ফেরা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১১/০৬/২০১২ - ৯:১৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হাঁটতে হাঁটতে বাঁশঝাড়ের বাঁকটাও পাড় হয়ে গেলেন টুকুনের বাবা । ঐ তো লিচু গাছটা দেখা যাচ্ছে । তিনি যেন স্পষ্ট দেখা পাচ্ছেন টুকুন দোল খাচ্ছে দোলনায় । তেমন বিশেষ কিছু নয়- পাঁটের দড়ি গাছের ডালে বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়া আর এতেই কী খুশি ছেলেটা । সকাল-বিকাল দোল খাওয়া । লেখাপড়া ওখানে- ভাত খাওয়া ওখানে- পারলে ঘুমও ওখানে । মন্তু একবার ঘুমে ঢুলে পরতে দেখে দৌড়ে গিয়ে ধরেছিল ।

মন্তুই আজ সাথে গিয়েছিল বাজারে । পুঁইশাক কিনে আবুল শেখকে বলে এসেছেন যেন পরশুও কিছু শাক বাড়িতে দিয়ে আসে- পুঁইশাকের ঝোলে ছোট চিংড়ি অনেক পছন্দ ছেলেটার, চিংড়িও নিয়ে রেখেছেন- পুকুরেও দেখেছেন অনেক চিংড়ি হয়েছ । মন্তু জাল ফেলবে আর ধরবে । আরও কিছু টুকিটাকি যা সদাই ছিল মন্তু কে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন । তাঁর একটু দেরি হল- একটু চা’র দোকানে বসলেন, কয়েকজনের সাথে দেখা হল- কথা হল টুকুনকে নিয়েও । সবাই বেশ খুশি- এতে গর্ব হওয়াটাই স্বাভাবিক । সবাইকে বললেন দোয়া করতে । একমাত্র ছেলে তাঁর । যক্ষের ধন ।

চা’র দোকানে বশেই যেন দেখতে পান ক্লাস এইটে বৃত্তি পেয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে টুকুন । বোঁকাছেলে । কোথায় খুশিতে ডগমগ হয়ে চিৎকার করবে- স্যারদের বাড়িতে যাবে, উল্টো স্কুল থেকে হেডস্যার আরও কয়েকজন স্যার আসলেন মিষ্টি নিয়ে- সাথে ডাক্তার আসলেন । ১০২º জ্বর নিয়ে ছাত্র তখন অচেতন প্রায় । পরে সেরে উঠে নিজেই বেশ করে বকে দিল নিজেকে । আর হয়নি ওরকম তবে এস.এস.সি’র রেজাল্ট নিয়েও যে টেনশন কম করেনি তা নয় । এক সপ্তাহ আগে হটাৎ খাওয়া থেকে উঠে গেল- ব্যাপার কী, ও বলল টেনশন হচ্ছে । পুরো সপ্তাহ কাটল খেয়ে-না খেয়ে, ঘুমিয়ে- না ঘুমিয়ে, রেজাল্ট যথারীতি অনেক ভাল ছিল । ভাবতে ভাবতে দুপুর গড়িয়ে এলো বলে । উঠতে হবে, সবাইকে বললেন টুকুন আসলে সবাই যেন যায় একবার বাড়িতে । বাজারে তো দেখা হবেই, তবুও বাড়িতে গিয়ে যেন দোয়া করে আসে সবাই । চা’র দোকান থেকে বেড়িয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন ।

এই পথেই কতদিন হাত ধরে টুকুনকে নিয়ে বাজারে এসেছেন । গনি মিঞা’র চা আর মতি’র পেঁয়াজু- দুটো অবশ্যই থাকতো টুকুনের জন্য । মতি কে বলতে হবে- ভাল করে যেন কিছু পেঁয়াজু বানিয়ে দেয় । মন্তুকে আবার পাঠাতে হবে বিকাল বেলা মতিকে খুঁজতে ।

ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ই স্কলারশিপ’টা পেল টুকুন । প্রথমে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব । যাবে কী যাবে না । এত ভাল সুযোগ হারানো ঠিক হবে না, বাবাই টুকুনকে বলা যায় ঠেলেই পাঠিয়ে দিল দূর দেশে । এর মাঝেই এতগুলো বছর চলে গেছে । বাড়ি ফেরা হয়নি । চাইলেই তো আর আসা যায় না । গ্রাজুয়েশন শেষ করল বিদেশী ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট করে । বৃত্তিও পেয়ে গেল । কোন এক টিচার ওকে এসিসট্যান্ট হিসেবেও নিয়ে নিলো । কাজ আর লেখাপড়া নিয়ে ক্লান্ত হয়ে যখন ফোন করতো বোঝাই যেত কত কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে । বাবা ওকে বলতো আগে লেখাপড়া ভাল ভাবে শেষ কর তারপর বাড়ি তো আসবেই- অধৈর্য হওয়ার কিছু নেই । আমি তো ভালই আছি । অবশ্য টুকুন বেশ কয়েকবার বলেছে বাবাকে সে নিয়ে যাবে । বাবাই না করেছে বারবার । এখানে গ্রামের আলো-বাতাসে বেশ ভাল আছি । ওখানে ভিনদেশে না হয় একবার যাব- ঘুরে দেখে আসব, কিন্তু তার আগে তুমি থিতু হও ।

একমাস আগে যখন ফোন করে বলল বেশ লম্বা ছুটি পেয়েছ তাই এবার দেশে আসছেই । যেভাবেই হোক । সেই থেকে প্রস্তুতি চলছে কী করা হবে ছেলের জন্য । বাড়িতে একা মানুষ- আর মন্তু থাকে । মন্তু কাজ টাজ করে দেয়, দীর্ঘদিন ধরেই সে আছে টুকুনদের বাড়িতে । টুকুনের ঘর পরিষ্কার করে রেখেছে সে- এই কাজ অবশ্য মন্তুকে নিয়মিতই করতে হত । বাবার হুকুম ছিল প্রতিদিন টুকুনের ঘর ঝকঝকে রাখা চাই- না থাকুক ছেলেটা, তাই বলে নোংরা রাখতে হবে । পুকুরের কয়েক পাশে আগাছা পরিষ্কার করে বেশ সুন্দর বসার জায়গাও বানিয়েছে- ঘুড়িটা ঠিক আছে কিনা দেখে রেখেছে । আর মায়ের কবরটা । যেদিন চলে গেল টুকুন এখানে বসে ছিল একা একা অনেকক্ষণ । মায়ের মুখ তো মনেই নেই ওর- ছবিতে কী আর মাকে পাওয়া যায় । মন্তু ছোট ফুপুকে নিয়ে এসেছে গতকাল- যতদিন টুকুন থাকবে ততদিন ফুপুরও থাকতেই হবে ।

বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে আরও অনেক কথাই মনে উকি দিল । টুকুনকে একদম ছোট রেখে ওর মা মারা গেল । সবাই বলেছে আর একবার বিয়ে করতে । অন্তত ছেলেটার জন্য হলেও । কিন্তু ও পথে আর পা বাড়াননি তিনি । কষ্ট করেছেন ছেলেকে নিয়ে । ছেলে আজ বড় হয়েছে । কষ্ট অনেকাংশে সার্থক ।

ভাবলেন এখন হয়তো সবকিছু গোছগাছ করা হয়ে গেছে টুকুনের । কাল বলেছিল তো আজ আর একবার ফোন করবে । করবে হয়তো । তিনি হাঁটতে থাকেন ।

হাঁটতে হাঁটতে বাঁশঝাড়ের বাঁকটাও পাড় হয়ে গেলেন তিনি । ঐ তো লিচু গাছটা দেখা যাচ্ছে । তিনি তাঁর সেলফোনের শব্দ শুনতে পান । এক বিদেশি নাম্বার ভাসছে স্ক্রিনে । ছেলেটা বোধহয় কল করল ।
দূর থেকে ভেসে আসা স্বরের মত কেউ জিজ্ঞেস করল “আপনি আজমল চাচা? টুকুনের বাবা”?
“হ্যাঁ, আমিই টুকুনের বাবা” ।
“আপনি কি একা, মানে- আপনার সাথে কি আর কেউ আছে”?
“না, আমি তো একাই, কেন? কে তুমি? টুকুনের বন্ধু”?
“চাচা, টুকুন আর নেই...” বলতে গিয়ে কেঁপে উঠল গলাটা ।
টুকুনের বাবা আজমল হোসেনের চোখে ঝাপসা হতে থাকে সবকিছু । লিচু গাছে দুলতে দুলতে টুকুন ছিটকে পরে মাটিতে ।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

আমরা বের হয়েছিলাম ঘুরতে, দেশে যাওয়ার আগে শহরটা আর একবার ঘুরে দেখতে । হটাৎ একটা গাড়ি ফুটপাতে উঠে যায়, কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি টুকুন আর সুদীপ ছিটকে পরে ধাক্কায় । সুদীপ ওখানেই হারিয়ে যায় । টুকুনের জ্ঞান ছিল তখনো । কিছু বলতে পারেনি । ডাক্তার চেষ্টা করেছে কিন্তু... ওর শেষ কথা ছিল- সন্ধ্যাবেলায় ঐ বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরতাম... আমি আর বলতে পারি না । গলা ধরে আসে ।

টুকুনের ঘরে টুকুনকে নিয়ে আর থাকা হল না । এবার প্ল্যান ছিল দু বন্ধু একসাথে যেহেতু দেশে যাচ্ছি- তাই একসাথেই থাকব যেকটা দিন পারি । ঘুরে-বেড়াবো আত্নীয়-স্বজনদের বাড়ি । আর যেখানে যাওয়া যায় । কিন্তু ও এমন কোথাও চলে গেল- আমার আর যাওয়া হল না । ভিনদেশি রাস্তায় ও বাবাকে পায় নি যে জড়িয়ে ধরবে । আমরা পারিনি ওকে জড়িয়ে ধরে রাখতে । এতদিন পর ফিরে এসে সেই বাঁশঝাড়ের পাশে- টুকুন এবার মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায় । ওর বাবা’র শূন্য হাতে হু হু বাতাস খেলে যায় ।

১১.০৬.২০১২
কড়িকাঠুরে


মন্তব্য

মরুদ্যান এর ছবি

একটু তাড়াহুড়া করে লিখসেন নাকি? আরেকটু গুছানো যাইত কিন্তু। আমার কাছে ছাড়াছাড়া লাগসে কিছুটা। যাই হোক একান্তই ব্যক্তিগত মতামত।
পোস্টে চলুক

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

অতিথি লেখক এর ছবি

আসলে এটাই প্রথম প্রয়াস ছিল- তাড়াহুড়ো হয়েছে- বলা যায় । দুপুরে প্লট মাথা আসল- সন্ধ্যায় শেষ করলাম, শুধু সময় না বুননেও সময় দেওয়া উচিত ছিল । যাই হোক, এতটুকু হবে এটাই তো আশা করি নি কোনদিন । ধন্যবাদ যথাযথ মন্তব্যের জন্য ।
আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

কড়িকাঠুরে

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

আমার কপিরাইটা করা নামটা ওঁয়া ওঁয়া

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

অতিথি লেখক এর ছবি

দুঃখিত, একটু বুঝিয়ে বলবেন- চিন্তিত

কড়িকাঠুরে

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

একটা উপন্যাস শুরু করেছিলাম 'ফেরা' নামে। হালকাচালে কয়রা মন্তব্য, আশাকরি সেভাবেই নিয়েছেন।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

মরুদ্যান এর ছবি

উপন্যাস কবে আইতেসে?? দেঁতো হাসি

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

থিসিস লিখতেছি বস। আপাতত আর কিচ্ছু মাথায় আনতে পারতেছি না।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

অতিথি লেখক এর ছবি

মমম ইয়ে, মানে... ... আমি তো এখানে নতুন- এটা জানতাম না ।
ভাই তো পর্ব ভাগ করে লিখেছেন- ফেরা০১,০২...০৮- এটা তো খালি ফেরা- দেঁতো হাসি
মজা করলাম...

কড়িকাঠুরে

অতিথি লেখক এর ছবি

একদম ঠিকাছে, ফাঁকিবাজদের এমনই শিক্ষা পাওয়া উচিত রেগে টং

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

সবাই দেখি আমার উপরে চেতা, কড়িকাঠুরে ভাই এর গল্পে অপ্রাসঙ্গিক কমেন্ট বেশি হচ্ছে। এটাই এখানে এ ব্যাপারে আমার শেষ কমেন্ট।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

বন্দনা এর ছবি

এগুলা বইলা লাভ কি মিয়া, আপনার কি ফেরা নিয়ে আবার সচলে ফেরা হবে, আমারতো মনে হয়না। চাল্লু

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

কাহিনী ভুলে গেছি, আমার নিজেরও সন্দেহ আছে, কবে ফেরা হবে!

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

বন্দনা এর ছবি

আপনার একটা শক্ত মাইর দরকার, মাইর এর উপর কথা নাই, তাছাড়া ভাইটামিন ও আছে মাইরে। কেলুয়ানার পাব্লিকদেরকে বলতে হবে যেন আপনার জন্য মাইরপানির ব্যবস্থা করে। খাইছে

তাপস শর্মা এর ছবি

হ, দেন দেন। লগে আমার ত্রফ থেইক্যাও ইট্টু দিয়া দিয়েন \m/ দেঁতো হাসি

বন্দনা এর ছবি

গল্প ভালো লেগেছে, তবে শেষটা আগেই বুঝতে পেরেছিলাম।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
কড়িকাঠুরে

রংধনুর কথা এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
কড়িকাঠুরে

তাপস শর্মা এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

ধইন্যা পাতা আগেও দিছিলাম- গেলো কই...?
আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- - আবার নেন

কড়িকাঠুরে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।