বিহাইন্ড দ্যা সিন অফ অ্যা সেশনাল প্রজেক্ট

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২৭/০৯/২০১০ - ১০:৫৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
তিতুমীর হল---রুম নাম্বার ৩১২।
রুমের বাইরে গোটা গোটা হরফে লেখা-"ভেতরে প্রজেক্টের কাজ চলিতেছে। বিরক্ত না করার জন্য অনুরোধ করা যাইতেছে।"
সতর্কবাণী লেখার আইডিয়াটা লুনারের। আমি বললাম, সাধু ভাষায় লেখার কী দরকার? লুনার বললো, সাধু ভাষায় লিখলে লেখার মধ্যে একটা weight আসে। তো আমরা এভাবে ব্যানার-পোস্টার টাঙ্গিয়ে, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আমাদের প্রজেক্টের কাজ করে যাচ্ছি। কাজ অবশ্য কিছুই এগোচ্ছে না। এক ধাপ এগোয় তো দুই ধাপ পিছাই। যে পয়েন্টে ৫ ভোল্ট পাওয়ার কথা সেখানে পাই না; যেখানে ভোল্টেজ থাকার কথা না সেখানে দেখি কোত্থেকে না কোত্থেকে ভল্টু মামা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা স্যার Resistor রহমানের কাসে যাই। স্যার বলেন, "জায়গায় জায়গায় ক্যাপাসিটর লাগাও। ক্যাপাসিটরের মধ্যেই সকল সমস্যার সমাধান নিহিত।" তো স্যারের কথামত আমরা জায়গায় জায়গায় ক্যাপাসিটর লাগাই। ফলশ্রুতিতে অবস্থা আরো খারাপ হয়। যে লেডটা জ্বলার কথা সেটা জ্বলে না, জ্বলে তার আত্নীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী। সবাই মিলে একসঙ্গে চোখে সরষে ফুল দেখা শুরু করি। এক কথায় ভয়াবহ অবস্থা। আদৌ প্রজেক্ট সাবমিট করতে পারবো কিনা সন্দেহ। অবশ্য পরাজয়ে ডরায় না বীর। চার চারজন বীরযোদ্ধা অত্যাধুনিক ব্রেডবোর্ড আর মাইক্রোকন্ট্রোলারকে সাথী নিয়ে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। সে কী পরাজিত হবার জন্য? কাভি নেহি।

২.
এইখানে বলে রাখি। যে কোন প্রজেক্টেই মূল কাজটা কিন্তু করে একজনই। বড়জোর দু'জন। এটা আমার স্বল্পসময়ের অভিজ্ঞতায় বলে। আমাদের গ্রুপে সেই দায়িত্বটা নিয়েছে মহামতি লুনার আর খালিদ। খালিদ বেচারা দিনভর কোড করতে থাকে আর লুনার সেই কোড হার্ডওয়ারে ইম্পলিমেন্ট করে। তাহলে বাকি দু'জনের ভূমিকা কী? কোপা (হাসিব) সারাদিন এটা ওটা ঝালাই করে। এই ক'দিনে সে যে পরিমাণ ঝালাই করেছে তাতে তাকে নির্দ্বিধায় ঝালাই এর ওপর একখানা পিএইচডি দিয়ে দেয়া যায়। বুয়েট থেকে বেরিয়ে যদি সে চাকরি-বাকরি নাও পায়, কুছ পরোয়া নেহি। পরনো ঢাকাউ একখানা ঝালাইয়ের দোকান দিলেও তো দু'জন মানুষের অন্নের সংস্থান হয়ে যায়। বাকি থাকে আমি। আমি তো মামা চিরকালের ফাঁকিবাজ। সবাই কাজ করছে আর আমি এই ফাঁকে একটু ফেসবুক আর সচলায়তন গুঁতিয়ে আসি। খানিকটা সময় পেলে খড়কুটোয় ঢুঁ মারি। আরো একটু সময় পেলে goal.com এ গিয়ে দেখে আসি মেসির কি অবস্থা। ক'দিনের মধ্যে বেচারা সুস্থ হয়ে উঠবে। কিংবা ইব্রা ম্যাজিকে নিলানের কোন গতিক হল কিনা-এইসব। মরিনহো আঙ্কেল নতুন করে কোন বেফাঁস মন্তব্য করে বসলেন কিনা-এইসব।

৩.
এর মধ্যে এক জুনিয়র এসে গ্যাঞ্জাম শুরু করে। ওরও কি একটা প্রজেক্ট আছে। প্রজেক্টটা একটা জায়গায় এসে আটকে গেছে। আমাদের কাছে এসেছে সাহায্য চাইতে। নিজেদের কাজ তো কিছুই হচ্ছে না, ভাবলাম জুনিয়রটাকেই একটু হেল্প করে ইহকাল ও পরকালের অশেষ নেকী হাসিল করি। তো এক একজন এক এক পরামর্শ দিতে শুরু করলাম। কেউ বললাম এখানে একটা মাল্টিপ্লেক্সার ইউজ কর। আরেকজন বললাম, মাক্স ইউজ করা ঝামেলা। ফ্লিপ-ফ্লপ ইউজ করলেই পারো। এইখানে একটা ঝামেলা আসে। ফ্লিপ-ফ্লপ তো বাজারে এভাইলেবল না। আচ্ছা ঠিক আসে, মাক্সই ইউজ কর। জুনিয়র খুশি হয়ে যায়। আমাদেরও নিজেদের উপর খানিকটা কনফিডেন্স ফিরে আসে। আবারো নিজেদের প্রজেক্টের কাজে মনোযোগ দেই। বাইরে চাওয়ালা ছেলেটা অনেকক্ষণ ধরে ঘোরাফেরা করছে। আমি একটা হাঁক দেই, "এই পিচ্চি, এদিকে আসো তো"। পিচ্চি এসে খুব স্মার্টলি বলে, "আমার নাম পিচ্চি না। আমার নাম আবু।"

৪.
এবং দিনশেষে আবারো একরাশ হতাশা। কাজের কাজ তো কিছুই হয় নাই, বরং আরো কয়েকটা লেড পুড়েছে, আইসি জ্বলে গেছে এবং মাথার তারও দু-একটা মনে হয় ছিঁড়ে গেছে। বাসায় ফিরতে ফিরতে লুনারকে বলি,"বাদ দেও তো এইসব। শাকিবদের তো একই প্রজেক্ট। ওদেরটা কপি-পেস্ট করলেই তো হয়। এতো কষ্ট করে কী হবে?" লুনার হাসে। অর্থপূর্ণ হাসি। বলে, "দরকার হলে প্রজেক্ট সাবমিট করবো না, কিন্তু অন্যদেরটা কপি-পেস্ট করবো না।" দ্যাটস দ্যা স্পিরিট, ম্যান। ভাংবো, তবু মচকাবো না। হারবো কিন্তু পরাজিত হব না।

৫.
নেক্সট উইকে মনে হয় বিছানা-বালিশ নিয়ে হলে উঠে পড়তে হবে। লুনারের আদেশ। দিনরাত ২৪ ঘন্টা কাজ করে হলেও প্রজেক্টটা দাঁড় করাতে হবে। বেঁচে থাকলে হয়তো আবারো সচলে দেখা হবে। লেখা হবে।

---আশফাক আহমেদ


মন্তব্য

অদ্রোহ এর ছবি

"ভেতরে প্রজেক্টের কাজ চলিতেছে। বিরক্ত না করার জন্য অনুরোধ করা যাইতেছে।"

গুরুচণ্ডালী দোষে দুষ্ট মনে হচ্ছে দেঁতো হাসি
সে যাকগে, বুয়েটের ভাইবেরাদর দেখলে ভালই লাগে :)।

--------------------------------------------

আজি দুঃখের রাতে, সুখের স্রোতে ভাসাও তরণী
তোমার অভয় বাজে হৃদয় মাঝে হৃদয় হরণী।

--------------------------------------------
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি-বাড়ি যায়
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাইয়া কোন ব্যাচের?

বাউলিয়ানা এর ছবি

প্রজেক্টের কাজ সবসময়ই ঝামেলার। তবে শেষ করার পর যে আনন্দ তার তুলনা নাই।

শুভকামনা রইল।

অতিথি লেখক এর ছবি

দোয়া রাইখেন বস

ফাহিম এর ছবি

হায় সেশনাল!

টিম কম্পোজিশনে একটা গুরুত্বপূর্ণ পোস্টের কথা ভুলে গেছেন। জোকার! চারজনের টিমে একটা জোকার না থাকলে সেশনাল ফাইটগুলা জমে না!

অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল। সেশনাল করতে করতে রাত দু'টা আড়াইটা বাজলেই চলো চানখারপুল। আমরা সেশনাল করতাম সোহরাওয়ার্দী হলে। যাওয়ার পথে রশীদ হল, শেরে বাংলা হল নিচ থেকে হাক দেওয়া হতো। আরো দুই তিন গ্রুপ হয়ে যেত। তারপর একসাথে আউলা হয়ে চানখারপুল।

আহ! কী সব দিন ছিল!!

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাইয়া কি সোহ্রাওয়ার্দী হলেরই?
কোন ব্যাচের?

অতিথি লেখক এর ছবি

আমাদের হার্ডওয়্যার প্রজেক্টগুলাতে আমার ভূমিকা প্রায় দর্শকেরই ছিল। মাঝে মাঝে ঘ্যান ঘ্যান করতাম, আমারে একটু ব্রেডবোর্ডে রেজিস্টরের পা ঢূকাতে দেয়ার জন্য। আমার গ্রুপের কর্মবীররা এতটাই কাজ করত, যে আমি বুঝে উঠার আগেই অনেক সময় প্রজেক্ট শেষ হয়ে যেত।

লেখা পড়ে মজা লাগল।

সজল

অতিথি লেখক এর ছবি

মাঝে মাঝে ঘ্যান ঘ্যান করতাম, আমারে একটু ব্রেডবোর্ডে রেজিস্টরের পা ঢূকাতে দেয়ার জন্য। আমার গ্রুপের কর্মবীররা এতটাই কাজ করত, যে আমি বুঝে উঠার আগেই অনেক সময় প্রজেক্ট শেষ হয়ে যেত।

এক্সপেরিয়েন্স শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ

সবজান্তা এর ছবি

হা হা... পুরানো দিনের স্মৃতি মনে পড়লো।

একেকটা প্রজেক্ট সাবমিশনের আগে পুরা শোকের মাতম হলের রুমে রুমে। আমার খেয়াল আছে, একবার খুবই আজব এক সমস্যা পেয়েছিলাম- ব্রেড বোর্ডের যে দুই স্লটের মধ্যে কানেকশন শর্ট থাকার কথা না, সেইখানেই ছিলো। আরেকবার আরো একটা মজার ঘটনা- কাজ করছি চার বিটের আলু নিয়ে। আমাদের আলু মারাত্মক এফিশিয়েন্ট ছিলো- পুরা কৃতিত্বই আমার দুই তার ছেঁড়া (!!) বন্ধুর। তো যাই হোক, আলু বানানোর পর যতোবারই ফাংশন টেস্ট করার জন্য ইনপুট দেই, আমরা বার বার অ্যাড ফাংশনটাই বেছে নেই, আর সংখ্যা ধরি তিন আর চার নাইলে পাঁচ আর চার। ফলাফল ঠিকই আসে। হঠাৎ জমা দেওয়ার আগের দিন কী মনে করে ভিন্ন একটা সংখ্যা ইনপুট দিতেই দেখি উত্তর মিলে না। অন্য সংখ্যা দেই, তবু মিলে না। যোগের বদলে অন্য ফাংশন দেই, তবুও মিলে না। তখনি বের হয় খুব ছোট্ট কিংবা মারাত্মক একটা লজিকের ভুল।

প্রজেক্ট সাবমিশন নিয়ে সবারই মনে হয় দারুণ দারুণ সব স্মৃতি আছে। লেখাটা ভালো লাগলো।


অলমিতি বিস্তারেণ

অতিথি লেখক এর ছবি

এই সমস্যাটা আমাদের রেগুলারই হয় অনলাইনে কোড সাবমিট করতে গিয়ে
দেখা যায় আমাদের দেয়া ইনপুটে কোড রান করছে, কিন্তু স্যার একটা ইনপুট দিলে বেচারা কোড বেকুব হয়ে যায়

অতিথি লেখক এর ছবি

এই সমস্যাটা আমাদের রেগুলারই হয় অনলাইনে কোড সাবমিট করতে গিয়ে
দেখা যায় আমাদের দেয়া ইনপুটে কোড রান করছে, কিন্তু স্যার একটা ইনপুট দিলে বেচারা কোড বেকুব হয়ে যায়

তাসনীম এর ছবি

অনেক কথাই মনে পড়ল। সেমেস্টারের শেষে চোখে সর্ষে ফুল দেখতে হতো। তবে এত হাতে কলমের কাজ করার উপায় তখন (১৯৮৯-৯৫) ছিল না, তাও শেষের দিকটা ভয়াবহ যেত।

মাইক্রোকন্ট্রোলার নিয়ে কাজ শুরু করেছি আমেরিকাতে এসে, এরপর এর কাছাকাছি কাজ অনেক করেছি...মনে হয়েছে এই জিনিস বুয়েটে একটু হাতে কলমে শিখতে পারলে অনেক ভালো হতো। আপনার অনেক এগিয়ে আছেন আমাদের থেকে।

আশা করছি শুভ হবে প্রজেক্টের ফলাফল...

+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাইয়া তো ঢাকা নিয়ে খুব চমৎকার কিছু লেখা দিয়েছেন (আমি কিন্তু মনে মনে আপনাকে এইজন্য অনেক হিংসা করি)
বুয়েটের স্ম্‌তিগুলো নিয়ে কিছু লেখেন না প্লিজ
আমরাও মুফতে ঘুরে আসি ২০ বছর আগের স্ম্‌তির অঙ্গনে

বোহেমিয়ান এর ছবি

আরেক বুয়েটিয়ান! সুস্বাগতম।
কিবোর্ড চলুক!
_________________________________________

_________________________________________
ওরে! কত কথা বলে রে!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।