গোবর ও পদ্মফুল : এস্টাবলিশমেন্ট-চক্রের ভেতর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা -মুহিত হাসান

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ০১/১২/২০১১ - ১২:০২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

লেখক: -মুহিত হাসান দিগন্ত

এক. ধান ভানতে শিবের গীত...খানিক ব্যক্তিগত প্রারম্ভিক :

এটা একশ ভাগ ঠিক যে— আমাকে কোনোভাবেই একজন নিয়মিত ব্লগার বলা যাবে না, তবু গত জুলাই মাস জুড়ে ভিকারুননিসা নুন স্কুলের যুগপৎ সাহসী এবং প্রতিবাদী ছাত্রীদের নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনের সময় বিভিন্ন ব্লগসাইটে ও ফেসবুকে যেসব লেখাপত্তর চলছিলো- তার বেশিরভাগই পড়তাম।

পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম নিশ্চিতভাবেই, কারণ তাদের এই সাহসিকতা ও স্কুলের প্রতি ভালোবাসা আমাকে বেশ আশাবাদী করে তুলেছিল। বলতে দ্বিধা নেই, এর ফলে ভিকারুননিসার ছাত্রীদের প্রতি একটা আলাদা রকমের শ্রদ্ধাবোধও তৈরি হয়েছিল বৈকি। এর কয়েকদিন পরই ‘কেন আন্দোলন ভিকারুননিসায়’ শিরোনামে ভিকারুননিসার প্রাক্তন কয়েকজন শিক্ষার্থীর লেখা একটি যৌথ কলাম পড়ি দৈনিক প্রথম আলোতে । যথারীতি এই কলামটিও ছিল যথেষ্ট সুলিখিত, কিন্তু শেষের দিকে একটি বাক্যে এসে আমি আচমকাই হোঁচট খাই। সেই বাক্যটি ছিল এমন:

[...]‘‘এই প্রতিষ্ঠানে স্থিতি ফিরে আসুক। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘিরে ছাত্রী ও অভিভাবকদের যে চাপ, তা হয়তো আরও বাড়বে ভবিষ্যতে।’

তাঁরা নিজেদের অগোচরে হয়তো এই আজব প্রত্যাশাই করে বসলেন, স্বনামধন্য স্কুলটিতে অভিভাবকরা নিজেদের সন্তানকে ভর্তির আশায় যে ভয়ানক ভিড়ের সৃষ্টি করেন- তা ভবিষ্যাতে আরো বাড়তে থাকুক। ঠিক এই জায়গাটিতেই আমার খানিকটা "ভয়" কাজ করে। কেন এই ভয়? সে কথাতেই এখন আসছি।

দুই. স্বনামখ্যাত স্কুল, নাকি এস্টাবলিশমেন্টের সূতিকাগার? :

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কীভাবে এস্টাবলিশমেন্ট চলে এল, তা নিয়ে আলোচনার আগে এর ইতিহাসটা পাঠকের সামনে খানিক খোলাসা করতে চাই। ১৫৩৪ সালে যখন ইংল্যাণ্ডের রাজা অষ্টম হেনরি ক্যাথলিক খ্রিষ্টধর্মের সাথে সম্পর্ক ভেঙে দিয়ে ফের চার্চ অব ইংল্যান্ড প্রতিষ্ঠা করলেন, ঠিক সেই সময়েই সামনে এলো এস্টাবলিশমেন্ট ব্যাপারটি। এই বিশেষ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটির সাথে রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট ও বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তোলা হলো। তাকে বলা হলো ‘এস্টাবলিশড্ চার্চ’। ফলত সেখানে এল অনেক রকমের রাজনৈতিক ও মোটা অঙ্কের আর্থিক সুযোগসুবিধা। যেগুলো থেকে বঞ্চিত হলো অন্য ক্যাথলিক চার্চগুলো। এমনটা চলেছিল সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত, তখন অবধি অবশ্য এস্টাবলিশমেন্ট বলতে সরকারি সুযোগসুবিধা পাওয়ার একচ্ছত্র অধিকারকেই বোঝাতো। কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের খরচে চলা সংগঠন- যেমন সেনা বা নৌবাহিনি, সিভিল-সার্ভিসও এর ভেতরে পড়ে । পরবর্তীতে অবশ্য অনেক ব্যাপক অর্থে শব্দটির ব্যবহার করা শুরু হয়। বামপন্থী তাত্ত্বিক রামকৃষ্ণ ভট্টচার্যের মতে :

[...]‘‘এস্টাবলিশমেন্ট বলতে তাহলে বোঝায় পুঁজিবাদী শোষণব্যবস্থার রক্ষকবাহিনী। আর সেই বাহিনীর মধ্যে সমস্ত শ্রেণীর লোক থাকে। এস্টাবলিশমেন্ট-এর আসল মালিকরা সব জায়গায় সশরীরে উপস্থিত থাকে না, শিখণ্ডী খাড়া রেখে মুনাফা শিকার করেন। ফলে, অনেকে শিখণ্ডীকেই আসল শত্রু মনে করে প্রচুর গোলা ছোড়েন। এক শিখণ্ডীর পতন হলে আরেক শিখণ্ডী আসে। পেছনের লোক নিরাপদে মুনাফার টাকা গুণে চলেন।’’

আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাতেও এই একই ধরনে, শুধু একটু আলাদা মুখোশ নিয়ে এস্টাবলিশমেন্ট রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে। পুঁজি খাটিয়ে ব্যবসা করা যায়, এমন যে-কোনো ব্যাপারেই পুঁজিপতিদের উৎসাহ অফুরন্ত। তেল-নুন-লাকড়ি,খাট-চেয়ার হতে আরম্ভ করে শিক্ষাও আজ তাই ব্যবসার একটা মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। তেল-নুনের মতো এও দেশের কিছু অংশের মানুষের প্রয়োজন মেটায়, তাই এখানেও ব্যবসা করতে পারলে ছাড়ে কে! আর এটাও পুঁজিওলারা জানেন, সাক্ষরতার সুযোগ নিয়ে যে ব্যবসা করা যায় তাতে লাভ বই লোকসান নেই। বরং খানিকটা চতুরতার সাথে তা করতে পারলে অন্যান্য ব্যবসার চাইতে লাভ উল্টো অনেক বেশীই হবে। এবং এই এস্টাবলিশমেন্ট জাঁকিয়ে বসেছে বিবিধ স্বনামখ্যাত স্কুল ও কলেজের ওপর। উদাহরণ স্বরূপ আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ, গভঃ ল্যাবরোটরি হাই স্কুল, ভিকারুননিসা নুন স্কুল এণ্ড কলেজ, হলিক্রস কলেজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের নাম বলা যায়। খানিকটা সরাসরি বলছি, প্রতি শিক্ষাবর্ষের শুরুতে এসব স্বনামখ্যাত স্কুলে ভর্তির জন্য অভিভাবকদের তোড়জোর দেখে মনে হয়, গোটা বিশ্বে যেন মাত্র এ-কটিই ভাল স্কুল রয়েছে! ফলে, কোমলমতি শিশুদের ওপর স্কুলে ভর্তির আগেই শুরু হয় এক অমানবিক মানসিক অত্যাচার। যা কিনা মূলত এই রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যে এস্টাবলিশমেন্টগিরি -সেখান থেকেই আগত।

রাষ্ট্র তার প্রাতিষ্ঠানিকতার বিস্তারের জন্য শিক্ষার ভেতরেও এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও মিথ্যাময় এস্টাবলিশমেন্ট ঢুকিয়ে দিচ্ছে (এস্টাবলিশমেন্টের সততা কেবল এক জায়গায়তেই, সেটা হলো তার মুনাফা করার প্রবণতার বেলায়)। বিত্তবান ও পুঁজিপতিদের জন্য শিক্ষা তার মূল লক্ষ্য ছেড়ে আজ স্রেফ দেখনদারি ও ব্যবসাদারির মধ্যেই এসে পড়েছে। অভিভাবকদের ভাষ্যানুসারে, এসব স্কুলেই নাকি পড়ালেখার মান সবচাইতে বেশি! কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় এর পুরোপুরি বিপরীত এক চিত্র। এসব স্কুলের ক্লাসরুমে শিক্ষক নামের বিদ্যাব্যাপারীরা ইচ্ছাকৃতভাবে পাঠদানে বিরত থাকেন। উল্টো প্রায় সব শিক্ষার্থীকেই বাইরের কোচিং সেন্টারে কিংবা অন্য শিক্ষকের কাছে সব বিষয়ের জন্য প্রাইভেট পড়তে দেখা যায়। দলিল-দস্তাবেজ এনে এর প্রমাণ দিতে হবে না, যে-কোনো স্বনামখ্যাত স্কুলের সামনের দেওয়ালের সামনে গিয়ে একবার দাঁড়ালেই টের পাবেন যে এদের প্রভাব কতটা রমরমার সাথে বাড়ছে ক্রমাগত। আর স্কুলগুলোতে ভর্তি-পরীক্ষার সময় যে-দৃশ্য দেখতে হয়, সে এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় দশা! একদা দৈনিক পত্রিকায় ক্লাস ওয়ানে ভর্তির কোচিং করায় এমন দুটি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। সেখানে বিবিধ স্বনামখ্যাত স্কুলের বিষয়ে এমনভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে শংসাবচন লেখা হয়েছিল, তাতে আমারই মনে হচ্ছিল যে সেইসব মাধ্যমিক বিদ্যালয় অক্সফোর্ড অথবা হাভার্ডের চাইতে কম নয় কোনো অংশেই! বস্তুত, বিদ্যাবাণিজ্যে পারঙ্গম এইসব ভুঁইফোঁড় কোচিংপ্রতিষ্ঠানগুলোই আরো বেশি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডিং তথা এস্টাবলিশমেন্টে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে, যা মোটেও ইতিবাচক কিছু নয়। এর ফলে অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠানেই অভিভাবকদের চাপ পড়ছে, আমাদের অজান্তেই নিঃশব্দে ভেঙে যাচ্ছে শিক্ষার ভারসাম্য । এটা অনেংকাশে আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র জনগণের জন্য এক অতি ভয়ানক অশনি সংকেতই বটে!

এখানেই যে শিশুদের মনের ভেতর এস্টাবলিশমেন্টের প্রবণতাসমূহ খুব সূক্ষ্মভাবে ও দক্ষচালে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তার ফল কিন্তু মোটেও আমাদের জন্য খুব সুখকর হবে না। উল্টো এই আত্মদম্ভী এলিট এবং ভয়ানকভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রজন্মকে নিয়ে আমাদের বেশ বিপদেই পড়তে হতে পারে অদূর ভবিষ্যাতে (খেয়াল করবেন, ভিকারুননিসা নুন স্কুলের ছাত্রীদের নিজেকে ‘ভিকি’ কিম্বা গভঃ ল্যাবোরটরি স্কুলের ছাত্রদের নিজেদের দম্ভভরে ‘ল্যাবরোটরিয়ান’ বলে পরিচয় দেওয়াটাও কিন্তু আদতে এক ধরণের কর্পোরেট এস্টাবলিশমেন্টজাত অহংকার)।

তিন. শিশু সুপারম্যান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডিং:

পুঁজি যে কেবল অর্থভিত্তিক ব্যাপার-স্যাপারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এমনটা কিন্তু সর্বদা হয় না। পুঁজি অর্থের সীমা ছাড়িয়ে অনেকসময় সামাজিক মর্যাদার উপাদান হয়ে দাঁড়ায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা চলে— আমি এমন অভিভাবকদের প্রায়ই দেখি, যারা কিনা বিভিন্ন সামাজিক সমাবেশে সুযোগ পেলেই নিজের ছেলেমেয়ে কোন বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে পড়ছে তার ফিরিস্তি দিতে মহাব্যস্ত হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে অবশ্য তাদের কাছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে কতটা মানস¤পন্ন লেখাপড়া হয়, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দক্ষতা কেমন Ñ সেটি বিবেচ্য নয়। বরং সেই প্রতিষ্ঠানের নামটি কতটা সুপরিচিত, হিসেবে সেই প্রতিষ্ঠানটি কতটা মূল্য পায় (অথচ দেখুন, শিক্ষার ক্ষেত্রে কিন্তু এসব কর্পোরেট লাভালাভের প্রসঙ্গটি আনাই অত্যন্ত গর্হিত বলে বিবেচিত হতো এককালে!) এবং সর্বোপরি রাজধানী ঢাকা শহরে সেই বিদ্যালয়টি কতটা এস্টাবলিশমেন্টের ছড়ি ঘোরাতে পেরেছে - সেইসব চটকদারিপূর্ণ নিয়ামকই তাদের আরাধ্য। ফলে শহুরে মধ্যবিত্ত , উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের মনের এইসব আশা পূরণেই মূলত রাষ্ট্রযন্ত্র কাজ করে যায়, এস্টাবলিশমেন্টের মূল লক্ষণ অনুসারে- সে কেবল নজর দেয় কতিপয় সুনির্দিষ্ট বিদ্যালয়ের দিকে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের নিশানামাফিক বেশ কয়েকজন একচক্ষু এলিট গড়ে তোলা ও জনগণের মৌলিক অধিকার শিক্ষাকে পণ্য করে তোলার কাজেই প্রকৃতপক্ষে ব্যস্ত থাকে। আর নয়া উদারতন্ত্রী(এই থিওরীটি কার্যত শোষণ ও নিপীড়নের পুজিঁবাদী ধারাটিকেই জনগণের আই-ওয়াশ করার মাধ্যমে সচল রাখতে সদা তৎপর) চিন্তাভাবনার তোড়ে ১% ক্ষমতাবান ধণিক শ্রেণী পরিচালিত এসকল বিদ্যালয়ে নিজেদের ছেলেমেয়েকে পড়ানোর স্বপ্নে বিভোর ৯৯% শোষিত শ্রেণীও। কারণ এই নয়া উদারপন্থা তাদের কল্পনায় থাকা সুপারম্যানের ধারণা অদ্ভুতভাবে বাস্তবে নিয়ে এসেছে ক্ষমতার মোহ ও অর্থের আকাঙ্খাকে কাজে লাগিয়ে। ধণিক শ্রেণী মধ্যবিত্তের সামনে ১% এর ধারণা এমনভাবে উপস্থাপন করে, যেন এ এক ক্ষূদে মহামানবের দল। তাই মধ্যবিত্তও তার সন্তানকে এই কল্পিত এক শতাংশের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ে, আর তাদের সন্তানসকলও নেমে পড়ে কর্পোরেট বিদ্যালয়ে ভর্তির ইদুঁর-দৌড়ে। ওইসব নির্দিষ্ট বিদ্যালয়ে পড়ছে এমন শিক্ষার্থীকে নিয়ে অভিভাবক ও আত্মীয়-স্বজনদের সামাজিক অনুষ্ঠানে ও যত্রতত্র বাড়তি আর দৃষ্টিকটু আদিখ্যাতা করবার ব্যাপারটি তো রয়েছেই। আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ বলে, পরবর্তীকালে এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মনের ভেতরে এক অপ-রূপ উন্নাসিকতা ও অহংকার এসে ভর করে। তারা পরিণত হয় এক রকমের সমাজবিচ্ছিন্ন জীবে। নিজেদের অতিরিক্ত উঁচু করে ভাববার যে গর্হিত মানসিকতা স্কুল তাদের শিখিয়েছে শৈশবেই, তারই চর্চা এসব ছেলেমেয়েরা জীবনভর করতে থাকে। সেজন্য সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক এক প্রভাব যে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর এসে পড়ছে, সেটি তো বলাই বাহুল্য! আর শিক্ষাক্ষেত্রে এই এস্টাবলিশমেন্টের কুপ্রভাব বাড়ানোর ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলোর আচরণও প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। এস.এস.সি. বা এইচ.এস.সি.-এর মতো পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ফলাফল বের হবার দিন টিভি চ্যানেল খুলে দেখেছেন যারা তারাই বুঝে যাবেন, এ দেশে শুধুমাত্র পাঁচ কি ছয়টি স্কুল-কলেজই বুঝি রয়েছে (ভিকারুননিসা স্কুল এণ্ড কলেজ, আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ প্রভৃতি)! পরের দিনে দৈনিক পত্রিকা খুলুন, দেখতে পাবেন- গোটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ওই পাঁচ-ছয়টি স্কুলের ভেতরেই যেন হাবুডুবু খাচ্ছে! এইসব স্কুলের ভর্তি-পরীক্ষা হলো কিনা, শিক্ষক নিয়োগ হবে নাকি— এসব নিয়ে তিন-চার কলামের নিউজ করতে গণমাধ্যমের কোনো আপত্তিই নেই। কিন্তু যেখানে গোটা দেশেরই সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা রসাতলে যাচ্ছে, সেসব নিয়ে তাদের কোনো খবর প্রচার করতে আমি কার্যত দেখতে পাই না। তাদের মনোযোগ কেবল ১% এর অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেলায়, ৯৯% গণমানুষের শিক্ষায় সার্বজনীন প্রবেশের যে অধিকার রয়েছে — সেটিকে তুলে ধরার দিকে তাদের নজর খুব কমই।

চার. গোবরে পদ্মফুল নয়, পদ্মবন চাই :

একটা বিষয় আমাদের সামনে খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে, রাষ্ট্রযন্ত্র তৃণমূলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে যতটা না নজর দেয়— তার চাইতে অনেক অনেক বেশী নজর দেয় হাতেগোণা কয়েকটি শহুরে এলিট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে। এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থের যোগানও অফুরন্ত। শহুরে বিদ্যালয়গুলো ক্রমাগত (এস্টাবলিশমেন্টের জন্যে হলেও) একটা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যায়। অথচ গোটা দেশের বাকিসব বিদ্যালয় যে তিমির সে তিমিরেই পড়ে থাকে। কিন্তু এটা আমাদের এক ধরনের ভয়ানক বৈষম্যের দিকেই নিয়ে যায়। কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্রমশ পোক্ত করে নেয় নিজেকে, আর বাকি সব চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়ার অপেক্ষায় দিন গুজরান করে। রূপকে বলতে গেলে, এ যেন অঢেল গোবরের ভেতর মাত্র কয়েকটি পদ্মফুল। কিন্ত আমারা এ কথা খুব ভাল করেই জানি যে, মাত্র কয়েকটি পদ্মফুল ও অনেকখানি গোবর— এহেন অবস্থার শিক্ষাকাঠামো দিয়ে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন ও জাগরণ কখনোই সম্ভবপর হবে না। আমরা চাই যে দেশের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই গড়ে উঠুক একটি শ্বেতশুভ্র পদ্মবনের মতো; শহুরে বা রাজধানীর স্কুলগুলো বৃহদাকারের পদ্ম হয়েই থাক,তাতে খুব একটা আপত্তি নেই— কিন্তু গোটা দেশ জুড়ে অন্যান্য ছোট আকৃতির স্কুলগুলোও যেন সমানভাবে, সমান-শক্তি নিয়ে পদ্মবন হয়ে একসঙ্গে ফুটে উঠতে পারে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা ও মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।

তথ্যসূত্র :

‘কেন আন্দোলন ভিকারুননিসায়?’— নাফিসা নূর, পলা আজিজ, ফারহানা আলম, নূর-এ-নাজিয়া, বর্ণালী সাহা, তাসমীয়া আনিকা, ফারজানা ইসলাম, সাথী সাহা, লায়লা ফারজানা, আফরীন হোসেন, মোশফেকা করিম, আফরীন তানজিলা, সামিয়া শারমীন ও আলিফা বিনতে হক। প্রথম আলো, ‘সম্পাদকীয়’, তারিখ : ১৭-০৭-২০১১।

‘এস্টাবলিশমেন্ট কাকে বলে’, ওরে বর্ণচোরা ঠাকুর এল ইত্যাদি বিতর্ক- রামকৃষ্ণ ভট্টচার্য। পৃষ্ঠা ৮৯-৯০। কলকাতা,অনুষ্টুপ, ২০১০।

পাদটীকা


মন্তব্য

নিটোল এর ছবি

লেখকের চিন্তাটুকু আর লেখাটা ভালো লাগল।

_________________
[খোমাখাতা]

মুহিত হাসান এর ছবি

অনেক অনেক আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- নিন ভাই হাসি

শিশিরকণা এর ছবি

ভাবনার খোরাক দিল লেখাটি।

এস্টাবলিশমেন্ট-এর আসল মালিকরা সব জায়গায় সশরীরে উপস্থিত থাকে না, শিখণ্ডী খাড়া রেখে মুনাফা শিকার করেন।

বিশেষত ভিকারুন্নিসার শাখা খোলার হিড়িক দেখে এইটি মনে হয়েছে বারে বারে। মূল শাখাটির সুনাম ছড়িয়েছে পড়ালেখার উন্নত ব্যবস্থা, ভালো শিক্ষকদের জন্য, কিন্তু বাকি শাখা গুলোতে যেসব শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে তারা কি সেই মানের বা সেইরকম অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ? এই ফেরেই তো পরিমলরা ঢুকে গেছে শিক্ষক সেজে। কেবল এস্টাব্লিশড স্কুলের ইউনিফর্ম গায়ে চড়ালেই কি বুদ্ধির বিকাশ হবে?
আর শাখা গুলোতে একি রকম সুযোগ সুবিধা কি বাচ্চারা পাচ্ছে? বেইলী রোডের শাখায় বিশাল মাঠ রয়েছে, ধানমন্ডি শাখার কোন মাঠ নেই। খেলাধুলার ক্ষেত্রে ভিকিদের অনেক সুনাম, কিন্তু সেখানে বেইলী রোড শাখা ছাড়া অন্যান্য শাখার মেয়েগুলা কি অংশ নিতে পারে?

ভালো স্কুল এই লেবেলের কার্যকরী মূল্য কোথায়?

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

মুহিত হাসান এর ছবি

চমৎকার মন্তব্যের জন্য অনেক অনেক আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
লেখাটিকে পরে আরো বড় করার ইচ্ছা আমার রয়েছে। তখন এই প্রসঙ্গগুলো নিয়েও বিস্তারিত বিশ্লেষণের প্রত্যাশা রাখি। হাসি

তারেক অণু এর ছবি
মুহিত হাসান এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- নেন অণুভাই হাসি

তৌফিক জোয়ার্দার এর ছবি

আমিও এস্টাবলিশমেন্টের ধ্বজাধারী একটি বিদ্যালয় থেকে পাশ করেছি; এখনো সেই ব্র্যান্ডেড নামে নিজেকে গর্বিতভাবে চিহ্নিত করি (আমার স্কুল থেকে পাশ করা প্রায় সবাই করে)। আপনার লেখাটি যেন দৃষ্টিউন্মোচনকারী। এভাবে কখনো ভেবে দেখিনি। তবে ব্যক্তিগতভাবে সবসময়ই চেয়ে এসেছি উন্নত শিক্ষা যেন একটি ক্ষুদ্র শ্রেণী/গোষ্ঠীর কুক্ষিগত না থাকে। লেখার জন্য ধন্যবাদ।

মুহিত হাসান এর ছবি

অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা জানবেন কোলাকুলি

বাউণ্ডুলে এর ছবি

চলুক
ঠিক মনের কথা লিখেছেন।
অসংখ্য ধন্যবাদ!

মুহিত হাসান এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

লেখার পেছনের চিন্তাটা ভাল লাগল। ভাল স্কুল-কলেজ়ে পড়া নিয়ে মানুষের মাঝে অনেক উন্নাসিকতা দেখেছি, এখনো দেখি। আগে রাগ হত, এখন হাসি পায়। এটা মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা, কোন না কোন দোহাই দিয়ে নিজেকে এলিট বা গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে মানুষ মানসিক শান্তি পায়। প্রথমে স্কুল-কলেজ দিয়ে শুরু হয়, তারপর আরও নানারকম ট্যাগিং/ব্র্যান্ডিং জীবনভর চলতে থাকে।

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

তাপস শর্মা  এর ছবি

অনেক ভাবনাকে উস্কে দেয় এই লেখা। মোহিত ভাই নিয়মিত লিখুন ...

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

আগেই পড়েছি। চমৎকার বিশ্লেষণ

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।