নিশীথ সূর্যের দেশে

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: বিষ্যুদ, ২১/০৭/২০১১ - ১০:২০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দিগন্ত ছোঁয়া পাহাড় সারি, পর্বতমালাও বলা যায়- কিছু কিছু পাহাড় চূড়া যে ২০০০ মিটারেরও বেশী উঁচু! কিন্তু এ শুধু প্রাণহীন রুক্ষ পাথরের স্তুপ তাও নয়, অধিকাংশ পাহাড়েই সারা বছর জমে থাকে বরফ, গ্রীষ্মে এই বরফগলা জল থেকেই তৈরি হয় লক্ষ জলপ্রপাত আর ঝর্ণার। আর একটু নিয়ে লক্ষ্য করলে চমকে উঠতে হয়, পাহাড়ের পাদদেশে অতল নীল জলের সম্মোহনী হ্রদ। একটি-দুটি নয়, হাজার হাজার মাইলব্যপী বিস্তৃত এই জলসীমানা। অনেক স্থানেই জল ছুয়ে পাহাড়ের ঢাল খাড়া উঠে গেছে ১৫০০ মিটার। প্রকৃতির এই ভয়াল অপরূপ সৌন্দর্য দেখলে পাকস্থলীর ভিতরে আপনাথেকেই একরাশ্ প্রজাপতি উড়ে যাবার মত গা শিরশির করা অনুভূতির জন্ম নেয়। চমক এখানেই শেষ নয়, অর্ধেক দিন লক্ষ্য রাখলেই দেখা যায় প্রকৃতির এক অদ্ভুত খেয়াল, পাহাড় ঘেরা এই জলাভূমিতে শুরু হয়েছে জোয়ার-ভাঁটা! তাহলে তো এ হ্রদ নয়, নদীও নয় ! এই জলাধারের সাথে যোগাযোগ আছে অতলান্তিক মহাসাগরের। কি হতে পারে এই স্বর্গসম স্থানটি- অনেকটা যেন পাহাড় ঘেরা সমুদ্র, স্ফটিক স্বচ্ছ জল, প্রায়শই দেখা যায় তিমি-ডলফিনের ঝাক, মহাসবুজের ছড়াছড়ি পাহাড়ের ঢালে ঢালে, আবার পাহাড়চুড়োয় বরফের স্তূপ সর্বদাই বিরাজমান- এর নামই ফিয়র্ড। নরওয়ের ফিয়র্ড অঞ্চল যাকে বিশ্বের সবচেয়ে নয়নাভিরাম স্থান বলে সবসময়ই অভিহিত করা হয়েছে, যা আকর্ষণের মায়াজালে আচ্ছন্ন করে রাখে বিশ্বের কোটি কোটি ভ্রমণপিপাসুদের। চলুন পাঠক, ঘুরে আসি Land of MidNight Sun নরওয়ে থেকে।

ফিনল্যান্ডের সাথে নরওয়ে আর সুইডেনের সীমানা থাকায় গাড়ী নিয়েই যাওয়ার চিন্তা ছিল বরাবরই কোন এক গ্রীষ্মে। কিন্তু সীমানা থাকলেই তো আর চট করে নরওয়ে যাওয়া যায় না, যা কিনা বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল দেশ। ফিনল্যান্ডে আসা পর্যটকরা সবসময় হা হতোম্মি করে আগুন গরম দামের কারণে, আর নরওয়ে ফিনল্যান্ডের একেবারে দ্বিগুণ ব্যয়বহুল, বিশেষ করে পেট্রলের দাম তো আকাশ ছোঁয়া! অনেক হিসেবনিকেশ কষে, পরিকল্পনা এঁটে এক জুলাই মাসের শেষে আমরা রওনা দিলাম মধ্য ফিনল্যান্ডের একরত্তি শহর VARKAUS থেকে।

দলটি আমাদের বহুজাতিক, Tero আর Jussi ফিনিশ্, Kuni ভিয়েতনামী আর অধম বঙ্গসন্তান। প্রথম দিনেই আমরা পেরিয়ে গেলাম ৮০০ কিমি, এর মধ্যে সুইডিশ সীমান্তবর্তি শহর Tornio থেমে পরবর্তী এক সপ্তাহের প্রয়োজনীয় খাদ্য-পানীয় ও অন্যান্য রসদপত্র কেনা হল। যাত্রা পথের প্রথম রাতটি কাটল সুইডেনের Burea ক্যাম্পিং-এ। উল্লেখ্য, আমাদের পরিকল্পনা ছিল সবসময়ই তাবুতে ঘুমাব, স্লিপিং ব্যাগের ভেতর আর ক্যাম্পিং-এ নামমাত্র ভাড়ায় থাকলে হোটেলে থাকার বিশাল খরচ যেমন বাঁচল, তেমন প্রকৃতির সন্নিবেশেও থাকা হল।

পরদিন সকাল থেকেই উৎকণ্ঠা, কখন পৌছাব নরওয়েতে, শৈশব থেকে যার কথা শুনে আসছি আমরা নিশীথ সূর্যের দেশ বলে। বিকেলের দিকে হঠাৎ দেখি রাস্তার পাশের সাইনবোর্ডগুলো আর সুইডিশে নয়, বরং অদ্ভুত বিজাতীয় এক ভাষায়, নজরে আসল লাল-নীল-সাদা পতাকা, ইয়াহু! গাড়ীর ভিতরে উদ্বাহু চিৎকার শুরু করলাম সবাই, স্বপ্ন হল সত্যি। এখানে বর্ডার চেকিং বলে কিছু চোখে পড়ল না , নেই কোন সীমান্ত রক্ষী বা প্রাচীর।

গোধূলি হয়ে আসায় সেদিন আর পথ না চলে তাবু গাড়লাম Turifos ক্যাম্পিং –এ, আমাদের তাবু থেকে মাত্র মিটার দশেক দূরেই মৃদু শব্দ করে বয়ে চলা এক স্রোতস্বিনী হল আমাদের সাথী। পাহাড়ি এলাকায় নেমে আসা সাত তাড়াতাড়ি আঁধারের জন্য আর ঘোরাঘুরি না করে ডিনারের জোগাড় শুরু হল সবাই মিলে। আমাদের Jussi একেবারে পেশাদার মাছশিকারি, চার বছর বয়স থেকে ঠাকুরদার সাথে মাছ ধরে ধরে এই শিল্পের সমস্ত নাড়ী- নক্ষত্র তার জানা। কিছুক্ষনের মাঝেই মাঝারি আকৃতির কিছু ঝর্ণার ট্রাউট জাতীয় মাছ ধরে হাজির সে, তারপর অবারিত আকাশের নিচে ফ্রাইং প্যানে ভাজা মাছ-পেয়াজ আর ভাতের যে অপূর্ব সমন্বয়, সে স্বাদ এখনও জিভে লেগে আছে !

পরদিন সকালেই নদীর তীর ধরে ট্রেকিং-এ আমরা, নদীটি খুব গভীর বা প্রসস্ত নয় কিন্তু অতি খরস্রোতা, দুই ধারই অত্যন্ত পাথুরে, প্রায়ই আমাদের পাথরের বিশাল সব স্তূপ ডিঙিয়ে যেতে হচ্ছে, কিন্তু সব বাঁধার পাহাড় দলেই নদীটি বয়ে চলেছে আশ্চর্য রকম সাবলীল ভাবে, কত বাঁক, চড়াই-উৎরাই তার পথে। কিছু বিশালাকৃতির ভীম গর্জনশীল জলপ্রপাতের কথা আলাদা ভাবে বলতেই হয়। ঘণ্টা দেড়েকের মাঝেই বোঝা গেল, নাম না জানা এই পাহাড়ি স্রোতস্বিনীই আমার এখন পর্যন্ত দেখা সবচেয়ে সুন্দর নদী, এতদিন পর্যন্ত টেকনাফকে জড়িয়ে রাখা নাফ নদীই এই জায়গাটি দখল করে ছিল।

নদীর পাশের পাহাড়গুলোতে মনে হল সবুজের বান ডেকেছে, এই বিস্তৃত সবুজ দেখে মনে হল বিভূতিভূষণ মনে হয় নরওয়েকে নিয়ে লিখেছেন- কি অপরূপ সবুজের সমুদ্র চারিদিকে যতদূর দৃষ্টি চলে। অরণ্যের অস্পষ্ট সীমারেখা পর্যন্ত বিস্তৃত থৈ থৈ করিতেছে। এক এক জায়গায় ফাঁকা জঙ্গলের দিকে বনের কি অনুপম শোভা! মানুষের চোখের আড়ালে সভ্য জগতের সীমা হইতে বহু দূরে এত সৌন্দর্য যে কার জন্য সাজানো!

দুপুরে রওনা দিলাম নরওয়ের পুরাতন রাজধানী Trondheim দেখার আশায়। প্রায় হাজার বছরের পুরনো এই নগরীর ক্যাথেড্রালটি নরওয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গির্জা, বাহির থেকে অনেকটা প্যারিসের নোতরদামের মত দেখতে। যা হোক, যেহেতু পরিকল্পনা ছিল নগরজীবন এড়িয়ে আমরা যতদূর সম্ভব প্রকৃতির কাছে থাকার চেষ্টা করব- অতএব, আবার যাত্রাপথে। চলন্ত অবস্থাতেই গাড়ী থেকে প্রকৃতির অনুপম রূপ সুধায় আচ্ছন্ন আমরা, যা সর্বদাই পরিবর্তনরত। গাঢ় সবুজ উপত্যকা, ন্যাড়া পাহাড়, গভীর খাঁড়ি, হঠাৎ হঠাৎ সবুজ সমভূমি, ফসলের ক্ষেত, সর্পিল খরস্রোতা নদী, গহন বন- কোন কবিই এমনকি হয়ত উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থও এই সৌন্দর্য কলম দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন না। নরওয়ে প্রকৃতির সত্যিকার বুনো সৌন্দর্যে ভরা এক দেশ, যা বহুমাত্রায় বর্ণিল ও প্রাচুর্যে অফুরান।

সেদিনের গন্তব্য বিখ্যাত Rondane ন্যাশনাল পার্ক। উল্লেখ্য, এটি নরওয়ের প্রথম ঘোষিত ন্যাশনাল পার্ক, এখানে ৭ টি পাহাড়চূড়ো আছে যার প্রতিটিই ২০০০ মিটারের বেশী উঁচু, আর রয়েছে দশ থেকে পনের হাজার বছর আগেকার বলগা হরিণ শিকারিদের হরিণ ধরার ফাদ ও আবাসস্থল। জায়গাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে, পৌছতে পৌছতে সন্ধ্যে হয়ে গেল, শেষ বিকেলের রোদ যায় যায় করছে। এর মধ্যেই তাবু খাটালাম খরস্রোতা হিম শীতল জলের এক নদীর পাশে, অদূরেই কুয়াশাচ্ছন্ন তেপান্তরের মাঠ, তার প্রান্তরেখায় সন্ধ্যার মেঘ আর হিম বরফ নিয়ে ঠাই দাড়িয়ে আছে পর্বতশ্রেণী। ঠাণ্ডা বাতাস চামড়া কেটে একবারে হাড়ের গোড়া পর্যন্ত আঘাত হানছে, এর মাঝেই চারিদিকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘনিয়ে উঠছে গাঢ় কুয়াশা। এ যেন লর্ড অফ দ্য রিংস সিনেমার কোন দৃশ্যপট, চোখ ফেরানো যায় না এই জাদুময়তা থেকে।

সকালে ঘুম ভাঙ্গল পাহাড়ি নদীর কূলকুল ধ্বনিতে নয়, আশ্চর্যজনকভাবে ভেড়ার ডাকে! যাঃ বাবা ঠিক শুনছি তো ? আমরাতো উত্তরের নরওয়েতে, দক্ষিণের অস্ট্রেলিয়াতে না! চোখ রগড়াতে রগড়াতে তাবুর কোল থেকে মাথা বের করে দেখি ভেড়ার পাল মনের সুখে চরে বেড়াচ্ছে, তাদের কানে আবার ট্যাগ লাগানো, বোঝা গেল এগুলি পার্ক কতৃপক্ষের ভেড়া! বেশ ঝকঝকে রোদ বাহির হয়েছে, সবার মাঝেই চনমনে একটা ভাব, সামনের দিকে দৃষ্টি পড়তেই পেয়ে গেলাম সেদিনের গন্তব্য, পর্বতশৃঙ্গ Valesmeden, যার উচ্চতা ২০১০ মিটার।

আমাদের সবার জীবনে এলো এক মহা অ্যাডভেঞ্চার পূর্ণ দিন, সেই সাথে বিপদসঙ্কুল ও ঝুঁকিপূর্ণ। এতো শুধু ঢাল বেয়ে পাহাড়ে ওঠা নয়, পথে অন্তত পাঁচটি বড় পাহাড় অতিক্রম করতে হয়েছে, বিশাল সব চড়াই-উৎরাই আর খাড়া ঢালে ভর্তি, বিশাল সব পাথরের চাঙ, কোথাওবা ক্ষুদ্র পাথর খণ্ডের সমারোহ, একবার পা পিছলালেই আর দেখতে হবে না! দিনের মাঝভাগে এক গিরিখাতের তলদেশে পৌছালাম আমরা, একেবারে শিউরে ওঠার মত জায়গা- রূক্ষ, পাথূরে, প্রাণের চিহ্ন মাত্র নেই, কেবল মাত্র কুৎসিত কোন সরীসৃপের মত সবুজ-হলুদ রঙের পাথরে ভর্তি। এতটাই প্রাণহীন, নির্জন যেন সাক্ষাৎ যমরাজের মৃত্যুপুরী, তাই গিরিখাতটির নাম দিলাম Death Valley । আমাদের গ্রহের কোন স্থান বলে মনেই হচ্ছে না, যেন মঙ্গল গ্রহ বা সাইন্স ফিকশন সিনেমায় দেখা কোন জায়গা! বিপদের মাত্রা আরো বাড়ল যখন ১০০০ মিটার আরোহণের পর সহযাত্রী Tero জানালো তার উচ্চতাভীতি আছে, নিচের দিকে তাকালেই তার মাথা ঘুরছে, মড়ার ওপর খাড়ার ঘা। কিন্তু কিছুই সেদিন দমাতে পারেনি আমাদের, মনের গহনে সবাই জপছিলাম একটাই মন্ত্র- I want that Peak. যদিও পথের রসদ ছিল যৎসামান্য, ২টিন টুনামাছ, ২টিন ফল আর কয়েক বোতল জল, ৪ জনের জন্য হাস্যকর বৈকি, তার উপর পথ যখন সম্পূর্ণ অচেনা ও এতটাই বন্ধুর। অবশেষে তুষার এলাকায় পৌছালাম আমরা, অপেক্ষাকৃত গভীর বলে সারাবছরই এখানে বরফ জমে থাকে। আবার পেজা বরফের স্তূপের নিচ থেকে কূলকুল শব্দে বয়ে চলছে বরফগলা ঝরনা। প্রাকৃতিক উৎস থেকে জলের বোতল পূর্ণ করার সাথে সাথে স্নো বল তৈরি করে একজন আরেকজনের প্রতি ছোড়াছুড়ি করতে কোন ভুল হল না, হাজার হলেও আগস্টের প্রথম সপ্তাহে আর কোথায় আমরা তুষার পাব! অবশেষে আসল পরম আকাঙ্খিত মুহূর্ত, আমরা পর্বত শিখরে!! এরপরে কেবলই আকাশ, চারিদিকে ভাল করে দৃষ্টিপাত করতেই সেই গা শির শির করা শিহরণ জাগানো অনুভূতির জন্ম নিল পাকস্থলীর ভেতরে। দিগন্ত পর্যন্ত ছড়ানো পর্বতশ্রেণী, মেঘে ঢাকা, রহস্যময়, মাঝে মাঝে সূর্যের আলোক ঝলক পড়ছে দূর ফিয়র্ডের জলে। চূড়োয় ফিনল্যান্ডের একটি পতাকা আর শুভেচ্ছাবাণী রেখে শুরু হল অবরোহণের পালা। পাঠকরা কেউ Rondane গেলে সেখানকার সুন্দরতম শৃঙ্গ Velesmeden পানে তাকিয়ে মনে করতে পারেন সেখান গর্বের সাথে একদা উড়েছিল সবুজ-লাল এক পতাকা।

চূড়া থেকে তাবুতে আসতে আসতে ফের ঘনিয়ে আসল আঁধারের রাজ্য, প্রায় ৩০ কিলোমিটারের উপর পদব্রজে ভ্রমণ শেষে রিক্ত অবসন্ন আমরা কোনমতে পরবর্তী ক্যাম্প এলাকা Otta-তে যেয়ে সোজা নিদ্রাদেবীর কোলে।
পরদিন পৌছালাম ফিয়র্ড এলাকায়, আর পাথুরে নয়, সবুজ স্নিগ্ধ প্রকৃতি। দেখা মিলল Sogne Fjord এর, ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ফিয়র্ডটিই নরওয়ের সবচেয়ে বড় ফিয়র্ড। তার স্বর্গীয় রূপ কাছে থেকে উপভোগের আশায় সেদিন বেশ বেলা থাকতেই ফিয়র্ডের কোল ঘেঁষে এক জায়গায় ক্যাম্প ফেলা হল। কিছুক্ষনের মধ্যেয় সেই মায়াবাস্তবতাময় জলরাশিতে দেখা মিলল ২ টি সামুদ্রিক ভোঁদড় আর দশটি ডলফিনের এক ঝাকের! অবিশ্বাস্য, বুনো, শান্ত, নিস্তব্ধ, অপরূপ পরিবেশ। সূর্যের আলোর সাথে সাথে ফিয়র্ডের জলের রংও পরিবর্তনশীল, কখনও পান্নার মত জ্বলজ্বলে সবুজ, কখনও অতলান্তিক নীল, কখনও বিষণ্ণ ধূসর, কখনও না স্ফটিক স্বচ্ছ। অসম্ভব আকর্ষণী ক্ষমতা ফিয়র্ডগুলোর, মোহমুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত। আবেগতাড়িত হইয়ে মেসেজ পাঠালাম বন্ধুদের, I dont believe in heaven, but if there could be a heaven, it must be in the Fjord area of Norway! It is just so Great !

পরের গন্তব্য নরওয়ের সবচেয়ে নয়নাভিরাম শহর বলে খ্যাত Bergen, যাকে বলা হয় নরওয়েজিয়ান সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র, উপকূলবর্তী অত্যন্ত গোছানো এক শহর। বেরগেন বন্দরের মাছের বাজারের সুনাম সারা জগৎ জুড়ে। আমরাও গেলাম বিভিন্ন ধরনের মাছ আর সামুদ্রিক প্রাণী দেখার আশায়, দামেও অতি সস্তা। বড় আকারের চিংড়ীর দাম দেখেতো আমাদের চক্ষুচড়কগাছ,মাত্র ৯ ইউরো কিলো, কেনাও হল কিছু পথের জন্য। এক জেলেনী দেখি আবার বিনামূল্যে ছোট এক ফালি তিমির মাংস সাধছে, ভাবটা এমন, প্রথমটা মুফতেই নেও, এরপরে ভাল তো লাগবেই, তখন চড়া দাম ধরে সব সুদেআসলে আদায় করব। এমনিই মানুষের লোভের কারণে তিমিহীন হয়ে যাচ্ছে মহাসাগরগুলো, তাই সেই লোভী মানুষদের দলে আর যোগ দিলাম না আমরা। বেরগেন শহরের কেন্দ্রীয় অংশ ভর্তি পুরনোকাঠের বাড়ী দিয়ে, যেগুলো অত্যন্ত সুদৃশ্য ও বর্ণিল, পুরো এলাকাটিই ইউনেস্কো কতৃক বিশ্বসম্পদ বলে ঘোষিত।

এর মধ্যে বার দুই ফেরী করে ফিয়র্ড পাড়ি দিতে হল, এই জলাভূমিকে আরও কাছ থেকে দেখার সুযোগ মেলায় কৃতার্থ আমরা, দিনটাও ছিল মেঘলা। উঁচু পাহাড়ি রাস্তায় উঠার দরুন কয়েকবারই গাড়ী মেঘের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করেছে, আর নরওয়েতে তো পাহাড়ি সুরঙ্গের (টানেল) ছড়াছড়ি। খানিক পরপরই সুড়ঙ্গ আর তার ভেতরকার ঘুটঘুটে আঁধার, কাজেই সানগ্লাস পড়ার অভ্যাস থাকলে সাবধান!

নরওয়ের শেষ রাত কাটল Odda ক্যাম্পিং এ, ট্রাভেল গাইদে লেখা আছে ,Odda- The Ugliest City of Norway! কিন্তু সত্যি বলতে আমাদের যাত্রায় এটিই সবচেয়ে সুন্দর ক্যাম্পিং এলাকা। দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী সবুজের চাদর মোড়ানো এক উপত্যকায়। সুন্দরের ছড়াছড়ি সেখানে, কুৎসিতের লেশমাত্রও নেয়। Odda তে কিছু কলকারখানা আছে, তাতেই হয়ত তার নামে এমন দুর্নাম ছড়িয়েছে। দেশ বেশী সুন্দর হলে যা হয় আর কি !

পরদিনের গন্তব্য অসলো, নরওয়ের রাজধানী। পথিমধ্যে থামা হল Seljordএ, জনশ্রুতি আছে এখানে স্কটল্যাণ্ডের লক নেসের নেসির মত কোন প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী থাকে, যার আদুরে নাম Selma! সেলমা দর্শনের আশায় সেই হ্রদের পাড়ে বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করলাম সবাই সমানে তার নাম ধরে, প্রাণীটি মনে হয় বেশ লাজুক, তাই দেখা এ যাত্রা মিলল না। কয়েকজন বিজ্ঞানী সোনার তরঙ্গ ব্যবহার করে এই হ্রদে একাধিক গভীর প্রাণীর অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছেন। তাই, জয়তু সেলমা।

অসলো বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর এবং গোছানো রাজধানীদের একটি, আসলে বলা যায় সাজানো গোছানো গ্রাম একটা, সবুজের ছড়াছড়ি সব জায়গাতে। নরওয়েজিয়ানরা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রতিকূল আবহাওয়াকে জয় করে বন্ধুর ভূমিতে পত্তন করেছে এক একটি শহরের। ভাইকিং জাদুঘরে শিহরিত হলাম সেকালের সমুদ্র দস্যু ও অভিযাত্রীদের কাঠের তৈরি হাজার বছরের পুরনো বিশালাকায় নৌকা দেখে, এমন নৌকাতে করেই তারা কলম্বাসেরও অন্তত একশ বছর আগে পৌঁছেছিল উত্তর আমেরিকায়, বসতি করেছিল কানাডা, গ্রীনল্যান্ড ও আইসল্যান্ডে।
অসলোর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল কন-টিকি জাদুঘর। প্রাতঃস্মরণীয় অভিযাত্রী, লেখক, নৃতত্ত্ববিদ থর হেয়ারডালের সারা জীবনের উপর আলোকপাত করা হয়েছে এইখানে। অভিভূত হয়েছি সত্যিকারের কন-টিকি ভেলা দেখে, বালসা কাঠের তৈরি এই ভেলাতেই হেয়ারডাল এবং তার বন্ধুরা প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়েছিল (প্রায় ৭৫০০ কিলোমিটার) কোন রকম আধুনিক সরঞ্জাম ছাড়াই, এই তত্ত্ব প্রমাণের জন্য যে দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসীরা সেটেলারদের অনেক আগেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছেছিল। আর ছিল RA নৌকা, প্রাচীন মিশরীয় সূর্য দেবতার নামের এই নলখাগড়ার নৌকাতে হেয়ারডাল আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়েছিলেন,আছে ইস্টার দ্বীপের মোয়াই মূর্তি, গ্যালোপোগাস দ্বীপের নানা নিদর্শন। মাত্র একজন মানুষ সারা জীবনে যে কত অসাধ্য সাধন করতে পারেন ও সেই সাথে নিজস্ব চিন্তা দিয়ে পারেন বিশ্বকে প্রভাবিত করতে থর হেয়ারডাল তার অন্যতম উজ্জল নিদরসন।এই অসাধারণ মানুষটি শৈশব থেকেই আমার প্রিয় ব্যক্তিত্বদের একজন, তার পুণ্যস্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অসলো ছাড়লাম আমরা।

তখন সহযাত্রীরা বাড়ী ফেরার নেশায় উম্মুখ, তাই সুইডেনে কোনমতে এক রাত অতিবাহিত করে পরদিন একটানা ২৪ ঘণ্টা পালা করে ১৮০০ কিলোমিটার গাড়ী চালিয়ে উপস্থিত হলাম বাড়ীতে। কত অজস্র স্মৃতি যে জমে আছে মনের মুকুরে এই ৮ দিনে ৫০০০ কিলোমিটার ভ্রমণের। আবার যেতে চায় আমি নরওয়েতে, ওখানে প্রতিটি দিন ছিল অন্যদিনের চেয়ে আলাদা। কোনদিন আমরা নদীর তীরে, অন্যদিন পাহাড়ে, আরেকদিন ফিয়র্ডের সৌন্দর্য অবলোকনেই ব্যস্ত। যেন স্বপ্নরাজ্যে ছিলাম মাঝের এই কয় দিন, এখনও সেই স্বপ্নে বিভোর কবে আবার যেতে পারব সেই স্বপ্ন রাজ্যে , এই আশায়।-













মন্তব্য

বইখাতা এর ছবি

কিন্তু অসাধারন সুন্দর এই জায়গাগুলোর ছবি কই? একটা ছবিও নাই! বর্ণনা ভাল লেগেছে। লেখার মাঝে একটু স্পেস দিয়েন।

তানিম এহসান এর ছবি

গ্লোবট্রটার ভাই গ্লোবট্রটার ভাই!! উফ, হিংসে হচ্ছেনা কেন? কি অদ্ভূত একটা জীবন কাটাচ্ছেন, ঠিক যেমনটা চেয়েছি আশৈশব!

আপনার একটা ছবি দিয়েনতো একদিন, মানুষটাকে দেখতে ইচ্ছে করতেছে!

guest_writer এর ছবি

আহা ! আহা! এত যাচাই বাছাই করে সবচেয়ে চমৎকার ১৫টি ছবি ফ্লিকারে আপলোড করেই তো পোস্ট করলাম লিখাটা, আশ্চর্য - একটা ছবিও আসে নাই ! অথচ আগের লেখাটায় তো এসেছিল !! আচ্ছা, লেখা ব্লগে প্রকাশিত হবার পরে কি কোনভাবে ছবি আপলোড করা যায় ??? --- অণু

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

এখন আর ব্লগে পরবেন না। মন্তব্যে পোস্ট করে দিন আপাতত।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

অসাধারণ লেখা আপনার। এই ভ্রমনে নিজে ছিলাম না বলে হিংসা হলো।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

অপছন্দনীয় এর ছবি

হাসি

guest_writer এর ছবি

খুব ভালো লাগলো আপনার বর্ণনা। তবে ছবি থাকলে ষোলকলা পূর্ণ হত।

পড়াচোর

বন্দনা- এর ছবি

অসাধারন অনুদা। পুরা পৃথীবিটাই কি আপনি ঘুরে ফেলছেন, হিংসা হিংসা হচ্ছে আপনাকে।

guest_writer এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ সবাইকে। এই খানেই কিছু ছবি দেবার চেষ্টা করছি, দেখা যাক কাজ করে না কি-- অণু



মৌনকুহর. এর ছবি

চমৎকার বর্ণনা...... ছবি দেন তাড়াতাড়ি হাসি

একজন পাঠক এর ছবি

আপনি কি ফিনল্যান্ড থাকেন ? আমি আগামী বছর এমএস করতে যাব, আপনার ইমেইল আইডি পাইলে ভালো হইতো তাইলে।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

মানুষ কেন যে ঘুরাঘুরির লেখাগুলো এত সুন্দর করে ব্লগে দেয়.......আমার মতো কতোজন চুপচাপ ঈর্ষায় জ্বলে!

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

guest_writer পাপী এর ছবি

চমৎকার লিখেছেন।

--------------
পাপী
--------------

মৃত্যুময় ঈষৎ এর ছবি

অসাধারণ বর্ণনা যথারীতি!!!! চলুক

guest_writer এর ছবি

ধন্যবাদ সবাইকে। ছবির দেবার উপায় না পেয়ে ফেসবুকের ২টি অ্যালব্যামের লিঙ্ক দিচ্ছি, আসা করি ভাল লাগবে সবার-
http://www.facebook.com/media/set/?set=a.69687510496.135225.608590496&type=1
http://www.facebook.com/media/set/?set=a.35824745496.94014.608590496&type=1

আমার ফেসবুক আই ডি Onu Tareq, ফিনল্যান্ডের কোন শহরে আসছেন? বন্দনা, এই বুড়ো পৃথিবীটা আমাদের কল্পনার চেয়েও অনেক অনেক বড়, পুরোটা ঘোরা স্রেফ অসম্ভব, কিন্তু চেষ্টা করতে ক্ষতি কি ! - অণু

তিথীডোর এর ছবি

বর্ণনা ভাল লাগলো। চলুক
ছবি দেখতে চাইইইইই। চাল্লু

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

ফারুক হাসান এর ছবি

তারেক অণু, আপনার লেখার হাত অসাধারণ। আরো ভ্রমণীয় আপনার কাছ থেকে পড়তে চাই, ছবি সহ। চলুক

guest_writer এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ ফারুক ভাই, আসলে আমার তো ছবিই তোলা হয় সবসময়,লিখা খুব কম, তাই আফসোস লাগছে ছবিগুলো আপলোড না হওয়ায়। খুব তাড়াতাড়িই সচলে দিচ্ছি পরের লিখাটি।--- অণু

guest_writer এর ছবি

ছবি দেবার চেষ্টা করছি--- অণু
[img=6x4]IMG_1972[/img]

অতিথি লেখক এর ছবি

অবশেষে ১টা ছবি ।

অনেকদিন আগে নরওয়ে'র ১টা পোস্টার কিনেছিলাম । এখনো ওটা আছে আমাদের ঘরে ।
খাড়া পাহাড়ের নিচেই হ্রদ । আজ জানা হল ওটা ফিয়র্ড ।

চলছে---
পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

কড়িকাঠুরে

তারেক অণু এর ছবি

পরে কিন্তু আরও লিখেছি ফিয়র্ড নিয়ে ।

অতিথি লেখক এর ছবি

দেখি লেগে আছি
পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

বেশিদিন লাগবেনা সবগুলো শেষ করতে

কড়িকাঠুরে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।