ছায়ার প্রহরান্তে

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২৫/১২/২০১০ - ১১:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


হঠাৎ চমকে উঠে আবার খেয়াল করি। নাহ্‌, আসলে ওটা কি? ভ্রু কুঁচকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করি। চারপাশের হালকা নীলচে আলো আরও রহস্যময় করে রেখেছে ওটাকে, চমকে ওঠাটাই স্বাভাবিক। অথবা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। আবার নড়ে উঠে ওর সামনের অংশ। দক্ষিণের দেয়ালে আটকে আছে নীলচে বর্ণের ডিমলাইটটার পূর্ব পাশে কয়েক গজ দূরত্বে। মাত্র পাঁচ ওয়াট হলে কি হবে, লাইটটা সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে যেন নিবিড়ভাবে লক্ষ্য রেখেছে । এত দূরত্বে থেকেও তার প্রতিটি কম্পন যেন আমি দেখতে পাচ্ছি, পরিস্কার।

বেশ কয় ইঞ্চি হবে লম্বায়। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না অবয়ব পুরাটা। ওটা কি চামচিকা? এই গভীর রাতে বেখেয়ালে ঢুকে পড়েছে হয়ত। পরক্ষণেই মনে হয়, নাহ্‌, তা কি করে হয়? দরজা জানালা তো বন্ধ। বাইরে হালকা ঝিঁঝিঁর শব্দও শোনা যাচ্ছে। সেই সাথে মাথার উপরের দেয়াল ঘড়ির টিক-টিক, নীলচে আবহ, আস্তে করে ছেড়ে দেওয়া সত্ত্বেও ফ্যানের হালকা শশশশ শব্দ মিলে কেমন যেন একটা ধুম্রজালের পূর্বাভাস। হঠাৎ হঠাৎ তার মাঝে অনুভব করছি বুকের ওঠানামার সাথে নাকের হালকা শিসজাতীয় আওয়াজ। বেঁচে আছি এখনও তাহলে। আবারও নজর পড়ে ঐদিকে। নাহ্‌, এখনও ওখানেই আছে। কিছুক্ষণ দেখলে মনে হতে পারে যেন দেয়াল পানিতে ভিজে আছে ঐ জায়গায়, আর কিছু নয়। লাইটের চারপাশে কিছু ক্ষুদ্রাকায় পতংগ ওড়াউড়ি করছে। তাদের ছায়া হালকা দৌড়াদুড়ি করছে ঐটার উপর দিয়ে; কিন্তু তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই একেবারে।

আচমকা নীলচে আলোটাকেও চোখে পড়ে। যেন আলোতে নয়, আলোকেই দেখছি। থরথর কাঁপছে ঘরের মাঝে। লাইটের দিকে তাকাই। কেমন যেন নিস্পৃহ, যেন প্রচন্ড অনিচ্ছার পরেও জ্বলতে বাধ্য করা হয়েছে তাকে, রাতকে অন্ধকার থেকে দূরে রাখায় মহা বিরক্ত। এদিকে বাতাসটা পিছু নিয়েছে ফ্যানের পাখার; অন্য কোনোদিকে তার নজর নাই। ব্যাটা, আমাকে ঠান্ডা কর, পাখার সাথে সাথে শশশশ করলে চলবে?? ভাবি- দেব নাকি সুইচ অফ করে, তখন বুঝবে ঠেলা। এমন অযথা চরকির মত ঘোরার কোনো মানে হয়? নিশ্চয় কার্বনের পরিমাণ বেড়ে গেছে বাতাসে। ক্যালেন্ডারটার দিকে তাকাই। নিচে চাপা পড়া অক্টোবর গরমে অতীষ্ঠ হয়ে কিনা কে জানে, একটু পরপর উপরে থাকা নভেম্বরকে কষে দিচ্ছে লাত্থি। আর তা সহ্য করতে না পেরে বাতাসের তালে একটু পরপর লাফিয়ে উঠছে নভেম্বর, কিন্তু ওজনের সাথে না পেরে পুনরায় চেপে ধরছে অক্টোবরকে। দক্ষিণ-পূর্ব দেয়ালের কোণায় আবছা কিছু মাকড়সার জাল বোঝা যায়। দীর্ঘদিনের অযত্নের অভিমান আটকে আছে সেখানে ছাইবর্ণে।

এখানে এখন আর অনেক কিছুই নেই; আবার অনেক কিছু আছে। আমি ছিলাম, আমার কিংবা আমার উপর এই আবহের অনেক অপ্রকাশিত দাবী ছিল। আজ আর তা নেই। এখন এদের (যারা আছে) সবাই সর্বদা সন্ত্রস্ত, ব্যস্ত আমার প্রহরের যেন কোনো ত্রুটি না হয়। প্রতিটি মুহূর্ত প্রস্তুত হয়ে আছে আমার পাশে, আমার জন্যে। পরিণামে নিজের অজান্তেই আমি অনেক দূরে চলে এসেছি তাদের থেকে। আগে বোধশক্তি ছিল, অনুভবের প্রয়োজন হয়নি। এখন অনুভব করতে চাই হৃদয়ের সমস্ত চিত্ত দিয়ে; কিন্তু সেই বোধশক্তি আর নাই। আছে শুধু কিছু স্বপ্নহীনতা; রাতকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে অনবরত শুধু অন্ধকারে পরিণত করে চলেছে।

সময়টা থেমে আসছে ওকে কেন্দ্র করে। দিক হারিয়ে ফেলেছে এই চার দেয়ালের মাঝে চক্কর দিতে দিতে। সহসাই নজরে পড়ে ওটা এখন শুধু আমার দৃষ্টিরই লক্ষ্যবস্তু না। ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে দূরত্বের দৈর্ঘ্য। আমি বুঝতে পারি না ঠিক এই মুহূর্তে কি ঘটতে চলেছে। আবার তাকাই ওটার দিকে। ছায়ার মধ্যে থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসে সে, গাঢ় কালো বর্ণের। ছায়াটাও কালো আর আশপাশ নীলচে হওয়ায় নজরে পড়েনি এতক্ষণ। সব পরিস্কার হয়ে যায়। হঠাৎ হারানোর আশংকায় উতলা হয়ে উঠি। কিন্তু চারপাশের মায়াবী পরিবেশ আমায় যেন অবশ করে রেখেছে। নড়তে পারিনা। অসহায় দৃষ্টিতে আশপাশে তাকাই, কেউ যদি এগিয়ে আসে। নাহ্‌, কাউকে পাইনা। বরং কি ঘটবে এ নিয়ে সবাই যেন উৎসুক হয়ে উঠেছে। নভেম্বর স্থির হয়ে গেল। বাতাসও দেখি আর নড়ে না। সবাই স্তব্ধ হয়ে আছে। এমনকি নীলচে আলোটা হঠাৎ চোখের সামনে উধাও হয়ে গেল। বুঝলাম না। মতিভ্রম হচ্ছে নাকি? শুধু ওকে আর ওর দিকে এগিয়ে আসা পদক্ষেপগুলোকে দেখতে পাচ্ছি। পেছনের দেয়ালটা, যার উপর ভর করে তারা আছে, সেটাও নেই। কী তাজ্জব! নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস আর হৃদস্পন্দনের শব্দও অপেক্ষায় স্থির হয়ে গেছে, উপস্থিতি বুঝতে পারছি না। অলোকীয় পরিবেশটার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে শুধু ঘড়ির কাঁটার শব্দটা মহানন্দে। আরেকটা ঘটনা ঘটতে চলেছে যা সে সময়ের পদচিহ্নে রেখে দেবে। অনেকক্ষণ ধরে কোনো উল্লেখযোগ্য বিষয়বস্তু পায়নি। এইবার পেয়েছে। গতি কমিয়ে নয়, একেবারে প্রায় থামিয়ে দিল ভালভাবে পর্যবেক্ষণের নিমিত্তে। তারপরে নেমে আসে এক পরাবাস্তব নিরবতা, মৃত্যুর শীতল স্পর্শ ছোঁয়া। শিরদাঁড়া বেয়ে হালকা শিহরণ বয়ে যায়। নীলচে আলোসহ পুরো ঘরটাই গায়েব হয়ে গেছে। শূণ্যতার মধ্যে আমার দৃষ্টিতে আঁকা হতে থাকে ছায়াটার শেষপ্রহর।


ছায়াটা আর থাকে না, থাকে না তার ধারকও। আর উভয়েই থেকে যায় আমার কাছে অপরিচিত, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। আলোটা ফিরে আসে দৃষ্টিতে, তার সাথে দেয়াল, নভেম্বর ইত্যাদি সবকিছুই। শুধু হলদে লেজ নাড়তে নাড়তে চলে যায় টিকটিকিটা, মুখ ঈষৎ হাঁ করা; সম্পূর্ণটা মনে হয় তখনও গিলতে পারেনি।

-অতীত


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

পুরো লেখাটায় একটা বিষাদ মাখানো।

আলোটা ফিরে আসে দৃষ্টিতে, তার সাথে দেয়াল, নভেম্বর ইত্যাদি সবকিছুই। শুধু হলদে লেজ নাড়তে নাড়তে চলে যায় টিকটিকিটা, মুখ ঈষৎ হাঁ করা; সম্পূর্ণটা মনে হয় তখনও গিলতে পারেনি।

বদ্দাকে নতুন করে জানলাম এই লেখার মধ্য দিয়ে।

---আশফাক আহমেদ

অতিথি লেখক এর ছবি

আশফাকঃ পড়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ।

পুনশ্চঃ কি জানলা নতুন???

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ভাল লাগল, প্রথমে ভেবেছিলাম ভূতের গল্প, তারপর টুইস্ট খেয়ে নিজেই চ্যাপ্টা হয়ে গেছি-

ধৈবত

অতিথি লেখক এর ছবি

ভূতের গল্প!!!!!! হা হা হা!!!

কে টুইস্ট দিল? অনুপস্থিত ভূতটা নাকি???

-অতীত

তিথীডোর এর ছবি

ভাল্লাগলো।
লিখুন নিয়মিত। হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ তিথী আপু; উৎসাহ পেলাম আপনার মন্তব্যে...

-অতীত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।