তার সাথে আজকেও আমার আবার দেখা হবে এটাই স্বাভাবিক। আমার সময়টা মনে আছে, ঠিক সাড়ে আটটায় ভদ্রলোক বের হবেন। সটান গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম চৌরাস্তার মোড়টায়, যেখানে রহিম চাচা আজকাল মাঠা বিক্রি করে। এক গ্লাস মাঠা হাতে নিতেই দেখলাম লোকটা আসছে।
আমাকে দেখেই মধ্যবয়েসি লোকটা একটু মুখ লুকানোর চেষ্টা করে। হাতের সম্ভবত একটা বিড়ি ছিল, সেটাও ফেলে দিল। হাতের ফাইলটা দিয়ে নিজের টেকো মাথা আড়াল করতে করতে এগিয়ে যায়, যেন আমাকে দেখলেই আজকের দিনটা নষ্ট হয়ে যাবে।
আমি এক ঢোকে হাতের মাঠাটা খেয়ে ফেলি। হালকা চালে ডাক দেই, ‘ মিজান সাহেব, একটু শুনে যান।’
চমকে উঠে লোকটা। ফাইলটা পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। চোখের চশমাটা কাঁপাকাঁপা হাতে ঠিক করে নেয়। যেন শুনতে পায়নি, এমন ভঙ্গিতে আবার বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে থাকে ।
আবার ডাক দিলাম, এবার আরেকটু জোরে।
‘এই যে মিজান সাহেব, দেখতে পাচ্ছেন না? এদিকে আসেন। ’
এতক্ষনে যেন দেখতে পেল। কাঁপতে কাঁপতে রাস্তা পার হতে লাগল।
তার এই হেঁটে আসাটা প্রতিদিন আমি উপভোগ করি। আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা একটা গদবাধা হাসির অনুষ্ঠানের মতো লাগে, নিত্যদিনই এই একই একঘেয়ে কান্ড। তবুও রোজ লোকটাকে ডাকি।
লোকটা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি।একেবারে ঘেমে নেয়ে একাকার । টেকো মাথাটাও ঘেমে গেছে। কেমন যেন অসহায় ভাব, পারলে এক ছুটে দৌড়ে পালায়। একটু হাসার চেষ্টা করে, কিন্তু হাসিটা কেমন পানসে লাগে, মনে হয় চিমটা দিয়ে গাল দুটো কেউ টেনে ধরেছে।
‘কি খবর মিজান সাহেব? দিনকাল কেমন চলে?’
‘এই তো...’ নিচুস্বরে বলে লোকটা। ‘আছি কোন রকম... তুমি কে-কেমন আছ?’
আমি জবাব দেই না। লোকটার হাসিটা একটু মিইয়ে যায়। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষন পর আমি তাকে আবার প্রশ্ন করি, ‘বাসার সবাই ভালো আছে?’
‘হ্যা হ্যা... সবাই ভালো আছে, সবাই ভালো আছে। নিতু তো তোমার কথাই বলে সারাক্ষন...’
এটাই শুনতে চেয়েছিলাম। ‘নিতুদি আমার কথা বলে?’
‘বলে না আবার!’ লোকটা একটু সাহস পায় ‘আমাকে তো শুধু তোমার কথা জিজ্ঞেস করে, বলে তুমি কি কর, কোথায় থাক এখন, কতদিন তোমাকে দেখে না...’
‘ও’।
আমার আর কিছু বলার থাকে না। প্রতিদিনের মতো আবার কিছুক্ষন চুপ হয়ে যাই। নিতুদির কথা ভাবতে থাকি।
লোকটা যাবার জন্য উসখুস করতে থাকে। কিছুক্ষন পর জিজ্ঞেস করে, ‘আমি চলে যাব?’
আমি কিছু বলি না। করিম চাচা ইশারা করে চলে যেতে। ছাড়া পেয়ে লোকটা আবার দ্রুতপায়ে চলে যায়।
আস্তে আস্তে আমি ক্লাবঘরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। নিতুদির স্বামী হিসেবে লোকটাকে মানায় না। তবুও নিতুদি কেন যে এই লোকটাকে বিয়ে করল তা আজও আমি বুঝলাম না। আমি তাই প্রতিশোধ নিয়ে যাই, প্রতিদিন , ঠিক এই সময়টায়। এর চেয়ে বেশি কিছু করবার শক্তি যে আমার নেই।
নিতুদিকে খুব মনে পড়ছে। নিতুদি, তুমি ভালো আছ তো?
_____________________________________________________________
মেঘদুত
মন্তব্য
ভালো লাগলো...
এ কেমন প্রতিশোধ আবার! আরেকটু ঝাল হতে পারতো না?
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ছোট্ট অথচ তীক্ষ্ণ। ভালো লাগলো।
ভালো লাগলো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ধন্যবাদ নজরুল ভাই...
বহুত খুব!!!! বহুত খুব!!!!!!
নিজের সীমাবদ্ধ গণ্ডিতে ভালো রকমের প্রতিশোধ।
--------নিশাচর পার্থ।
নতুন মন্তব্য করুন