পাঠদান কর্মসূচীঃ ক্রিকেটীয় চিন্তা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২২/০৩/২০১২ - ৮:০৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার পুরনো ছাত্র পরিষ্কার বিদ্রোহ করেছে, আমার কাছ থেকে আজকে কিছুই শিখবে না। হ্যাঁ, আজ – এশিয়া কাপের ফাইনালের দিন। অথচ, আজকে কতো কিছুই না শেখানোর আছে। সকালে কিছুক্ষণ তর্ক করলাম, তারপর বিরক্ত হয়ে আমার একমাত্র জার্সিটা গায়ে চাপিয়ে বেড়িয়ে পরলাম। দিকে দিকে শুধু বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়, সবাই নানা ডিজাইনের জার্সি পরে কাজ করতে যাচ্ছে। বুঝলাম, ১১ জনের দলে পোষাচ্ছে না, আরও কয়েক কোটি মানুষ ওদের সাথে খেলতে চায়। পরিচিত সবজিওয়ালা মামা আমাকে দেখেই দুইগাল হেসে বলল – আইজ আমরা জিতুম, লিচ্ছিন্ত থাহুইন। আমিও চারগাল হেসে জবাব দিলাম “অবশ্যই আমরা জিতবো, পাকিস্তানীদের এতো বড়ো সাহস-আমাদের সাথে খেলতে আসছে”। মামা একটু গম্ভীর হয়ে বলল – ঠিক কইছেন, বেশি বাইরা গেছে। আমরারে হারায়া কাপ নিবো গা? দেহুম নে, কত্ত সাহস। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একী সুরের কথা বারবার কানে আসলো যার সারাংশ হচ্ছে – পাকিস্তানের এতো বড়ো সাহস কীভাবে হল যে তারা মার্চ মাসে আমাদের সাথে খেলতে আসে। এই কথাগুলো শুনতে কী যে ভালো লাগে। মানুষ আসলে কিছুই ভুলে নি, নতুন প্রজন্মও সবকিছু মনে রেখেছে – এটা ভাবলেই বুকের ভেতর হিমেল বাতাস বয়ে যায়। যদিও অনেকেই বলে খেলা আর রাজনীতি আলাদা, কিন্তু আমি কখনো মুক্তিযুদ্ধের কথা ভুলতে পারি না, ক্ষমা করতে পারি না পাকিস্তানীদের।

বাতাসে ভাসতে ভাসতে বাসায় ফেরত আসলাম, যদিও জানি খেলা দেখার ভাগ্য নেই। আজকে কেউ আমাকে নিয়ে রিস্ক নিবে না কেউ। দুপুরের খাবার খেতে খেতে দুইদলকে নিয়ে একটু আলোচনা করছি, টিভি তো অন আছেই। আমি বড়দাকে বললাম – যাই বলো, পাকিস্তান শক্ত টীম, আর বলতে না বলতেই বুয়ার বিখ্যাত চিৎকার; বাংলাদেশ টসে জিতে গেছে। কেউ একজন বুয়াকে বলেছে বাংলাদেশ টসে জিতলেই খেলা জিতবে, এইজন্য তার এই খুশির চেঁচামেচি। ত্যাঁদড় ছোঁড়া পরিষ্কার সবগুলো দাঁত বের করে বলল – হালা, তুমি একটু ভালো কইছ আর পাকিস্তান টস মিস করলো। আইজ যদি পাকিস্তানরে সাপোর্ট না করো তো তোমার একদিন কি আমার একদিন। “হালা” শব্দটা বরাবরের মতো হজম করে হাসিমুখে বললাম, এরকম শাস্তি দিসনারে, মরে যাব।

খাওয়াদাওয়া শেষ করে সবাই একসাথে খেলা দেখতে বসে গেলাম, আমাকে কেউ তেমন খেয়াল করলো না। আনন্দ যাতে কম না হয় সেজন্য পুটলাপুটলি নিয়ে কিছু আত্মীয়স্বজন চলে এসেছে, সাথে তাদের আণ্ডাবাচ্চা। বাচ্চা পার্টিকে প্রচুর পরিমাণ ঘুষ দিয়ে কথা আদায় করা হয়েছে – খেলার সময় কার্টুন দেখার বায়না ধরে চিৎকার করবে না। যেহেতু এদের প্রতিজ্ঞা যেকোনো রাজনীতিবিদের প্রতিজ্ঞার সমপর্যায়ের, তাই আমি আর পরিষ্কার ব্যাকআপ হিসেবে কিছু চালু কার্টুনের ডিভিডি এনে রেখেছি। বড়দা গত ম্যাচের মতো এবারও দাদী আর পাশের বাসার দিদাকে হুমকি দিয়ে রেখেছে, কোনদিকেই যেন কোন কমতি না থাকে। কিন্তু, একী হল?! এতো করেও শেষ কূল রক্ষা হল না, শুরুতেই বেশ কিছু বাউন্ডারী। বুক ধুকপুক করছে, টেনশনে হাতের অর্ধেক নখ খেয়ে ফেলেছি – বাকি জা আছে সেগুলো খেতেও বেশি সময় বাকি নেই। প্রথম ওভারে এই অবস্থা হলেতো ম্যাচ শেষ হওয়ার আগে আমি নিজের দুই হাতও খেয়ে ফেলবো। এই সময় আমার নখের মায়াতেই বোধহয় বাবা একটা ঝাড়ি দিলেন – পাজীর পা ঝারা, আজ তুই আবার খেলা দেখতে বসেছিস। আমার বাসায় বসে তুই রাজাকারগিরি করিস, এতো সাহস। দয়াপরবশ হয়ে পরিষ্কার বলল – আইজ পাকিস্তানরে সাপোর্ট দিব, আর পাকিস্তান হারবো। এইলাইগা বসায়ে রাখছি। আমিও তাড়াতাড়ি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, বাবা আমি আজ পাকিস্তান। এটুকু বলতে না বলতেই নাসির জামশেদ শেষ। ওররে, চিৎকার। পুরো এলাকাতে চিৎকার। কার্টুনপাগল পিচ্চিগুলো পর্যন্ত লাফাতে লাফাতে “বাংলাদেশ বাংলাদেশ” বলে আমাদের ঘাড়ে উঠে যাচ্ছে। এক উদযাপন শেষ হতে না হতেই ইউনুস খানকে বিশ্রামের সুযোগ দেয়া হল। “আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে” – এই গানটা গাওয়া উচিত, কিন্তু “শাহরুখের মতো” শাহাদাত কিঞ্চিৎ চিন্তায় ফেলে দিলো, তার উপর হাফিজের উইকেটও স্নায়ুর উপর যথেষ্ট চাপ দিচ্ছে। মনের দুঃখে আমি কোলবালিশ নিয়ে ঘুমাতে চলে গেলাম।

প্রচণ্ড কোলাহলে ঘুমটা কেঁচে গেলো, ভূমিকম্প হচ্ছে ভেবে দিলাম একটা দৌড়। কিসের কি, রাজ্জাক ভাই হাফিজকে সাজুগুজু করতে সাজঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে – আকাশবাতাস উল্লাসে মাতোয়ারা। কিন্তু এরপর আবার শুরু হল উইকেট খরা। আর তার মাঝেই অন্য ঘরে গিয়ে এই লেখাটা লিখতে শুরু করে দিলাম। পরিষ্কার কিছু শিখতে না চাইলে আমার কি, ক্লাসতো আর বন্ধ করে দেয়া যায় না। পরে নাহয় এই লেখাটাই পড়তে দিবো। ব্যাপারটা কিন্তু ঠিকই কাজে দিলো – আমার অমনোযোগের কারনেই হয়ত আফ্রিদিও বিশ্রামঘরে ফেরত গেলো। সব মিলিয়ে ভালোই চলছিলো, কিন্তু পাকিস্তানীদের মতো দেখতে, শাহরুখের মতো হতে চাওয়া শাহাদাত ভাইয়া শেষ ওভারে ১৯ রান দিয়ে খুব স্মার্টভাবে ইনিংস শেষ করলো। আজ পাকিস্তানী তরুণীদের মন নিশ্চয়ই তিনি জয় করে নিয়েছেন।

খেলা এখনো শেষ হয় নি। সব কুসংস্কার মেনে নিয়ে, আমরা কয়েক কোটি মানুষ আশা করে বসে আছি – আজ বাংলাদেশ জিতবে। শুধু একটা ক্রিকেট দল নয়, আজ আমরা সবাই জিতবো, পুরো বাংলাদেশ আজ জিতবে। আমি এর বাইরে আর কিছুই চিন্তা করতে চাই না, আর কোন অপশন নিয়ে আজ ভাবতে পারবো না।

পাদটীকাঃ ক্রিকেট নিয়ে ব্যক্তিগত, পারিবারিক এসব ছোট ছোট ভাবনাগুলো কোন গণমাধ্যমে আসে না। তারপরও ওই ১১ জন মানুষ আমাদের সবার এই আশা, ভালবাসা ঠিকই অনুভব করে – আমি এটা তীব্রভাবে বিশ্বাস করি। তাই, আজকের ফলাফল যাই হোক না কেন আমাদের ভালবাসা যেন ঘৃণাতে পরিনত না হয়।

- বান্ধবী


মন্তব্য

ব্যঙের ছাতা এর ছবি

সহমত। শতভাগ সহমত।
১০৩ বলে ১১৯ রান। ভয় লাগছে। এখন শুধু প্রার্থনা করছি, তোমরা ১১ জন সব পারবে, তোমাদের ক্ষমতা আছে। আমাদের বিশ্বাস আছে তোমাদের উপর। আস্থা আছে। তোমরা নিজেদের উপর আস্থা রাখো, সাহস রাখো। আমরা তোমাদের সাথেই আছি।

বান্ধবী এর ছবি

পুরো ম্যাচ এই আমরা সবাই সাথে ছিলাম ...... এবং এখনও আছি, সামনের দিনগুলোতে থাকবো

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

পোস্টে চলুক
৯২ বলে ১০৭ রান দরকার। আমরা জিতবই।
----------------------------------------------------
প্রথম পাতায় একই লেখকের দুটি লেখা (পাঠদান কর্মসূচীঃ ক্রিকেট) বেমানান।

ব্যঙের ছাতা এর ছবি

৪৭ বলে ৬৭ রান। আশায় বসতি। বুক বেঁধে আছি।

বান্ধবী এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি হেরে গিয়েও আমরা জিতে গেছি দেঁতো হাসি

প্রথম পাতায় একই লেখকের দুটি লেখা বিষয়ে সচলায়তন নীতিমালা আমার জানা নেই, তবে আগের লেখাটা এখন দ্বিতীয় পাতায় চলে গেছে।

ব্যঙের ছাতা এর ছবি

কেউ কি আছেন? সঞ্জয় মানজেকার বলেছেন, "পাকিরা আমাদের সোলার পেক্সাসে ঘুশি মেরেছে, সাকিব আউট"
ওরে একটা ঘুষি দেয়া যায় কিভাবে চিন্তিত
২৯ বলে ৪৭ রান মন খারাপ

বান্ধবী এর ছবি

এরকম অনেক মন্তব্য শুনতেই হবে, এশিয়া কাপে বাংলাদেশ দলকে নিয়ে বাকী তিনটা দলই চিন্তিত হয়েছে। তাই এসব শুনে বিচলিত হবেন না হাসি

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

সবাই কাঁদছি।
এরকম পরাজয় মেনে নিতে পারলাম না।
শাহাদাতের ১৯ রান আমাদের হারিয়ে দিল।
এই পাক-পেয়ারুকে দল থেকে বের করে দেয়া চায়।

সাই দ এর ছবি

শাহাদাত হারায়া দিল। শেষ ওভারে ১৯ রান আর রান আউট মিস।

ব্যঙের ছাতা এর ছবি

হ্যাঁ, এই পাক-পেয়ারু আজ হারিয়ে দিল মন খারাপ

বান্ধবী এর ছবি

শাহাদাতকে শেষ ওভারে বল করতে দেয়ার সিদ্ধান্ত কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ। তারপরও অনেক কিছু হতে পারতো, কিন্তু হয়নি। এই না হওয়ার বেদনাটাই সবচেয়ে বেশী। তবে সামনের দিনগুলো নিয়ে আমি ভীষণ আশাবাদী। আর লড়াকু এই জাতীয় দলকে, আমার দলকে সব প্রাপ্তির জন্য অভিনন্দন।

সবুজ পাহাড়ের রাজা, সাই দ, ব্যঙের ছাতা - সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।