অভিযোজন কাহিনী – সুইজারল্যান্ড ৩

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি
লিখেছেন ইয়াসির আরাফাত [অতিথি] (তারিখ: সোম, ০৯/০৪/২০১২ - ২:০৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ভ্রমণের চেয়ে আনন্দময় বিনোদন সম্ভবতঃ খুব বেশি নেই। আপনার যদি খুব খারাপ সময় যেতে থাকে, পকেট ফাঁকা না থাকলে কোথাও থেকে ঘুরে আসুন, ক্লান্তি, ক্লেদ আর বিষন্নতা মুহূর্তে কেটে যাবে এতে কোন সন্দেহ নেই। নতুন দেশে এসেছি, একটু গুছিয়ে উঠতেই বেশ খানিকটা সময় কেটে গিয়েছে, তার ওপর দ্বিতীয় মাস থেকেই রমযান শুরু হয়ে যাওয়াতে অফিস-বাসার মধ্যেই জীবন সীমাবদ্ধ ছিল। রোজা রেখে ঘোরাঘুরি করা হয়তো একেবারে কঠিন নয়,

ভ্রমণের চেয়ে আনন্দময় বিনোদন সম্ভবতঃ খুব বেশি নেই। আপনার যদি খুব খারাপ সময় যেতে থাকে, পকেট ফাঁকা না থাকলে কোথাও থেকে ঘুরে আসুন, ক্লান্তি, ক্লেদ আর বিষন্নতা মুহূর্তে কেটে যাবে এতে কোন সন্দেহ নেই। নতুন দেশে এসেছি, একটু গুছিয়ে উঠতেই বেশ খানিকটা সময় কেটে গিয়েছে, তার ওপর দ্বিতীয় মাস থেকেই রমযান শুরু হয়ে যাওয়াতে অফিস-বাসার মধ্যেই জীবন সীমাবদ্ধ ছিল। রোজা রেখে ঘোরাঘুরি করা হয়তো একেবারে কঠিন নয়, কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় এত দীর্ঘ দিবস আর দেখি নি আগে, ভোর ৩:৫০ এ সেহরি খেয়ে সন্ধ্যা ৯:১৫ তে ইফতার।

আমার সংক্ষিপ্ত দুঃসময় শেষ হয়েছে, অবশেষে একটি ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছি। সাড়ে তিন কামরার ছিমছাম বাসা, নতুন রঙ করে দেয়া হয়েছে, চারিদিকে তাকালে মন ভালো হয়ে যায়। আমার মালপত্র যথাসময়ে জাহাজে করে চলে এসেছে, সেগুলো গুছিয়ে নেয়ার পর মোটামুটি প্রস্তুত আমরা, প্রথম ভ্রমণের জন্য। রিলোকেশন এজেন্ট একটি বই দিয়ে গিয়েছিল, হান্ড্রেড মোস্ট বিউটিফুল প্লেসেস ইন সুইটজারল্যান্ড। দেখেশুনে কাছাকাছি একটা জায়গা বাছাই করলাম, ভালোই লাগবে মনে হলো।

জায়গার নাম ভালোব (Vallorbe), ফ্রেঞ্চরা প্রায়শঃই ইংরেজী “আর” অক্ষরটিকে “খ” এর কাছাকাছি কিছু একটা উচ্চারন করে অথবা উহ্য রাখে আর “এ” অক্ষরটি সবসময় “আ” হবে। সুইস-ফ্রেঞ্চ সীমানায় পাহাড়ী এলাকার একটি উপত্যকা, পাশ দিয়ে বয়ে গেছে অব (Orbe) নদী, এই নদীর উৎসমুখ দেখা নিয়েই আমাদের আজকের অভিযান।

IMG_4726

ছবি – ১ : অব নদীর উপত্যকা, রেল স্টেশন থেকে তোলা

জায়গাটায় যাবার সহজ উপায় হচ্ছে ট্রেন, প্রতি ঘন্টায় দুটি ট্রেন লুজান থেকে যায় এবং আসে। ছোট বড় টিলার মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে রেলপথ, চারপাশে নয়নাভিরাম দৃশ্য, মাঝে মাঝে বড়সড় টিলার উপর এক দুইটি নিঃসঙ্গ বাড়ি, সব মিলিয়ে খুবই উপভোগ্য যাত্রা। কিন্তু মাত্র চল্লিশ মিনিট পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। মানে ঠিক জায়গামত নয়, এখান থেকে দুই কিলোমিটার হাঁটতে হবে। গাড়ি নিয়ে এলে সরাসরি স্পটে চলে যাওয়া যেত।

IMG_4719

ছবি ২: রেল স্টেশনের বাইরে দিক নির্দেশনা দেয়া, আমরা যাব ডানে, চল্লিশ মিনিটের হাঁটা পথ

সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়, একটু বৃষ্টি হয়েছে বলে কনকনে ঠান্ডা। কে বলবে কয়েকদিন আগে গরমে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম!

পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঢালু পথ বেয়ে নেমে যেতে হবে, খারাপ লাগবে না বোধহয় পদযাত্রা।

IMG_4734

ছবি ৩ : এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম

কিছুক্ষন হাঁটার পর অধৈর্য হয়ে উঠতে থাকি, পথ ফুরোচ্ছে না কেন? কিছুদুর সামনে এগোবার পর দেখি, একটি সাবধান বাণী লেখা রয়েছে সাইনবোর্ডে, “Pietons”। কথায় বলে, অল্পবিদ্যা ভয়ংকর। আমি মনে করলাম সাপের কথা বলছে নাতো? ইংরেজী আর ফরাসী ভাষা অনেক শব্দই একটু এদিক ওদিক করে শেয়ার করে, যদি Python কে বুঝিয়ে থাকে, তবে গেছি! আতঙ্ক বেড়ে ওঠার আগেই গুগল ট্রান্সলেটর খুললাম, শব্দটার মানে হচ্ছে “পথচারী”। একটি বাঁকের কাছে লাগানো, ফুটপাথ নেই বলে পথচারীরা রাস্তা দিয়েই হাঁটে, তাই গাড়ির চালকদেরকে সাবধান করা হচ্ছে। আমি আর আমার স্ত্রী দুজনের দিকে তাকিয়ে বোকার মত হেসে ফেললাম।

IMG_4751

ছবি ৪ : যাচ্ছি তো যাচ্ছিই, একটু এগিয়ে সাপের ভয় পেয়েছিলাম

আমরা ধীরে হাঁটছিলাম, তাই পৌঁছাতে এক ঘন্টার ওপরে লেগে গিয়েছিল। কিছুটা কাঁচা রাস্তা পাড়ি দিতে হবে, একটা বাঁক ঘুরে চোখ জুড়িয়ে গেল। ছোটবেলায় পোস্টারে যেমন দেখতাম, তেমনই কিছু একটা ভেসে উঠল চোখের সামনে।

IMG_4806

ছবি ৫: অগভীর খরস্রোতা অব নদী

আমরা যেটা দেখতে এসেছি সেটা হল অব নদীর গুহা (Grottes De l’Orbe)। ফ্রান্স এবং সুইজারল্যান্ডের কিছু অংশে এটি পাতাল নদী হিসেবে প্রবাহিত। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে বয়ে যাবার সময় এটি ছোট বড় অনেক গুহা তৈরী করেছে, সেগুলোকে খুঁড়ে জোড়া দিয়ে মোটামুটি চক্রাকার একটা পথ তৈরী করা হয়েছে, প্রবেশ এবং প্রস্থান একই জায়গায়।

ঢুকেই যে যায়গাটা পেলাম সেটার নাম শান্ত পানির হ্রদ। একটু পর পর আলো জ্বলে উঠছে পানির নিচ থেকে, আলো সবুজ না পানির নিচে শ্যাওলা সবুজ পরিস্কার বুঝতে পারি নি।

IMG_4817

ছবি ৬ : শান্ত পানির হ্রদ

একটু পর থেকেই শুরু হল যা দেখতে এসেছিলাম, পানি চোঁয়ানো ক্যালসিয়াম স্তম্ভের প্রদর্শনী। অনেক আগে পড়েছিলাম মাসুদ রানা’র অন্ধকারে চিতা বইটি। সেখানে এরকম একটা গুহার খুব সুন্দর বর্ণনা দেয়া ছিল। যতবার পড়তাম, যেতে ইচ্ছা হত সেখানে। এতদিন পরে সেই ইচ্ছা পূরণ হলো। ভ্রমণের আগে গুগুলের সহায়তায় যেটা জেনেছি সেটা হচ্ছে, যদি এরকম স্তম্ভ ছাদ থেকে ঝোলে তো তার নাম স্ট্যালাক্টাইট (Stalactite), যদি মেঝের ওপর জমা হয় তো স্ট্যালাগমাইট (Stalagmite), আর ছাদ মেঝে জোড়া লেগে গেলে কলাম (Column)। তাদের আবার নানা রকম ধরণ আর নানা রকম বৈজ্ঞানিক নাম। আমার কঠিন শব্দগুলো মনে নেই বলে নিজের মত করে বাংলা নাম দিয়ে দিলাম।

IMG_4827

ছবি ৭ : ভুতের দাঁত

IMG_4843

ছবি ৮ : শান্ত পানি ২, ওদিকে আর যাবার উপায় নেই

IMG_4851

ছবি ৯ : এটার বাংলা নাম দিতে চাচ্ছি না, তবে দুবাইয়ের বুর্জ আল আরবের সাথে কিছুটা মিল আছে

IMG_4854

ছবি ১০ : কোথাও বেমক্কা উঁচু নিচু থাকলে সিঁড়ির ব্যবস্থা আছে, দেয়ালের ফ্যাকাশে রঙ নির্দেশ করছে এখানে এক সময় পানির স্তর কোন পর্যন্ত ছিল

IMG_4857

ছবি ১১ : উল্টো ব্যাঙের ছাতা

IMG_4858

ছবি ১২ : ফুলকপি

IMG_4861

ছবি ১৩ : দৈত্যাকৃতি ব্যাঙের ছাতা

IMG_4867

ছবি ১৪ : এটার নাম ওরা দিয়েছে গ্লেসিয়ার, দেখে বোঝা যাচ্ছে কেন!

IMG_4869

ছবি ১৫ : পাটের আঁটি

IMG_4872

ছবি ১৬ : আঙুর থোকা

IMG_4880

ছবি ১৭ : এটি একটি বিশাল কলাম, সম্ভবতঃ সবচাইতে প্রাচীন গুলোর একটি

IMG_4886

ছবি ১৮ : বাইসন, কর্তৃপক্ষের দেয়া নাম

IMG_4888

ছবি ১৯ : উল্টো মানব

IMG_4895

ছবি ২০ : চীনা মন্দির

IMG_4909

ছবি ২১ : কচু পাতা

IMG_4914

ছবি ২২ : ঘুরে ঘুরে প্রবেশমুখের কাছাকাছি চলে এসেছি, দুটি বড় পাথরের বাধা পেয়ে পানি প্রবল গর্জনে আছড়ে পড়ছে নিচের দিকে

IMG_4936

ছবি ২৩ : স্ট্যালাক্টাইট আর স্ট্যালাগমাইট যুগল, হয়তো আর শ’খানিক বছরের মধ্যে কলামে পরিণত হবে

IMG_4949

ছবি ২৪ : যীশু

২৪ নম্বর ছবিটি নিয়ে কিছু বেশি কথা না বললেই নয়। আমার ক্যামেরার হাত একেবারে যাচ্ছেতাই, আমি সব ছবি অটো মোডে দিয়ে তুলি। যেটা আমার ছবিতে ধরা পড়ে নি সেটা হচ্ছে, এই গুহাটির ছাদ প্রায় সাত আট তলা সমান উঁচুতে। অনেক অনেক আগে যখন অব নদী মাটির উপর দিয়ে বইত, তখন কোন এক সময়ে প্রকৃতির খেয়ালে একটি ফাটল পেয়ে যায় সে। খরস্রোতে ফাটল আস্তে আস্তে গভীর হতে থাকে। কয়েক হাজার বছর ধরে পানির ধারা নীচে নামতে নামে আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে পৌঁচেছে, আগামী দিনগুলোতে আরও নামবে।। চোখের সামনে দ্রুতগতির সিনেমার মত ভেসে আসতে থাকে একটি পাহাড়ের বুক চিরে পানির স্রোতের নীচে নেমে আসার দৃশ্য, কেমন যেন অভিভুত করে দেয় মন।

IMG_4965

ছবি ২৫ : প্রথম দিককার ডুবুরীদের পোষাক

IMG_4968

ছবি ২৬ : একজন ডুবুরীর প্রতিকৃতির সাথে বর্তমান কেয়ারটেকারদের একজন

IMG_4969

ছবি ২৭ : অব নদীর উৎস এবং প্রবাহ

IMG_4980

ছবি ২৮ : গুহা থেকে আহরণ করা মুল্যবান পাথর - ১

IMG_4982

ছবি ২৯ : গুহা থেকে আহরণ করা মুল্যবান পাথর - ২

IMG_4985

ছবি ৩০ : গুহা থেকে আহরণ করা মুল্যবান পাথর - ৩

IMG_5003

ছবি ৩১ : পাহাড়ের নিচ থেকে বেরিয়ে আসছে স্রোত, এটাই নদীর উৎসমুখ

(এই গল্পটা শেষ, তবে পুরনো ঘটনার রেশ ধরে সিরিজ চলবে)

ইয়াসির


মন্তব্য

চরম উদাস এর ছবি

চলুক
দারুণ লাগলো

ইয়াসির এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ। গতদিন জিজ্ঞেস করেও করা হয়নি, "সাহিত্যিক" কি হারিয়ে গেল?

চরম উদাস এর ছবি

হারায় নাই ভাই। সাহিত্যক এর বড় অংশ বেশ কয়েক বছর আগে লেখা। সেটাকেই ঠিক ঠাক করে গত বছরের শেষ থেকে সচলে প্রকাশ করা শুরু করেছিলাম। এখন পরের বেশ কিছু জায়গা নিজের মনের মত হচ্ছে না। তাই ৮০ ভাগ শেষ হয়ে যাওয়া উপন্যাসের অনেক অংশ আবার নতুন করে লিখছি। বেশ খানিকটা সময় নেব হ‌য়তো আরো কিন্তু হারাবে না।

নরাধম এর ছবি

অনেক ভালো লাগল। চলুক

ইয়াসির এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ

স্বপ্ন-হীন এর ছবি

চলুক
ভালো লাগা জানিয়ে গেলাম।
পোস্টে উত্তম জাঝা!

ইয়াসির এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ

স্বপ্ন-হীন এর ছবি

চলুক
ভালো লাগা জানিয়ে গেলাম।

পোস্টে উত্তম জাঝা!

আনোয়ার এর ছবি

চলুক

ইয়াসির এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

চলুক

সান এন্টোনিওর ন্যাচারাল ব্রীজ ক্যাভার্ণের কথা মনে পড়ে গেল। আমার ছবিগুলো--দেখি পোস্ট করতে হবে।

ইয়াসির এর ছবি

অপেক্ষা থাকলো।

সত্যপীর এর ছবি

"ভূতের দাঁত", "ফুলকপি", "পাটের আঁটি" দেঁতো হাসি

লিখা চলুক।

..................................................................
#Banshibir.

ইয়াসির এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ

যাযাবর এর ছবি

পড়ে ভালো লাগলো। চলুক চলুক উত্তম জাঝা!

ইয়াসির এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

দারুন।
চলুক।

ইয়াসির এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ

প্রখর-রোদ্দুর এর ছবি

চলুক

ইয়াসির এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

বাউলিয়ানা এর ছবি

চলুক

ইয়াসির এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

দারুণ লাগল। চলুক

ছবিগুলোর ক্যাপশন জব্বর হয়েছে।

ইয়াসির এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ যথারীতি উদার মন্তব্যের জন্য

সৌরভ কবীর  এর ছবি

ভালো লাগলো।

ইয়াসির এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ

ব্যঙের ছাতা এর ছবি

ব্যঙের ছাতা গুলো বেশি ভালো লেগেছে। দেঁতো হাসি

ইয়াসির এর ছবি

দেঁতো হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।