‘জ্বীনের বাদশা আসেন’ --- বেগুন চালান

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২৬/০৩/২০১২ - ১১:০০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মফস্বলের আলো আঁধারির মধ্য গল্প বলার আত্বীয় স্বজন থেকে দূরে, মোটামুটি পাড়া-পড়শীদের সাথেই বড় হয়েছি আমরা, অত্যন্ত বাস্তববাদী মায়ের তিক্ষ্ণ নযরদারীর মধ্য। শহুরে নীতি নিয়মের মধ্যে বড় হওয়া আমাদের চেনা জানার সীমানা ছোট হলেও কল্পনার জগতটা কিন্ত সমৃদ্ধ ছিল, গল্পের বই এর কল্যানে। রহস্যময় জগতের মতই আকর্ষনীয় ছিল কুচ কুচে কালো বেড়াল, সাপ, পেঁচা, বাদুর সাঁঝের আধারে বন্ধুদের কাছে শোনা সেই ‘তেনাদের’ গল্প। এমনিতেও বাস্তবের কিছু ঘটনার ব্যাখ্যা অনেক সময়ই রহস্যময় রয়ে যেত ঐ আমলে। আজকের এ লেখাটা স্মৃতি থেকেই ঐ রকমের একটি লেখা।

তখন আমাদের বাড়ীটা ছিলো নারকেল বাগানের মধ্য, ভিতরের দিকে। সামনে গাজী সাহেবের ভাড়া দেয়ার জন্য ব্যাস্ত চওড়া রাস্তার সমান্ত্রালে সামনে পিছনে খোলা বারান্দাসহ একসাথে লাগানো পাকা ঘর, টিনের চাল। কয়েক হাত ঊঠোনের পর একই প্যাটার্নে গোলপাতার ছাঊনি, মুলিবাঁশের বেড়া, কাঁচা ভিতের রান্না ঘর, তারও কয়েক হাত পরে পাকা দেয়ালের রেল গাড়ির বগির মত প্রতি দুই কামরার বাসিন্দার জন্য একটি করে স্যানিটারী টয়লেট, লাগোয়া ছাদবিহীন পাকা গোছলের জায়গা। বারান্দা, উঠোনের সীমানা ঘেরা ছিলো মুলিবাঁশের বেড়া দিয়ে। সেই রেল বাড়ির প্রথম বগিতে ছিল ঘোষের দোকান, খাঁটি গাওয়া ঘি আর সন্দেসের জন্য যেটা ছিল বিখ্যাত। তার পাশের বগি ছিল এক হার্ডওয়ারের দোকান, সাইকেলের/রিক্সার চাকা বানানো, মেরামতের কারখানা। যদিও আমাদের চুম্বকের মত টানতো কারখানার ওয়েল্ডাররা যখন কালো চশমা পড়ে ধাতব পার্টগুলি জোড়া দিত, চোখ ‘কানা’ হবার ভয়ে আমরা ঐ দিকটা মারাতামই না। কারখানার পর চার, পাঁচ ঘর ভাড়াটে।

গাজী সাহেবের সীমানার পিছনে, বড় নারকেল বাগান, লাইন দিয়ে সার সার নারকেল গাছ, চার সারি গাছের পর, ঐ রেলবাড়ীর সাথে আড়া আড়ি ভাবে ইংরেজী টি অক্ষরের ঠ্যাঙ্গের মত দুটো আলাদা বাসার একটায় আমরা ভাড়া থাকতাম তখন, ভিতরের বারান্দার পরেই বিরাট উঠোনের সীমানার পাশে চারটে নারকেল গাছ, বেড়ার পিছনেই মাঝারি আকারের টলটলে পুকুর। খিড়কির দরজা দিয়ে পুকুরের পাড় দিয়ে পায়েচলা পথটাই ছিল বিকেল বেলায় কচি কাঁচাদের রাজত্ব। গাছের চিকন ডালে সুতোর নীচে বড়সিতে ছোট ছোট মাছ, ব্যাং, কাকঁড়া, জোক বা অন্যান্য জলজ প্রানীর আবিস্কার, হটাৎ হটাৎ ঢোড়া সাপের দেখা মিলতো, কিন্তু কিছু দিনেই বুঝে গিয়েছিলাম, নির্বিশ এই সরিসৃপ এইসব ক্ষুদে রাস্কেলদের থেকে পালিয়েই নিজেদের জীবন বাঁচাতো। পুকুর পাড়ে খেলতাম গোল্লছুট, এক্কা দোক্কা, বুড়ির চু, ছেলেরা খেলতো ফুট বল, হাডুডু।

সেইবার ভাদ্র মাসে পরলো গা-জ্বালানো প্রচন্ড গরম, জব জবে ঘামে চিট চিটে ঘামাচিতে রাতে ঘুমানো কঠিন ব্যাপার। তো এক রাতে গরমে অস্থির হয়ে আম্মাই পুকুরে ডুব দিয়ে সাতার কেটে গা জুরানোর প্রস্তাব দিলেন। সবাই দলবেধে পুকুর ঘাটে। মরা চাঁদের আলোয় দেখি আমাদের সামনে দিয়ে এক মস্ত বড় ঢোড়া সাপ পালিয়ে যাচ্ছে। পানিতে সাতার কেটে ক্লান্ত হয়ে যখন গোসলখানায় ঢুকবো, দেখি রান্না ঘরের চালে এক হুতুম পেচা জ্বল-জ্বলে চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। একটু পরে ঠিক মাথার উপর দিয়ে কর্কশ স্বরে ডাকতে ডাকতে সে উড়ে চলে গেল, গা ছম ছম ভয় নিয়েই মশারির নীচে শীতল পাটির বিছানায় শুতে এলাম। গুমোট গরমে এপাস ওপাস করছি, কোত্থেকে দুই হুলো বেড়াল ঝগরা শুরু করলো, মনে হচ্ছে যেন একদম মানুষের বাচ্চা তারস্বরে কাঁদছে। আম্মা এসে আমাদের পাশে শুয়ে হাত পাখার বাতাশ করতে লাগলেন।

এক হ্যাচকা টানে ঘুম চোখে বিছানা থেকে মাটিতে, আম্মার ধাক্কায় খোলা দরজা দিয়ে বাইরে চলে এলাম সেই দুপুর রাতে। বাইরে তখন কুরুক্ষেত্র। দম আটকানো ধোঁয়া, লোকজানের চিৎকার চেচামেচিতেও কেমন কেমন করে যেন সব বাড়ীর বৌ-ঝি, শিশু, বুড়োরা নারকেল বাগানের খোলা নিরাপদ কোনায় এসে গেলাম। প্রায় পঞ্চাশ হাত দূরে চোখের সামনে হার্ড-ওয়ারের গোলপাতার কারখানা থেকে গল গল করে ধোঁয়া বেরুচ্ছে, চালে আগুনের ঝলক দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। কিছুক্ষনের মধ্যই আগুন পুরো চালের দখল নিল, আর আমরা ভয়ে বিস্ময়ে দেখলাম আগুনের লোলিহান শিখা যেন হেলে দুলে নাচছে, ধ্বংশের নাচ, ছরিয়ে দিচ্ছে ফোয়ারার মত ফুল্কি। সেই থম থমে গুমটের মধ্য গত কত কত দিন গাছের একটি পাতাও নড়েনি, হটাৎ সেই নারিকেল গাছের পাতাগুলিও হেলে দুলে ঘুর্নির মত সেই নাচে যোগ দিল, শন শনে বাতাসে!! বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যাই থাকুক না কেন সেই দুর্যোগের মাঝরাতে সবার মনে হয়েছে অশরিরী কোন কিছুই এর পিছনে রয়েছে।

মানুষের কৌশলের কাছে পরাস্থ হোল সেই সর্বগ্রাসী আগুন, কারখানার পরের ঘরটি বাদ দিয়ে তৃতীয় ঘরের চালে বাঁশের মই বেয়ে উপরে ভেজা কাঁথা বিছিয়ে তার উপরে বালতি হাড়ি-পাতিল ভরা পানি ঢেলে, মুলিবাশের বেড়াগুলি মাটিতে শুইয়ে দিয়ে, যেখানে যেখানে আগুনের ফুলকি গুলি বাতাসে উড়ে এসেছে, সেগুলি সাথে সাথেই নিবিয়ে, দরজা জানালায় ভারী ভেজা চাদর কাঁথা বিছিয়ে যখন আগুন নিয়ন্ত্রনে, তখন প্রায় ভোর হয়ে গেছে। মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল জ্বিন-ভুতের মত আগুনের তান্ডব, আর সুফি সাহেবের বসন্তের দাগে হতশ্রী মেয়ের সাহসের গল্প, যে ঠান্ডা মাথায় ভেজা কাঁথায় নিজেকে আবৃত করে বাঁশের মই বেয়ে চালে উঠে ভেজা কাঁথা বিছিয়ে দিয়েছিল। মালের ক্ষতি অনেক হোলেও জানের তেমন ক্ষতি হয়নি, পুকুর ঘাটে পরে গিয়ে সুফি সাহেবের পা ভাংগা ছাড়া।

পয়ষট্টির যুদ্ধের পর ইন্ডিয়া থেকে এসে আমাদের গাজী সাহেবের কোনার বাড়ীটাতে বসতি গড়া সুফি সাহেব আমার ছোটবেলার সবচেয়ে আকর্ষনীয়, রহস্যময় চরিত্র। মুখে ঘন কাঁচা পাকা দাড়ি, বাবব্রি চুল, মোটা রোমশ ভ্রুর নীচে খুব উজ্বল দুটি চোখ, মাঝারি আকারের মানুষটাকে হাসি খুশিই দেখেছি প্রায় প্রতিদিন। সমবয়সীদের মতই পাঞ্জাবি, লুংগি পড়তেন, কিন্ত তার উপরে পরতেন কালোর উপর রং চঙ্গের এক আলখোল্লা, মাথায় পাগ্রি। গলায় মালার মতন ঝুলাতেন বিভিন্ন পাথরের তজবি। হাতলে চমৎকার খোদাই এর কাজ করা লাঠি থাকতো এক হাতে, অন্য হাতে থাকতো একটি ঝোলা। এক কামরায় তিনি সালোওয়ার কামিজ পড়া মেজাজি বউ নিয়ে থাকতেন, পাসের কামরায় থাকতেন উনার তালপাতার সেপাই জামাই আর হিমালয়ের মত বড় সর, মুখে পক্সের দাগে হতশ্রী শান্ত মেয়ে, যিনি সামনে আঁচল টেনে অন্য রকম ভাবে শারি পরতেন। বাংলা উচ্চারনটাও কট কট করে কানে লাগতো।

সুফি সাহেবের চমৎকার বাংলা বলা আমার বয়সি একটি নাতনিও ছিল, নাম হেলেনা। যে আমার খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেল শিঘ্রিই। আমার পছন্দের বই গুলি তারও পছন্দের। বন্ধুত্ব আরো ঘনিষ্ঠ হোলে হেলেনা ফিসফিসিয়ে জানালো তার নানা শুধু কবিরাজ নন, তিনি জ্বিনের বাদশার বন্ধুও। শিকড়-বাকরের ঔষধের সাথে সাথে বিভিন্ন রত্ন পাথর, তাবিজ, মাদুলি, পানি পড়া, এমনকি বাটি চালান, বেগুন চালান দিয়ে চোরাই মাল চোরসহ ধরতে পারেন। সত্যি?! আমার কৌতুহলি মনে বুনো বাতাশ হামলে পরলো, নিজ চোখে দেখার জন্য। পাড়া পড়শী জানলে কিন্তু খুব মুশকিল, কাউকে বলবোনা কিরে কেটে (কসম) কথা দিলাম। ঐ বয়সে বন্ধুত্ব মানে তো তাই।

আগুন লাগার সপ্তাহ দুয়েক পরে এক সকালে আমাদের খিড়কি দরজা ঠেলে আমাদের বাসায় শহরের অপর পাশ থেকে বেবী ট্যাক্সিতে করে শহর ডিঙ্গিয়ে এলেন চমৎকার আলাপী এক মহিলা। নাম মিনু, সঙ্গে দেবশিশুর মত উনার ছোট্ট দুটি মেয়ে বিনু আর রেনু। উনি এসে একদম আপন জনের মত রান্নাঘরে, যেখানে আম্মা লালশাক বাছছেন দুপুরের রান্নার জন্য, মিনু খালা (তখন নিয়মই ছিল চেনা অচেনা মহিলাদের খালা, চাচী ডাকা) আম্মার সাথে শাক বাছায় হাত লাগালেন। বারান্দায় বিছানো মাদুরে পিচ্চি বিনু আর রেনু আমাদের সাথে ভাব করে ফেললো। উনি আসলে এসেছেন সুফি সাহেবের বাসায়, কিন্তু হেলেনারা গেছে হাস্পাতালে ভাঙ্গা পায়ের চিকিৎসার জন্য। উনারা ফিরে আসা পর্যন্ত মিনু খালা আমাদের বাসায় থাকতে চাইলেন। আম্মা খুব খুশি হয়ে সুজির হালুয়া আর মুড়ি দিয়ে চা দিলেন। বিনু রেনু মাদুরেই খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে গেল। হেলেনারা বাসায় ফিরলে ঘুমন্ত রেনুকে কোলে নিয়ে আমি মিনু খালার সাথে গেলাম।

আমাকে দেখে হেলেনা খুব খুশি হয়ে গেল, তার পড়ার টেবিলে নীহার রঞ্জনের ‘কালো ভ্রমর’ দেখে তার দিকে তাকাতেই, সে রাজি দুই দিনের জন্য আমাকে ধার দেবে পড়তে, কিন্ত দুই দিনের মধ্যেই ঐ ঢাউস বইটা কিভাবে শেষ করবো ? গল্প করতে করতে এসে গেল নোনতা বিস্কিট আর লেবু শরবত। আমাদের গল্পের মাঝেই হটাৎ মিনু খালা এলেন, আমাকে প্রায় মিনতির স্বরে অনুনয় করলেন একটি ছোট্ট কাজ করে দেয়ার জন্য। অনুরোধ করলেন কেউ যেন না জানে। কাজটা খুব সোজা, সুফি নানার ঘরে বসে নানা যে দোওয়া টোওয়া পড়বেন আমি সেগুলি উনার সাথে সাথে সেগুলি পড়বো উনি যা বলেন তা করবো, মিনিট পনেরোর বেশি লাগবেনা, এতে মিনু খালার খুবই উপকার হবে। ঘরে খালার সাথে হেলেনার মা এবং নানীও দাঁড়িয়ে আছেন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। রাজি না হওয়ার কোন যুক্তি পেলামনা। ‘হ্যা’ বলার সাথে সাথেই উনারা খুব খুশি হয়ে নানার ঘরে চলে গেলেন।

মিনিট পাচেক পরে আমাদের ডাকার পর হেলেনা সহ আমি নানার ঘরে গেলাম। অবাক হোয়ে দেখলাম এই ভর দুপুরেও জানালা দরজা বন্দ করে অন্ধকার করা হয়েছে, আর দুটো মালাসায় মধ্যে তুষ, কয়লায়, সাথে অন্যকিছু দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া দিচ্ছেন ঘরের আনাচে কানাচে অনেকটা সন্ধ্যাবেলায় দরজা জানালা বন্দ করে মশা তাড়ানোর জন্য ধুপ দেয়ার মত। নানী একটি ঝক ঝকে ছোট্ট কাসার বাটিটে তেলের মধ্যে চুবানো কাপরের পাকানো সলতের এক মাথায় আগুনের শিখার উপরে একটি চক চকে কালো বেগুনে ধরে আছেন, অনেকটা সেই আমলে আঁতুর ঘরে নবজাতকের জন্য কলাপাতায় কাজল বানানোর মত। সুফি নানা ভাংগা পা নিয়ে বিছানায়ই একটা জায়নামায বিছিয়ে তার উপর একটি পাথরের বাটিতে কিছু শিকড় বাকর দিয়ে ছোট্ট করে আগুন জ্বালিয়েছেন, ঘরটাতে সুন্দর, মিস্টি, অথচ বুনো মতন গন্ধে ভুর ভুর করছে। নানার সামনে আরো কিছু শিকড়, রত্ন পাথর,(আমি রত্ন তত্ন চিনি না, তবে সেগুলি সাধারন রাস্তায় পড়ে থাকা পাথরের টুকরো নয়)।

এতক্ষনে মিনু খালা আমাকে জানালেন, গত পরশু জন্মদিনে ঘর ভর্তি আত্বীয় স্বজনের মধ্যে থেকে বিনুর গলা থেকে তিন ভরির এক সোনার চেইন চুরি হয়েছে। সুফি নানা বেগুন চালান দিয়ে চোরকে দেখাবেন। আমি যেন সেটা দেখে উনাদের এই উপকারটা করি। শুধু তুলা রাশির জাতক বলেই আমাকে উনি অনুরোধ করছেন। আমার কৌতুহলি মনে হোল এ যে দেখি মেঘ না চাইতেই বৃস্টি! মফস্বলে তখন বান মারা, বাটি চালান, বেগুন চালানের গল্প শোনে নি এমন কেউ কি আছেন?

আমাকে একটি হাতল ওয়ালা কাঠের চেয়ারে বসতে বললেন, সামনে একটি ছোট্ট কাঠের টেবিলে কত গুলি শিকড়, পাথর। হেলেনা বিনু রেনুকে নিয়ে বাইরে চলে গেল। মাটিতে বিছানো চাদরে গোল হয়ে বসেছেন নানী এবং খালারা। কুয়াশার মত ধোয়াচ্ছন্ন ঘরে কেমন যেন একটু থম থমে রহস্যময়। বসার পর নানা সব্বাইকে উনার পড়া মন্ত্রের মত কিছু অপরিচিত শব্দ(আমার জানা কোন বাংলা বা আরবী শব্দ ছিল না সেগুলি)উচ্চারন করলে আমরা সেটা রিপিট করলাম মৃদু, সমস্বরে। নানী জগ থেকে ঢেলে একটু তিতকুটে একটু বিস্বাদ পানীয় দিলেন ছোট্ট কাপে করে। নানার সামনের সেই মিস্টি বুনো ধোঁয়া সহ পাথরের বাটিটা আমার সামনের টেবিলে রাখলেন। তার পর সেই কালো বেগুনটা আমার হাতে দিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে তা দেখার জন্য বললেন নানা। দেখি বেগুনের এক পাশে সেই পাকানো সলতের শিখায় ঠিক সেই কাজলের মতই একটি চক চকে আস্তরন, অস্পস্ট আয়নার মত, আমি আমার নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেলাম সেখানে। নানা জিজ্ঞেস করলেন আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি কিনা।

ধোঁয়ায় আমার নাক চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি পরতে লাগলো, এবং হটাৎ মাথাটা খুব ভারী মনে হলো, ঝাপসা চোখে বেগুনটার দিকে তাকিয়ে যেন দেখলাম, আমার প্রতিবিম্বের বদলে সেখানে আবছা, অস্পস্ট দুটো চেয়ারের ছবি। সুফি নানা আমাকে বুঝিয়ে বললেন যেকোন সময়ে ঐ চেয়ারে জ্বিনের বাদশাকে দেখতে পাবো। পরিস্কার কোন কিছু নয়, আবছা মত যা দেখবো, তা খুব খেয়াল করে দেখতে হবে। বাদশার মাথা উপরে নীচে নাড়া মানে ‘হ্যা’, ডানে বামে নাড়া মানে ‘না’। আমার এখন ‘জ্বিনের বাদশা আসেন’ বলতে হবে, তিনি আসলে সালাম দিতে হবে। পানি ভরা ঝাপসা চোখে বেগুনের মধ্যে দেখতে পেলাম কে যেন সাদা কাপড় পড়ে চেয়ারে বসে আছে, সালামের উত্তরে মাথা উপরে নীচে নাড়লেন। নানার নির্দেশে আমি মনোয়ারার মেয়ে চমন আরার গলার চেইনের কথা জিজ্ঞেস করলাম।

পানিতে ঝাপসা চোখে দেখলাম, সেই চেয়ারের বদলে, একটি পাকা বাড়ীর ভিতরের(মনে হোল) উঠোন। সীমানার পাকা দেয়ালের ঠিক পাস দিয়ে একটা পাকা খোলা ড্রেন। গোলাপি কাপর পড়া একটি বাচ্চা হাত পা নেড়ে হাটছে।

মিনু খালা উঠে এলেন দেখার জন্য, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলেন না, মুখে বললেন, ‘জন্মদিনের ড্রেসটা গোলাপিই ছিল’।

ড্রেনের উলটো দিক থেকে দুইজন এসে একজন বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল। একটানে বাচ্চাটার থেকে কিছু ছিনিয়ে নিয়ে কোল থেকে নামিয়ে যে দিক থেকে এসেছিল, ঠিক সেইদিকেই মিলিয়ে গেল।

খালা, নানা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন ‘ঐ দুই জন পুরুষ না মহিলা, কি রঙের কাপর পরনে?’

পানিতে ঝাপসা চোখে আমি শুধু দেখতে পারলাম কালো অথবা কাছা কাছি কোন গাঢ় রঙের কাপর হবে, অস্পস্ট, কার্টুনের মত রেখাময় অস্তিত্ব। চেহারা, পুরুষ কিম্বা মহিলা বুঝতে পারছি না।

এর পর ঘরের ভিতর থেকে একজন আকাশি রঙ্গের কাপর পরে এসে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলেন।

খুব অবাক হয়ে মিনু খালা বললেন ‘ঐ দিন আমি আকাশি রঙ্গের শারিই পরেছিলাম, এবং ড্রেনের পাস থেকেই ক্রন্দনরত বিনুকে আমিই কোলে করে ঘরে এনেছি। এগুলি তো এখানে কারো জানার কথা না’।

শিকড় বাকরের ধোঁয়ার জন্যই হোক বা ঐ তিতে কষটা পানীয়ের জন্যই হোক আমি খুব খুবই অসুস্থ বোধ করলাম, আমার হাত থেকে বেগুনটা পরে গেল। চোখ নাক দিয়ে ঝর ঝর করে পানি ঝরছে, সমস্ত মুখ লাল হয়ে ফুলে গেল। আমাকে ধরে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে এলেন, এবং আমাকে বাসায় নিয়ে এলেন উনারা। আমার ঐ বিদ্ধস্ত চেহারা দেখে আম্মা আৎকে উঠলেন। হটাৎ সবার সামনেই বমি করে ফেললাম, বারান্দার মাদুরেই অচেতনের মত ঘুমুতে লাগলাম।

ঐ দিকে মিনু খালার সাথে সুফি নানার মধ্যে কাজের পারিশ্রমিক নিয়ে কথা কাটা কাটির মাঝেই গাজি সাহেব হটাৎ মাসিক বাড়ী ভাড়ার টাকা নিতে এসে হাতে নাতে ধরে ফেললেন বেগুন চালান দেয়ার অপকর্মটি। তিনি বাড়ী ছাড়ার নোটিশ দিলেন। কপালের ফেরে ঠিক তখনই বেচু, দীপু, নুরুদের দল বাড়ীর সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। ভাড়াটে উচ্ছেদের মত মহৎ কাজে সোৎসাহে, চারটে ঠেলা গাড়ী যোগার করে সন্ধ্যার আগেই পাড়া থেকে তাড়িয়ে দেয়া হোল পুরো পরিবারটিকে, মাল পত্র তচনচ হলে সুফি সাহেব বান মারতে ভুল করবেন না, এই ভয়েই কেউ লুটপাটে আগায়নি। বাটি চালান বা বান মারার ফলা ফলে ভয় পায় না এমন বীর খুব কমই ছিল তখন।

সুস্থ হলে আম্মার বকার পরিমান মনে মনে তুলনা করুন পিঠে আস্ত এক চ্যালা কাঠ ভাঙ্গার সমান।(ভাগ্যিস আমাদের বাড়ীতে দৈহিক মার ধরের চল ছিলনা) বকা খেয়ে যতটা কসট পেয়েচি তার থেকে আরো অনেক অনেক দুঃখ পেয়েছি, আমার মনটা হাহাকার করে উঠেছে, হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর জন্য। সব চেয়ে বড় কস্ট হোল স্বচক্ষে অজানা অচেনা অশ্রুত যা দেখলাম একটি বেগুনের মধ্যে সেটা কেমন করে, কি ভাবে, সম্ভব হলো তা আর জানার উপায় রইলো না।

আসমা খান, অটোয়া


মন্তব্য

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

অনেকদিন পর লিখলেন মনে হয়।
কেমন আছেন? আপনার কোন পোস্টে আপনার অসুস্থতার কথা পড়েছিলাম বলে মনে পড়ে।

লিখা চলতে থাকুক।
শুভ কামনা রইল।

আসমা খান, অটোয়া এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ, সময় নিয়ে গল্পটি পড়াও মন্তব্যর জন্য।ভালো থাকবেন।

তারেক অণু এর ছবি

ভালো লাগল। অনেক দিন পর আপনার উপস্থিতি , আশা করি ভাল আছেন।

আসমা খান, অটোয়া এর ছবি

অশেষ ধন্যবাদ, মন্তব্যর জন্য। আপনার লেখার সাথে সাথে আমরাও যে কত অজানাকে জানছি। ভ্রমন চলতে থাকুক, ভালো থাকবেন।

প্রখর-রোদ্দুর এর ছবি

ভালো লাগলো স্মৃতির পাতা থেকে রহস্যের গল্প পড়ে।
অনেক ভালো থাকুন।

আসমা খান, অটোয়া এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়া ও মন্তব্যর জন্য। ভালো থাকবেন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।