বাংলা রসসাহিত্যের মনোজ্ঞ বিশ্লেষণ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৬/০৪/২০১২ - ৭:৩২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সন্দেহ নেই, সুকুমার রায় কথিত হাসতে যাদের মানা সেই ‘রামগড়ুরের ছানা’ জাতীয় বাঙালির সংখ্যাই বৃহৎবঙ্গে অধিক। তবে নিজস্ব লেখনিগুণে পাঠককে হাসাতে পারেন এমন লেখকও কিন্তু বাংলা সাহিত্যে একেবারে কম নয়। যারা ঝকঝকে, নির্মল হাস্যরস ও সূক্ষ্ম-তির্যক ব্যঙ্গ কৌতুকের অনাবিল ‘রসের কারবারি’—এমন কয়েকজন রম্যলেখকের সাথে আমরা পরিচিত হই আরেক বিরলপ্রজ রসসাহিত্যিক আবদুশ শাকুরের রসিক বাঙালি নামক এক ব্যতিক্রমী বইয়ের মাধ্যমে। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, পরশুরাম, সুকুমার রায়, শিবরাম চক্রবর্তী, সৈয়দ মুজতবা আলী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় —বাংলা রসসাহিত্যের এই দিকপালদের নিয়েই মূলত বইটিতে আলোচনা করা হলেও লেখক স্রেফ তার ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। তিনি এখানে একইসঙ্গে বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য রসসাহিত্যিকদের পরিচয় ও তাঁদের লেখালেখি সর্ম্পকে বিভিন্ন তথ্য, সাহিত্যে হাস্যরসের প্রকৃতি এবং বৈচিত্র্যের কথাও অনবদ্যভাবে তুলে ধরেছেন।

সাধারণভাবে বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত ইতিহাসগ্রন্থে রসসাহিত্যিক হিসেবে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের নামের উল্লেখটুকু পাওয়া যায় মাত্র। কিন্তু তাঁর মতো অমর গল্পবলিয়েকে (যিনি একইসঙ্গে বাংলা সাহিত্যে অদ্ভুতরসের প্রর্বতকও বটেন) নিয়ে সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গীতে কোনো গভীর বা বিস্তৃত বিশ্লেষণ খুব একটা হয়নি। সেদিক থেকে দেখলে এ বইয়ের ‘ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের রম্যগল্প’ শীর্ষক প্রবন্ধটি তুলনারহিত এই কথাশিল্পীর প্রসঙ্গে ক্ষুদ্রতম পরিসরে একটা পূর্ণাঙ্গ আলোচনা হয়ে উঠেছে। আবদুশ শাকুরের মতে, জীবদ্দশায় সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ডমরু-চরিতে ত্রৈলোক্যনাথের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে। পরশুরামের গল্পের কেদার চাটুজ্জে কিংবা অমূল্যকুমার দাশগুপ্তের (সম্বুদ্ধ ছদ্মনামেই এককালে অধিক পরিচিত ছিলেন) তৈরি দুঁদে শিকারী কান্তি চৌধুরী—ডমরু-চরিত-এর দুর্দান্ত ডমরুধরের কাছে এসব চরিত্রগুলো নেহাতই চুনোপুঁটি গোছের। ত্রৈলোক্যনাথের কল্পনাশক্তি তাঁর পর্যবেক্ষণশক্তির চাইতে কম ছিলো — প্রমথনাথ বিশী কথিত এমন একটি একপেশে মন্তব্যকে এখানে লেখক শাণিত যুক্তি আর দক্ষ বিশ্লেষণের মাধ্যমে অগ্রহণযোগ্য বলেই প্রমাণ করেছেন। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের বিভিন্ন গল্প থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে শাকুর দেখিয়েছেন যে তাঁর সাহিত্যে যেমন মিশে ছিলো তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশক্তি, তেমনি ছিলো গগনভেদী কল্পনার কারুকাজও। এছাড়া পাশাপাশি দুটিকে রেখে যদি তুলনামূলক বিবেচনা করা যায়, তাহলে অবশ্যই কল্পনাশক্তির পাল্লাটিই অধিক ভারী হবে। তিনি একদিকে কল্পনা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন চমকপ্রদ আজগুবি-উদ্ভট আ্যখান, অন্যদিকে তীব্র শ্লেষের সাথে নকশাকারে সাহিত্যে এনেছেন কশাঘাতে জর্জরিত নির্মম সমাজ-সমালোচনা।

রসিক বাঙালি বইটিতে পরশুরামের হাসির গল্প নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আবদুশ শাকুর লিখেছেন, অধ্যাপক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় পরশুরামকে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের উত্তরসূরী বলে ঘোষণা করলেও তাঁর তুলনা একমাত্র চলে ইংরেজী ভাষার আধুনিক পর্বের অন্যতম রম্যলেখক স্টিফেন লিককের সাথে। কারণ দুজনেই সমাজের সুচারু নকশা-আঁকিয়ে, দুজনইে ‘সংযমস্নিগ্ধ রসিকতা’ ও ‘বুদ্ধিদীপ্ত উইটের’ ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত পরিমিতভাবে। এর চেয়ে বরঞ্চ পরশুরামকে ত্রৈলোক্যনাথের গুণমুগ্ধ শিষ্য বলাটা শ্রেয়তর। পরশুরামের রচনায় তাঁর (ত্রৈলোক্যনাথ) কল্পনাবিলাস বারে বারে ফিরে এসেছে আরো সুমার্জিত এবং নাগরিক হয়ে। তিনি প্রথম দুটি গল্পগ্রন্থে এঁকেছেন জীবন-যাপনের চিত্র, সাহিত্যিক-জীবনের শেষপর্বের গল্পসমূহে ব্যাখা করেছেন জীবনতত্ত্ব। ‘হাতে গল্পের কলম এবং মনে মনীষার প্রেরণা’ — তাঁর ভেতর এই দুটি জিনিসের যুগপৎ সমন্বয় ঘটবার জন্যেই এটি সম্ভব হয়েছে। পরশুরামের রম্যগল্পের অন্তরালে প্রেরণারূপে ক্রোধ অথবা জ্বালা থাকলেও তা হাস্যকৌতুকের কলারীতি অনুযায়ী সর্বদা সৌকুমার্যের সাথে যতোটা সম্ভব সমাহিতই থেকেছে। ফলে শেষপর্যন্ত তা সার্থক কৌতুকের এক চরম ফলপ্রাপ্তি হয়ে উঠেছে ।

‘হাস্যশিল্পী সুকুমার রায়’ নামের এক সুদীর্ঘ (প্রায় ৪৬ পৃষ্ঠা) ও অসাধারণ প্রবন্ধে আবদুশ শাকুর তুলে ধরেছেন বিস্ময়কর রসসাহিত্যিক সুকুমার রায়ের জীবন ও কর্মের খতিয়ান, আর সেইসঙ্গে অভিনবভাবে করেছেন তাঁর যাবতীয় সাহিত্যের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ। লেখক আমাদের দেখিয়েছেন যে, বাংলা সমালোচনা সাহিত্যে সুকুমার রায় বরাবরই খানিকটা উপেক্ষিত ছিলেন, মানে যথোচিত মূল্যায়িত হননি । এর বাইরে তাঁকে নিয়ে যে যৎসামান্য আলোচনা হয়েছে তাতে শুধু সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর বাহ্যিক কৃতিত্বের কথাটাই এসেছে। অথচ শিল্পগুণ, সৌন্দর্যবিবেচনা, শৈলী, বাক্চরিত্র— এসব গুরুত্বপূর্ণ দিক হতে সে-সব রচনার পর্যাপ্ত কোনোবিচারই আসলে কোথাও কখনো হয়নি। তাই উক্ত প্রবন্ধটিতেই প্রথমবারের মতো আঙ্গিকগত দিক থেকে সুকুমার-সাহিত্যের সবিস্তার মূল্যবান আলোচনা করা হয়েছে — এ কথাটি বোধকরি অতিশয়োক্তি বলে গণ্য হবে না । লেখক সুকুমার রায়ের ননসেন্স সাহিত্যের তো বটেই, তাঁর ব্যঙ্গ, ছড়ার সঙ্গে আঁকা আনুসঙ্গিক চিত্র, সাহিত্যের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সাঙ্গীতিক উপাদান ও বৈজ্ঞানিক উপাদান, তাঁর তৈরি করা কাল্পনিক-আজব প্রাণীজগৎ— এরকম বিচিত্র প্রসঙ্গগুলো নিয়েও লেখক এখানে পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করেছেন। আবদুশ শাকুর দেখিয়েছেন. সুকুমার রায়ের নিজের হাতে আঁকা অনবদ্য ছবিগুলোতে রয়েছে মোটমাট তিনটি ‘একান্তই নিজস্ব’ শক্তি: এক. অসাধারণ পর্যবেক্ষণশক্তি, দুই. শিল্পীর অপূর্ব রসবোধ ও তিন. চিত্রে ‘অসম্ভব’ এর উদ্ভাবন।

হাসির রাজা প্রবাদপ্রতিম শিব্রাম ওরফে শিবরাম চক্রবর্তীকে নিয়ে আলোচ্য গ্রন্থে রয়েছে দুটি রচনা। লেখকের ধারণা, বাংলা সাহিত্যে অনেক রথী-মহারথী লেখক হাসির সঙ্গে খুশীর বাতাস বইয়ে দিয়েছেন; কিন্তু শিবরামের আগে কেউই এরকম ‘ছাদফাটানো- রসায়নের হাসি’ নিয়ে আসতে পারেননি। তিনি কখনোই নিছক ভাঁড়ামো করার জন্য গল্প লেখেননি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিবরাম ক্রিটিকরূপে হাসির সৃষ্টি করেন। আবদুশ শাকুরের ব্যাখ্যা : ‘এই তীব্র জীবনজিজ্ঞাসাই নিরন্তর প্ররোচিত করেছে তাঁকে(শিবরাম) সম্পূর্ণ মোহমুক্ত দৃষ্টিতে দেখে চারপাশের জগজ্জীবনের দৈনন্দিনের আটপৌরে ব্যাপারগুলিকেও চুলচেরা কাটাছেঁড়া করতে, তবে তাঁর একান্ত নিজস্ব মিছরির ছুরিটি দিয়ে। প্রয়োজনে প্রচলিত বিশ্বাসের, এমনকি ক্ষতিকর ঐতিহ্যের, ওপরও আঘাত হানতে কুন্ঠিত হন না শিবরাম। ছেড়ে কথা কন না মহাপুরুষদেরও, এমনকি রবীন্দ্রনাথকেও। এ সমস্তর মধ্য দিয়েই এক আলাদা শিবরাম বেরিয়ে আসেন, যিনি নিতান্ত প্রচলিত ধারার গল্প লিখবেন না’ (পৃষ্ঠা ১০৯)। শিবরামের কৌতুককে লেখক অহেতুক ফুর্তিবাদী বলতে চান না, সেগুলোর ভেতর তিনি দেখতে পান প্রতিবাদ— যা আসে বস্তুচেতনা, সমাজচেতনা ও কল্যাণচেতনার মোড়কে। তাঁর রচনাধারার গতিপ্রকৃতি অবলোকন করলে এমন উপলব্ধি হতে পারে যে সেই বাতিকগ্রস্ত বিশ্বে কেবল কচিকাঁচা শিশুরাই স্বাভাবিক। কাজেই শিশুকিশোর-সাহিত্যে শিবরামের আর্বিভাব বাংলাভাষার জন্যে এক বৃহৎ আশীর্বাদই ছিলো বইকি। আর শিশুসাহিত্যে তাঁর আগমনের সাথে সাথে তুমুল জনপ্রিয়তা পাবার মূলে তিনজন আলঙ্কারিকের অবদানের কথাও মনে রাখা জরুরি। কারণ ওই ত্রিমূর্তিই ( শৈল চক্রবর্তী,রেবতীভূষণ ও প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ী)‘না-দেখা পাঠকের সঙ্গে শিবরামের পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছে’। অবশ্য পরিশেষে আবদুশ শাকুর এও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সাহিত্যের ইতিহাসে শিবরাম যেন শুধু ছোটদের লেখক বলেই অপাংক্তেয় না হয়ে থাকেন। যদি তা হয়, তবে বাংলা সাহিত্যের গর্ব করবার মতো একটি পরিপুষ্ট শাখা চিরকাল আমাদের চর্চার-চিন্তার নিতান্ত বহির্ভূতই রয়ে যাবে।

বিচিত্র ক্ষেত্রে বিচরণকারী পণ্ডিত সৈয়দ মুজতবা আলীকে নিয়ে রসিক বাঙালি -তে তিনটি প্রবন্ধ মিলবে। তিনটি রচনার উপজীব্য যথাক্রমে মুজতবা আলীর গল্প, প্রবন্ধ ও রম্যরচনা। তবে আবদুশ শাকুরের আলোচনার কলম কেবল তিনটি বিষয়ের মধ্যে কোনোভাবেই থেমে থাকেনি। সমস্ত মুজতবাসাহিত্য নিয়ে শাকুরের বিশ্লেষণসার এই প্রবন্ধত্রয়ীতে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্পের ভেতরে তিনি একইসাথে খুঁজে পেয়েছেন হাস্যের কোলাহল ও কান্নার কলরোল। তাঁর হাস্যরসাত্মক গল্পগুলিও যেন করুণরসাত্মকও হয়ে ওঠে জুড়িহীন সাবলীলতার সঙ্গে। মুজতবা আলী কল্পনাজাত রচনার চেয়ে বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন শোনা-ঘটনা সঞ্জাত রচনাতেই। শেষমেশ গল্পসংক্রান্ত এহেন বিতর্কিত সংজ্ঞাসঙ্কটকে দূরে রেখেই লেখক আসল কথাটি বলে দিয়েছেন, ‘মুজতবা আলীর যে-কোনো লেখাই যেন একটা আকর্ষণীয় গল্প অথবা ছোটগল্প’ (পৃষ্ঠা ১৪৫)। আবার মুজতবার রম্যরচনা ও প্রবন্ধের বিষয়ে বলতে গিয়ে আবদুশ শাকুর খেয়াল করেছেন যে প্রায়শই তাঁর প্রবন্ধকে রচনা থেকে পৃথক করা যায় না, ‘একদিকে প্রবন্ধ তাঁর ব্যক্তিত্বের যোগে রচনা হয়ে যেতে চায়। আরেকদিকে রচনা তাঁর পাণ্ডিত্যের যোগে প্রবন্ধ হয়ে উঠতে চায়’ (পৃষ্ঠা ১৪৬)। প্রমথ চৌধুরী আর মুজতবার তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে লেখক বলেছেন, প্রমথ হচ্ছেন বৈঠকী মগজমন্থী; আর মুজতবা বৈঠকী মর্মস্পর্শী। গদ্যরচনা প্রসঙ্গে যে ‘আলো-আঁধারি’র কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, মুজতবা আলী হচ্ছেন সেই জিনিসটির প্রকৃত ভাণ্ডারী-সমঝদার। এই ‘আলো-আঁধারি’ দিয়েই তিনি বাংলা ভাষায় সম্পূর্ণ নতুন বর্ণ-গন্ধ-স্বাদের অন্তরঙ্গ রচনাসাহিত্য যোগ করেছেন। আদতে সৈয়দ মুজতবা আলীর পুরো সাহিত্যকর্ম এবং পাণ্ডিত্য বা দার্শনিক উপলদ্ধির মধ্যেই প্রধানত পাওয়া যাবে রমণীয়তা, আর তার কেন্দ্রেই রয়েছে বিশুদ্ধ-খাঁটি হাস্যরস। এজন্যই হাস্যরসের এক অফুরন্ত ডেটা ব্যাংক হয়ে উঠেছেন তিনি, ‘যেখানে পাঠক রসটির সব রকমের ভ্যারাইটিই মজুদ পায়’(পৃষ্ঠা ১৮০)। প্রসন্ন-বিষণ্ণ-বু্দ্ধিবৃত্তি-হৃদয়বৃত্তি — পূর্বসূরীদের সকল বৈশিষ্ট্যই মুজতবা ধারণ করেছেন একটি অ-অনুকরণীয় ভঙ্গিমায়। তাঁর কাছে হিউমার ছিলো বিশেষ, উইট নির্বিশেষ। নির্বিশেষ উইটের ছোঁয়াতেই তিনি কিঞ্চিৎ হালকা জীবনস্মৃতিকেও মহৎ শৈলির নজিরবিহীন শিল্পকৃতির আকৃতিতে অনায়াসে গড়ে তোলেন ।

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের রম্যরচনা সুনন্দের জার্নাল-এ আবদুশ শাকুর দেখতে পেয়েছেন এমন এক হাসির স্পর্শ— যা নির্দিষ্ট কোনো দর্শনের ভার বহন করে না। তার গর্ভে সে কোনো ব্যক্তিক-সামাজিক-রাষ্ট্রিক-সাংস্কৃতিক অন্তর্গূঢ় কষ্ট ধারণ করে না। সে হাসিটি যেন জলের ওপর সর্বদা খেলা করা রোদ অথবা হ্রদের শরীরে চিকচিক করা জ্যোৎস্নার মতো। শাকুর এ প্রসঙ্গটি নিয়ে আরো বলেছেন যে, ‘বঙ্কিমচন্দ্রের হীরকোজ্জ্বল কৌতুকরসের অমূল্য গুণ ব্যাখা করতে গিয়ে এই হাসিটিকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন উজ্জ্বল শুভ্র হাস্য— যা সকল বিষয়কেই আলোকিত করে তুলতে পারে, যার পরশে রচনার সর্বাংশের প্রাণ এবং গতি দীপ্যমান হয়ে ওঠে এবং রমণীয়তা বাড়ে। এই নির্মল হাস্যজনিত কৌতুকরসই এ গ্রন্থে সঙ্কলিত নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সুনন্দর জার্নাল’-নামক রম্যরচনাগুলিকে স্বর্ণোজ্জ্বল করেছে’ (পৃষ্ঠা ১৮৭)। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের রম্যরচনায় পাওয়া যায় অম্ল-মধুর-লঘু-গুরু বহু স্বাদমিশ্রিত এক আয়োজন, বিবিধ বিষয়ের ওপর বিচিত্র ফোড়ন। অনেকটা মুজতবা আলীর মতোই তাঁর এমন স্বাভাবিক পারঙ্গমতা ছিলো যে, মাঝে মধ্যে তাঁর রম্যরচনাকে রসরচনা, ছোটগল্পকে সরসগল্পের থেকে চালুনিবাছুনির মাধ্যমে আলাদা করাটা যারপরনাই মুশকিলই হতো। আর তিনি ছোটদের বড়দের—উভয় আসরেই সমান আদরণীয় হয়েছিলেন তাঁর লক্ষ্যভেদী এবং মার্জিতরুচির কৌতুকের জন্যে।

রসিক বাঙালি-বইটির উপজীব্য-সংশ্লিষ্ট বিধায় গ্রন্থটির অন্তে যোজিত আবদুশ শাকুরের ‘হাস্যরস’ প্রবন্ধটি একই সঙ্গে অসামান্য পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও চরম অর্ন্তভেদী। এতে লেখক অত্যন্ত সুচারুভাবে সাহিত্যে হাস্যরসের পরিচয়,প্রকারভেদ,দর্শন,ভূমিকা ইত্যাদি প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন। এতে বিশ্বসাহিত্যের হাস্যরসের ক্লাসিক ধারাটির সাথে বঙ্গদেশীয় হাসি ও তার পরিচর্যাকারী লেখকদেরও বিস্তারিত খতিয়ান পাঠক পাবেন। আবদুশ শাকুর তাঁর দক্ষ-পরিশীলিত কলমে দেখিয়েছেন কীভাবে ব্যঙ্গ ও রঙ্গ সহোদর ভাইবোনের মতো হয়েও শেষপর্যন্ত আলাদা হয়ে ওঠে। লেখকের এই তুলনাহীন বিশ্লেষণের দীর্ঘ অংশটুকু এখানে উদ্ধৃত না করে পারা গেলো না : ‘প্রসঙ্গত স্মর্তব্য যে ব্যঙ্গ ও রঙ্গ সহোদর ভাই-বোনেরই মতো, চেহারায় সদৃশ হলেও চারিত্র্যে বিসদৃশ। তাই আচরণেই তাদের আলাদা করা যায়, যথা মূঢ়তা-মূর্খতাকে তাড়া করার তীব্রতার মাত্রা দিয়ে। অর্ধপণ্ডিত, অর্থহীন, অসার, ভণ্ড ইত্যাদি হাস্যাস্পদ চরিত্রাবলী উপস্থিত থাকে উভয় আসরেই। তবে ওদের উদাহরণ মারফত অন্যদের শোধনে প্রয়াসী কেবল ব্যঙ্গহাস্যরসাত্মক শিল্পী, যদিও সে-প্রয়াস সততই প্রচ্ছন্ন। তা ছাড়া, উপহাস উভয়েরই প্রধান অস্ত্র হলেও কেবল ব্যঙ্গেই ওটা সংগ্রামপ্রবণ, রঙ্গে নয়— বলেছেন চলতি শতকের কৃতী সাহিত্যসমালোচক নর্থর্প্ ফ্রাই। তাই শ্রেষ্ঠ ব্যঙ্গসাহিত্যিকগণ, যেমন সুইফ্ট, ডাইড্রেন্, বোয়লো, পোপ্, বঙ্কিম, মার্ক টোয়েন, মনসুর, অরওয়েল যখন খুশি হরিসীয় অনুগ্র বিদ্রুপপ্রিয় প্রসন্নব্যঙ্গের স্বনটি অবলম্বন করেছেন। আবার যখন মর্জি তাঁরা জুভিনলীয় তীব্র বিদ্রূপপ্রবণ বিষণ্ণব্যঙ্গের স্বন গ্রহণ করে কৌতুকশিল্পসৃষ্টিতে তৎপর হয়েছেন সেই সীমান্তপথটি ধরে, যে-পথে হাস্যরস অবলীলায় মিশে যায় করুণরসের সাথে।’ (পৃষ্ঠা ২০০)
প্রবন্ধের আরেক অংশে পাওয়া যায় বাংলা সাহিত্যে হাস্যরসের ধারা সর্ম্পকে শাকুরের অভিনব ও পুরোপুরি আনকোরা ব্যাখা : ‘আদ্য বাংলা রচনা চর্যাপদের উপজীব্য একনিষ্ঠ ধর্মচর্চা হাস্যরসের অনুকূল ক্ষেত্র হয়তো ছিলো না। তবু ধর্ম জনগণের ভেতরেই প্রচারের বিষয় বিধায় উদ্ভট উপমা, পরোক্ষ ভাষণ, রসালো প্রবচন প্রভৃতি চমকপ্রদ বাণীবয়নের সুবাদে হাস্যরসের যে-আভাষ চর্যাপদে ফুটে উঠতে দেখা যায়— সে-ই বরং অনুকরণগত স্থূলতা-ছাড়ানো এবং পরিশীলিত শিল্পরূপের অঞ্চল-মাড়ানো মোটামুটি রসোত্তীর্ণ হাস্যের সুদূরতম পূর্বাভাস।। হাস্যরসের ক্ষীণ একটা ধারা নাথ-সাহিত্যেও নিরীক্ষ্য। তবে শিব-সাহিত্যে দ্রষ্টব্য স্থূল ধারাই।’ (পৃষ্ঠা ২১২)

সামগ্রিকভাবে দেখলে, রসিক বাঙালি হয়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যের হাস্যরসের এক নির্মল প্রস্রবণবিশেষ। খানিকটা ধ্যানস্থ হলেই আমরা শুনতে পাই শাকুরের অশ্রুত আহ্বান: ‘এসো, অবগাহন কর,এ রসের নির্ঝরে।’ সাহিত্যের এই আদরণীয় অথচ সমালোচকদের উপেক্ষিত ধারাটি এখানে গভীর মননশীলতার সঙ্গে বিশ্লেষিত। সেদিক থেকে রসিক বাঙালি যেন রসসাহিত্যের ওপর আলোকসম্পাতী একটি তুলনাহীন গ্রন্থ। বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের ইতিহাসেও বইটি একটি মাইল-ফলক হিসেবে বিবেচিত হবে এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায়। আবদুশ শাকুরের উচ্চমার্গীয়,পান্ডিত্যপূর্ণ ও রসগ্রাহী ব্যাখার বাহাদুরি এবং সূক্ষ্ম-প্রসাদগুণসম্পন্ন গদ্যভাষা সত্যিই স্বকীয়তায় ভাস্বর। রসসাহিত্যের প্রতি তাঁর যে নিখাদ ভালোবাসা, আত্মনিবেদন রয়েছে তা উক্ত বইটির দ্বারাই প্রমাণিত হয়।

‘রসের রসিক না হলে কে গো জানতে পায়’— লালন সাঁইয়ের গানের এ চরণটি অনন্যসাধারণ রসসাহিত্যস্রষ্টা আবদুশ শাকুর সর্ম্পকে খুবই মানানসই। রসিক বাঙালি থেকে রসগ্রহণের চেষ্টা করতে গিয়ে মনে হলো এটি কমদামে অধিক বিকোনো হালকারসে চুবানো গরম জিলাপি নয়; গাঢ় রসে ডুবানো মালাই বিশেষ—যার স্বাদ পেতে হলে পাঠককেও হতে হবে কড়াপাকের। তাঁকে পড়তে হবে একনিবিষ্ট মনে, গভীরচারী অন্বেষণ সহযোগে। অন্যকথায়, আবদুশ শাকুরের লেখার রসাস্বাদনের জন্যে পাঠশ্রমের উচ্চমূল্য দিতেই হবে।

রসিক বাঙালি ।। আবদুশ শাকুর।। ফেব্রুয়ারি ২০০৯।। ঐতিহ্য, ঢাকা।। প্রচ্ছদশিল্পী: ধ্রুব এষ।। ২২৪ পৃষ্ঠা।। ২৮০ টাকা।।

লেখক:
======
দিগন্ত চৌধুরী
======


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

শাকুর সাহেব নিজেও দারুণ রসিক।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

রসসাহিত্য নিয়ে ইদানিংকালের লেখকেরা মনে হয় তেমন একটা ভাবছেন না। এ বিষয়ে যদিও খুব একটা খুঁটিয়ে পড়া হয়নি, আগে সুকুমার বড়ুয়া ছিলেন কিন্তু বর্লুতমানে লুৎফর রহমান রিটন ভাই ছাড়া তেমন কাউকেই নিয়মিত দেখতে পাইনা। অত্যন্ত সিরিয়াস বিষয়গুলো নিয়ে রিটন ভাই যেভাবে রসালো করে লেখেন তা অতুলনীয়, অন্তত সমসাময়িকতার বিবেচনায়। আরেকটা বিষয় মনে হলো, রসবোধের মাত্রা ব্যাক্তি থেকে ব্যাক্তিতে ভিন্ন। তাই একই ধরনের বিষয় হয়তো সকলের ভালো লাগতে না'ও পারে। কিন্তু যদি সুকুমার রায়ের কথা বলেন, তার লেখাগুলো ছিলো সবার কাছে সুখপাঠ্য অন্তত যত মানুষকে পড়তে দেখেছি। আপনার বিশ্লেষণ ভালো লেগেছে।

আমাদের শৈশবে দেখেছি উপশহর বা গ্রামগুলিতে রসসাহিত্য বলতে সাধারনত সেই গোপাল ভাঁড় বা নাসিরুদ্দিন হোজ্জার কিংবদন্তীসম ইমেজ যদিও তাদের গল্পগুলো ছিলো নিছকই কৌতুক এবং মোরালের পরিমান অতি অল্প। কিন্তু সেই কৌতুকগুলো কিন্তু আজও মানুষ উপভোগ করে।

পারিশেষে লেখকসমাজের কাছে আমারেআবেদন, সাহিত্যের এই ধারাটা যেনো হারিয়ে না যায় সেদিকে আপনারা সচেষ্ট হোন।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

চরম উদাস এর ছবি

চলুক

রস সাহিত্য আসলেই কমে যাচ্ছে দিনদিন।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

চলুক
ভালো রিভিউ।

তারেক অণু এর ছবি

(গুড়) চলুক

জহিরুল ইসলাম নাদিম এর ছবি

ভালো লাগলো। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

কল্যাণ এর ছবি

চিন্তিত

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

ভালো লেগেছে। বইটা সংগ্রহ করব। এ বিষয়ে লেখার জন্য আপনাকে একরাশ আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।