অপেক্ষা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ৩১/০৩/২০১২ - ১১:০১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মঙ্গলবার টিফিন বিরতির পর বাংলা ক্লাস। আমি ক্লাস পালালাম।

‘স্কুল পালালেই রবীন্দ্রনাথ হওয়া যায় না’ এই বাক্যটির কারক বিভক্তি নির্ণয় ততদিনে শিখে গেছি ভালমতই। স্কুল পালিয়ে রবীন্দ্রনাথ হবার স্বপ্ন আমার কোন কালেই ছিলনা। তবে যা ছিল, সেটি অপেক্ষা। বিকাল তিনটায় বাংলাদেশ বেতারের (তখন রেডিও বাংলাদেশ) ক চ্যানেলে ‘শার্লক হোমস’ হবে। নাম ভূমিকায় মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। আর ওয়াটসনের চরিত্রে মুঃ এনামুল হক। অষ্টম শ্রেণীতে উঠতে উঠতে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল পড়া হয়ে গেছে। তবুও রেডিওতে শার্লক হোমস হবে। এজন্য আমার অপেক্ষার ক্লান্তি নেই। ‘অজুহাত’ নামীয় তিন নম্বর হাত ততদিনে গজিয়ে গেছে আমার। বিচিত্র সব অজুহাত বানিয়ে দ্বিতীয়ার্ধে স্কুল ফাঁকি দিয়ে বাসায় ফিরে রেডিও খুলে বসতাম। বাস্কারভিলের হাউন্ড কুকুরগুলোর মতই শার্লক হোমসের উপর যত লেখা, আঁকা, ছবি খুঁজে পেতে নিতাম।

একবার বিবিসি বাংলা বিভাগ রসবোধসম্পন্ন কৌতুকের উপর জরীপ চালাল। জরীপের ফলাফলে দেখা গেলো ঐ বছরের সবথেকে মজার কৌতুকটি শার্লক হোমসকে নিয়ে। কৌতুকটি এমন- শার্লক হোমস এক অভিযানে গেছেন কালাহারি মরুভূমিতে। পথে রাত নেমেছে। মরুভূমির জাহাজ উটটিকে এক তাল গাছের (জানতে চাইবেন না যেন- মরুভূমিতে তাল গাছ এলো কোথা থেকে) সাথে বেঁধে রেখে বন্ধু ওয়াটসনকে সাথে নিয়ে দ্রুত একটা তাবু খাটিয়ে ফেললেন রাত কাটাবার জন্য। মরুভূমির পথে চলে দুজনেই ক্লান্ত খুব। শোয়া মাত্রই বিভোর ঘুম। মাঝরাতে হোমসের ধাক্কায় ওয়াটসনের ঘুম ছুটে গেলো।
হোমস ডাকলেন- ওয়াটসন!
- বল।
- কিছু দেখতে পাচ্ছ?
ওয়াটসন চিৎ হয়ে শুয়ে ছিলেন। তাঁর চোখের সামনে মরুভূমির ওপর অসংখ্য তারায় খচিত পরিস্কার আকাশ।
- হুম। দেখতে পাচ্ছি। চোখ ডলে ঘুম মুছে ওয়াটসন জবাব দিলেন।
- কি?
- জ্বলজ্বলে তারায় বোনা ছায়াপথ। ডানদিকে সপ্তর্ষি। আরও উপরে লুব্ধক--
- আর কিছু? কবিতার মতন কাব্য করার মাঝে হোমস তাঁকে থামিয়ে দিলেন।
- কই! আর কি? ওয়াটসন অবাক হয়ে এদিক ওদিক চাইলেন।
- আরে! মাথার ওপর থেকে আমাদের তাঁবুটা চুরি হয়ে গেছে! প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে হোমস বললেন।

ভুলে যাবার অভ্যাসটা আমার একটু বেশি। অনেক মজার মজার কথা মানুষের থেকে শুনি। কৌতুক শুনে সুড়সুড়ি পেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে হাসি। হাসির পর ভুলে যাই। পরে, অন্য কোন আসরে সেই কৌতুকটি আবার শুনে মনে পড়ে- আরে এইটাতো আমার কমন পড়েছে! শোনার পড়ে মনে হয়। আগে না। সময়মত লাগসই একটা কৌতুক বা মজার কথা বলে ফেলে আমি মানুষকে আনন্দিত করতে পারিনা। অজস্র কৌতুক শুনে এবং যথারীতি ভুলে গেলেও শার্লক হোমসের এই কৌতুকটি মাত্র একবার শুনেও আমি ভুলি নাই। শার্লক হোমসের জন্য সে এক অপেক্ষার দিন ছিল!

এই সময়টিতে আরও একটি অপেক্ষার পালা যোগ হল। এক বুধবার রাতে টিভিতে দেখি বড়বড় এলোমেলো চুলের একজন দীর্ঘদেহী হালকা পলকা ইংরেজ নায়ক কি সব ধুন্দুমার কাজ করে যাচ্ছেন। একটা ছোট্ট ছুরি আর হাতের নাগালের ভেতর থাকা এটাসেটা দিয়ে শত্রুর দলকে একাই কুপোকাত করে ফেলছেন। একটা নির্জন বদ্ধ ঘরের ভেতর থেকে চাবি বানিয়ে বেরিয়ে আসছেন। এই অদ্ভুত বুদ্ধিমান মানুষটার ভীষণ ভক্ত হয়ে গেলাম আমি। শুরু হল বুধবার রাত নয়টা বাজার অপেক্ষা। সন্ধ্যা ঘনাবার আগেই রীতিমত বাধ্য ছেলের মতো বই নিয়ে টেবিলে বসে যাই। উদ্দেশ্য একটাই। ম্যাকগাইভার দেখায় যেন কেউ বিঘ্ন না ঘটায়। আম্মু মিটিমিটি হাসেন। মাঝে মধ্যে সপ্তাহের অন্যান্য দিনগুলোর আমলনামার ব্যত্যয়সমূহ উল্লেখপূর্বক ম্যাকগাইভার দেখায় এম্বারগো জারী করেন। সেই রাতগুলো ছিল আমার জন্য বিভীষিকাময় রাত। পুরো এক সপ্তাহের অপেক্ষার পর এই অনুষ্ঠানটি দেখতে না পারার যন্ত্রণা দিব্যজ্ঞানে আমি যেন আজও উপলব্ধি করতে পারি।

আমার অপেক্ষার শুরু অবশ্য আরও আগে। কার্পেন্টার্স ব্যান্ডের When I was young/ I'd listen to the radio/ Waitin' for my favorite songs/ When they played I'd sing along/ It made me smile- এই গানের চরিত্রটির মতন রেডিও ধরে বসে থাকা থেকে আমার অপেক্ষার শুরু। কি ভালই না লাগত পছন্দের একটা গান হঠাৎ ইথার তরঙ্গে ভেসে ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিলে’। দিন যায়। আমি হাতেপায়ে বড় হতে থাকি। বেড়ে উঠতে উঠতে সবিস্ময়ে দেখি, আমার অপেক্ষার ধরণ পাল্টে যাচ্ছে বিরামহীন।

দুর্মুখেরা বলে থাকেন বাঙ্গালী মাত্রই কমবেশি কবিতা ও প্রেম রোগে আক্রান্ত। যথাসময়ে আমিও নিয়ম মেনে এইসকল জাতিগত রোগে আক্রান্ত হলাম। একটা দুইটা কবিতা লিখি। লিখে খুব যত্ন করে ‘প্রিয় সম্পাদক মহাশয়’ বরাবর লেফাফায় মুড়ে ডাক বিভাগের লাল রঙের বাক্সে টুপ করে ফেলে দিয়ে আসি। তারপর শুরু হয় অনন্ত অপেক্ষা। কবে তা ছাপা হবে, কবি বলে খ্যাতি জুটবে। আমবঙ্গজ আমায় মাথায় তুলে রাখবে। আমার কলম নিংড়ে ভাব ভাষা পাওয়া পংতিমালা লোকে নরম কণ্ঠে বা গরম স্লোগানে উদ্ধৃত করবে। আহা! সে দিন কবে যে আসবে! দিনকতক আগে একটা বিজ্ঞাপনে জটিল বাক্য ছিল- ‘আমার ঘাড় আর উঁচা হয় না!’ অতীব দুঃখের বিষয়, কবতে লিখে গেলেও আমার কবতেও কেন যেন আর ছাপা হয় না। তা বলে কবি হবার দুর্দান্ত বাসনা আজিও আমি পদ্মা সুরমা মহানন্দার জলে ভাসিয়ে দিইনি! ‘কবতে তোমায় যে ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়ব না’ টাইপের আঠালো চরিত্রের মানুষ আমি।

কবিতার ন্যায় প্রেম। বাঙ্গাল প্রেমের শিরোমণি চণ্ডীদাস বাবু রজকিনীর জল আনবার ঘাটের পাশে ১২ বছর বড়শি বাইলেন। আহা! প্রেমে পড়ে অপেক্ষার এর থেকে মোক্ষম দৃষ্টান্ত আর কি হতে পারে! মানুষ প্রেমে পড়ে। পড়া মানে তো পতন। পতন সর্বদাই নিম্নগামী । প্রেম কি তবে নিম্নগামী (সতর্কিকরণ- নিম্নগামী বলতে এখানে আর্থিক/ সামাজিক/ মানসিক নিম্নগামী বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে; শারীরিক নয়)হয়? আমার এবিষয়ে জ্ঞান অতি সীমিত। কারণ প্রেম মাঝে মধ্যে আমার উপর এসে পড়ার চেষ্টা করলেও আমি বাইন মাছের মতন পিছলে গেছি। তবে হ্যাঁ। ভেবে দেখলাম- ত্রিশোর্দ্ধ বছর ধরে আমি বিশুদ্ধভাবে একটি প্রেমের জন্য অপেক্ষায় আছি ভীষণ। সেইদিক থেকে সুনীল বাবুকে আমার ভীষণ আপন জ্ঞান হয়। তাঁর তেত্রিশ বছরের অপেক্ষার সাথে আমার বড়ই মিল। একটি বিষয় ছাড়া। কবি কোন একটা বিশেষ জায়গায় সফল তদন্তকার্য চালিয়ে ওখানে কেবল মাংসের গন্ধ আবিষ্কার করেছিলেন। এই তাঁর কষ্ট। হতভাগা আমি বালকবেলা হতে নিয়মিত টারজান, হোমস, ম্যাকগাইভার, জেমস বণ্ড আর মাসুদ রানার সাথে ঘুরেফিরেও এমন একটা তদন্তকার্য চালাতে পারলামনা!! হায় অপেক্ষা!!

তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা দিয়ে কেবল হাঁটাহাঁটি শুরু করেছি। হলের ক্যান্টিনে যাই। কাউন্টারে বসা নুরুর কাছ থেকে নগদ টাকায় টোকেন নিয়ে টেবিলে বসি। টেবিল বয় এদিক ওদিক ছুটাছুটি করে। আমি ডাকি। ও যেন শুনতে পায়না। একটু পর হলের বিশেষ দলীয় ত্যাগী রাজপথের লড়াকু নিঃস্বার্থ ছাত্রদরদী ভাইয়েরা আসেন। উনারা টোকেন ছাড়াই খাবার টেবিলে এসে বসতে বসতে টেবিল বয় পাঁচ পদের খাবার সাজিয়ে দাঁত কেলিয়ে জিজ্ঞেস করে- ‘স্যার, আরও কিসু লাগব?’ আমার খাবার আসা আরও দেরী হতে থাকলে আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আর অপেক্ষা করতে থাকি।

বাস কাউন্টারগুলোতে জত্রতত্র ভিড়ভাট্টা লেগেই থাকে। আমি অপেক্ষা করতে থাকি একটা ফাঁকা বাস পাওয়া যায় কিনা। একটা একটু ফাঁকা বাস আসেনা তবুও। এইসব ভিড়ের বাসেই সবাই কেমন কনুই দিয়ে ঠেলে গুতিয়ে হাতল ধরে ঝুলে পড়ে। আমি পারি না। কাউন্টারে অপেক্ষায় দাড়িয়ে থেকে থেকে আমার পায়ে রীতিমত শেকড় বাকড় গজিয়ে যায়। যদিওবা ঠেলেঠূলে বাসে উঠলাম, এরপর জ্যামে বসে ভাবি এটা ছুটবে কখন। এইভাবে আস্তে ধীরে নাগরিক হাজারো অপেক্ষা আমার রোজনামচায় ঢুকে যেতে থাকে।

রুমমেট বড়ভাই ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। তাঁর টেবিলে রাখা রামজিলাল আর সেন-এর ব্যবচ্ছেদে শেক্সপিয়ার, কিটস পড়ি একটু আধটু। একদিন হঠাৎ অদ্ভুত কবিতা পেলাম একটা - To His Coy Mistress - এন্ড্রু মার্ভেল- এর লেখা।
Had we but world enough, and time,
This coyness, Lady, were no crime
We would sit down and think which way
To walk and pass our long love's day.

কবি তাঁর লজ্জাবনত প্রেয়সীকে বলছেন সময় বড় অল্প। অপেক্ষার ধূসর লগ্ন পেরুতে তিনি অনিচ্ছুক। আমারও মনে হল- এই না হলে জীবন! তবে এই মনোভাব বেশিদিন জারী রইল না। একদিন পরিচয় হল ভ্লাদিমির আর এস্ত্রাগন নামীয় দুই অদ্ভুত চরিত্রের সাথে, যারা একটা গ্রাম্য রাস্তার ধারে গাছের নীচে ‘গডো’-র জন্য অপেক্ষা করছিলো। আর অপেক্ষা শেষে গডোর দেখা না পেয়ে মরে যেতে চাইছিল। কি অদ্ভুত! গডোর জন্যও অপেক্ষা করা যায়! স্যামুয়েল বেকেট ফেলে আরজ আলী মাতুব্বরে চোখ রাখলাম। সে এক অন্য গল্প। অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে হবে ক্ষণ---
তবে-
সেজন্যে অপেক্ষা না করলেও হবে--

পথিক পরাণ
-----------------------------
Pavel352 এট yahoo.com


মন্তব্য

পথিক পরাণ এর ছবি

একটা গুরুতর সমস্যা।
লেখা সংরক্ষণের আগে সময় নিয়ে হরফ মোটা তাজাকরণ, উদ্ধৃতাংশ প্রযোজ্য চিহ্নযুক্তকরণ, লেখার এলাইনমেন্ট ডানে বামে ভরপুরকরণ নিশ্চিত করে প্রিভিউ দেখে নিচ্ছি। পোস্ট প্রকাশের পর সব কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে!!

লেখক পথ হারালে না হয় খুঁজে পেতে নিবে- লেখা পথ হারালে তার গতিতে বড়ই দুর্গতি---

--------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ--

মর্ম এর ছবি

লেখাটায় একটু অস্থিরতার ছাপ পেলাম কেন যেন, দুশ্চিন্তায় আছেন খুব?

আগের লেখাগুলোর মত আরো ভাল লেখা চাই। ভাল থাকুন।

অনেক শুভেচ্ছা।

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

পথিক পরাণ এর ছবি

মর্ম ভাই- দুশ্চিন্তা নাই। তবে মাঝে মধ্যে 'কিসুই ভাল্ললাগেনা' সিনড্রোম-এ আক্রান্ত হৈ। এই আরকি।
আপনার উৎকণ্ঠা ছুঁয়ে গেলো ভীষণ। অনেক ভালো থাকুন।

কাজি মামুন এর ছবি

লেখা ভাল লেগেছে, পথিক ভাই। চলুক

পথিক পরাণ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ মামুন ভাই।
অপেক্ষার বদলে ধনেপাতা-- আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

তাপস শর্মা এর ছবি

ভালো লাগল।

পথিক পরাণ এর ছবি

ধন্যবাদ দাদা--- আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

আব্দুর রহমান এর ছবি

চলুক

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

কুমার এর ছবি

"অপেক্ষার ধরণ পাল্টে যাচ্ছে বিরামহীন"। হ, এক্কেরে মনের কথা, পথিক ভাই।
আমাদের শহরে একটি কালো রেলগাড়ি 'র মত গল্প কিন্তু আরও চাই।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।