সম্পাদকের মাথায় আছে, এই কাগজে ছাপানো ঘটনাপঞ্জি যার কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, সে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের, প্রায়শ ছোটখাটো পুরোনো জিনিস সে জোগাড় করে, যার অধিকাংশই ব্যক্তিগতভাবে অথবা প্রথাবিরুদ্ধ উপায়ে বিক্রি করে, কারণ এটা শুধু তার পেশাই নয় ভালোবাসাও বটে। এসব পুরোনো জিনিসের আবেদন বারবার ফিরে আসে, এগুলোর প্রকৃত মূল্য বা সৌন্দর্য তার কারণ নয়, এমনকি শিক্ষিত চোখেও সেগুলো অনাকর্ষণীয় মনে হতে পারে, বরং এগুলোর ঐতিহ্যই দায়ী এর জন্য। এহেন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের মালিকেরা প্রাচীন মৃত মানুষদের সম্পর্কে ধারণা নিতে ভালোবাসে, জীর্ণ এলিজাবেথিয়ান চামচ দিয়ে এরা চুমুক দেয় স্যুপে, এদের রান্নাঘর অথবা বৈঠকখানায় দেখতে পাওয়া যায় ভঙ্গুর ওক কাঠের টেবিল, কতেক সময় ভাঙা প্রাচীন চেয়ার। এরা চায় এদের বাচ্চারা তাদের ক্লান্ত, দক্ষ হাতে ম্রিয়মাণ সূচিকর্মের নকশা ঠিক করবে, তাদের উজ্জ্বল চোখ খুঁজে পাবে সেলাইয়ের প্রতিটি ফোঁড়।

উদাহরণ হিসেবে মে শোরের কথা বলি (তার ডাক নাম ছিল ফেইরি যা তার নামের নিচে ব্র্যাকেটে আঁকা ছিল), সে তার দশম জন্মদিনে ওই ধরনের একটি সূচিকর্ম সম্পূর্ণ করেছিল, মে মাসের প্রথম দিন—নিঃসন্দেহে তার নামের উৎপত্তিও এখান থেকেই—১৭০২ ইং সনে, এবং কোথায় সে এখন তার জন্মদিন পালন করে? কেউ হয়তো জানবে না। যেখান থেকে সে এসেছে, সেই দারুণ রহস্যময় সাগরে সে মিলিয়ে গেছে, এবং সেখানে সে বাস করে, অথবা ঘুমায়, ঘুমায় এবং ঘুমায়। সে তরুণী অবস্থায় মারা গেছে নাকি বৃদ্ধা হয়ে, বিবাহিতা ছিল নাকি কুমারী? সে কি তার বাচ্চাদের সূচিকর্ম শিখিয়েছে নাকি তার কোনো বাচ্চাই ছিল না? সে সুখী ছিল না অসুখী, সে কি সুন্দরী ছিল নাকি ছিল সাধারণ আটপৌরে? সে পাপী ছিল না সন্ত? কেউ হয়তো জানবে না। সে জন্মেছিল ১৬৯২ ইং সনের পয়লা মে, এবং নিশ্চয়ই তার মৃত্যুর তারিখ অরক্ষিত রয়ে গেছে। মানুষের জ্ঞানগম্যি যতটুকু যায় তাতে এইটুকুই তার পুরো কাহিনী, শুধু এত বেশি অথবা এত কম, যেমনটি আমাদের অধিকাংশই, যারা আজ শ্বাস নিচ্ছি তারা রেখে যাব, যখন এই পৃথিবী সূর্যের চারদিকে আরও দু শ আঠারো বার প্রদক্ষিণ করবে।

কিন্তু যে পান্ডুলিপিটির কিছুটা উন্নত সংস্করণ ছাপা হয়েছে পরের পৃষ্ঠাগুলোয়, সেটি যার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে সেই ব্যক্তিটি হতে পারে বৈচিত্র্যময় সংগ্রাহক শ্রেণীর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। কয়েক বছর হয় সে মারা গেছে, কোনো আত্মীয়-পরিজন না রেখে; এবং তার উইল অনুযায়ী স্থানীয় জাদুঘরে তার বিচিত্র সম্পদের একটি অংশের জায়গা হয়েছে, বাকি অংশ বিক্রি করা হয়েছে তার মরমি ভ্রাতৃত্ব সংঘের কল্যাণে, কারণ বুড়ো ভদ্রলোকটি ছিলেন আধ্যাত্মবাদী। এ কারণে তার প্রকৃত নামটি উল্লেখ করতে আর কোনো অসুবিধে নেই, তার নাম পটস্। ইংল্যান্ডের পশ্চিমে এক ছোট্ট শহরে মি. পটসের একটি দোকান ছিল, যেটি তিনি চালাতেন প্রায় তাঁর মতোই বৃদ্ধ আর অদ্ভুত এক সহকারীর সহায়তায়। এর বাইরে তাঁর অন্য কোনো কিছু ছিল কি না কিংবা তাঁর কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিল কি না সেসব এখন অজানা, জানাটা অপ্রয়োজনীয়ও বটে। সে যা-ই হোক, যখন কোনো প্রাচীন নিদর্শন কেনার প্রয়োজন হতো তাঁর, একই সাথে প্রয়োজন হতো টাকারও, আর তার জন্য সে বাধ্য হতো অন্য কোনো কিছু বিক্রি করতে। সত্যি, মি. পটসের কাছ থেকে কিছু কেনার এটাই ছিল একমাত্র উপলক্ষ।

এখন আমি, এই সম্পাদক স্বয়ং, পুরোনো জিনিস সংগ্রহ করতে ভালোবাসি, আর এ কারণে মি. পটস্ আমার প্রতি বিশেষ সহানুভূতিশীল ছিলেন। এই বিষয়টি আমি অবগত ছিলাম বলে তার সহকারীটির সাথে আমার একটি বিশেষ ব্যবস্থা তৈরি করা ছিল যে যখনই তার মনিবের টাকার প্রয়োজন হতো, আমি সেটা জানতে পারতাম। আর এভাবে একদিন নিচের চিঠিটি আমার হাতে এল—

জনাব,

আমার মনিব কিছু পুরোনো, ভাঙাচোরা চীনামাটির মূর্তি কিনতে যাচ্ছে, কী ভয়াবহ কুৎসিত এক একটা! তাই, আপনি যদি সেই পুরোনো লম্বা ঘড়িটি অথবা অন্য যে কোনো কিছু ন্যায্য মূল্যে পেতে চান তবে এটাই আপনার সুযোগ। যা হোক বিষয়টি গোপন রাখুন, আমাদের চুক্তি অনুযায়ী।

আপনার বিশ্বস্ত, টম।

(সে সব সময় টম নামে সই করত, আমার ধারণা এটা তার সাবধানতা, যদিও তার প্রকৃত নাম আরও ভালো কিছু ছিল বলে আমার বিশ্বাস।)

এই পত্রের ফল দাঁড়াল এই যে, আমাকে শরতের ভেজা আবহাওয়ায় একটি লম্বা ও অসন্তোষজনক সাইকেল ভ্রমণে বের হতে হলো, এবং যেতে হলো মি. পটসের দোকানে। টম একজন বৃদ্ধা, মোটা মহিলার কাছে অদ্ভুত ধরনের অন্তর্বাস বিক্রির চেষ্টা করছিল, আমাকে দেখে চোখ টিপল। দোকানের ছায়াঢাকা এক কোণে একটি উঁচু টুলে মি. পটস নিজেই বসে আছেন, শীর্ণচর্ম ছোট্ট মানুষটির শিরদাঁড়া বাঁকা হয়ে আছে, টেকো মাথা, এবং বড়শির মতো বাঁকা নাকে বিশাল এক হর্নরিমের চশমা, যা নিজের বাসায় বসে থাকা পেঁচার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। তিনি বস্তুত কোনো কিছুই না করায় ব্যস্ত, তাকিয়ে আছেন শূন্য দৃষ্টিতে, টমের মতে এটি তাঁর প্রকাশভঙ্গি—আত্মাদের সাথে যোগাযোগ করার।

‘খদ্দের!’ কর্কশ কণ্ঠে টম বলল। ‘আপনার প্রার্থনায় বাগড়া দেয়ার জন্য দুঃখিত, মনিব; কিন্তু যেহেতু আমার দু জোড়া হাত নেই তাই আমি একা ভিড় সামলাই কী করে।’ ভিড় বলতে বৃদ্ধা মহিলাটি আর আমি।

মি. পটস্ টুল থেকে নেমে তৈরি হলেন ক্রেতার মুখোমুখি হওয়ার জন্য। যখন তিনি দেখলেন খদ্দেরটি কে, আচমকা শক্ত হয়ে উঠল তাঁর চেহারা। সত্য এই যে, যদিও আমাদের পরস্পরের প্রতি অন্তর্গত এবং আধ্যাত্মিক সহানুভূতি আছে, তথাপি একটা বাহ্যিক বৈরিতার ভাবও রয়েছে। স্থানীয় নিলামে দু বার আমি মি. পটসের চেয়ে বেশি ডেকে তাঁর আকাঙ্ক্ষিত বস্তু থেকে তাঁকে বঞ্চিত করেছি। সর্বোপরি, প্রতিটি ভালো সংগ্রাহকের মতো তিনিও অন্য সংগ্রাহককে ঘৃণা করাটাকে নিজের দায়িত্ব মনে করেন। সর্বশেষ, কয়েক বার আমি তাঁর ধার্য করা দরের চেয়ে কম মূল্য প্রস্তাব করেছি। এটা সত্যি যে আমি অনেক আগেই তাঁর সাথে দরাদরি করা বন্ধ করে দিয়েছি, কারণ মি. পটস্ কখনোই তাঁর উল্লেখ করা মূল্যের চেয়ে কম রাখেন না।

‘আপনার কী চাই, স্যার?’ কিছুটা রুষ্ট গলায় তিনি বললেন। ‘স্যান্ডো, ইজের, গলবন্ধনী, নাকি মোজা?’

‘ওহ্, মোজা, আমার ধারণা,’ কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে উত্তর দিলাম, মনে মনে চিন্তা করছি ওগুলোই বহন করার জন্য সবচেয়ে সহজ হবে। কোত্থেকে যেন মি.পটসের হাতে কিম্ভুতকিমাকার কিছু উলের মোজা উদয় হলো, সেগুলো প্রায় আমার দিকে ছুড়ে মারতে মারতে বললেন এগুলোই আছে তাঁর স্টকে। এখন, আমি উলের মোজা ঘৃণা করি এবং, কখনোই পরি না। তবুও, আমি একজোড়া নিয়ে নিলাম আমার বাগানের বুড়ো মালীর কথা চিন্তা করে এবং পার্সেলটি যখন বাঁধা হচ্ছে আমি ধীরে ধীরে সুচতুর গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘নতুন কিছু এসেছে ওপরে, মি. পটস্?’

“না, স্যার,” তিনি সংক্ষেপে উত্তর দিলেন, “তেমন কিছু না, আর যদি কিছু থেকেও থাকে কী লাভ আপনাকে দেখিয়ে, বিশেষত ওই ঘড়িটার ব্যাপারে যা হয়েছিল তার পরে?”

“আপনি ঘড়িটার জন্য ১৫ পাউন্ড চেয়েছিলেন, তাই না মি. পটস্?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“না, স্যার, এটা ছিল ১৭ পাউন্ড এবং তার সাথে শতকরা ১০ ভাগ যোগ করে নিন; অঙ্কটা কত দাঁড়ায় তা আপনিই বের করতে পারবেন।”

“আচ্ছা, ওটা আরেক বার দেখতে হবে মি.পটস্,” আমি বিনীতভাবে উত্তর দিলাম, তিনি আমার দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে টমকে দোকানের দিকে খেয়াল রাখতে বলে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন।

মি. পটস্ আমায় যে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলেন তা খুবই পুরোনো, এলিজাবেথিয়ান, যদিও ভয়াবহ অলঙ্করণের মাধ্যমে আধুনিক রূচির উপযোগী করার চেষ্টা করা হয়েছে তবু একসময় যে বাড়িটিকে অভিজাত হিসেবে গণ্য করা হতো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সরু ওক কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ওপরের দু তলায় অসংখ্য ঘরের ভেতর প্রবেশ করা যায়, কিছু ঘরের সামনে মোটা ওক কাঠের বীম এবং সাদা রং করা—অন্তত একসময় রং করা হয়েছিল, খুব সম্ভব গত প্রজন্মের সময়।

এই ঘরগুলো বিচিত্র ধরনের আসবাবপত্রে পূর্ণ, বেশির ভাগই জরাজীর্ণ, যদিও বেশির ভাগ জিনিসের জন্যই ডিলারদের কাছ থেকে ভালো দাম পাওয়া যেত। কিন্তু মি. পটস্ এ ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর, ডিলারদের কেউই এ পর্যন্ত এই ওক কাঠের সিঁড়িতে পা দিতে পারেনি। চিলেকোঠা পর্যন্ত জায়গাটিতে বিভিন্ন আসবাব ও অন্যান্য জিনিস, যেমন বই, চীনামাটির বাসনপত্র, গ্লাস ভাঙা সূচিকর্ম এবং আমার অজানা আরও নানাকিছু স্তূপ করে রাখা। সত্যি মি.পটস্ কোথায় ঘুমান সেটি একটি রহস্য; হয় তার দোকানের কাউন্টারের নিচে, অথবা সম্ভবত রাতে চিলেকোঠার ওপরে পোকায় কাটা জ্যাকোবিয়ান পালঙ্কে, কারণ আমি লক্ষ করেছি অসংখ্য পা ভাঙা চেয়ারের ভেতর দিয়ে ওখানে যাতায়াতের একটি পথ রয়েছে, সেখানে পোকায় ঝাঁঝরা করা কার্টনের মধ্যে কয়েকটি ময়লা কম্বলও আছে।

এই পালঙ্ক থেকে সামান্য দূরে, ঢালু দেয়ালের গায়ে উন্মত্ততার সাথে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে আমার আকাঙ্ক্ষিত ঘড়িটি। এটি প্রথম রেগুলেটর ঘড়িগুলোর একটি, যার পেন্ডুলামটি কাঠের, এটার কারিগর স্বয়ং এটি ব্যবহার করত তার অন্য সবগুলো ঘড়ির সময় পরীক্ষা করার জন্য; চারধারে মেহগনি কাঠের খাঁচা, সরল আর নিখুঁত, ওই সময়ের তুলনায় শ্রেষ্ঠ নকশায় তৈরি। এটি এতই সুন্দর যে, সত্যি, এটি হতে পারে ‘প্রথম দর্শনেই প্রেম’-এর উদাহরণ, এবং যদিও সাময়িক বিচ্ছেদ ছিল বন্দোবস্তের অভাবে, অন্য কথায় দামের প্রশ্নে, এখন আমি অনুভব করলাম আর কোনো কিছুই আমাদের আলাদা করতে পারবে না।

তো, আমি রাজি হলাম বৃদ্ধ পটস্-কে ২০ পাউন্ড দিতে, নিখুঁতভাবে বললে ১৮ পাউন্ড ১৪ শিলিং, তার বলা দামের সাথে ১০ শতাংশ যোগ করে। বুড়ো আরও বেশি দাম না চাওয়ায় কিছুটা কৃতজ্ঞতাও অনুভব করলাম মনে মনে। আমি যেই পাশ ফিরেছি, যে কোনোভাবে, আমার চোখ গিয়ে পড়ল একটি হলুদ রঙের অক্ষয় সাইপ্রেস কাঠের তৈরি আলমিরার দিকে, এর দরজাগুলো কয়েক শ বছর ধরে তেমনই আছে যেমনটি ছিল এগুলো লাগানোর সময়।

“বিয়ের আলমিরা”, আমার জিজ্ঞাস্যু দৃষ্টি দেখে পটস্ বললেন।

“ইটালিয়ান, প্রায় ১৬০০ সালের?” আমি শুধালাম।

“হতে পারে, অথবা কোনো ডাচ নাগরিকের জন্য ইটালিয়ান শিল্পীর হাতে তৈরি, তবে আরও পুরোনো, কেউ একজন গরম ইস্তিরি দিয়ে এর ঢাকনাটি পুড়িয়ে ফেলেছে ১৫৯৭ সালে। এটি বিক্রির জন্য নয়, মোটেও বিক্রির জন্য নয়, এত বেশি ভালো যে বিক্রি করা সম্ভব নয়। ভেতরে তাকিয়ে দেখুন, স্প্রিং তালায় পুরোনো চাবি লাগানো আছে। এতটা কারুকাজ আমার আর কোথাও চোখে পড়েনি। দেবতা এবং দেবী এবং আমি জানি না আরও কী কী, এবং একটা ফুলের মালার মাঝখানে ভেনাস বসে আছেন হাতে দুটি হৃদয় ধারণ করে, এতে এটাই স্পষ্ট যে এটা একটা বিয়ের আলমিরা। একদা এটা পূর্ণ ছিল কোনো একটি কনের পোশাক, চাদর, অন্তর্বাস এবং কাপড়ে, এবং ঈশ্বরই জানেন আর কী কী ছিল। আমি অবাক হই এই ভেবে যে এখন সে কোথায় আছে। কোথাও কোথাও কাপড় পোকায় কাটেনি, আশা করি। এক বিচ্ছিন্ন, প্রাচীন পরিবার থেকে আমি এটা কিনেছি। বহু দিন আগে, বহু দিন আগে! অনেক বছর হয় আমি তাকাইনি এটার ভেতরে, সত্যি, তবে জঞ্জাল ছাড়া আর কিছুই নেই এখন ওটার ভিতর।”

এভাবে তিনি নিজের মনে বকতে বকতে চাবিটি ঘুরালেন। অব্যবহারে তালায় জং ধরে গেছে, কিন্তু এটা তেমন প্রতিবাদ না করেই খুলে গেল, আলমিরার ভেতর দিকের দারুণ কারুকাজ প্রকাশ হয়ে পড়ল। সত্যিই অপূর্ব, আমি এ ধরনের শৈল্পিক কাজ আগে কখনো দেখিনি।

“দেখতে পাচ্ছি না ঠিকমতো,” বিড়বিড় করলেন পটস্, “কাঁচগুলো ধোয়া উচিত, কিন্তু আমার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে আর এটা করা হয়নি, এবং তাও প্রায় বিশ বছর হয়ে গেল। অবশ্যই তার অভাব অনুভব করি খুব, কিন্তু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ এখন আর বাড়ি ঘষা-মাজা করা হয় না। আমি দেখেছি এতে প্রচুর জিনিসপত্র ভাঙা পড়ে, এমনকি খোয়াও যায়! এ ধরনের একটা ঘটনার পর আমার স্ত্রীকে বললাম আমি এখন অনুধাবন করতে পারি কেন মেয়েদের আত্মা নেই বলে বলা হয়। যখন সে আমার কথা বুঝতে পারল, যা করতে সে সময় নিল বেশ—ঝগড়া হতো আমাদের মধ্যে, নিয়মিত ঝগড়া—এবং তখন সে আমার মাথা লক্ষ করে একটা ড্রেসডেন মূর্তি ছুড়ে মেরেছিল। সৌভাগ্যবশত আমি সেটা ধরে ফেলি, যৌবনে আমি ক্রিকেটার ছিলাম কিনা! ভেনাসের দিকে তাকাও, সুন্দর না? কী, দেখতে পাচ্ছ না ঠিকমতো? একটু অপেক্ষা করো, লণ্ঠনের ব্যবস্থা করছি। নগ্ন মোমবাতি আনা যাবে না এখানে—সবকিছুই এত দামি; কোনো অর্থই পর্যাপ্ত নয় পুনরায় এগুলো কেনার জন্য। আমার স্ত্রী এবং আমার মধ্যে এ নিয়েও ঝগড়া হতো। আপনি ওই পুরোনো প্রার্থনা-টুলটায় বসুন একটু।”

ছায়াচ্ছন্ন সিঁড়ি বেয়ে তিনি ধীর পদক্ষেপে নেমে গেলেন এবং মিসেস পটস্, যাঁর কথা আমি এই প্রথম শুনলাম, তাঁর সম্বন্ধে ভাবনায় ডুবে গেলাম। দেখতে কেমন ছিলেন তিনি? একজন খ্যাপাটে নারী, আমি নিশ্চিত, তা পুরুষরা যতই ভিন্নমত পোষণ করুন না কেন, বাড়ী-ঘর ঘষে-মেজে ঝকঝকে করার বেলায় তাঁরা একই মানসিকতার। কোনো সন্দেহ নেই তিনি স্ত্রীকে ছাড়া ভালো ছিলেন, ওই শুকনো বুড়ো শিল্পীটি তাঁর বউয়ের কাছে আর কী-ই বা চাইতে পারতেন?

মিসেস পটসের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে, সত্য বলতে কি, তাঁর অস্পষ্ট অস্তিত্বের কোনো স্থান নেইও, আমি আলমিরাটি নিয়ে পড়লাম। ওহ্! এটি সত্যি দারুণ। মিনিট দু-একের মধ্যে ঘড়িটার কথা বিস্মৃত হলাম এবং ওই আলমিরাটি আমার কাছে সৌন্দর্যের শেষ কথা বলে মনে হতে লাগল। ঘড়িটা মাত্র ঘন্টাখানেকের জন্য হালকা প্রেমের সৃষ্টি করেছিল। এখানে উপস্থিত অনন্ত রানী, যদি না অন্য কোথাও এর চেয়েও ভাল আলমিরা থেকে থাকে, এবং আমাকে সেটিও খুঁজে বের করতে হতো। ইতোমধ্যে, ওই বুড়ো পটস্ যা-ই দাবি করুন এটির জন্য, অবশ্যই তা পরিশোধ করতে হবে এমনকি যদি আমার ক্ষীণ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে গচ্ছিত টাকার চেয়ে বেশিও তুলতে হয়, তা-ও সই।

আলমিরাটায় অসংখ্য জিনিসপত্তর, যেমন কিছু সাধারণ জিনিস এবং ট্যাপেস্ট্রির (রঙিন পশমি সুতায় অলঙ্কৃত চিত্রিত কাপড়খণ্ড, যা সাধারণত দেয়াল বা আসবাবপত্র ঢাকার কাজে ব্যবহৃত হয়—অনুবাদক) প্রান্ত এবং রানী অ্যান টাইপের চরিত্রের পুরোনো কাপড়, রাখা হয়েছে এখানে, কোনো সন্দেহ নেই, সংরক্ষণের জন্য, যেহেতু মথ এই সাইপ্রেস কাঠ পছন্দ করে না। আর আছে কিছু বই এবং একটি রহস্যময় বান্ডিল যা কৌতূহল উদ্রেককারী ডোরাকাটা রঙের শাল কাপড়ে বাঁধা। বান্ডিলটি আমায় উত্তেজিত করে তুলেছিল, এবং শালের কিনার ধরে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলাম। যদ্দুর দেখা গেল তাতে বুঝতে পারলাম এটি ধারণ করে আছে আরেকটি উজ্জ্বল রঙের পোশাক, পার্চমেন্টের (লেখার উপযোগী করে তৈরি করা পশুচর্মে লিখিত পান্ডুলিপি—অনুবাদক) মতো দেখতে একটি মোটা প্যাকেটও রয়েছে, আনাড়ি হাতে তৈরি এবং ঈষৎ ক্ষয়প্রাপ্ত পান্ডুলিপিটাতে নিম্ন মানের কালো কালিতে লেখা রয়েছে। শালের ভেতরে আরও কিছু জিনিসও ছিল, যেমন লাল অচেনা কাঠে তৈরি বাক্স, কিন্তু তক্ষুনি সিঁড়ি থেকে বুড়ো পটসের পায়ের আওয়াজ ভেসে আসায় আরও অনুসন্ধান চালানোর সময় ছিল না, এবং ভাবলাম বান্ডিলটি যথাযথভাবে রেখে দেয়াটাই শ্রেয়তর। তিনি লণ্ঠন নিয়ে এসে পৌঁছালেন এবং তার আলোয় আমরা আলমিরাটি পরীক্ষা করলাম।

“খুব ভালো,” আমি বললাম, “খুব সুন্দর, যদিও এটি বড় অঙ্কের প্রশ্ন।”

“হ্যাঁ, স্যার,” তিনি উত্তর দিলেন খেদভরা কণ্ঠে, “আমার ধারণা আপনি পরিধানের চার শ বছর পরেও পোশাক পরিষ্কার ও নতুন থাকাটা পছন্দ করেন, এবং যদি তা হয়, আমি বোধ হয় বলতে পারব কোথায় আপনার পছন্দসই জিনিস খুঁজে পাবেন। পাঁচ বছর আগে এক ছোকড়া যে কিনা কীভাবে অ্যান্টিক তৈরি করা যায় শিখতে চেয়েছিল তাঁর জন্য আমি পরিকল্পনাটা নিজে নিজে সৃষ্টি করেছি। সে এখন জেলের ভেতর এবং তাঁর অ্যান্টিক খুব স্বল্প মূল্যে পাওয়া যায়। আমি তাঁকে সেখানে যেতে সাহায্য করেছি যেন সে সমাজের প্রতি হুমকি হয়ে না ওঠে।”

“কত দাম?” আমি হালকা চালে জানতে চাইলাম।

“আমি কি বলিনি যে এটা বিক্রির জন্য নয়। আমার মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করুন এবং আসুন এবং আমার নিলামে এটি কিনুন।”

আমি কোনো উত্তর দিলাম না, কিন্তু পটস্ তাঁর প্রার্থনা-টুলে বসে থাকায় পরীক্ষা চালু রাখলাম। পটস্ যেন অন্য কোথাও বিচরণ করছেন।

“উত্তম,” সৌজন্যবোধের শেষ সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই আমি বললাম, “বিক্রি না হলে আমার দেখার কোনো অর্থ নেই। কোনো সন্দেহ নেই আপনি এটি আরও ধনি কোনো ব্যক্তির জন্য রেখে দিতে চান, এবং অবশ্যই আপনি সঠিক কাজটিই করছেন। আপনি কি ঘড়িটি পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবেন, মি. পটস্, আমাকে এখন যেতেই হবে। যেহেতু দশ মাইল চালিয়ে যেতে হবে এবং অন্ধকার হতে আর এক ঘণ্টাও বাকি নেই।”

“যেখানে আছেন থামুন,” পটসের কণ্ঠ ফাঁপা শোনায়। “এ ধরনের বিষয়ের সাথে অন্ধকারে পথ পাড়ি দেয়ার তুলনা কীভাবে হয়, এমনকি যদি আপনার লন্ঠন না-ও থাকে? যেখানে আছেন দাঁড়ান, আমি কিছু একটা শুনতে পাচ্ছি।”

আমি তাই থামলাম এবং আমার পাইপ ভরতে শুরু করলাম।

“পাইপটা রেখে দিন,” পটস্ বললেন, যেন দিবাস্বপ্নের ঘোর থেকে বেরিয়ে আসছেন, “পাইপ মানে দিয়াশলাই; কোনো দিয়াশলাই নেই এখানে।”

আমি আদেশ পালন করলাম, এবং তিনি আবার চিন্তার জগতে ডুবে গেলেন। আমি যেন সম্মোহিত হয়ে আছি। অবশেষে তিনি প্রার্থনা-টুলটি থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং একই রকম ফাঁপা কণ্ঠে বললেন, “যুবক, আপনি আলমিরাটি পেতে পারেন, এবং মূল্য ৫০ লিরা। এখন ঈশ্বরের দোহাই ৪০ লিরা বলবেন না, অথবা এটি ১০০ লিরায় পরিণত হবে আপনার ঘর থেকে বেরোনোর আগেই।”

“ভেতরের জিনিসগুলোসহ?” আমি স্বাভাবিক থাকি।

“হ্যাঁ, জিনিসগুলোসহ। এই জিনিসগুলোই আপনার পাওয়ার জন্য আমাকে বলা হয়েছে।”

“দেখুন, পটস্,” আমি অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছি, “কোনো ভূত-প্রেতের কথা বলতে চাইছেন? এই ঘরে আপনি এবং আমি ছাড়া কেউ নেই, তাই আপনাকে যদি কেউ কিছু বলে থাকে তাহলে তা কেবল নিচতলার টম।”

“টম,” তাঁর কণ্ঠে অব্যক্ত শ্লেষ মেশানো, “টম! খুব সম্ভব আপনি কাকতাড়ুয়াটার কথা বোঝাতে চেয়েছেন। টমের মাথায় ঘিলু অবশ্য তার চেয়েও অনেক কম। কেউ নেই এখানে? ওহ্! কিছু লোক এত বোকা হয়। কেন, জায়গাটা তো তাঁদের দ্বারা পরিপূর্ণ।”

“তাঁদের দ্বারা পরিপূর্ণ?”

“কারা? কেন, প্রেতাত্মাসমূহ! অবশ্যই, অজ্ঞতার কারণে এ নামেই আপনি তাঁদের ডাকতে পারেন। আমি তাঁদের বলি মৃতদের আত্মা। কেউ কেউ যথেষ্ট সুন্দরও। ওখানে একটির দিকে তাকান,” এবং তিনি লণ্ঠনটি তুলে ধরলেন। কিছু মশারির খুঁটি স্তূপ করে রাখা, তাঁর দৃষ্টি সেখানেই নিবদ্ধ।

“শুভদিন, পটস্,” দ্রুত বললাম।

“যেখানে আছেন দাঁড়ান,” পটস্ আবারও বললেন। “আপনি আমাকে এখনও বিশ্বাস করেননি, কিন্তু আমার মতো বয়স হলে আপনি আমার কথা স্মরণ করবেন এবং বিশ্বাস করবেন—আমি যা করি এবং দেখি তার চেয়ে বেশি— আমার চেয়েও নিঃসংশয় হয়ে, কারণ এটার বীজ আপনার আত্মার ভেতরেই আছে, যদিও তা পৃথিবী, রক্তমাংশ এবং শয়তানের চাপে দমিত হয়ে আছে। অপেক্ষা করুন পাপের কারণে সমস্যায় না পড়া পর্যন্ত; অপেক্ষা করুন সমস্যার আগুনে রক্তমাংশ পুড়ে না যাওয়া পর্যন্ত; অপেক্ষা করুন আলোর দেখা না পাওয়া পর্যন্ত এবং আলো খুঁজে পাওয়া এবং আলোয় বসবাস না করা পর্যন্ত, তারপর আপনি বিশ্বাস করবেন;—তারপর—আপনি দেখতে পাবেন।“

সবকিছুই তিনি বললেন গুরুগম্ভীর কণ্ঠে, এবং ওই নোংরা ঘরটিতে দাঁড়িয়ে যেখানকার জিনিসপত্রের সারি অনেক মৃত নারী-পুরুষের প্রিয় বস্তু ছিল একসময়, হাতে ধরা লণ্ঠনটি নাড়াতে নাড়াতে এবং স্থির দৃষ্টি নিয়ে—তিনি কিসের দিকে তাকিয়ে ছিলেন?—সত্যিই বুড়ো পটস্-কে প্রভাব সৃষ্টিকারী মনে হচ্ছিল। তাঁর বক্রদেহ এবং কুৎসিত অবয়ব পরিণত হয়েছে আধ্যাত্মিক উপস্থিতিতে; তিনি যেন তাঁদেরই একজন যাঁরা “আলো খুঁজে পেয়েছে”।

“আপনি আমাকে বিশ্বাস করবেন না,” তিনি বলে চলেন, “কিন্তু একজন নারী আমাকে যা বলেছেন তা আপনার কাছে পৌঁছে দিয়ে যাই। নারীটি অদ্ভুত রকমের; আমি আর কখনোই তাঁর মতো কাউকে দেখিনি। তিনি একজন বিদেশিনী এবং তাঁর গায়ের রং গাঢ়। তাঁর গায়ে অস্বাভাবিক উন্নত পোশাক এবং তাঁর মাথায় কিছু একটা পড়া রয়েছে। ওইখানে, ওইযে, ওই..” তাঁর আঙুল ময়লা জানালার মধ্য দিয়ে আকাশে উঁকি দেয়া নতুন চাঁদের দিকে তাক করা। “একটি সুন্দর নারীর আকৃতি,” তিনি বলে চলেন, “এবং ওহ্! ঈশ্বর, কী তাঁর চোখ—আমি এমন চোখ আর দেখিনি। বড় এবং শান্ত, বনে যেসব হরিণী ঘুরে বেড়ায় তাঁদের চোখের মতোই। গর্বিতও, তিনি এমন একজন যে শাসন করেছে, এবং একজন নারী, যদিও বিদেশিনী। উত্তম, আমি আগে কখনো প্রেমে পড়িনি, কিন্তু আমি এটা এখন অনুভব করতে পারি, এবং আপনিও পারবেন হে যুবক, যদি আপনি তাঁকে দেখতে পান, এবং আমার ধারণা অন্য কেউও তার সময় এলে তা-ই করবে।”

“সে আপনার কাছে কী বলল?” আমি জানতে চাই, কারণ ইতিমধ্যেই ব্যাপারটি যথেষ্ট টানছে আমায়। বুড়ো পটসের মুখে সুন্দরী নারীর বর্ণনা কে না শুনতে চাইবে?

“আপনাকে বলাটা একটু কঠিন কারণ তিনি একটা অদ্ভুত ভাষায় কথা বলেন এবং আমাকে এটা মনে মনে অনুবাদ করে নিতে হয়েছে। কিন্তু তাঁর কথার সারমর্ম এই রকম। আলমিরাটা, এর ভেতরের জিনিসপত্রসহ, আপনাকে পেতে হবে। একটা পান্ডুলিপি আছে সেখানে, তিনি বলেছেন, অথবা কিছু অংশ ক্ষয় হয়ে যাওয়ায় পান্ডুলিপির অংশবিশেষ আছে কেবল। পান্ডুলিপিটা আপনার পড়ে দেখতে হবে অথবা এটা ছাপাতে হবে যাতে দুনিয়াও এটার কথা জানতে পারে। তিনি বলেছেন যে ‘হুবার্ট’ চায় আপনি তা করেন। আমি নিশ্চিত নামটা হুবার্টই, যদিও তিনি আরও কিছু উপাধির কথা বলেছিলেন যা আমি বুঝতে পারিনি। আমার এতটুকুই স্মরণে আছে, একটা নগরের কিছু বিষয় ব্যতিত, হ্যাঁ, একটা স্বর্ণনগরী এবং শেষ যে মহাযুদ্ধে হুবার্ট পতিত হয়েছিলেন তাতে তিনি অর্জন করেছিলেন গৌরবময় জয়। আমি বুঝেছি যে তিনি বলতে চাইছিলেন কারণ তা লেখাটাতে নেই, কিন্তু আপনি ব্যাঘাত সৃষ্টি করলেন এবং অবশ্যই, তিনি চলে গেলেন। হ্যাঁ, মূল্য ৫০ লিরা এবং তার এক ফার্দিংও কম নয়, কিন্তু যখন খুশি তা পরিশোধ করতে পারেন কারণ আমি জানি আপনি খুবই সৎ, এবং আপনি মূল্য পরিশোধ করেন বা না করেন আলমিরাটা এবং এর ভেতরে যা কিছুই আছে তা আপনার কাছে যাওয়া উচিত এবং অন্য কারও কাছে নয়।”

“ঠিক আছে,” আমি বললাম, “কিন্তু কুরিয়ারের ওপর ভরসা করবেন না। আমি একটা গাড়ি পাঠিয়ে দেব কাল সকালে। এখন এটা তালাবদ্ধ করুন এবং চাবিটা আমার কাছে দিন।”

নির্ধারিত সময়ে আলমিরাটা এসে পৌঁছাল এবং বান্ডিলটা পরীক্ষা করে দেখলাম। কারণ অন্য জিনিসগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, যদিও সেগুলোর মধ্যে কিছু ছিল সত্যি আকর্ষণীয়। শালের ভেতর গেঁথে রাখা একটা কাগজ পাওয়া গেল, সই এবং তারিখ দেয়া নেই, কিন্তু এ লেখাটা থেকে পান্ডুলিপিটার চরিত্র এবং ধরন বুঝতে পারা যায়, ষাট বছর আগে একজন নারী এটা লিখেছিলেন। সেটি এ রকম—

“আমার স্বর্গীয় পিতা, যিনি যৌবনে একজন মহান পরিব্রাজক ছিলেন এবং অদ্ভুত সব জায়গার রহস্য অনুসন্ধানে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তিনি এই জিনিসগুলো তাঁর বিয়ের আগে একটি ভ্রমণ থেকে ঘরে ফিরে আসার সময় নিয়ে এসেছিলেন, আমার ধারণা দক্ষিণ আমেরিকা থেকে। তিনি একদা আমাকে বলেছিলেন যে পোশাকটি পাওয়া গিয়েছিল একজন সমাধিস্থ নারীর মৃতদেহ থেকে। নারীটি অবশ্যই মহান কেউ ছিলেন, কারণ তাঁকে ঘিরে আরও অনেকগুলো নারীর মৃতদেহ রাখা ছিল, খুব সম্ভব তাঁর ভৃত্যদের মৃত্যু হলে তাঁর সাথেই সমাধিস্থ করা হয়েছিল। তাঁদের দেহগুলো একটি পাথরের টেবিল ঘিরে বসিয়ে রাখা হয়েছিল, যার শেষ মাথায় একটি পুরুষদেহ পড়ে ছিল। বাবা দেহগুলো দেখতে পান একটা জঙ্গল-নগরীর ধ্বংসাবশেষের কাছে, সমাধিটা মাটির বিশাল স্তূপের নিচে চাপা পড়ে ছিল। ওই নারীটির, যাঁর দেহের পোশাকটি সংরক্ষণের জন্য মুড়ে রাখা হয়েছিল লম্বা উলের ভেড়ার চামড়ায় তৈরি কাফন দিয়ে, কোনো উপায়ে মমি করা হয়েছিল, যা ওই এলাকার একটা দেশাচার, যা হোক দেখতে তিনি ছিলেন রাজকীয়। অন্যগুলো ছিল নিছক কঙ্কাল, কিন্তু পুরুষদেহটার লম্বা গৌর দাড়ি ছিল এবং চুল তখনও ঝুলছিল খুলি থেকে, এবং তাঁর পাশে রাখা তরবারিটা স্পর্শ করা মাত্র টুকরা টুকরা হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য হাতলে খচিত অ্যাম্বার পাথরসহ ফলাটা অক্ষত ছিল। আমার ধারণা বাবা বলেছিলেন চামড়া বা পার্চমেন্টের প্যাকেটটা, যার নিচের দিকটা বিশ্রিভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল আর্দ্রতায়, রাখা ছিল পুরুষটির পায়ের নিচে। তিনি বলেছিলেন যে, যাঁরা সমাধিটা খুঁজে পেয়েছিল তাঁদের তিনি প্রচুর অর্থ দিয়েছিলেন পোশাক, স্বর্ণালঙ্কার, এবং পান্নার কন্ঠহারটির জন্য, এর আগে এত নিখুঁত কোনো কিছু পাওয়া যায়নি, এবং কাপড়টির কাজগুলো সোনালী সুতোয় করা। বাবা আমায় এও বলেছিলেন যে তিনি চান না জিনিসগুলো বিক্রি করা হোক।”

লেখাটি এ পর্যন্তই।

এটা পড়ে আমি পোশাকটা পরীক্ষা করে দেখলাম। এ ধরনের কিছু আমি আগে কখনো দেখিনি, যদিও যেসব বিশেষজ্ঞকে দেখিয়েছি তাঁরা বলেছেন যে এটা অবশ্যই দক্ষিণ আমেরিকান এবং বহু কাল আগের, এবং খুব সম্ভব অলঙ্কারগুলোর মতোই ইনকা-পূর্ব পেরুভিয়ান। ভারতীয় শালটির মতোই এটাতেও বহু উজ্জ্বল রঙের ছড়াছড়ি যা সাধারণভাবে টকটকে লালের মতো দেখায়। এটা পরিষ্কার যে এই লাল পোশাকটা পরা হতো একটা রক্তাভ বর্ডার দেয়া লিলেনের স্কার্টের ওপর। আমি বলেছি যে বাক্সটায় অলঙ্কারগুলো ছিল, সবগুলোই সাধারণ স্বর্ণের তৈরি—একটা কোমরবন্ধনী; একটা মাথায় পরার বলয় যার ওপরে নতুন চাঁদের আকৃতি এবং একটা পান্নার কণ্ঠহার, অকাট পাথরগুলোয় চিড় ধরেছে, কী কারণে তা আমি জানি না, কিন্তু পালিশ করা এবং লাল সোনার ভেতর যত্নের সাথে লাগানো। সেখানে দুটো রিংও ছিল। রিং দুটোয় একটা চিরকুট মোড়ানো যার লেখাটা ভিন্ন হাতের, খুব সম্ভব লেখাটা স্মরণিকার লেখিকার পিতার—

“এটি একটি নারী মমির ডান হাতের প্রথম আঙুল থেকে নেয়া যার জন্য আমি দুঃখিত, ওই পরিস্থিতিতে রেখে আসাটা অসম্ভবই ছিল।”

অন্য রিংটি একটা চামড়ার ব্যাগে ছিল, দক্ষতার সাথে স্বর্ণসুতা অথবা খুবই পাতলা তার দিয়ে এম্ব্রয়ডারি করা, যা আমার ধারণা মেয়েটির পরিচ্ছেদের অংশ ছিল। এটা একটা বিশাল ওয়েডিং রিঙের মতো, কিন্তু ছয় অথবা আট গুন মোটা, এবং সম্পূর্ণটা জুড়ে ঐতিহ্যগত নকশা খোদাই করা যা দেখতে সূর্যকে ঘিরে থাকা রশ্মির মতো, অথবা পাপড়িবিশিষ্ট ফুলও হতে পারে। সর্বশেষ সেখানে ছিল তরবারিটির ফলা, মানে যতটুকু অবশিষ্ট ছিল আর কি।

এগুলোই ছিল মনোহারী সামগ্রী, যদি এই নামে তাদের ডাকা যায়। স্বর্ণের ওজন ব্যতিত এগুলোর সামান্যই মূল্য আছে, কারণ, যেমনটি আমি বলেছি, অলঙ্কারগুলোয় আগুন অথবা অজানা কোনো কারণে চিড় ধরেছিল। শুধু তা-ই নয়, প্রাচীন মিশরীয় গহনার মতো সৌন্দর্য কিংবা আকর্ষণ কোনোটাই এগুলোর নেই; নিঃসন্দেহে একটি রুক্ষ সভ্যতা এবং সময়ই এর জন্য দায়ী। তবুও তাদের মূল্য ছিল, এবং এখনও আছে, আমার কল্পনায়, একটি সুনিশ্চিত মর্যাদার অধিকারী তারা, যা তাদের একান্তই নিজস্ব।

এখানে পটসের অদ্ভুত স্বভাব আমার ওপরেও আছর ফেলেছে—কোনো সন্দেহ নেই এ জিনিসগুলো মানব সংসর্গে বিশিষ্ট রূপ পেয়েছিল। কে ওই ক্রুশাকৃতি (ক্রিশ্চিয়ান ক্রুশ হতে পারে না) স্বর্ণসুতার কাজ করা লাল টকটকে জামাটি পরেছে, এবং তার নিচে রক্তাভ বর্ডার দেয়া স্কার্টটি, এবং পান্নার কণ্ঠহারটি এবং স্বর্ণালি বলয়টি যার ওপরে শোভা পেত নতুন চাঁদের আকৃতি? প্রতীয়মান হয় একটি সমাধির ভেতর একটি মমির গায়ে ছিল এসব, একটি মমি যা অনেক দিন আগে গত হওয়া একটি অদ্ভুত এবং প্রায় ভিন্নগ্রহের নারীর। পাগলাটে পটস্ ইংল্যান্ডের এক ধ্বংসপ্রায় বাড়ির নোংরার ভেতর দাঁড়িয়ে তাঁকে যেমনটি স্বপ্নে দেখেছেন—সে কি তেমনই একজন, আমি অবাক হই, তেমনই হরিণী চোখ এবং রাজকীয় ছাপবিশিষ্ট?

না, এসবই অবান্তর। পটস্ বসবাস করেছেন ছায়াদের সাথে। আত্মার আবির্ভাব এবং ফিরে যাওয়া—এসবই তাঁর কল্পনাপ্রসূত। তবু, সে একজন নারী ছিল, এবং প্রতীয়মান হয় তার একজন প্রেমিক বা স্বামী ছিল, একজন সোনালি দাড়ির পুরুষ। কীভাবে ওই সময়ে, যা অবশ্যই অনেক আগে, একজন সোনালি দাড়ির পুরুষ এল একজন নারীর সাথে। এমন একজন নারী যে এমন গহনা এবং পোশাক পরিধান করত? এবং ওই তরবারির ফলা, যা বহু ব্যবহারে মসৃণ এবং তার হাতলে খচিত কালো হয়ে আসা অ্যাম্বার পাথর! কোত্থেকে এল এটি? আমার ধারণা—বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষা দ্বারা আমার দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করার আগের কথা এটা—খুব সম্ভব তরবারিটা নরওয়েজীয়। আমি নরওয়েজীয় গল্পগাঁথা পড়েছি এবং আমার একটা গল্প স্মরণে আছে যাতে মহান নরওয়েজিয়ান বীরদের কথা বলা হয়েছে। তাঁরা আট-নয় শ বছর আগে আটলান্টিকের অপর তীরে পৌঁছেছিলেন যা বর্তমানে আমেরিকা হিসেবে পরিচিত। সমাধির গৌর চুলের পুরুষটি কি তাঁদের একজন ছিলেন?

শুধুমাত্র প্রাথমিক জ্ঞানসম্পন্ন একজন লোকের হাতে তৈরি ভেড়ার চামড়ার স্তূপটার দিকে তাকানোর আগে আমার ভাবনার গতি এ রকমই ছিল। তখনও জানি না ওই স্তূপটিতেই আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। পড়তে গিয়ে আমাদের অবশ্য পিছু হটতে হয়েছিল, পান্ডুলিপিটার উপাদানগুলো ছিল নিছকই নিষ্প্রভ। বান্ডিলটা বৃহৎ এবং শুষ্ক খড়কুটো দিয়ে বাঁধা, চমৎকার খড়কুটো যা আমাকে পানামা হ্যাটের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু বান্ডিলের নিচের দিকে থাকা কয়েকটা পার্চমেন্ট আর্দ্রতায় ক্ষয় হয়ে গেছে, অনেকগুলো পৃষ্ঠার অংশবিশেষ কেবল অবশিষ্ট আছে, তাও ছাতা-ধরা এবং ধূলিধূসরিত। এ কারণে বান্ডিলের দড়িটা খুলে ফেলা সহজ ছিল এবং এর ভেতরে, পৃষ্ঠাগুলো ঠিকভাবে ধরে রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল মজবুত এবং তুলনামূলক আধুনিক রশি—যার ভেতরের লাল সুতাটি বলে দিচ্ছে এটি ছিল পুরোনো ধাঁচের নেভি কর্ড।

এসব বাধা আমি অতিক্রম করলাম এবং সবার ওপরে বসানো খালি চামড়াটা সরিয়ে দিলাম। নিচে দেখা গেল পার্চমেন্টের প্রথম পাতাটা, ঘন ঘন, খুবই ঘন ঘন, ছোট্ট কালো বর্ণের লেখা, এতটাই অস্পষ্ট এবং বিবর্ণ যে যদি লেখাটা আমি পড়তেও পারতাম, যা আমি পারি না, তবু অর্থ ধরতে পারতাম না। ব্যাপারটা ছিল খুবই নিরাশাব্যঞ্জক। কোনো সন্দেহ নেই যে লেখাটায় সব রহস্যের উত্তর রয়েছে, কিন্তু এটা কখনোই আমার বা অন্য কারও পক্ষে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। বুড়ো পটসের কাছে হরিণীচোখ নারীর আবির্ভাব বিফলে গেল; এই পান্ডুলিপিটা আমার কাছে হস্তান্তর করার আদেশটিও তাই একই পরিণতি পেল।

সে সময় আমি এমনটিই ভাবছিলাম, তখনও বিজ্ঞানের হাতিয়ার সম্বন্ধে জানি না। পরে, যা হোক, আমি ওই বিশাল বান্ডিলটি একজন বন্ধুর কাছে নিয়ে গেলাম, একজন অভিজ্ঞ বন্ধু, যার পেশাই ছিল পুরোনো পান্ডুলিপির অর্থ উদ্ধার করা।

“দেখে তো কোনো ভরসা পাচ্ছি না,” সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল সে। “তবুও, চেষ্টা করে দেখি; চেষ্টা না করলে কিছুই জানা যায় না।”

তখন সে আলমিরা থেকে ফ্যাকাশে হলুদ বর্ণের একটা তরলভর্তি বোতল বের করল। একটা সাধারণ ব্রাশ সেই তরলে চুবিয়ে লেখার প্রথম লাইনগুলোর ওপর ঘষে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। এক মিনিটের মধ্যে, আমার বিস্ফারিত চোখের সামনেই সেই বিবর্ণ, অস্পষ্ট লেখাটা কয়লার মতো কালো হয়ে উঠল। এতটাই কালো যে মনে হচ্ছিল যেন মাত্র গতকালই সর্বশ্রেষ্ঠ, অত্যাধুনিক কোনো কালিতে লেখা হয়েছে।

“ঠিক আছে।” তার গলায় বিজয়ের সুর, “ভেজিটেবল কালিতে লেখা, আর আমার এই পরশমণি কালিটাকে ঠিক লেখার সময়কার অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে। অবশ্য রাত না পোহাতেই লেখাটা আবারও বিবর্ণ হয়ে যাবে। বলতেই হয়, বন্ধু, তোমার পাণ্ডুলিপিটি যথেষ্ট প্রাচীন, দ্বিতীয় রিচার্ডের সময়কার, কিন্তু এটা আমি খুব সহজেই পড়তে পারব। লেখাটার শুরু হয়েছে কীভাবে দেখো, 'আমি, হুবার্ট ডি হেস্টিংস্, তাভান্তিনসুয়ুর মাটিতে বসে লিখছি, যেখানে আমার জন্ম সেই ইংল্যান্ড থেকে অনেক দূরে এবং সেখানে হয়তো আর কখনোই আমার ফেরা হবে না, যেমনটি পূর্ব-ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, আমার পূর্বপুরুষ থরগ্রিমারের তরবারির চিহ্নই আমাকে নিয়ে এসেছে এই অচিন দেশে, যে তরবারিটি আমার মা আমাকে দিয়েছিলেন ফ্রেঞ্চরা হেস্টিংস্ নগরী পুড়িয়ে দেয়ার দিন,' এবং এরপর আরও আছে।” এখানে সে থামল।

“ঈশ্বরের দোহাই, বাকিটা পড়ো,” আমি বললাম।

“মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড,” সে উত্তর দিল, “আমার মনে হয় এটা কয়েক মাসের কাজ, এবং সময় দেয়ার জন্য আমি বেতন নেই এ কথাটা বলতে হচ্ছে বলে ক্ষমা করো। এখন শোনো তোমাকে কী করতে হবে। প্রতিটি পাতা ধরে ধরে ফ্লুইড লাগাতে হবে, এবং লেখা পরিষ্কার হয়ে ফুটলে আবার বিবর্ণ হয়ে যাবার আগেই ছবি তুলে রাখতে হবে। তারপর একজন দক্ষ ব্যক্তি—দুটি নাম আমার মনে পড়ছে এই মুহূর্তে—নিয়োগ করতে হবে পাতা ধরে ধরে লেখার মর্মার্থ উদ্ধারে। তোমার পয়সা খরচ হবে, কিন্তু বলতেই হয় এটা হবে যথার্থ। এই শয়তান জায়গাটা কোথায় আছে, বা ছিল, এই তাভান্তিনসুয়ুর মাটি?”

“আমি জানি,” আমি উত্তর দিলাম, অন্তত একটি ক্ষেত্রে বন্ধুর কাছ থেকে নিজেকে অগ্রসর দেখাতে পেরে খুশি লাগল। “স্প্যানিশদের আগ্রাসনের আগে পেরু সাম্রাজ্যের স্থানীয় নাম ছিল তাভান্তিনসুয়ু। কিন্তু এই হুবার্ট দ্বিতীয় রিচার্ডের সময়ে সেখানে কীভাবে পৌঁছাল? পিজারো-র পা দেয়ারও কয়েক শতক আগের কথা এটা।”

“যাও খোঁজো,” সে উত্তর দিল, “এটা তোমাকে দীর্ঘসময় ধরে আশ্চর্যান্বিত করে রাখবে এবং খুব সম্ভব উত্তরটি অর্থোদ্ধারের খরচ উঠিয়ে নিয়ে আসবে, যদি সেটি প্রকাশনাযোগ্য হয়, আমি আশা করি তা-ই যেন হয়, কিন্তু আবার, আমি এত বেশি পুরোনো পাণ্ডুলিপি পড়েছি এবং এগুলোর বেশির ভাগই খুব বেশি সাদামাটা হয়ে থাকে।”

যা হোক, কাজটি সম্পূর্ণ করতে কত খরচ করতে হয়েছিল তা আমি উল্লেখ করতে চাই না, এবং এখানে পাবেন সেই ফলাফলটি, অল্পবিস্তর আধুনিকীকৃত, যেহেতু প্রায়শ হুবার্ট অব হেস্টিংস্ নিজের বর্ণনা দিয়েছে কিছুটা অদ্ভুত ও অপ্রচলিত উপায়ে। সে কখনো কখনো ইন্ডিয়ান শব্দও ব্যবহার করেছে, যেহেতু এই পেরুভিয়ান, বা এদেরই একটি উপবিভাগ চ্যানকাদের সাথে তাকে কথা বলতে হতো, এত দীর্ঘদিন ধরে, যে সে বোধ হয় নিজের ভাষাই ভুলতে শুরু করেছিল। তার কাহিনি আমার কাছে খুবই রোমান্টিক এবং আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। আশা করি অন্যরাও এই একই ধারণা পোষণ করবেন। আসুন যাচাই করি।

কিন্তু, আহ্, আমি ভেবে অবাক হই এর শেষ পরিণতি কী, সন্দেহাতীতভাবে যার কিছু বিবরণ ক্ষয়ে যাওয়া পাতাগুলোয় সংরক্ষিত ছিল, যদিও নিঃসন্দেহে যে ভয়ানক যুদ্ধে তাকে অংশ নিতে হয়েছিল তার কোনো উল্লেখ করা হয়নি, যেহেতু কুইলা একেবারেই লিখতে পারত না, ইংরেজিতে তো অবশ্যই না, তবুও আমার ধারণা সে তাকে এবং এই পাণ্ডুলিপিটাকে রক্ষা করতে পেরেছিল।

শেষ পরিণতির ইঙ্গিতটুকু শুধু পটসের স্বপ্ন বা দর্শনশক্তিতে পাওয়া সম্ভব, এবং স্বপ্ন বা দর্শনশক্তির কী-ই বা মূল্য আছে?

(চলবে...)

ছবিসূত্র : google.com

কুটুমবাড়ি


মন্তব্য

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

প্রিয় কুটুমবাড়ি,
পড়লাম। আরো ঝরঝরে অনুবাদ চাই। নইলে গুল্লি। ভালো থাকবেন। ও আচ্ছা, পরের পর্ব কবে দেবেন? অপেক্ষায় থাকলাম।

অতিথি লেখক এর ছবি

মানিকদা,
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আরও ঝরঝরে করার চেষ্টা করছি, তবে উপন্যাসটি বোধ হয় সব শ্রেণীর পাঠকের জন্য নয়। আর পর্বগুলো বেশ বড় বড়, কিছুটা সময় দেবেন আশা করি। ভালো থাকবেন।

কুটুমবাড়ি

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রায় ১০০ বার পঠিত, অথচ মন্তব্য মাত্র ১টি! ভাষাটা একটু বেশি খটমটে হয়ে গেছে, নাকি এত বড় পোস্ট কেউ পুরোটা পড়ছে না? চিন্তিত

কুটুমবাড়ি

বইখাতা এর ছবি

পোস্ট তো বড় হয়েই গেছে, অনুবাদটা আরেকটু কম আড়ষ্ট হলে ভাল হতো। গল্পের কাহিনীর টানেই পুরোটা পড়লাম। আরো ছোটো পর্বে দিয়েন, তাহলে আরো বেশি পাঠক পড়ার আগ্রহ পাবে।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি

কুটুমবাড়ি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।