প্রসঙ্গঃ জীবাণুনাশকের অকার্যকারিতা ও এর বিশ্বব্যাপী বিস্তার(antimicrobial resistance and its global spread)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৪/০৪/২০১১ - ৮:০৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সর্বক্ষেত্রে রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাদের মস্তিষ্ক কে সারাক্ষণ জ্যাম করে রাখে।দেশের বিরাজমান মূল সমস্যাগুলো তাই আলোচনার বাইরে থেকে যায় বা কম আলোচিত হয়।একটা গভীর সমস্যা আমাদেরকে একেবারেই নিভৃতে গ্রাস করতে চলেছে।এটা একটা পৃথিবিব্যাপী সমস্যা হলেও আমরা আরও কয়েকটি দেশের সাথে মিলিতভাবে এই সমস্যার নেতৃত্ব দিয়ে চলেছি-নিজেদের অজান্তেই।কিন্তু এইধরনের নেতৃত্ব কখনোই সম্মানের নয়। তাই আমাদের উচিৎ সেখান থেকে সরে আসা।সমস্যাটি হলো জীবাণুনাশকের অকার্যকারিতা বা antimicrobial resistance. এই সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞ্যান,সচেতনতা,পারস্পারিক সহযোগীতাই পারে আমদের এই সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে।

সংক্রামক ব্যাধি ও এন্টিবায়োটিকের ভূমিকা:

সংক্রামক ব্যাধি বা infectious disease বলতে সাধারণ অর্থে সেই সব রোগ-ব্যাধি কে বুঝিয়ে থাকে যারা সাধারণত একজন মানুষ থেকে আর একজন মানুষে সংক্রমিত হতে পারে;আরো ব্যাপক অর্থে এক প্রাণী থেকে আর এক প্রাণীতে সংক্রমিত হতে পারে।এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই অসুখগুলোর জন্য কোন কোন অণুজীব গুলো দ্বায়ী।এগুলো হলো-
I. ব্যাক্টেরিয়া
II. ভাইরাস
III. পরজীবী(parasite)
IV. ছত্রাক
এদের মধ্যে ব্যাক্টেরিয়া ঘটিত রোগের জন্য এন্টিবায়োটি,viral disease এর জন্য antiviral, একই ভাবে ছত্রাক ও পরজীবী ঘটিত রোগের জন্য আলাদা আলাদা ঔষধ পাওয়া যায়।এই সবগুলো ঔষধ কে একত্রে antimicrobial drug বলা হয়ে থাকে।

Antimicrobial drugs গুলো কিভাবে কাজ করে?

সাধারণত,ব্যাক্টেরিয়ার কোষে যে কোষ প্রাচীর(cell wall) থাকে, মাতৃকোষ থেকে নতুন ব্যাক্টেরিয়া তৈরী হওয়ার সময় সেই কোষ প্রাচীর তৈরীতে বাঁধা দিয়ে,অথবা ব্যাক্টেরিয়ার প্রোটিন তৈরিতে বাঁধা দিয়ে ব্যাক্টেরিয়া কে ধ্বংস করাই এন্টিবায়োটিকের কাজ।এমন আরো কিছু mechanism of action বিদ্যমান।

Antimicrobial resistance কী এবং কিভাবে তৈরি হয়?

সাধারণত সব প্রাণীদের মাঝেই নিজেকে রক্ষা করার জন্য বিশেষ বিশেষ কৌশল লক্ষ্য করা যায়। antimicrobial drug যেন কাজ না করতে পারে সেই উদ্দেশ্যে microorganism গুলোও নিজেদের গঠন ও বৈশিষ্ঠে বেশকিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকে।এরফলে ঐ drug আর ঐ organism কে ধ্বংস করতে পারেনা।সহজ ভাষায় এটাকেই বলা হয় antimicrobial resistance বা “জীবাণুনাশকের অকার্যকারিতা।”

Antimicrobial resistance কেন হয়?

একটা ঔষধের সফল কার্যকারীতার জন্য কয়েকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সেগুল হলো-
I. সঠিক ঔষধ
II. সঠিক মাত্রা(dose)
III. নিয়মিত ঔষধ সেবন এবং
IV. পর্যাপ্ত সময়কাল(duration) ধরে ঔষধ সেবন।
এগুলোর কোন একটা যখন বিঘ্নিত হয় তখনই তৈরি হয় resistance.
আমরা কেন ঝুঁকির মধ্যে আছি?
বাঙ্গালী হিসেবে আমাদের কয়েকটি গুণ একটু বেশি।তার একটা হলো সুযোগ পেলেই ডাক্তারি করা।
একটা কিছু হলেই আমরা নিজের জন্য যেমন ডাক্তার হয়ে যায়,তেমনি অন্যের জন্যও।একটু সর্দি-কাশি হলেই আমরা দোকানে যেয়ে ইচ্ছা মতো এন্টিবায়োটিক কিনে খেয়ে ফেলি।আবার অসুখ একটু ভাল হলেই ঔষধ বন্ধ।সুতরাং ঔষধ খাওয়ার সময় উপরের শর্তগুলো কোনটাই আমরা সঠিকভাবে পূরণ করিনা।
আবার সাধারণ সর্দি-কাশি,ডায়রিয়া ইত্যাদি রোগগুলো সাধারণত ভাইরাস দ্বারা হয়ে থাকে।সেগুলো এক সপ্তাহ পরে এমনিতেই ভাল হয়ে যায়।কিন্তু আমরা সে ক্ষেত্রেও এন্টিবায়োটিকের আশ্রয় নিই।ফলাফল যথাবিহিত antimicrobial resistance.

সমস্যার ব্যপকতা ও পরিণতিঃ

এভাবে নির্বিচারে মুড়িড় মতো antibiotic খাওয়ার ফলে অধিকাংশ জীবাণু antibiotic এর প্রতি resistant হয়ে উঠছে।এমন কি এই resistant ব্যাক্টেরিয়া মানুষের মল-মূত্রের মাধ্যমে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে।আর এই resistant ব্যাক্টেরিয়া যখন অপর কাউকে আক্রমন করছে তার ক্ষেত্রেও ঐ ঔষধ কাজ করছে না।শুধু তাই নয়,মানুষের চিকিৎসায় যে পরিমাণ antibiotic ব্যবহৃত হয় তার প্রায় দ্বিগুণের ও বেশি ব্যবহৃত হয় পশুপাখির রোগ চিকিৎসায়।
তাই TB থেকে এখন তৈরি হয়েছে MDR(Multi Drug Resistant) TB.এভাবে organism গুলো multi-drug resistant হতে হতে তৈরি হচ্ছে ‘Super Bug’ যার বিরুদ্ধে কোন ঔষধ ই তেমন কার্যকর নয়।
Drug resistance এর কারণে চিকিৎসা ব্যয় প্রায় ২০-২০০ গুণ বৃদ্ধি পাবে।বৃদ্ধি পাবে চিকিৎসার সময়কাল।আমাদের হাসপাতাল গুলোতে এমনিতেই রোগী রাখার জায়গা নেই,তখন কী হবে একবার ভেবে দেখুন!
আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সেলফ ভর্তি ঔষধ থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসার অভাবে মারা যাবে।তাই আসুন একটু careful হই।

পরিত্রাণের উপায় কী?

পরিত্রাণ সহজ নয়;আবার কঠিনও নয়।কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত,পারিবারিক এবং সামাজিক সচেতনতা ও দ্বায়িত্ববোধ।এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় নীতিমালা।
 রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ মতো এন্টিবায়োটিক সেবন করুন।
 পল্লী চিকিৎসকের দেয়া এন্টিবায়োটিক গ্রহণে মানুষকে নিরুৎসাহিত করুন।
 একই ধরনের অসুখ বলেই একই ধরনের ঔষধ খাওয়া উচিৎ নয়।
 অসুখের উপসর্গ ভালো হয়ে গেলেই ঔষধ খাওয়া ছেড়ে দেওয়া উচিৎ নয়,এতে শরীরের ভেতরে কিছু ব্যাক্টেরিয়া থেকে যায় এবং ঐ রোগি প্রস্রাব-পায়খানার মাধ্যমে ঐ অসুখ অন্য মানুষে ছড়াতে থাকে-এই অবস্থায় ঐ রোগি কে বলাহয় carrier বা রোগের বাহক।
 নিয়মিত ঔষধ সেবন করা অত্যন্ত জরুরী।
 সাধারণ সর্দি-কাশি,জ্বর,ডায়রিয়া এগুলোতে এন্টিবায়োটিক খাওয়ার আগে ৩-৪ দিন অপেক্ষা করুন।এগুলো সাধারণত ভাইরাস ঘটিত এবং ঔষধ ছাড়ায় এক সপ্তাহের ভেতরে ভালো হয়ে যায়।

রাষ্ট্রীয় নীতিমালাঃ

পৃথিবীর সব দেশেই রেজিস্টার্ড চিকিৎসিকের প্রেস্ক্রিপশন ছাড়া ঔষধ বিক্রি নিষেধ।কিন্তু আমাদের দেশের সরকার যেহেতু একটু মন্থর,তাই আজও এই নীতিমালা তৈরি সম্ভব হয় নি।আমাদের মন্ত্রিপরিষদ নাকি এই পর্যন্ত তিন বার নীতিমালা তে স্বাক্ষর করেও সেটা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।এটা করতে গেলে চিকিৎসা ক্ষেত্রেও ব্যপক সংস্কার প্রয়োজন;তা না হলে চিকিৎসা ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।

উপসংহারঃ

আলোচনার রাস্তা খোলা থাক-এমন একটা বিষয়ের উপসংহার টানা উচিৎ হবে না।

বিঃ দ্রঃ এটা কোন reference নয়;সব ধরণের মানুষের বুঝার সুবিধার্তে সহজ ভাষায় লেখা কিছু কথা।সব ধরণের ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়।আরও বিস্তারিত জানার জন্য পড়ালেখা করুন। ধন্যবাদ।

তরুন হাসান
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

চলুক

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

আরেকটা বিষয় উল্লেখ করে নিতে পারেন। 'এটা কোনো মেডিকাল অ্যাডভাইস নয়। এই তথ্য পড়ে কারো কোনো বিপদ হলে দায়ী করতে পারবেন না।' এধরনের ক্লজ জরুরী মনে হয়।

মাহবুব রানা এর ছবি

চলুক
লিখতে থাকলে ইংরেজীর ব‌্যবহার আরেকটু কমিয়ে আনতে পারবেন আশা করি।

হাসিব এর ছবি

আমার কাছে ইংরেজির ব্যবহারটা অতিরিক্ত মনে হয়নি। রেজিস্ট্যান্সকে প্রতিরোধ হয়তো লেখা যেত। আর ইংরেজি শব্দগুলো বাংলা হরফে লিখলে হয়তো চোখে কম পড়তো। তবে ওটা না করাতে এমন কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হয়েছে বলে মনে হয় না।

মাহবুব রানা এর ছবি

আর ইংরেজি শব্দগুলো বাংলা হরফে লিখলে হয়তো চোখে কম পড়তো।

আমি এটাই বলতে চেয়েছিলাম।
সময়মত সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে না পাওয়াটা মনে হয় বিজ্ঞান লেখার সবচেয়ে বড় সমস্যা। ইংরেজি শব্দগুলো বাংলা হরফে লিখাটা তাই একটা ভালো সমাধান। কিন্তু পোস্টে দেখুন মাঝে মাঝেই বাংলার সাথে ইংরেজীটাও দিয়ে দিয়েছেন, যেটা না হলেও চলতো, এই আর কি হাসি

কুটুমবাড়ি [অতিথি] এর ছবি

রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শমতো অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ গ্রহণ করুন! এ ব্যাপারে সবার মধ্যে আরও সচেতনতা বাড়াতে হবে।

আমি তো এখন সুযোগ পেলেই সবাইকে বলে বেড়াই, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খাবেন না, এবং ভালো হয়ে গেলেও কোর্স কমপ্লিট করবেন (এটাই বেশি জরুরি)। নইলে সাময়িকভাবে সুস্থ হয়ে গেলেও পরবর্তীতে নিজের ও বংশধরদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হতে হবে, হয়তো সেই পরিণতি হবে আরও বেশি ভয়ঙ্কর। সুতরাং সময় থাকতে সাবধান!

হাসিব এর ছবি

লেখাটা ভালো হয়েছে। এরকম টিউটো আরো কিছু আসা দরকার।

পল্লী চিকিৎসকের দেয়া এন্টিবায়োটিক গ্রহণে মানুষকে নিরুৎসাহিত করুন।

শহুরে বিখ্যাত চিকিৎসকেরাও রোগীর রোগের বর্ননা না শুনেই এগুলো আকছার দিয়ে থাকেন। এটা শুধু পল্লী চিকিৎসকদেরই দোষ না।

guest writer rajkonya এর ছবি

ফার্মাসিউটিক্যালের কয়েকটা কোর্স ছিল অনার্স আর মাস্টার্সে।আর এই কোর্সগুলোই ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয়। সে সুবাদে এসব সম্পর্কে কিছুটা আগেই জানা ছিল। ক্লাসে স্যারের লেকচার শুনে শুনে আমার রীতিমত এন্টিবায়োটিক ফোবিয়া হয়ে গেছে। আর ডাক্তারদেরই বা কি দোষ? প্র্যাসকিপশনে অনেক সময় দরকার না থাকলেও কিছু এন্টিবায়োটিকের কথা তাদের লিখে দিতে হয়। দরজার বাইরে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেতিভরা দাঁড়িয়ে থাকে কী প্র্যাস্ক্রাইব করা হল তা চেক করার জন্য। ইয়ে, মানে...

এন্টিবায়োটিক প্র্যাস্ক্রাইব করার সময় ডাক্তাদেরও কিছু বিষয় খেয়াল রাখা দরকার। রোগী আগে কী ধরনের এন্টিবায়োটিক খেয়েছে তার হিস্ট্রি জেনে নেওয়া উচিত। যেটা আমাদের দেশের বেশির ভাগ ডাক্তারেরাই করেন না। :-/

পশু পাখিদের ক্ষেত্রেও এন্টিবায়োটিকের কিছু এডভার্স ইফেক্ট দেখা যায়। ফুড প্রোসেসিং এর উপর একটা কোর্স ছিল আমাদের। সেটা পড়তে গিয়ে জেনেছিলাম, কোন এক প্রজাতির গরুর দুধ থেকে আর দই বা বিভিন্ন ধরনের কার্ড তৈরি করা যাচ্ছিল না। কারণ অনুসন্ধান করে জানা যায়, কোন একটি এন্টিবায়োটিক ওষুধের প্রভাবে তা ঘটছে!

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

অতি সম্প্রতি পশুর উপর এন্টিবায়োটিকের কুফল জানা গেছে: http://www.latimes.com/health/boostershots/la-heb-meat-bacteria-20110415,0,7997782.story

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।