কোন্ এক একাকিনী যেন, তারি পানে নির্জন একাকী!

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ০১/০৮/২০১১ - ৩:২৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ছোটবেলার একটা কথা মনে পড়ছে। ছোটভাইয়ার টাইফয়েড হয়েছিলো। ঢাকার হাসপাতাল থেকে আমরা যখন বাসায় ফিরে যাই বাহন ছিলো ট্রেন। বাবা আমাদের জন্য যাত্রাপথের খাবার কিনতে ট্রেন ছাড়বার ঠিক আগে আগে স্টেশনে নেমেছেন। ট্রেন ছাড়ার প্রায় সময় হয়ে গিয়েছে, ট্রেনের গেইট লক করে দেয়া হয়েছে, গার্ড এসে একবার পাশ দিয়ে ঘুরে গেছে। আমি ঠাঁয় তাকিয়ে আছি গেটের দিকে। টেনশনে আমার ঘাড় ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে। বুক ধড়ফড় করা শুরু করে দিয়েছে। মনে হচ্ছিলো বার বার ট্রেনটা যদি বাবা-কে ফেলে চলতে শুরু করে দেয়,বাবা তখন কিভাবে ফিরবেন। আবার বাবার পকেটে ট্রেনের টিকেট। টিকেট ছাড়া আমাদের কে যদি মাঝপথে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেয়, কিংবা যদি জরিমানাও করে?মা’র ব্যাগে কি এত টাকা আছে? ফের বুক ধড়ফড় করা শুরু করে দিলো, বাবা যদি হারিয়ে যায়। মা-কে বলতে চাইলাম, একবার বাবা কেন ফিরছে না। মা মনে হল বেশ নির্ভার। বকা খাবো ভেবে বলতে পারলাম না। হঠাৎ খুব কান্না পেতে শুরু করলো।

এমন সময় দেখি গেটে নক, বাবা তার ডান হাতের তর্জনীতে রুপায় বাঁধাই করা বড় মুক্তোর একটা আংটি পরতেন। ট্রেনের গ্লাসে মুক্তোর সেই শব্দটা এখনো আমার স্মৃতিতে এত স্পষ্ট!বাবা উঠবার ঠিক ১০ সেকেন্ডের মাথায় ট্রেন চলতে শুরু করে দিলো। আমার বুক থেকে যেন একটা বিরাট পাথর ধপ করে নেমে গেলো।

সময় গিয়েছে। আমি বড় হয়েছি। কত শত দ্বায়িত্ব নিয়েছি আর নিচ্ছি নিজের জীবনে আর কর্মক্ষেত্রে। বাবা-বিহীন জীবনে নিজেকে অভ্যস্ত করে নেয়ায়ও প্রায় সফল হয়ে যাচ্ছি। টেনশনটুকু আমার সঙ্গে প্রায় আগের মতই আছে। ফ্যামিলির কেউ যখন দূরযাত্রায় সওয়ার হয়, তাদের পৌঁছুতে নির্ধারিত সময়ের একটু বেশি লেগে গেলেই আমার পাল্পিটিশন শুরু হয়ে যায়। এক পর্যায়ে দুরাকাত নফল নামাজ পড়ে ফেলি।

আজকে সারাদিন অসম্ভব অবসাদগ্রস্ত দিন কাটিয়েছি। বুকের ভেতর অনবরত ক্ষরণ হচ্ছিলো। যে কাজটাই করছিলাম খুব বেশি সময় নিয়েছি করতে কিংবা এলোমেলো করে ফেলেছি। দুপুরে খেতে বসে মনে হল গলা দিয়ে খাবার নামছেনা। একটা একাকীত্ব তরল কোন কিছুর মত গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে রেখেছে। একটা বন্ধু ফোন দেয়ার পর বল্লো, কি ব্যাপার গলা এত ভারী কেন? আমি মন খুব খারাপ লাগছে বলে টপ টপ করে চোখ গড়িয়ে পানি ফেলতে শুরু করে দিলাম।

বিকেলে আরো বড় একটা বাজে কাজ করে বসলাম। খুবি সামান্য কিন্তু ইগনোর করা যায় না এমন ভুল একটা এপ্রুভালে দু’দুবার বস-দের কাছে সাইন করাতে হলো এক-ই কাগজ। খুব হতাশা নিয়ে বস কে স্যরি বলতে হয়েছে হেসে হেসে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় আর মুখজুড়ে বোকা বোকা ঐ হাসিটার কারণেই হয়তো এ যাত্রা বেঁচে গেছি অবধারিত একটা ঝাড়ি খাওয়া থেকে।

আমার আজকের অস্থিরতার মূলে ছিলো প্রিয় মানুষটার সাথে যোগাযোগহীনতা। এই ব্যাপারটায় আমি কেন জানি এত সেন্সিটিভ হয়ে যাই। পৃথিবীর দুপ্রান্তে দুটো মানুষ বসবাস করছে। সময় এর পার্থক্য প্রায় ১৪ ঘন্টা। যোগাযোগের কিছুটা গ্যাপ হয়তো এক্সেপ্টেবল-ই। কিন্তু আমি এই টেনশনটুকু নিতে পারি না। যেমন, আমি জানি ও ঘুমায় ৪-৫ ঘন্টা। ওর ঘুম ভাঙার পর টেক্সট না পেলেই মনে হতে থাকে, কেন উঠতে পারলো না। অসুস্থ হয়ে গেছে নাকি। আবার মনে হয় এতক্ষণ তো ও ঘুমায় না। তাহলে কি আমার কথা ভুলে গেছে। কি করছে- কোথায় যাচ্ছে কেন আমাকে বলছে না। কোন কারণে যদি সাত আট ঘন্টা যোগাযোগ না হয়, হয়তো ও ঘুরতে গেছে কোথাও কিংবা ব্যস্ত- আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে, গলা ক্রমাগত শুকিয়ে যেতে থাকে, মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কোন কাজে কনসেন্ট্রেশন দিতে পারি না। আর ক্রমাগত ভুল করতে থাকি, স্বাভাবিকতার চেয়ে একটু অসংলগ্ন আচরণ করতে থাকি।

তবে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে অস্থিরতা করছি- আমি বুঝতে পারছি আমার এটা করা উচিত না। আরেকটু শান্ত থাকা উচিত। এটার নাম তাহলে কি? বহুরূপী ব্যাক্তিত্বের সংঘাত? দ্বিধাগ্রস্ততা? এটাকে আমি কিভাবে ডিল করতে পারি?আবার ওর কাছ থেকে একটু রেসপন্স পেলেই শান্ত হয়ে যাই।

মাঝে মাঝে ভয় লাগে এই যে আমি বার্ন আউট করছি- এটা আমার রিলেশনশিপের জন্য হেলদি না। কারণ এই সময়টুকুতে আমি ক্রমাগত ওকে মেইল/টেক্সট করতে থাকি-যে কারনে আমার অস্থিরতাটা ওর অগোচর থাকে না। আমার এই অস্থিরতাটার দুটো ইফেক্ট হতে পারে- ও নিজেও বার্ন আউট করে আমার উপর বিরক্ত হতে পারে। দ্বিতীয়, আমি ওকে ট্রাস্ট করছি না – এটা ভেবে আমার উপর ওর আস্থা হারাতে পারে। যার কোনটাই আমাদের রিলেশনশিপের জন্য ভালোনা। আমার জন্য আরো বেশি প্রেসিং।

টেনশন করা টা আমার সহজাত স্বভাবে অংশ জানি। কিন্তু ওর ব্যপারে এই টেনশনটা মাত্রাছাড়া। অন্যসব কিছু তখন অসার লাগে। নিজেকে বোঝাই ব্যস্ত থাকো, ভুলে থাকো। কিন্তু ব্যস্ততাটা নিজেকে আরো একা করে দেয়। মানুষের সঙ্গ অসহ্য লাগে। প্রিয় বন্ধুদের কেউ যদি পিঠে হাত রেখে বলে এত ফ্যাকাশে কেন, টপটপ করে চোখ গড়িয়ে জল ঝরতে থাকে। ভালোবাসা কি এইটুকু অস্থিরতার দাবী রাখতেই পারে?

জ্ঞানীগুনীরা বলেন দীর্ঘ দূরত্বের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু তবু তো আমরা এই ধরনের সম্পর্কে জড়াই। কিংবা স্বল্প দূরত্বের সম্পর্ক প্রয়োজনের তাগিদে দীর্ঘ দূরত্বে রূপ নেয়। আর আবেগ তো সূত্র মেনে ডানা মেলে না মনের পাখায়। তাই সব জেনে বুঝেও হলাহল গলায় ঢেলে নেই আমি বা আমার মত আর কেউ।

যে কথাটুকু বলতে এত ভূমিকা, এই লেখাটির পাঠক কেউ কেউ হয়তো লং ডিস্টেন্স রিলেশনশিপ ব্যাপারটার মধ্য দিয়ে গেছেন বা যাচ্ছেন। কিভাবে ছমাস কিংবা এক বছরের অপেক্ষা’র সময়টুকু কে একটু সহনীয় অস্থিরতায় নামিয়ে আনা যায় –এ ব্যাপারে কেউ কি সাহায্য করতে পারেন?

মাকড়শার বউ।


মন্তব্য

পাঠিকা  এর ছবি

লং ডিস্টান্স খুব খুবই বাজে একটা ব্যপার...আমি খানিকটা আপনার মতই। আমি আর আমার বর নির্দীষ্ট টাইম ঠিক করে রাখি কখন কখন কথা বলবো। তবে ওর বাইরেও কথা হয় আর অন-লাইনে টোকাটুকি চলতে থাকে।

নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলুন...বই পড়ুন, পুরানো বন্ধুদের সাথে আড্ডা, গান শেখা, ছবি আঁকা ইত্যাদির ক্লাসে ভর্তি হয়ে যান। যখন আবার দেখা হবে তখন কি করবেন, কই ঘুরবেন এইসব প্লান করুন।

শুভ কামনা রইলো!

মৌনকুহর এর ছবি

এই লেখার শেষাংশের ব্যাপারে কিছু বলার মত অভিজ্ঞতা এখনও হয় নি, ও ব্যাপারে না হয় অন্য সচলেরা কিছু বলবেন। কিন্তু প্রথম দিকের ঘটনাটা খুব ভালো লাগলো, ঠিক এমন অভিজ্ঞতা আমারও আছে।

আর দিদি, আপনার নিকটা কিন্তু দুর্দান্ত!! আপনার বর জানেন কি?? খাইছে

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

অর্ক রায় চৌধুরী এর ছবি

মাকড়শার বউ ভীষণ ভালো থাকুন।
শেষের অংশর ব্যাপারে আমারও কিছু বলার নেই, তবে নিজের অস্থিরতার কথা খুলে বলতে পারেন, কিছুটা ভালো লাগবে মনে হয়।

আশালতা এর ছবি

মাকড়শার বউ, আপনার লেখা ভালো হয়েছে। পড়তে গিয়ে কেন যেন একজনের কথা মনে পড়ছিল... নিকটি অনন্য, এই নামের কোন লেখা পড়িনি, যদিও মনে হচ্ছিল চেনা কারো লেখা পড়ছি।

আপনার অনুরোধের প্রেক্ষিতে বলতে পারি, লং বা শর্ট যেকোনো রিলেশনই আসলে বিশ্বাসের ভিতে দাঁড়িয়ে থাকে। অস্থিরতা কমাতে সাধারণ উপায় হল ভালো লাগে এমন কিছুতে নিজেকে ব্যস্ত করে রাখা। লাইফ স্টাইলে কিছু চেঞ্জ আনা অনেক সময় কাজে দেয়। নতুন হেয়ার কাট, নতুন ভাষার ক্লাস, বনসাই, ইন্টেরিওর ডেকোরেশন বা যোগ ব্যায়ামের ক্লাস এসব হেল্প করতে পারে।

এসবেও হেল্প না হলে প্রফেশনাল হেল্প নিতে পারেন। আপনি কোথায় থাকেন জানিনা, তবে ঢাকায় এখন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির এক্সপার্ট অনেকেই আছেন, তাঁদের কাছে যেতে পারেন। এর মানে এই না যে আপনাকে পাগল ঠাওরাচ্ছি, এনারা কোন ওষুধ দেন না, কেবল কাউন্সেলিং করেন। যারা নিজেদের বিহেভিয়ার অথবা ব্যক্তিগত সমস্যা নিজে থেকে ম্যানেজ করতে অসমর্থ হন, তাঁরা এঁদের কাছে পজিটিভ গাইড লাইন পেতে পারেন।আমার পরিবারে একগাদা ডাক্তার থাকায় এই বিষয়টা আমি জানি। নিজেকে ভালো রাখতে আপনি উদ্যোগী হয়ে নিজেই নিজেকে সাহায্য করতে পারেন অথবা এরকম প্রফেশনাল কারো হেল্প নেয়ার কথা ভাবতে পারেন।
শুভেচ্ছা রইল। হাসি

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

প্রখর রোদ্দুর এর ছবি

পৃথিবীর যে কোন কিছুই টিকে থাকে যখন তার নিজস্ব আলাদা একটি অবস্থান থাকে। আপনার নিজস্ব একটি বলয় তৈরী করুন। ভালোবাসা আর নিজের সব বাদ দিয়ে কেবল তার জন্যই মলিন হওয়া কিন্তু এক কথা নয়। আপনি আপনি হয়ে উঠুন। প্রয়োজনে আপনার তিনিও যেন আপনার কাছে তার চাহিদার অবস্থান টুকুপান। কেবল বলতে চাইছি নিজের অবস্থান তৈরী করুন তাতে নিজের এবং তার উভয়ের জন্যই আগামী মঙ্গলময় হবে।

আশালতা এর ছবি

চমৎকার বলেছেন প্রখর রোদ্দুর। আমারও মনে হয় যে একটা হেলদি রিলেশনের জন্য দুজনেরই নিজস্ব বলয় থাকা দরকার যা কিনা একইসাথে দুজনকেই স্পর্শ করে থাকবে। এতে দমবন্ধ হয়ে যাবার অনুভূতিটা আসেনা অথচ একসাথে হাত ধরে এগোনোর আনন্দটা থাকে।

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

তানিম এহসান এর ছবি

শুভকামনা রইলো। তীব্রতাকে সমস্যা না ভেবে তীব্রতাটুকুকে সাথে নিয়েই উপরের অনেকগুলো পরামর্শ অনুযায়ী অন্যভাবে সময় কাটান। মাকড়সার জাল আপনার জীবন ব্যাপ্ত রাখুক। শুভেচ্ছা!

বন্দনা এর ছবি

আমি নিজে ও টেনশনের রোগী, আপনাকে কি আর বলবো আপু। তবে আমার প্রফ বলেন যে টেনশন রিলিজের এখন নাকি বেশ ভালো চিকিতসা আছে, আশাদির সাথে একমত, আপনি একবার গিয়ে দেখিয়ে আসতে পারেন অন্তত।

তিথীডোর এর ছবি

খুব মায়া লাগল লেখাটা পড়ে....

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

শ্রীকৃষ্ণ এর ছবি

আপনের বরের প্রতি জেলাস হয়ে গেলাম, লেখা সুন্দর হয় (গুড়) ছে

জনৈক মাকড়শা এর ছবি

আপনার বরের ক্রমশ বেগবান 'পরস্পর-বিমুখী' হৃদকম্পের কারন যে আপনি, তা নিয়ে আর কোন সন্দেহের অবকাশ নেই! মেনকা দেবী হাজার মাইল দূর হতে এসে ধ্যানমগ্ন বিশ্বামিত্রের ধ্যানভঙ্গের কারন হয়েছিলেন। আর এযুগের মেনকা হয়ে হাজার মাইল দূরে বসে আপনি একই অসাধ্য সাধন করেছেন। আপনাকে অভিনন্দন!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।