ঝরঝর মুখর ...

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ১৬/০৬/২০১২ - ২:৩৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।
আষাঢ়স্য প্রথম দিবস। উদয় পর্বতচূড়ায় মেঘের ভেলা ভেসে এলো। পর্বতপাদে রামগিরি বনে যক্ষের মন বিক্ষিপ্ত, বিরহে ম্যুহমান। বছর গড়িয়ে গেছে নির্বাসনের। মেঘের আগমনে প্রণয়িনীর দূরে থাকার ব্যাথা যেন উথলে উঠল তার। ‘ধুমজ্যোতি জল’ আর ‘পবন’ যোগে মেঘ দূর দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ায়। যক্ষের বোধ হল, মেঘ-ই পারে তার বিরহবার্তা দূর অলকনগরে ধনবান যক্ষগণের পাহারা এড়িয়ে মরম যাতনায় বিদ্ধ প্রিয়ার কাছে পৌঁছে দিতে। অলকনগর তো কাছে নয়! কৈলাস চূড়া ডিঙ্গিয়ে বিদিশা নগর। তারপর দেখা মিলবে নির্বিন্ধ্যা নদীর। ক্ষীণ তটিনীর ধারা পেরিয়ে ঋদ্ধ উজ্জয়িনী পুরি। এতক নগর আর পর্বত পেরিয়ে তবেই প্রিয়ার দেখা মিলবে। সেকালে জিএসএম আর সিডিএমএ প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটে নাই। রামগিরি বন হতে অলকনগরে বার্তা পাঠানোর মেঘ অপেক্ষা উত্তম দূত আর কি ছিল? মহাকবি কালিদাসের ‘মেঘদূতম’ কাব্যে বিরহ, আষাঢ়ের মেঘ আর জলের এমনই এক নিবিড় পরিচয় মেলে। সেই থেকেই বুঝি আষাঢ় বিরহের দখলে আছে!

২।
বর্ষার এই বেদনা বিধুর চেহারা একালের লেখাতেও সমান প্রতিভাত। রবীন্দ্রনাথ মহাশয় লিখলেন,

শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি—
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী। (সোনার তরী)

বর্ষণ যেন আকাশের দেউলিয়াত্বে আমাদেরও নিঃস্ব করতে পিছপা হয় না। গীতবিতানের শুকনো পাতায় বর্ষার গান কেবল পথ হারিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ‘শাওন রাতে যদি/ স্মরণে আসে মোরে’ গেয়ে নজরুল কি বিরহকেই জাগিয়ে তোলেননি? লতাজির আওয়াজে ‘আষাঢ় শ্রাবণ/ মানে নাতো মন’ গানটি শুনে চোখের কোণে অশ্রু না জমাই হবে ব্যতিক্রম। শক্তি চাটুয্যে ‘আকাশ ছেঁচা জলে’ প্রিয়ার কেশ ভিজিয়ে নেবার দৃশ্যকল্প ভেবে রেখেছেন মনে, কিন্তু শেষটাতে ওই তাকে ছুঁতে না পাবার হাহাকার জড়ানো। বৃষ্টির সব থেকে মহৎ ছবিটা বুঝি ফরাসি কবি এপলিয়েনর-এর আঁকা। তাঁর কবিতাটি বরং বৃষ্টির খুব ব্যথিত সংঘবদ্ধ ফোঁটার এক মিলিত ছবি যেন...

বৃ
..ষ্টি

…….প
……….ড়
…………ছে

……………..যে
………………..ন

…………………..না
……………………..রী
……………………….দে
………………………….র

…………………………….ক
……………………………….ণ্ঠ
………………………………….স্ব
…………………………………….র

……………………………………….স্মৃ
………………………………………….তি
…………………………………………….র

………………………………………………ভে
………………………………………………….ত
……………………………………………………রে

তু
…মি
…….ও

…………বৃ
……………ষ্টি
………………র

………………….ম
……………………তো

………………………………ঝ
…………………………………রে

…………………………………….যা
……………………………………….চ্ছ

…………………………………………..জী
……………………………………………...ব
…………………………………………………নে
……………………………………………………র

বি
….ন্দু

………বি
………….ন্দু

…………….আ
………………..শ্চ
…………………...র্য

……………………….সা
…………………………..ক্ষা
………………………………ত...

৩।
বরষণের আরও একটা দিক আছে। কালিদাস জানিয়ে রেখেছেন...
‘তোমার আয়ত্তাধীন কৃষিকাজ যত।
জনপদ বধূগণ জানে রীতিমতো’।।

হালের কবির ভাষায়...
‘বৃষ্টি মানে শস্যক্ষেতে মিলন সুখে গর্ভ ধারণ
নিমেষে তার বুকের ভেতর গোলাপ ফোঁটার পরাগায়ন’

ব্যাঙেদের বরষণে ভারি সুবিধে হয় বটে। তবে অন্য ক্ষেত্রে নেহায়েত অসুবিধাও কম নয়। বাঁশি (আবার রবীন্দ্রনাথ!)কবিতার রূপটা এমন...
বর্ষা ঘনঘোর।
ট্রামের খরচা বাড়ে,
মাঝে মাঝে মাইনেও কাটা যায়।
গলিটার কোণে কোণে
জমে ওঠে, পচে ওঠে
আমের খোসা ও আঁঠি, কাঁঠালের ভূতি,
মাছের কান্‌কা,
মরা বেড়ালের ছানা—
ছাইপাঁশ আরো কত কী যে।
ছাতার অবস্থাখানা জরিমানা-দেওয়া
মাইনের মতো,
বহু ছিদ্র তার।

মহামহিম রবি বাবুর যুগে ডাস্টবিনের বালাই ছিল না। এযুগে ডাস্টবিন আছে বটে, কিন্তু বরষায় তাঁর চেহারাটা দেখবার মতো হয়! অন্যদিকে বহু ছিদ্রযুক্ত ছাতা মাথায় বর্ষণ ঠেকানো লোকের গুণতিই যে বেশি আজ। বর্ষার রূপটি তাই ঠিক কমনীয় থাকে না আর। এরপর কবির লেখায় এলো আরো একটি নকশা। পুরস্কার কবিতায় দেখি...

সেদিন বরষা ঝরঝর ঝরে
কহিল কবির স্ত্রী
`রাশি রাশি মিল করিয়াছ জড়ো,
রচিতেছ বসি পুঁথি বড়ো বড়ো,
মাথার উপরে বাড়ি পড়ো-পড়ো,
তার খোঁজ রাখ কি!

কবিদের মাথার ওপর বরষা ঠেকানোর ছাঁদতো সেই ‘টালত মোর ঘর, নাহি পরবেশি’র যুগ থেকেই উধাও! একালের গেরস্থরাও খরবায়ুতে সমান হেনস্থা হচ্ছেন।

৪।
ছেলেবেলায় প্রথম বর্ষণের দিন রোদে পোড়ামাটি ছেড়ে এক অদ্ভুত সোঁদা গন্ধ উঠত। আমি আকণ্ঠ পান করতাম সেই ঘ্রাণ। এখনো বৃষ্টির আগে উন্মুখ হয়ে থাকি অজান্তে, কখন উঠবে সেই ঘ্রাণ! আজ আর সে ঘ্রাণ উঠেনা। অথবা নিয়মিত নাগরিক বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে নিজেই সে ঘ্রাণ ভুলে গেছি!

আজ শুক্রবারের অবাক বিকেলে কাজহীন আমি। রাত থেকেই এখানে আকাশের মন ভার। বড় ভারী আর ঘন কালো মেঘের দল দাবড়ে বেড়াচ্ছে বেশামাল হাওয়া। বারান্দার ঝুল ঘেঁষে হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি। মেঘের ঘর্ষণে গর্জনে জানান না দিয়েই কেমন আপোষে নেমে এলো মুঠো মুঠো মেঘবিন্দু! বাইরে নারকোল, তাল, পুরনো অশ্বত্থ আর দেবদারু শাখাগুলো কেমন বেদম ভিজে একশা হল মুহূর্তে! বারান্দার লোহার গরাদ গলে কুঁচি কুঁচি বারি বিন্দু ভেসে আসছে। জমা হচ্ছে খালি পায়ের পাতায়, চোখের উপর। শিউরে উঠছি কি এক মাদক স্পর্শে যেন। দূরে খোলা মাঠের পরে আদুল গায়ে কয়েকটি কিশোর। ওকি আমিই ছোটবেলার এই সেদিনের বৃষ্টি মাথায়! কি জানি? কি সব ছবি যেন মনের কোণে উস্কানি দেয়! নিরদ সি চৌধুরী অনেক আক্ষেপে দেশ ছেড়েছিলেন। কিন্তু বরষা তাঁকে ছাড়েনি। একদা তিনি বিলাত বিভূঁইয়ে কবুল করলেন, ‘জল দেখিলে প্রবাসে দেশের কথা মনে পরে।‘ আমি তো দেশান্তরি হইনি। তবুও এ কোন বিরহের ছবি তুমুল বরষণে ভিজে ভিজে গলে ঢলে পরে স্মৃতি বেয়ে! তবে কি সব খানেই আষাঢ় শ্রাবণ মনের ঘরে হামলা করে!

বর্ষণ এমন কেন?

--------------
পথিক পরাণ


মন্তব্য

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

বাইরে খুব বৃষ্টি পড়ছে।
এমন পরিবেশে আপনার লেখাটা পেয়ে ভালো লাগল।

অতিথি লেখক এর ছবি

মানচিত্রের ভেতর আমি বোধহয় আপনার বেশ কাছাকাছি আছি। এদিকেও বৃষ্টি হচ্ছে বেশ।

ভালো থাকুন।

---------------
পথিক পরাণ

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

আমি তো শিলিগুড়িতে।
আপনি কোথায় থাকেন?

অতিথি লেখক এর ছবি

এখন লালমনিরহাট- কুড়িগ্রাম/রংপুরের পাশে। আপনার বাড়ি তো ওপাশে। তাই বলেছি---

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন।
রংপুর-লালমনির হাট এর সাথে এখানকার আবহাওয়া প্রায় একইরকম থাকে।
আসলে বেয়ারা আবহাওয়ার বর্ডারের কথা খেয়াল থাকে না যে!! হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

খাইছে

কালো কাক এর ছবি

"একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যা" রচনা পড়েছিলাম, ঐটার কথা মনে পড়লো। হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

খাইসে--- ব্লগ লিখতে গিয়ে শেষে রচনা লেইখা ফেললাম-- ইয়ে, মানে...

পথিক পরাণ

Shreyasi এর ছবি

অনেক ভালো লাগলো...
-শ্রেয়সী

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার তো জল নেই
আছে মেঘের পানে চাওয়া---

ভালো লাগার জন্য এই রইল -- আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-------------
পথিক পরাণ

অতিথি লেখক এর ছবি

হাততালি - (গুড়)

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

পথিক পরাণ

ক্রেসিডা এর ছবি

ভালো লাগলো।

__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।