কুকুর চুরি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৭/০৫/২০১২ - ৩:০৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হঠাৎ করেই আমাদের লাল কুররটা বদহজমে মরে গেল। কুকুরটা সবার এতো প্রিয় ছিল যে, সিদ্ধান্ত হলো- আবার কুকুর পুষলে সেটা লাল রংয়েরই হবে। তো আমি আর আমার ছোট ছোট সব চাচতো ভাইয়েরা শীতকালের অপেক্ষায় রইলাম- শীতকালে নেড়ি কুকুরগুলো বচ্চা দেয় কিনা।

হঠাৎ করেই আমাদের লাল কুররটা বদহজমে মরে গেল। কুকুরটা সবার এতো প্রিয় ছিল যে, সিদ্ধান্ত হলো- আবার কুকুর পুষলে সেটা লাল রংয়েরই হবে। তো আমি আর আমার ছোট ছোট সব চাচতো ভাইয়েরা শীতকালের অপেক্ষায় রইলাম- শীতকালে নেড়ি কুকুরগুলো বচ্চা দেয় কিনা।

বর্ষা শরত হেমন্ত শেষ করে অবশেষে এলো শীত । কুকুরের তুলতুলে ছানায় ভরে উঠল পাড়ার গোলাঘর, পাটখড়ি, বিচালি গাঁদার তলাগুলো। আমারাও মহা শোরগোলে কুকুর ছানার খান-তল্লাশে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কিন্তু কোথাও ঠিক আমাদের আগের কুকুরটার মতো লাল রংয়ের ছানা মিলল না। যদিওবা দু-একটা মিলল তার কোনোটাই মর্দা নয়, মাদি। হয়রাণ হয়ে অবশেষে যখন খোঁজাখুঁজির চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছি, ঠিক তখনই একদিন চাচাতো ভাই ফিন্টু এসে জানালো ডোমপাড়ায় দুটো লাল বাচ্চা দেখে এসেছে এবং দুটোই মর্দা। তখন আমাদের আনন্দ আর দেখে কে!

কিন্তু শূধু আনন্দ করলে তো আর চলবে না, একটাকে তো ধরে আনতে হবে! সম্যসা হচ্ছে ডোম পাড়া থেকে আমাদের পাড়ার দূরত্ব এক মাইলেরও বেশি, তাই ইচ্ছে করলেই যখন-তখন ধরে আনা যায় না। তাছাড়া কুকুর ছানাগুলো যে বাড়ির সে বাড়ির ছেলেরাই বা ধরে আনতে দেবে কেন? যদিও এসব কুকুরছানার বেশিরভাগই শেয়ালের পেটে যাবে আর বাকিগুলো পরে বেওয়ারিশ হয়ে পথে পথে ঘুরবে- অতএব চুরি করতে হবে!

আমরা বৈঠকে বসলাম। ফিন্টু জানালো- সকাল আটটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্তই নাকি উপযুক্ত সময়। এ সমেয়ে ডোমপাড়ার পুরুষেরা শুকোরের পাল চরাতে বের হয় আর মহিলারা কুলো চ্যাঙারি ফেরি করে বেড়ায় এগ্রাম থেকে সেগ্রামে।

পরদিন সকালেই আমরা ডোমপাড়ায় হাজির। আমাদের সাননে দিয়েই ডোমপাড়ার নারী-পুরষেরা বেরিয়ে গেলো যে যার কাজে। সূর্য কেবল ঘন কুয়াশার চাদর ভেদ করে উঁকি মারার চেষ্টা করছে। ডোমপাড়ার পুকুর পাড়ে একটা প্রকাণ্ড লিচুগাছ। পরিকল্পনা মাফিক ফিন্টু গিয়ে লিচুগাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল। বাকি তিনভাই এগিয়ে গেলাম ডোমবাড়িগুলোর দিকে। ছেলে বুড়োর একটা জটলা দেখলাম গোল হয়ে আগুন পোহাচ্ছে। মাটিতে দাগ কেটে মার্বেল খেলছে একদল কিশোর। তাদের পাশেই খেলা করছে চার-পাঁচটা ফুটফুটে কুকুরছানা। দুটো আবার লাল রংয়ের। ভাগ্য ভালো যে মা কুকুরটা আশেপাশে নেই। আমারা রাস্তায় দাঁড়িয়েই 'কুর-কুর কুর-কর' বলে চিৎকার দিয়ে চেষ্টা করলাম বাচ্চাগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণের। বাচ্চগুলোর ভেতর চাঞ্চল্য লক্ষ্য দেখা গেল। কী করা উচিৎ ওরা যেন বুঝে উঠতে পারছিল না। একটা সাদকালো রংয়ের ছানাকে দেখলাম, সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে আমদের দিকে এগিয়ে আসছে। অন্যগুলোও ভীরু চোখে এদিক-ওদিক একবার দেখে নিয়ে প্রথম বাচ্চাটাকে অনুসরণ করল।

আমাদের চিৎকার মার্বেল খেলারত ছেলেদের দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছিল। আমাদের মতলব বুঝে হৈ হৈ করে তেড়ে এলো ওরা। আমরাও পালানোর ভান করে ভৌ-দৌড় দিলাম। আর এই সুযোগে ফিন্টু গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে একটা লাল রঙের কুকুরছানা কব্জা করে উল্টোপথে দৌড় দিল।

ধাওয়া খেয়ে বেশ কিছুক্ষণ ছোটার পর মনে হলো, আর নয়; এবার ওদেরকে আসল কৌশলটা জানিয়ে দেয়া যাক। মুহূর্তের জন্য পেছন দিকে ঘুরে বললাম, 'ওই দেখ্, তোদের কুকুর ছানা কে নিয়ে যায়!'

ধাওয়কারী ছেলেরা পেছনে ফিরে দেখে আসল চোর ফিন্টু! ওরা আমাদের ছেড়ে এবার ফিন্টুর দিকে তেড়ে গেলো। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

পরের দুটোদিন বেশ হৈ চৈ করে কাটল আমাদের। সারাটাদিন কুকুর ছানাটা নিয়েই ব্যস্ত, এমনকী পড়ার সময়ও মন চাইত বাচ্চাটাকে একটু আদর করে আসি। দোকান থেকে কেক, বিস্কুট কিনে খাওয়াতাম। দিনের বেলা কোনো সম্যস্যা ছিলো না, রাত হলেই হয়তো মা আর ভাইবোনের কথা মনে পড়ে যেত বাচ্চাটার। তাই করুণ স্বরে কেঁদে উঠত। তা শুনে আমার আমার যে কী খারাপ লাগত তকন!

কুকুরছানার সাথে খেলার সেই আনন্দ দুদিনেই মাটি হয়ে গেল। চতুর্থদিন ভোরে চারভাই মিলে বাচ্চাটাকে জাগাতে গিয়ে দেখি, গোয়াল ঘরটা খালি। কোথায় গেল! খোঁজ খোঁজ রব উঠল সবার মাঝে। অনকে তল্লাসি চালিয়েও যখন হদিস মিলল না ঠিক তখনই আমি আবিষ্কার করলাম, গোয়াল ঘরের কঞ্চির বেড়ায় বেশ বড়সড় একটা ফুঁটো। একটা বড় কুকুর অনায়াশে ঢুকতে পারবে সেই ফুঁটো দিয়ে। কাজটা যে শেয়াল পণ্ডিতের তাতে কারো সন্দেহ রইল না।

চার-পাঁচদিন পর একমাত্র ফিন্টু ছাড়া বাকি তিনভাই শোক ভুলে নতুন উদ্যমে কাজ শুর করলাম। ডোমপাড়ায় আরেকটা আভিযান চালিয়ে দ্বিতীয় লাল ছানাটাও চুরি করার সিদ্ধান্ত পাকা হলো। এবং দ্বিতীয় অভিযানটাও সফল হলো। ডোমপাড়ার ছেলেরা ভাবতেই পারেনি সেদিন অমন রাম-ধাওয়া খায়ার পর এক সপ্তাহের মধ্যেই আবার ওপাড়া মুখো হব। আর আমাদের আবার দেখার পর ওরা ভেবেছিল, প্রথম দিনের কৌশলই হয়তো অবলম্বন করব। আমরা যখন 'কুর-কুর কুর-কুর' বলে চিৎকার দিলাম তখন ওরা ভাবল, আজো হয়তো ফিন্টু লিচুগাছের আড়ালে লূকিয়ে আছে। তাই আমাদেরকে গুরুত্ব না দিয়ে ওরা সে দিকে দিকে ছুটল ফিন্টুকে হাতেনাতে ধরার জন্য। এই ফাঁকে আমারা দ্বিতীয় ছানাটাকে নিয়ে পগার পার! পরে যখন নিজেদের বোকামী বুঝতে পেরেছিল তখন ওরা কীভাবে নিজেদের ওপরে রাগ ঝেড়েছিল সে কথা কল্পনা করলে আজো আমার হাসি পায়।

এই বাচ্চাটাকে আমরা আর পণ্ডিতমশায়ের খাবার হতে দিইনি। পরবর্তী দশ বছর সেই লাল কুকরটাই পাড়াটাকে শাসন করেছে। গভীর রাতের ওর বাঘের মতো গুরুগম্ভীর গর্জন কলজে কাঁপিয়ে দিত আমাদেরও। ওকে নিয়ে মাঠে অভিযান চালিয়ে কত যে শেয়াল, বেজি, বনবিড়াল, গুইসাপ মেরে পাড়ার লোকেদের কত হাঁস-মুরগি রক্ষা করেছি তার ইয়ত্তা নেই। পাড়ার সব কুকুরগুলো ওকে দেখামাত্র লেজ গুটিয়ে আগেভাগেই আত্মসমর্পন করত। চোর দূরে থাক, পুলিশেরও হয়তো সাধ্য ছিল ওর বাধা পেরিয়ে রাতে আমাদের বাড়িতে ঢোকে। শেয়াল আর বনবিড়ালদের কথা আর নাইবা বললাম।

এখন আমি সেই গ্রাম থেকে বহুদূরের পথ ঢাকা শহরে বাস করি। রাত বিরাতে কারো পোষা হাউন্ডের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেলে এখনো ভাবি, বুঝি আমাদের সেই লাল কুকরটা শেয়াল বাবাজিদেরকে সদর্পে জানিয়ে দিচ্ছ, 'সাবধান! এ বাড়ির ত্রিসীমনায় ঘেঁষবে না কেউ!'

একটু পরে ঘুমের ঘোর কেটে যায়। তখন কুকুর চুরির কথা ভাবলে আপন মনেই যেমন হাঃ হঃ করে হেসে উঠি, তেমনি কুকুরটার জন্য মনটা হু হু করে কেঁদে ওঠে। কারণ ঢাকা ছেড়ে বাড়ি গেলেও যে তাকে আর দেখতে পাব না- আট বছর হলো আমাদের সেই প্রিয় লাল কুকুরটা না ফেরার দেশে চলে গেছে।

----------------------

আব্দুল গাফফার রনি


মন্তব্য

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

ডোমপাড়ার বাচ্চারা কুকুরের দেখাশুনা করতে পারবে না এইরকম একটা পূর্বানুমানকে প্রশ্রয় দেয়া হইতে পারে। তবে বাচ্চারাও শ্রেণীসচেতন হয়। হয় না তা না।

আমার মনে হয় আপনি বাচ্চাদের জন্যও লিখতে পারবেন। যদিও বাচ্চাদের জন্য লিখতে অনেক অনেক সাবধানে লিখতে হয়।

ভাষায় সরলতা আছে এক প্রকার।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

মেঘা এর ছবি

একজন লেখক তার লেখা দেবার পর নাকি অন্য ব্লগারদের আরো ৯টি লেখা প্রকাশিত হতে হয় তারপর নাকি আবার লেখা দেয়া যায়? তাহলে প্রথম পাতাতেই তো রনি ভাইয়ের ২টা লেখা দেখতে পাচ্ছি ইয়ে, মানে... কেউ আমাকে বুঝিয়ে বললে ভালো হয়।

স্যরি রনি ভাই আমি সেদিন এমন একটা সিস্টেমের কথা মডারেটরদের কাছ থেকে জেনেছি তাই জিজ্ঞেস করলাম। আপনি কিছু মনে করবেন না।

অমিত আহমেদ এর ছবি

লেখাটা ভালো লেগেছে সরল অকপটতার জন্য। আপনার লেখার হাত দারুণ। আর

আমার মনে হয় আপনি বাচ্চাদের জন্যও লিখতে পারবেন। যদিও বাচ্চাদের জন্য লিখতে অনেক অনেক সাবধানে লিখতে হয়।

এই মন্তব্যের সাথেও একমত।

স্বপ্নহারা এর ছবি

সচলের নিয়ম অনুসারে নীড়পাতায় একই লেখকের একাধিক লেখাকে নিরুত্সাহিত করা হয়।

-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...

স্বপ্নহারা এর ছবি

আপনার লেখার হাত ভাল। কিন্তু এই লেখাটা ভাল লাগেনি অতটা।

-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...

সন্দেশ এর ছবি

প্রিয় আব্দুল গাফফার রনি,
অনুগ্রহ করে প্রথম পাতায় একাধিক পোস্ট করা থেকে বিরত থাকবেন। এই পোস্টটি সরিয়ে দেয়া হলো। প্রথম পাতার পোস্টটি সরে গেলে পুনরায় লেখাটি পোস্ট করতে পারেন।

ধন্যবাদ।