যে গল্পের শেষ নেই

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৯/০৩/২০১২ - ১১:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অজপাড়া গাঁয়ে থাকি আমি। সন্ধ্যায় হারিকেন আর কুপির আলোয় আলোকিত হয় গ্রামের প্রতিটি পরিবার। রাতের নির্জনতা এখানে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে গভীর হয়। শিয়ালের দল হুক্কাহুয়া শব্দে লুকোচুরি খেলে গম ক্ষেতের আড়ালে। বাতাসে লুটোপুটি খেয়ে বাঁশ ঝাড়ে একটি আরেকটির উপর আছড়ে পড়ে সৃষ্টি হয় আদি ভৌতিক শব্দ। ঝিরি ঝিরি হাওয়ায় ভর করে ভেসে আসে হুতুম পেঁচার ডাক। ভোরে মুয়াজ্জিনের আহবান ও পাখির গানে জনপদ জেগে উঠে। আলো আধারীতে মাটির কাঁচা রাস্তা যখন ধীরে ধীরে মুখরিত হতে থাকে তখন বাড়ির পাশের মক্তব থেকে কচিকাঁচার শব্দ ভেসে আসে। বেলা হয়ে এলে আমি যখন স্কুলের পথ ধরি তখন ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা মক্তব শেষে মুখর শব্দে ঘরে ফিরে। এখানে জীবন বলতে এমনই মধুর ও প্রাণোচ্ছল।

প্রতিদিন প্রায় তিন মাইলের মত হেটে স্কুলে যাই। মাটির কাঁচা রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে ফসলভরা সবুজ মাঠের বুক চিড়ে। কখনো উঠোনের মাঝ দিয়ে, কখনোবা বাঁশ ঝাড়ের ভেতর দিয়ে ছায়াঘেরা সবুজের আঙ্গিনা ঘেঁষে মেঠোপথটি পৌছে গেছে স্কুল পর্যন্ত। বর্ষায় দিগন্তজোড়া বিস্তৃত মাঠ ভরে মাটির কাঁচা রাস্তার পাড় ঘেঁষে থৈ থৈ জলে হাসের ঝাঁক খেলা করে। শাপলা ফুলে ভরে উঠে রুপসী বাংলার বিস্তৃত দিগন্ত। এই পথে ক্লান্তি তাই আমাকে ছুঁতে পারেনি কখনো।

অন্যসব দিনের মত আজও টিফিন পিরিয়ডে পত্রিকার পাতা উল্টে পাল্টে দেখছিলাম। হঠাৎ ভেতরের পৃষ্ঠায় একটা ছবিতে আমার দৃষ্টি আটকে গেল। জীর্ণ পোশাকের নির্লিপ্ত চাহনিতে কাঠের ক্র্যাচে ভর করা এক পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার সাদাকালো ছবি। শিরোনামঃ- “ভিক্ষা করে জীবন চালায় পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা রমিজ উদ্দিন”। আমার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে উঠে। আমি চোখে অন্ধকার দেখতে থাকি। টিফিন পিরিয়ডের পর ক্লাসে গিয়ে এই প্রথমবার ছাত্রদের পড়াতে পারিনি। যাদের আমি বীরত্বগাথা মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প শুনিয়েছি, যাদের আলোকিত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছি, দেশমাতৃকার প্রতি অসীম ভালবাসায় শহীদ যোদ্ধাদের পবিত্র রক্তে রঞ্জিত পূণ্য ভূমি এই সবুজ বাংলার স্বাধীনতার কথা বলেছি, আজ তাদের বলতে পারিনি যাদের রক্তে, যাদের ত্যাগে এই স্বাধীন বাংলাদেশ তাদেরই কেউ কেউ ভিক্ষা করে জীবন চালায়!

স্কুল থেকে ফিরছি, রাস্তার পাশে সবুজ শ্যামলে ঘেরা আমার প্রিয় রুপসী বাংলার সবকিছুই আগের মতই আছে। তবুও আজ নিজেকে বড় ক্লান্ত বড় ভঙ্গুর ও বিধ্বস্ত লাগে।

এখন অনেক রাত। ক্লান্ত শরীর নিয়ে শুয়ে আছি। দুচোখে ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই। অনেক সময়ের পরে আজ রক্তঝরা দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে খুব। মনে পড়ছে 'শকুন মার'-এর কথা, জিন্নাহ ভাইয়ের কথা; মনে পড়ছে প্রিয় রমিজ ভাইয়ের কথা। মনে পড়ছে শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা রাখা এই আমি ছোট্ট হাতে বন্দুক চালিয়েছি পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে। নিশুথির অন্ধকারে কত শত স্বজনের লাশ পায়ে মাড়িয়ে গিয়েছি জানা নেই। বারুদ আর লাশ পচা গন্ধে বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে দুহাতে চেপে ধরে রেখেছি থ্রী-নট-থ্রী। শুধু জানতাম প্রাণের শেষ স্পন্দনটুকুর বিনিময়েও যদি একটি পাক শকুন ধ্বংস হয় তবে সেখানেই স্বার্থকতা, সেই মরণেও আত্মা তৃপ্তি পাবে।

জিন্নাহ ভাইয়ের নেতৃত্বে আমাদের সাতজনের দল 'শকুন মার'। দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলাম আমি। জিন্নাহ ভাই বয়সে আমার চেয়ে বিশ বছরের বড়। রমিজ ভাই যখন জিন্নাহ ভাইয়ের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন তখন কাকা বলে সম্বোধন করতেই তিনি টকটকে লাল চোখ নিয়ে আমাকে ধমক দিলেন। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, তবে ধমকের কারণে নয় উনার টকটকে লাল চোখ দেখে। যেন কতকাল ধরে ঘুম নেই। যেন জেগে আছেন হিংস্র শকুনের দলকে গায়েল করতে।

এরপর তিনি আমাকে দুহাতে চেপে ধরে কাছে টেনে নিয়ে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। আমি উনার বুকের ভেতরের চাপা কষ্টগুলোর অস্ফুট শব্দ শুনতে পেলাম। ঠিক কতক্ষণ জড়িয়ে ছিলেন, তিনি হয়ত বুঝতে পারেন নি। রমিজ ভাইয়ের ঝাকুনিতে তিনি সংবিত ফিরে পেয়ে আমাকে ছেড়ে দিয়ে থুতনিতে ধরে ভাঙা গলায় বললেন- যদিও তুমি আমার ছেলের বয়সী তবুও তুমি আমার সহযোদ্ধা, আমাকে ভাই বলেই ডাকবে। পরে রমিজ ভাইয়ের কাছে জেনেছি, আমার বয়সী একটা ছেলে ছিল জিন্নাহ ভাইয়ের। শকুনের দল উনার স্ত্রী-পুত্র দুজনকেই নির্মম ভাবে হত্যা করে।

জিন্নাহ ভাই আমাকে রাইফেল চালাতে নিষেধ করেছিলেন প্রথমে। যুদ্ধ সরঞ্জাম নিয়ে দলের সাথে থেকে শুধু সাহায্য করতে বললেন। নাছোড় বান্দা এই আমি রমিজ ভাইয়ের কাছে শুধু আকুতি মিনতি করতাম, রাইফেল হাতে নিয়ে গুলি করার চেষ্টা করতাম। আমার আগ্রহ ও অস্ত্র চালাতে উদগ্রীব হয়ে আছি দেখে কেবলমাত্র রমিজ ভাইয়ের অনুরোধেই তিনি নিজ হাতে আমাকে রাইফেল চালানো শিখালেন। রাইফেল হাতে আমি হয়ে উঠলাম জিন্নাহ ভাইয়ের একনিষ্ঠ সহযোদ্ধা। 'শকুন মার' দলের সাথে থেকে একে একে অনেকগুলো সফল অপারেশান চালিয়ে ছিলাম। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গিয়েছিল কৃষ্ণগ্রামের মিলিটারি ক্যাম্পের অপারেশানটা। আমার জীবন স্মৃতিপটে এত ভয়ংকর রাত এর আগে আর কখনোই আসেনি।

নভেম্বরের শেষ দিকটায় যখন বাংলার মাটি একে একে শকুন মুক্ত হতে শুরু করল তখন আমিন মিয়া এসে জানাল কৃষ্ণগ্রামে মিলিটারি ক্যাম্প বসেছে। গ্রামের মেয়েদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পে, শিশু-বৃদ্ধদের গুলি করে মেরে ফেলছে। ঘরে ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে সারাগ্রাম। আর এসব কাজে মিলিটারিদের সহযোগীতা করছে রাজাকার রমজান আলী ও তার শান্তিরক্ষা কমিটি। আমিন মিয়ার বৃদ্ধ মা-বাবাকেও মিলিটারি গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমিন মিয়া বাড়ি ছিল না, খবর পেয়ে ছুটে এসে দেখে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে তার বাড়িতে। উঠানে পরে আছে বাবা-মা'র রক্তাক্ত মৃত দেহ। রমজান রাজাকার যখন মিলিটারি নিয়ে আমিন মিয়ার খোঁজে আবারও বাড়িতে আসে, তখন বুটের শব্দ শুনে গোয়াল ঘরের পেছনে গোবরমাখা খড়ের ভেতরে লুকিয়ে মরার মত পরে ছিল। তাকে না পেয়ে মিলিটারি চলে গেলে রমজান রাজাকারের কণ্ঠ ভেসে আসে- 'মিয়ারা, তোমরা আমিনরে খুইজ্যা বাইর কর। মুক্তিদের সাথে তার কিন্তু যোগাযোগ আছে। তারে ধরতে পারলে মুক্তিদের খোঁজ পাওয়া যাইব। আর আজ রাইতে আরও মিলিটারি আসব। রাইতে তোমরাও আমার সাথে থাকবা।'

রমিজ ভাইও কৃষ্ণগ্রামের। বাবা মা মারা যাওয়ায় একমাত্র বোনকে নিয়ে মামার সাথে থাকেন। নানা বেঁচে নেই অনেক দিন হল। মামার সংসারে ছোট একটা ছেলে, মামী, নানী আর রমিজ ভাই ও তার বোন। রমিজ ভাই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন এটা শুধু রমিজ ভাইয়ের বোন, মামা আর আমিন মিয়া জানেন। আমিন মিয়ার কাছ থেকে জানতে পারলাম রমিজ ভাইয়ের বোনকেও রমজান রাজাকারের দল মিলিটারির হাতে তুলে দিয়েছে। রমিজ ভাইয়ের মামা বাড়ি ছিল না। উনার মামীকেও মিলিটারি গুলি করে মেরে ফেলেছে। রমিজ ভাই ক্রোধে পাগল হয়ে একাই মেশিনগান হাতে ছুটে যেতে লাগলেন। জিন্নাহ ভাই দৌড়ে গিয়ে রমিজ ভাইকে থামালেন।

রাত এগারটার দিকে জিন্নাহ ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা কৃষ্ণগ্রামে যাই। আমাদের দলের তিন সদস্যকে গ্রেনেড, গোলাবারুদ ও অস্ত্রসহ শম্ভু ব্রীজের কাছে পাঠিয়ে দিলেন জিন্নাহ ভাই। জিন্নাহ ভাই, রমিজ ভাই আর আমিন মিয়া সহ আমরা বাকীরা মিলিটারি ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে যাই। মিলিটারি ক্যাম্পের পেছনে একটু দূরে খালের ধারে বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে আমরা রাইফেল, গ্রেনেড নিয়ে অবস্থান নিই। রাতের নির্জনতা ভেঙে মিলিটারি ক্যাম্প থেকে আর্তনাদ, চিৎকার ও গোঙ্গানীর শব্দ ভেসে আসে। রমিজ ভাই অস্থির হয়ে উঠেন হিংস্র পশুদের উপর ঝাপিয়ে পড়তে। আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসতেই মিলিটারি ক্যাম্পে পশুদের ছুটাছুটি বেড়ে যায়।

জিন্নাহ ভাই আমিন মিয়াকে সঙ্গে করে ক্যাম্পের অবস্থা দেখে এসে আমাদের অ্যাকশান প্ল্যান বুঝিয়ে দেন। ধরে আনা গ্রামের মেয়েদের একটা রুমে তালাবদ্ধ করে রেখেছে। সব মিলিয়ে পনের-বিশ জন মিলিটারি আছে এই ক্যাম্পে। রমজান রাজাকারকেও দেখা গেছে মিলিটারি ক্যাম্পে। তবে তার সাঙ্গপাঙ্গরা কেউ নেই এখানে, হয়ত পালিয়ে গেছে। এরই মাঝে আমাদের বাকী সদস্যরাও ফিরে আসলে জিন্নাহ ভাই আমাদেরকে ক্যাম্পে ধরে আনা মেয়েদের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন- “কোন অবস্থাতেই ভুল করা যাবেনা, আমাদের একটা ভুল এতগুলো মানুষের নির্ঘাত মৃত্যু ডেকে আনবে। একটা কথা মনে রাখবে, জীবন দিয়ে হলেও কোন মিলিটারিকে পালিয়ে যেতে দিবে না।” রমিজ ভাই সারাটা সময় চুপ করে ছিলেন। এই প্রথম বার অপারেশানের আগে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। মরে যাব তাতে কোন কষ্ট নেই, কোন ভয় নেই। শুধু এতগুলো মা-বোনদের কথা ভাবতেই ঘাম দিতে শুরু করল।

বাঁশ ঝাড়ের আড়াল থেকে অস্ত্র আর গ্রেনেড হাতে আমরা ধীরে ধীরে ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে যাই। রমিজ ভাই দুহাতে গ্রেনেড চেপে ধরে এগুতে লাগলেন। রাতের এই অন্ধকারেও জিন্নাহ ভাইয়ের লাল চোখ দুটো জ্বল জ্বল করতে থাকে। আমিন মিয়াও গ্রেনেড হাতে রমিজ ভাইয়ের সাথে সাথে এগুতে লাগলনে। এত নিস্পৃহ নির্লিপ্ত রমিজ ভাইকে আমি এর আগে কখনো দেখিনি। আজ তিনি কোন ভুল করতে চান না, একটা শকুনকেও তিনি প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে দিতে রাজি নন।

রমিজ ভাই আর আমিন মিয়া গ্রেনেড হাতে ঝাপিয়ে পরেছেন। জিন্নাহ ভাইয়ের মেশিন গান ঝংকারে বেজে উঠেছে। আমিও কখন যে ক্রমাগত গুলি করে যাচ্ছি বুঝতে পারিনি। ভয়ার্থ চিৎকার, গুলি আর গ্রেনেডের শব্দে প্রকম্পিত চারপাশ। রমিজ ভাই মেশিনগান নিয়ে ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকে পরেছেন। গ্রেনেডের বিস্ফোরণে ক্যাম্পের একটা অংশ উড়ে গেছে। চার-পাঁচ জন মিলিটারিও উড়ে গেছে ক্যাম্পের সাথে সাথে। হানাদার বাহিনীও ক্রমাগত গুলি করে যাচ্ছে। হানাদারের গুলির আঘাতে আমিন মিয়া নিথর পরে আছে। ব্যগ্র সিংহ-র মত জিন্নাহ ভাই একটা একটা করে শকুন বধ করছেন। কিন্তু ভাগ্য জিন্নাহ ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করে হেসেছিল বোধহয়। আমারই চোখের সামনে শত্রুর গুলিতে মূহুর্তেই ঝাঁজরা হয়ে গেছে হয়ে উনার বুক। অস্ফুট কষ্টগুলো দীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে নিথর ফেলে রেখে চলে গেছে বহুদূরে। আমাদের বাকী সদস্যরাও শ্বাসরুদ্ধকর ভাবে জীবন বাজী রেখে একে একে শেষ করে দিচ্ছে হানাদার বাহিনীকে। ক্যাম্প আমাদের দখলে চলে আসার একটু আগে রমিজ ভাই শত্রুদের দিকে গ্রেনেড ছুড়ে দিতেই শত্রুর গুলির আঘাতে মাটিতে পড়ে গেলেন। শত্রুর আঘাতে আমাদের আরও একজন সদস্য শ্যামল ঘোষ শহীদ হলেন।

অস্ত্রের দামামা বাজিয়ে সব শকুন মেরে ক্যাম্প যখন আমাদের দখলে তখন চারিদিকে রক্তের বন্যা বইছে। জিন্নাহ ভাইয়ের নিথর দেহ পরে আছে মেশিনগান ঝাপটে ধরে। আমি রমিজ ভাইয়ের মাথা কোলে তুলে নির্বাক বসে আছি। গুলির আঘাতে তিনি ধরাশায়ী হলেও প্রাণে বেঁচে আছেন। আটকে রাখা মা-বোনদের মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। তবে কেউ আর আগের সেই মানুষটি রইল না। রক্তাক্ত বিধ্বস্ত পড়ে আছে কেউ কেউ। চারিদিকে বীভৎস্য লাশ পোড়া আর বারুদের গন্ধ। সেই সাথে অস্ফুট গোঙ্গানী, চিৎকার আর কান্নার রোল চারিদিকে। রমিজ ভাইকে আমরা কয়েকজন তুলে রমিজ ভাইকে সঙ্গে নিয়েই উনার বোনের খোঁজে যাই। ঘরের এক কোণে রমিজ ভাইয়ের বোনকে লাশ হিসেবে উদ্ধার করা হয়।

দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন দেশে রমিজ ভাই পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। স্বাধীন রাষ্ট্রে নতুন স্বপ্ন নিয়ে আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়ি। একটা সময় রমিজ ভাইকে আর কোথাও খুজে পাই না। অনেক খুঁজেছিলাম রমিজ ভাইকে। কেউ কোন সন্ধান দিতে পারে নি কখনো। আমিও পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। একটা সময় বিয়ে করে সংসারী হই। সেই সাথে গ্রামের হাই স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করি। রমিজ ভাইয়ের কথা প্রায়ই মনে পড়লেও ব্যস্ততার অযুহাতে তেমন ভাবে খোঁজ করা হয়ে উঠেনি।

আজ পত্রিকার ভেতরের পৃষ্ঠায় সাদাকালো ফ্রেমে জীর্ণ পোশাকে ক্র্যাচের ভর করা বৃদ্ধ রমিজ ভাইকে দেখে বাকরুদ্ধ হয়েছি। নিজের অজান্তেই চোখের কোণে নোনা জলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে। যুদ্ধে পঙ্গুত্ববরণ করা বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবন চলে ভিক্ষা করে। রাতের অন্ধকারে অকুতভয় বীর সৈনিক রমিজ উদ্দিন কি তবে এই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন? জীবন বাজী রেখে বাংলার মাটি পাক শকুন মুক্ত করে স্বাধীন দেশে জীর্ণ পোশাকে ক্র্যাচে ভর করে ভিক্ষা করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছিলেন? হয়ত উত্তর জানা নেই রমিজ ভাইয়ের, যেমনটি নেই আমারও।

অথচ যুদ্ধাপরাধারের দায়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে রাজাকার রমজান আলীর রঙিন ছবিসহ নিউজ ছাপা হয়েছে পত্রিকার প্রথম পাতায়। সুন্দর, মসৃণ, পরিষ্কার পরিপাটি পোশাকে এই স্বাধীন বাংলার পতাকাতলে রাজাকার রমজান আলীর প্রতি কতই না যত্ন ও গুরুত্বের ছাপ। অসুস্থ হয়ে পরলে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর উন্নত চিকিৎসার নিশ্চয়তা। সেই সাথে বিশেষ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। বিশেষ গুরুত্ব সহকারে রাষ্ট্রপক্ষ উদ্দ্যেগ নিয়ে কমিটি গঠন করে সেই সব রাজাকারদের জন্য। অথচ এই পরিপাটি পোশাকের নিশ্চয়তা নেই মুক্তিযোদ্ধাদের, নেই খাদ্যের নিরাপত্তা। অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলেও নেই আধুনিক প্রযুক্তির উন্নত চিকিৎসা সেবা। হয়ত রমিজ ভাইয়ের খবর দেখে রাজাকার রজমান আলী নিরবে বিজয়ীর কুৎসিত হাসি হেসে থাকবে। আর বিবর্ণ ফ্রেমে পত্রিকায় ভেতরের পাতায় স্থান পাবে রমিজ ভাইয়ের মত আরও অগণিত মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃখগাথা।

সেকেন্ডের কাটা ঘুরে ঘুরে মিনিটে ধাক্কা দিতেই সময় মূহুর্তেই ঘন্টা পেরিয়ে এসে দাঁড়ায় দিন-রাতের আবর্তনে। নদীতে জোয়ার আসে, দিন পেরিয়ে রাতের নির্জনতা ভেঙে পূর্ণ জ্যোছনাবেলায় চলে জোয়ার-ভাটার নিত্য খেলা।

দিন যায়, রাত আসে। রাত দিনের অমোঘ আসা যাওয়ায় কখন যে এতগুলো বছর পেরিয়ে গেল তা বুঝতে পারিনি কখনো। হয়ত বুঝতেও পারতাম না। নিয়তি এমনই হয়। তীক্ষ্ণ স্থির দৃষ্টিতে চোখে চোখ রেখে কটাক্ষ করে দেখিয়ে দেয় বাস্তবতাগুলো। সত্য নির্মম হলেও সত্যই। তেমনি বাস্তবতা নিষ্ঠুর হলেও অগ্রায্য করার উপায় থাকে না জানি। তবুও এত নির্মম এত নিষ্ঠুর ভাবে তা আমার সামনে এসে দাঁড়াবে ভাবিনি কখনো। কেউ কি কখনও ভেবেছিল এমনটি হবে!

---------------------------
মোখলেছুর রহমান সজল


মন্তব্য

সত্যপীর এর ছবি

ভাল লাগল।

..................................................................
#Banshibir.

মোখলেছুর রহমান সজল  এর ছবি

ধন্যবাদ।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

চলুক

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

মোখলেছুর রহমান সজল  এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

পথিক পরাণ এর ছবি

কি দেখার কথা কি দেখছি--
সত্যিই দুঃখজনক আমাদের বীর সন্তানদের প্রতি এই অবহেলা।

মোখলেছুর রহমান সজল  এর ছবি

হুমম। সত্যিই দুঃখজনক এই অবহেলা।
কবে মুক্তিযোদ্ধাদের তাদের সর্বনিম্ন প্রাপ্যটুকু বুঝিয়ে দেওয়া হবে?
এ বুঝি শুধু প্রশ্নই থেকে গেল।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।