চার দেয়ালের ভিতর থেকে বৃষ্টি উপভোগ...

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২৭/০৪/২০১২ - ১০:৪৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হাঁসগুলো প্যাঁক প্যাঁক ডেকেই চলেছে অবিরাম। বাইরে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমার বাসার পাশের প্লটটা এখনও খালি। সেখানে এককোনায় ছাপড়া তুলে বসবাস করে একটি পরিবার। আমেনা’র মার পরিবার। নামটা জানি, কারন প্রায়ই ঐ আমেনার মায়ের চিৎকার শোনা যায় । আমেনা, আমেনা বলে বিরামহীন ডাক । আমেনা নামের পিচ্চি মেয়েটা মনে হয় একটু দুষ্টু কিছিমের। তাই এই নিত্ত ডাকাডাকি। ঐ পরিবারের অন্য সদস্যের মধ্যে আছে অনেকগুলো পাতিহাঁস আর রাজহাঁস।

অন্য সাধারন দিনের বিকেলটা ঐ খালি প্লটের জায়গাটায় বাচ্চা পোলাপানের খেলা আর চিৎকার- চেঁচামেচিতে মুখরিত থাকে। তাই হাঁসগুলো এককোনায় গুটিসুটি মেরে থাকে। কখনও দলবলসহ আস্তে আস্তে রাস্তায় উপর উঠে আসে, আবার গাড়ি চাপা পড়ার ভয়ে ফিরে যায় তাদের ছোট্ট ডেরায়। আজকের বৃষ্টিটা তাদের জন্য এসেছে আশীর্বাদ হয়ে। পোলাপানগুলো বৃষ্টিতে মাঠে নামেনি, তাই পুরোদস্তুর মাঠটাই এখন তাদের দখলে। চলছে হাঁসদের জলকেলির মহোৎসব আর সাথে অবিরাম প্যাঁক প্যাঁক ডাকাডাকি। হাঁসেদের মাতৃভাষা ‘প্যাঁক প্যাঁক’ শিখতে বা বুঝতে পারলে বেশ হত। আনন্দ টা ভাগাভাগি করা যেত । আফসোস !!

৫ম তলার বারান্দায় বসে হাঁসদের উৎসব দেখতে বেশ মজাই লাগছে। পাশ ফিরে দেখি, গ্রিলের ফাঁক গলিয়ে হাত বাড়িয়ে একটু বৃষ্টির স্পর্শ নেবার চেষ্টায় পাশের বাসার ছোট্ট মেয়েটা। বৃষ্টির ফোঁটার স্পর্শ আর তার মুখের হাসি সমানুপাতিক হারে বাড়ছে। মুগ্ধতা তার সারা মুখজুড়ে। আমিও মনের অজান্তেই গ্রিলের ফাঁক গলিয়ে হাতটা বাড়াই, সাথে সাথে কয়েকফোঁটা বৃষ্টি স্পর্শ করে হাত। বেশ ঠাণ্ডা জলের ফোঁটা ।

সামনের রাস্তায় দেখি কয়েকটা ছেলে ফুটবল নিয়ে নেমেছে। রিক্সাগুলো হুটতুলে, পর্দা লাগিয়ে যাচ্ছে পাশ কাটিয়ে। একটা রিক্সা আবার চলছে হুট খুলেই , যাত্রী দুজন বেশ আয়েশ করেই ভিজছে। আমার মনে হল, আচ্ছা ওদের সাথে কি মুঠোফোন নাই ? মুঠোফোনের জীবনটা কিভাবে বাচাচ্ছে ওরা ! জানতে ইচ্ছা করে। অনেকের মানিব্যগে দেখেছি ছোট্ট একটা পলিব্যাগ ভাঁজ করে গোঁজা থাকে। এটা বৃষ্টি সতর্কতা । হঠাৎ বৃষ্টি আসলে ঐ পলিব্যাগে মুঠোফোন ঢুকিয়ে একেবারে নিশ্চিন্ত। কিন্তু আমার কেন জানি এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়ে ওঠে নাই কখনো। হঠাৎ বৃষ্টি আসলে তাই আশেপাশে ঝাঁপড়া খুঁজি, খুঁজি দোকানের বারান্দা কিম্বা প্রিয় টং দোকানের ঝুঁপড়ি।

সামনের বাসাটার ছাদের দিকে চোখ পড়তেই যা দেখছি, তা আসলে বড়ই মনোরম। যেমনটি নাটক-সিনেমায় দেখা যায়। একযুগল প্রেমিক-প্রেমিকা অথবা নবদম্পতি হাত ধরাধরি করে ছাঁদে বৃষ্টিতে ভিজছে। আহা ! বেশ রোমান্টিক অবস্থা। বেহায়ার মত এই দৃশ্য অবলোকন করা মোটেও শোভন নয়। তাড়াতাড়ি দৃষ্টি অন্যদিকে প্রদান করাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে হয়।

অন্য একটি বাসার ছাঁদে দেখি দুইটি ছেলে ভিজে ভিজে ক্রিকেট খেলছে। ঐ ছাঁদটার অর্ধেকটা জুড়ে বিভিন্ন গাছে পরিপূর্ণ । বাড়ির মালিক বেশ গাছ প্রেমিক বলেই মনে হয়। ছাদের বাকি অর্ধেকটায় প্রায়ই দেখি দুইটা ছেলে ক্রিকেট খেলে। এত অল্প জায়গায় ক্রিকেট খেলার যে কায়দাটা তারা রপ্ত করেছে, সেটা এক বিস্ময়। কখনও দেখিনি ক্রিকেট বল লাফিয়ে ছাদ থেকে নিচে পড়েছে। আজ তারা ভিজে ভিজেই খেলছে। চশমার কাঁচে বৃষ্টির ফোঁটা জমে যাচ্ছে তাই কিছুক্ষন পরপর চশমা খুলে গেঞ্জিতে মুছতে হচ্ছে। তাই বলে কি খেলা বন্ধ করে দেবে ? প্রশ্নই ওঠে না ! খেলা তো চলবেই।

ছোটবেলায়, এরকম বৃষ্টিতে আমাদের বাড়ির উঠানটা চরম পিচ্ছিল হয়ে গেছে। আমরা পিচ্চিরা বৃষ্টি হলে সেখানেই সড়াৎ -সড়াৎ খেলেছি। একটু দৌড়ে এসে পিচ্ছিল জায়গায় এসে হাল ছেড়ে দিলে পিছলা খেয়ে সড়াৎ করে চলে গেছি অনেকদুর। কে কার চেয়ে বেশি যেতে পারে সেটাই হচ্ছে খেলা। এই খেলায় মাঝে মাঝে কন্ট্রোল হারিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছি। কখনো সখোনো পায়ে থেকেছে ফুটবল। ফুটবলে একটা লাথি মেরেছি কি মারি নাই, তার আগেই গোটা কয়েক চিৎ-পটাং নাটক হয়ে গেছে।

খেলা শেষে সারা গায়ে এত বেশি কাদায় মাখামাখি যে সেটা ধুয়ে মুছে সাফ করার জন্য বৃষ্টির ফোঁটা যথেষ্ট নয়। তাই নাইতে গেছি বাড়ির সামনের নদীতে আবার কখনও বাড়ির ভিতরের পুকুরে। বৃষ্টিতে নাইতে নেমে সাঁতরিয়ে বেশ কিছুদুর চলে গেছি। তারপর চিৎ হয়ে আকাশপানে মুখ করে আছি। চোখ বন্ধ , বৃষ্টির ফোঁটাগুলো সরাসরি পড়ছে মুখের উপর, চোখের পাতার উপর । অভূতপূর্ব সেই ক্ষণ। মাঝে মাঝে মুখ খুলে নিয়েছি বৃষ্টির ফোঁটার স্বাদ ।

বৃষ্টিতে সাবান দিয়ে নাইতে গিয়ে হয়েছে এক চরম ফ্যাঁসাদ। সাবানের ফেনা তো আর কাটে না।যতই পানি ঢালি একটু ফেনা ফেনা ভাব থেকেই যায় শরীরে। গোসল সেরে মরিচ-পিঁয়াজ আর সর্ষে তেলে মাখানো মুড়ি। এখনও জীভে জল এসে যাচ্ছে।

যখন আরেকটু ছোট, তখন এমন বৃষ্টির সময় দাদাজানের পাশে শুয়ে রাজ্যের গল্প শুনেছি। এমন দিনে গল্পগুলো ঠিক কি রকমের হত সেটা মনে করার চেষ্টা করছি কিন্তু ঠিক মনে পড়ছেনা। শুধু মনে পড়ছে কাঁথা গায় দিয়ে বেশ গুটি-শুটি মেরে দাদাজানের গা ঘেঁসে শুয়ে আছি। মাঝে মাঝে দাদাজানও আবদার করেন। তার দশটা পাঁকাচুল উঠিয়ে দিতে পারলে তবেই তিনি একটি নতুন গল্প বলবেন। মহা-উৎসাহে পাঁকাচুল উঠাতে লেগে গেছি। গুনে গুনে দশটি পাঁকাচুল তার হাতে দিলেই গল্প শুরু। তবে এই দশটি পাঁকাচুল উঠাতে গিয়ে কয়টা কাঁচাচুল উঠিয়েছি সেটা বেমালুম চেপে গেছি।

আশেপাশে বৃষ্টি দেখাটা কিন্তু শেষ হয়নি। ঐযে শেষ যে ছাঁদে ক্রিকেট খেলা চলছিল, সেখান থেকে আবার নিচের দিকে চেয়েছি। বৃষ্টিতো চলছেই অবিরাম। আমার বাসার আশেপাশের বেশ কয়েকটা খালি প্লটে ছাঁপড়া করে কিছু পরিবার থাকে। সবগুলো ছাপড়া ঘরেই দেখছি পানি ঢুকে যাচ্ছে। ওয়াসাও চরম বেরসিক। রাস্তার একপাশ কেঁটে-কুঁটে শেষ করে রেখেছে । জলে কাদায় একাকার অবস্থা। সবমিলিয়ে সব নোংরা পানি ঢুকছে তাদের ঘরে। তারা অক্লান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে তা ঠেকাবার।

ভাবছিলাম, বৃষ্টিটা আরও কয়েক ঘণ্টা আগে হত, তাহলে হয়ত দুষ্কৃতকারীরা আগুন দিতে পারত না ঐ বাসটায়, যেই বাসের ভিতর ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত ড্রাইভার বদর আলী ঘুমাচ্ছিল। এই ঘুমই হত না তার শেষ ঘুম। দুঃখিত বদর আলী। আমরা বড়ই দুর্বল, আমরা শুধুই দুঃখ প্রকাশ করতে পারি। ওরা আমাদের নিয়ে খেলছে।

বৃষ্টি তোকে বড় ভালবাসি। তুই কি পারবি , ধুয়ে মুছে পবিত্র করে দিতে আমাদের এই আবাসভূমি ?

পাদটীকা ঃ লেখাটা লিখেছি ২১/০৪/২০১২ ইং তারিখে যেদিন বদর আলীকে পুড়িয়ে মারা হয়। এর তাই বদর আলীর ঘটনাটা এসেছে। আজকে টিভিতে বদর আলীর পরিবার নিয়ে একটা প্রতিবেদন দেখাচ্ছিল। তাদের ভাষ্যমতে কেউ তাদের খোঁজ নেয়নি। না সরকার, না বিরোধীদল। এমনকি যে পরিবহণ কোম্পানিতে সে চাকরি করত তারা পর্যন্ত কোনও খোঁজ নেয়নি। সত্যিই, বিচিত্র এই দেশ আর আরও বিচিত্র আমরা।

ঃঃঃ স্বপ্নখুঁজি ঃঃঃ


মন্তব্য

কল্যাণ এর ছবি

চলুক মন খারাপ

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

স্বপ্নখুঁজি এর ছবি

পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

অমি_বন্যা এর ছবি

আপনার লেখাটি পড়ে ছোটবেলায় বৃষ্টি স্নানের কথা মনে পড়ে গেলো। ওই সময় বাসায় কারো একটু জ্বর বা কেউ একটু অসুস্থ হলে কদর বাড়ত। আর সেজন্যই বৃষ্টিতে ভিজে পুকুরে দুব দিতাম তাহলে নাকি জ্বর আসে। আর জ্বর আসা মানেই তো বাড়তি মনোযোগ আকর্ষণ সবার। সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেলো।

স্বপ্নখুঁজি এর ছবি

বৃষ্টি নিয়ে সবারই এত-শত ঘটনা, যার কোনও শেষ নাই। আপনাকে তার কিছুটা মনে করিয়ে দিতে পেরে ভালো লাগলো।

পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

কুমার এর ছবি

চলুক

স্বপ্নখুঁজি এর ছবি

পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

বৃষ্টির রঙ এর ছবি

আমরা ছোটবেলায় বৃষ্টি শুরুর আগে আগে, ঘন কালো মেঘের দিকে তাকিয়ে পরী খুঁজতাম। কে যেন একবার বলেছিল যে মেঘের ভাঁজে ভাঁজে পরী উড়ে যায়।

স্বপ্নখুঁজি এর ছবি

ইশ! আমাকে তো কেউ কখনও পরী খোঁজার কথা বলেনি। তাহলে তো আমিও মেঘের ভাঁজে ভাঁজে পরী খুঁজতাম।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

বৃষ্টির বর্ণনা বেশ ভালো লাগলো পড়তে। ঢাকায় সবচেয়ে যেটা মিস করি, তা হলো টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ। পাহাড়ে বৃষ্টি দেখার খুব ইচ্ছা আমার। হয়ত কখনও হবে সেটা...

লেখার শেষ অংশ পড়ে খারাপ লাগলো। আশা করি এসব ঘটনা আর ঘটবে না। হয়ত সত্যি হবে না এটা, তবুও আশা করতে দোষ কী!

স্বপ্নখুঁজি এর ছবি

একদম ঠিক আমিও যেটা সবচেয়ে মিস করি সেটা হল টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ। সত্যিই অসাধারণ, এর সাথে কিছুর তুলনা নাই। ঝমঝম, টিপটিপ কিম্বা মুষলধারে যেভাবেই নামুক বৃষ্টি প্রত্যেকটার একটা আলাদা সুর আছে টিনের চালে।
পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

বনের রাজা টারজান এর ছবি

ভালো লেগেছে।
আমিও বৃষ্টি খুব ই ভালবাসি।
বৃষ্টির খণ্ড খণ্ড দৃশ্য ভাল লাগলো।

স্বপ্নখুঁজি এর ছবি

পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

তাপস শর্মা এর ছবি

ছুঁয়ে গেছে লেখাটা। চলুক অনুভূতিগুলো চোখের সামনে মনে হয় ভেসে উঠে। অফুরন্ত বৃষ্টির ঝাপটার আশায়।

স্বপ্নখুঁজি এর ছবি

অনুভূতিগুলো এমনই হয়। ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় বৃষ্টির ঝাপটার মত।
পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

রিম ঝিমঝিমম বৃষ্টি, খুবই ভালো লাগলো।

স্বপ্নখুঁজি এর ছবি

আপনার ভালো লাগাতে এই অধমেরও ভালো লাগলো।
পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

হঠাৎ করে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে, আপনার লেখাটা মিস করে গেছিলাম।
এখন মেক আপ দিতে গিয়ে পড়ে ফেললাম। চোখ টিপি

ভাল লাগল আপনার বর্ণনা।
বহু কথা মনে পড়ে গেল।

স্বপ্নখুঁজি এর ছবি

আমিও হঠাৎ অনেক ব্যস্ত হয়ে গেছিলাম, তাই সচলে ঢুঁ মারা হয় নাই। আজ ঢুকে ভাবলাম, দেখিত লাস্ট লেখাটার কি অবস্তা । দেখি আপনার কমেন্ট। যারপরনাই প্রীত হইলাম।
ভাল থাকবেন। শুভকামনা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।