শৈশব কৈশরের দিনগুলি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ১২/০৫/২০১২ - ৩:৪২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কয়েকদিন ধরে মনটা খুব অস্থির হয়ে আছে। কেন অস্থির হয়ে আছে সেটা বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছি। যতই দিন যাচ্ছে মনে হচ্ছে ততোই জীবনটা একটু একটু করে জটিল হচ্ছে। আজকাল একটা প্রবাদ সবসময় মনে পড়ে, যায় দিন ভালো আসে দিন খারাপ। ব্যাপারটা সবার জন্য হয়ত না। তবে মনে হয় জীবনের একটা পর্যায়ে গিয়ে সবারই এরকমটা মনে হয়। আজকাল শৈশব কৈশরের কথা মনে করে ভীষন হিংসা হয়। সেই উদ্দাম দুরন্ত দিনগুলোকে ফিরে পেতে মনটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। সেটা এমন একটা সময় ছিল, যখন গভীর চিন্তাভাবনা ছাড়াই কোন কিছু করে ফেলা যেত। এখন এমনকি একটা ফুল গাছ লাগানোর কথা মাথায় আসলেও নানা রকম চিন্তায় সেগুলো কেমন যেন পরির্বতিত হয়ে যায় বা ভেস্তে যায়।

আমার কৈশরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো কেটেছে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা শহরগুলোতে। বাবার সরকারী চাকরীর জন্য এখানে ওখানে করে অনেক জায়গায় থাকা হয়েছিলো। তবে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে বাগেরহাটের দিনগুলোর কথা। আমি যখন বাগেরহাট যাই তখন আমি ক্লাস এইটের ছাত্র। সময়টা ছিল বছরের মাঝামাঝি। বাবা হঠাৎ একদিন বললো বদলী হয়ে গেছি, বাগেরহাট যেতে হবে। আমি তখন ভাবলাম কি স্বেচ্ছাচারিতা! বললেই হল! আমার এখানকার বন্ধুবান্ধবকে ছেড়ে আমি যাব না। বাবাকেও বললাম কথাটা। সে বুঝালো ওখানে নতুন বন্ধু হবে। তাহলে পুরোনো বন্ধুদের কি হবে? বাবা বললো যাদেরকে তোমার ভালো বন্ধু মনে করো তারা তো তোমার বন্ধুই, হাজার মাইল দূরে গেলেও তারা বন্ধুই থাকবে (আশ্বার্য্যজনকভাবে প্রায় তেরো বছর পরে আমার অতি প্রিয় একজন শিক্ষক ঠিক একই কথা বলে আমাকে সাড়ে পাঁচশ মাইল দূরে নিয়ে এসেছেন)। যাইহোক আসলাম বাগেরহাট এ। যাওয়ার দ্বিতীয় দিনের মাথায় আমাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া হলো। হেডমাস্টারের সাথে মনে হয় আগে কথা বলা ছিলো। সাধারনত সরকারী চাকরীজীবিদের ছেলেমেয়েরা সরকারী স্কুলগুলোতে বছরের মাঝেও ভর্তি হতে পারে। হেডমাস্টার মশাই দেখলাম ভীষন জাদরেল। আগের স্কুলে (সরকারী বিজ্ঞান কলেজ) ভালো ছাত্র হিসাবে আমার একটা সুনাম ছিল। কিন্তু ইনি দেখি আমাকে পাত্তাই দিচ্ছেন না। ভাবলাম না দিক, সমস্যা নাই। সময়মত দেখায় দেব। কিন্তু হঠাৎ বলে দিলেন তুমি নতুন এসেছো জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা আমাদের স্কুল থেকে দেয়া যাবে না। স্কুল থেকে যারা পরীক্ষা দেবে তাদের ১০০% ছেলেকে বৃত্তি পাইতে হবে। সুতরাং তুমি আগে দেখাও তুমি পরীক্ষা দেয়ার উপযুক্ত। বলেই সেকেন্ড টার্মিনালে একটা প্রায় অসম্ভব টার্গেট দিয়ে দিলেন। একে তো পুরানো মানুষগুলোকে ছেড়ে এসে যন্ত্রনায় ছিলাম এরসাথে যুক্ত হলো আরেক বিপদ। অনেক কষ্টে প্রমান করলাম আমি পরীক্ষা দেওয়ার উপযুক্ত। আমাকে পাঠানো হল জুনিয়র বৃত্তি সেকশনে যেখানে স্কুলের ক্লাস এইটের সবচেয়ে ভালো ছাত্ররা বছরের শুরু থেকে আছে। এদের বৃত্তি পরীক্ষার পাঁচটা বিষয় ছাড়া আর কিছু পড়া লাগে না। মনে হল ভালই তো, আজাইরা কিছু সাবজেক্ট কমে গেল।

আমাদের স্কুলের ঠিক সামনেই একটা পুকুর ছিল। পুকুরটার একপাশে ছিল আবাসিক ছাত্রদের হোস্টেল। আরেকপাশটা জুড়ে ছিলো বাগান। স্কুলের মূল ভবনটার ঠিক সামনে একটা মাঠ ছিল। ওখানে রোজ সকালে আমাদের এসেম্বলী হত। ছোটবেলার সেই শপথ পাঠ, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া এখন খুব মিস করি। আমাদের পিটি স্যারের প্রতিদিন সকালের কাজ ছিলো কে কে ঠিকমত ইউনিফর্ম পরে আসেনি সেটা খুজে বের করা। অভিযুক্ত কাউকে পাওয়া গেলেই শাস্তি। শাস্তিটা হল একটি করে বেত্রাঘাত। অভিযুক্তদের বেশিরভাগই দেখা যেত কেডস না পরে স্যান্ডেল পরে আসার জন্য শাস্তি পেত।

ক্লাস নাইনে উঠে হঠাৎ করে কলম খেলার একটা ঝোক আসলো সবার মধ্যে। স্কুল লাইফে কলম খেলার সাথে পরিচয় হয়নি এমন মানুষ মনে হয় কমই আছে। তারপরও যাদের সেই খেলার সাথে পরিচয় নেই তাদের জন্য বলি, এই খেলার নিয়ম হল টেবিলের উপর কয়েকজন মিলে নিজের কলম নিয়ে অনেকটা ক্যারম খেলার স্টাইলে ফাইট করতে থাকবে। যার কলম শেষ পর্যন্ত টেবিলে থাকবে সে বিজয়ী। হঠাৎ করে কেন এইখেলার নেশা সবার মধ্যে উদয় হল তা কে জানে। আমাদের ক্লাস শুরু হত সকাল ১০টা থেকে। আমরা ৯টার মধ্যে স্কুলে গিয়ে স্যারের টেবিলে কলম নিয়ে হাজির। আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে টেবিলে জায়গা বরাদ্দ চলতো।

সেসময় আমার দিনের সবচেয়ে প্রিয় সময়টা ছিলো বিকালবেলা। কারন বিকাল মানেই মাঠে ক্রিকেট অথবা ফুটবল খেলার সময়। বেশিরভাগ সময় নিজেদের মধ্যে দল করে খেলতাম। তবে মাঝেমাঝে অন্য ক্লাসের সাথে ম্যাচ হত যেগুলো ছিল খুবি প্রেস্টিজের ম্যাচ। সেই খেলা আর খেলার সঙ্গীদের কথা মনে করলে এখনও মনে হয় একটা টাইম মেশিন থাকলে মন্দ হত না। বর্ষাকালে ঝুম বৃষ্টিতে ফুটবল খেলার যে কি মজা সেটা বলে বুঝানো সম্ভব না। আজ এই প্রবাস জীবনে বৃষ্টি দেখে ভাবি কতদিন যে বাড়িতে না বলে, প্রাইভেট স্যারের পড়া ফাকি দিয়ে মাঠে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলেছি। পরে বাসায় এসে মার কাছে বকা খেয়েছি হাজারবার, কিন্তু কিছুই যেন দমিয়ে রাখতে পারেনি শৈশবের দুরন্তপনাকে।

আমাদের স্কুলের সবচেয়ে রাগী টিচার ছিলেন শাহনাওয়াজ স্যার। ক্লাস নাইন-টেন এ তিনি আমাদের ফিজিক্স ক্লাস নিতেন। তখন আমরা সবে এইট থেকে নাইনে উঠেছি। একদিন সকালে হঠাৎ করে কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম আজকে স্কুল পালাব। কিন্তু ক্লাসের কতিপয় ছাত্র যারা নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকে তাদেরকে একসঙ্গে না দেখলে স্যাররা নিশ্চিত সন্দেহ করবেন। তাছাড়া কয়েকজন স্যার ইতিমধ্যে কয়েকজনকে দেখেছেন যে তারা স্কুলে এসেছে। কিছুটা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পাওয়া গেল। যা আছে কপালে বলে বের হয়ে গেলাম। সারাদিন এখানে সেখানে ঘুরলাম। একসাথে বসে আড্ডা দিলাম। পরের দিন দেখি ক্লাস টিচারের বদলে প্রথম ক্লাসে আসলেন শাহনাওয়াজ স্যার। যা বুঝার বুঝে গেলাম। আর উপায় নাই, ধরা খেয়েছি। স্যার সুন্দর করে পলায়নকারি ছাত্রদের নাম ডেকে সামনে এনে বললেন প্রত্যেকে দুইটা করে বেতের বাড়ি খাবি। ঠিক কর কে কোথায় খাবি, হাতে খাবি না পাছায় খাবি। এই বুড়োমানুষটার হাতে এত জোর কিভাবে আসে সেটা ভেবে খুব অবাক হয়েছিলাম। স্কুল পালানোর শখ সেদিনি মিটে গিয়েছিল। উল্লেখ্য শাহনাওয়াজ স্যার ছিল স্কুলে আমার সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক। কারন কঠোরতার ভিতরে তাঁর একটা নরম মন ছিল যা একজন বাবার সন্তানের জন্য থাকে। শাহনাওয়াজ স্যারের নিজের কোন ছেলেমেয়ে ছিল না। হয়ত সেকারনেই প্রতিটা ছাত্রকে নিজের ছেলের মত শাসন করতেন এবং ভালোবাসতেন।

লিখতে বসে এরকম হাজার হাজার ছোট ছোট ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। কিছু ঘটনা অনেক মজার কিন্তু বলা যাচ্ছে না। সবকিছু লিখতে গেলে হয়ত মাসের পর মাস চলে যাবে তারপরও মনে হবে ওহ ওইটা তো বলা হল না। সেদিনগুলোর কথা যখনি মনে আসে শুধু বুকের মাঝে কোথায় যেন কিছু জায়গা খালি মনে হয়। মানুষকে যদি যেকোন ইচ্ছে সত্যি করে পাওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হত, শৈশবকে আরেকবার পাওয়ার ইচ্ছেটা সবাই তালিকার উপরের দিকেই রাখত।

(জাদুকর)


মন্তব্য

পুেপ এর ছবি

সে জানত ; সবাই জানে শৈশবে আর ফেরা যায়না । সুনীল >পাহাড় চূড়ায় ।

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

মানুষকে যদি যেকোন ইচ্ছে সত্যি করে পাওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হত, শৈশবকে আরেকবার পাওয়ার ইচ্ছেটা সবাই তালিকার উপরের দিকেই রাখত।

পূর্ণ সহমত । চলুক

লেখাটা ভাল লাগল।

কলম খেলার কথা বলে কত কথা মনে করিয়ে দিলেন ভাই।
এক একজন তো এ নিয়ে গবেষণা করে পি,এইচ,ডি করে ফেলেছিল। কারওটাতে গার্ডার লাগানো, কারও কলমের মাথায় আবার বালি ভরা। উফ্‌, কী সুন্দর সেই দিনগুলো।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

এই প্রৌঢ় বয়সে তো শৈশব, কৈশোরের স্মৃতিগুলোই বেশী নাড়া দেয়। ভালো লাগলো আপনার স্মৃতিচারণ।

জাদুকর এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ।

আসমা খান, অটোয়া এর ছবি

চমৎকার স্মৃতিচারন। ফেলে আসা শৈশবের সেই দিন গুলি এত মধুর হয়, বার বার ফিরে যেতে ইচ্ছেই করে সেই সব দিনে।

জাদুকর এর ছবি

সত্যিই তাই!

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

বেশ ভালো লাগলো। আমাদের সবারই শৈশব-কৈশোরের কিছু স্মৃতি মনে হয় মিলে যায়। সময় করে লিখুন আরও।

জাদুকর এর ছবি

ধন্যবাদ। চেষ্টা থাকবে।

বন্দনা এর ছবি

আপনার স্কুল্বেলার গল্প বেশ লাগ্লো। সবারি বোধহয় স্কুলবেলার এমন কিছু স্মৃতি আছে। কেমন নস্টালজিক লাগে মনে হলেই, ফিরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই স্কুলবেলায়।

জাদুকর এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।

Jui Mony Das এর ছবি

কি অদ্ভুত না- যে জীবনটা নিয়ে আমাদের এত লাফালাফি এর কোনকিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রনে নেই.........ফিরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাই বোধ হয় জবিন মানেই অন্তহীন এগিয়ে যাওয়া..... কেমন একটা সোঁদামাটির গন্ধ এসে লাগল এই আটপৌরে যাপিত জীবনে............

জাদুকর এর ছবি

আসলেই ফিরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

লেখা ভালো লেগেছে চলুক
কিন্তু আমি আমার শৈশবে যেতে চাই না, স্কুলে যেতে চাইলা। আমি পালিয়ে যেতে চাই এই যাপিত জীবন থেকে।

শাব্দিক এর ছবি

কলম খেলার মনে পড়তে হাসি পেয়ে গেল। কি এক নেশা ছিল।
লেখা চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।