হাড়ে হাড়ে যায় চেনা

ঈপ্সিত আর চম্পাকলি এর ছবি
লিখেছেন ঈপ্সিত আর চম্পাকলি [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ২৫/০৭/২০১২ - ১:০৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(১)
- “হ্যালো, সাহানা, আরে আমি এখন বুয়েনস্‌ আয়ার্স এয়ার্পোর্টে স্ট্র্যান্ডেড। এল্‌ ক্যালাফাটে-গামী ফ্লাইটটা সাত ঘন্টা ডিলেইড!”
- “বেশ হয়েছে অর্ক, ঠিক হয়েছে, যেমন এই খৃস্টমাসের ছুটির সময়ে আমায় লস্‌ অ্যাঞ্জেলেসে একলা ফেলে ওই ধাপার মাঠের মত একটা জায়গায় ছুটলি!”
- “ধাপার মাঠ আবার কোত্থেকে এল?”
- “ওই আর্জেন্টিনার প্যাটাগোনিয়া জায়গাটার যে মরুভূমি টাইপের জায়গাটার ছবি দেখিয়ে বললি কি নাকি বিশ্ববিখ্যাত ‘পেট্রিফায়েড ফরেস্ট’ ন্যাশানাল পার্ক, সেটা দেখেই আমার ধাপার মাঠ ছাড়া কিচ্ছু মনে হয়নি। ম্যাগোঃ!”
- “বাজে বকিস না, ইউনেস্কো ওটাকে বায়োস্ফীয়ার ওয়ার্ল্ড রিজার্ভ ডিক্লেয়ার করেছে, তা জানিস?”
- “তা জেনে আমার কি হবে শুনি? ধাপার মাঠের মত গড়নটা তো পালটে যাবে না, যাবে?”
- “সে তুই রাগ করে ওরকম বলছিস, আর তাছাড়া আমি তো আর বেড়াতে যাইনি, প্রোজেক্টের কাজে গেছি। প্যাটাগোনিয়ায় এত এত ভালো ভালো ফসিল উদ্ধার হয়েছে, যে আমাদের মিউজিয়ামের ডিরেক্টরের নির্দেশে প্রত্যেক বছর আমাদের প্যাটাগনিয়ায় কোন না কোন এক্সক্যাভেশান প্রজেক্ট শিডিউল্ড্‌ থাকেই।”
- “আর তোদের মিউজিয়ামের ডিরেক্টরের পরেই তুই কিনা, তাই তোকেই দৌড়তে হল ফসিল খুঁজে বের করতে!”
- “আঃ, আবার শুরু করলি, বললাম তো এখন আমাদের অফিসে নাইন্টি পার্সেন্ট স্টাফ ছুটিতে। পঁচিশে ডিসেম্বরের আগে পরে অ্যামেরিকান কোন অফিসে কেউ কাজ করে? তুইই বল, তোদের সফট্‌ওয়্যর ডিপার্ট্মেন্টেই কি কেউ পড়ে আছে?”
- “তা আছে, আমাদের আইটি ডিপার্ট্মেন্টে তো গাদা গাদা দেশী জনগণ, তাই তাদের এই সময় টানা ছুটি নেওয়ার দরকার হয়না, সেইজন্যেই তো বলেছিলাম তোকে এই সময় না যেতে, আমি এই সময় আরামসে অফিস কেটে এদিক ওদিক যেতে পারতাম, ছুটিও নিতে হত না, আবার কেউ খবর্দারি করারও থাকত না।”
- “কি করব সাহানা, এই সবে আগের বছর জয়েন করলাম এলিজাবেথ মিউজিয়ামে এত কাঠ খড় পুড়িয়ে। তার মধ্যে এই এক্সপেডিশানটায় আমায় নমিনেট করেছে আমার বস, সেটা অবশ্য আর কোন সিনীয়ার প্যালিওন্টোলজিস্ট পায়নি বলেই, কিন্তু আমার কেরিয়ারের শুরুতেই এটা কিন্তু একটা অপ্রত্যাশিত ব্রেক্‌, কি করে না বলি বলত?”
- “হ্যাঁ হ্যাঁ, তা আর বলতে, প্যাটাগোনিয়ার নাম শুনেই তোর যেরকম লালাক্ষরণ হচ্ছিল, দেখিস, এবার তুই যাচ্ছিস তো, ফসিল নয়, একটা জ্যান্ত ডাইনোসরই পেয়ে যাবি, যত্তসব আদ্ভুতের একশেষ! কি, না প্যালিওন্টোলজি –এরকম অদ্ভুত প্রফেশান যে কারোর হতে পারে..., দেশে তো যাকেই বলতাম, তাকেই তারপর আবার বুঝিয়ে বলতে হত ওই ডাইনোসরের হাড়-গোড় খুঁজে পেতে তাপ্পি লাগিয়ে মিউজিয়ামে ঝুলিয়ে রাখার সাব্জেক্ট নিয়ে আমার বয়-ফ্রেন্ড পড়াশোনা করছে বিদেশে গিয়ে!”
- “সে তুই যা ইচ্ছে বলিস, আমার কিছু যায় আসে না, তুইও যখন সেরামিক্স টেকনোলজি নিয়ে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে গেলি, আমার জেঠিমা অবাক হয়ে বলেছিল পায়খানার কমোড বানাতে গেলে চার বছর ধরে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে হয়? কাজেই কোন সাব্জেক্টের ব্যাপ্তি বা গভীরতা নিয়ে সাধারণ লোকের কিছু ভুল ধারণা থাকবেই, সেটা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। আর তোর তো আরও গোলমেলে ব্যাপার, শিখলি কমোড বানানো, আর করছিস সফট্‌ওয়্যরএ চাকরি। আর ‘অদ্ভুত প্রফেশান’ যদি বলতেই হয়, সফট্‌ওয়্যর-কেই বলতে হবে।”
- “আহারে, র্যা ন্ডম স্যাম্পলিং করে দশটা লোককে জিজ্ঞাসা কর সফট্‌ওয়্যর প্রফেশান হিসেবে অদ্ভুত নাকি প্যালিওন্টোলজি প্রফেশান হিসেবে অদ্ভুত, দেখ কি জবাব পাস!”
- “সব জিনিস ওরকম ডিমক্র্যাটিক্যালি নিষ্পত্তি করা যায় না। লজিক্যালি বোঝ, এই যে আমরা বলি পাঁচ ভূত, সেগুলো কি? জল, হাওয়া, আগুন, আকাশ, মাটি – সেগুলোর সব কিছু দিয়েই ফসিলের জন্ম, বা বলা যায় ফসিল তৈরি হবে কি হবে না সেটা নির্ভর করছে অনেকটাই এই পাঁচ ভূতের ওপর। কিন্তু তোর সফট্‌ওয়্যর? না কোন গ্র্যাভিটির নিয়ম মানে, না হাওয়াতে ওড়ে, না জলে ভেজে, না আগুনে পোড়ে। হার্ডওয়্যারের কথা বলছি না কিন্তু, তোর এই যে সফট্‌ওয়্যরএর ফাইল, ফোল্ডার, ই-এক্স-ই, ইত্যাদি এইগুলোর কথা বলছি, কোন ভূতের বাপের সাধ্য আছে তোর প্রফেশানের কিছু করে? এবার বল, ‘অদ্ভুত’ উপাধিটা কার পাওয়ার কথা?”
- “শেষ হয়েছে অর্ক? এবার কাজের কথা বলি? গেলি তো ওয়ান্‌-ওয়ে টিকিট কেটে, কবে আসবি ঠিক করে বলত?”
- “আরে আগেই তো বললাম, ওখানে গিয়ে কাজের ওপর সব কিছু নির্ভর করছে। কিছু না পাওয়া গেলে, দশ দিনের মধ্যে ফিরছি, কিন্তু ধর যদি সত্যিই ‘পেট্রিফায়েড ফরেস্ট’ ন্যাশানাল পার্কে গিয়ে মাটির তলা থেকে কিছু ফসিল পাওয়া যায়, তাহলে তখন স্ট্র্যাটিগ্র্যাফির সাহায্যে বের করতে হবে যে ফসিলটা কোন যুগের, প্যালিওজোয়িক হলে একরকম ভাবে এগোতে হবে, আবার মেসোজোয়িক যুগের হলে দেখতে হবে ক্রেটাশিয়াস নাকি জুরাসিক নাকি ট্রায়াসিক যুগের ফসিল।”
- “সেই দেখ জুরাসিক যুগের ডাইনোসরের ফসিল তোদেরও মেইন গোল, খামোখা তর্ক করছিলি যে প্যালিওন্টোলজি প্রফেশানের ব্যাপ্তি, গভীরতা, আরও কি কি যেন ভারি ভারি শব্দ!”
- “সেটা দেখ অস্বীকার করে লাভ নেই। আমি তো একেবারে কোন চ্যারিটেব্ল্‌ রিসার্চ ইন্সটিটিউটে চাকরি করিনা, করি একটা ঝাঁ-চকচকে প্রাইভেট মিউজিয়ামে, কাজেই সেখানেও করপোরেট স্ট্র্যাটেজি হল প্রফিট, পাব্লিসিটি, মার্কেটিং, সেলস্‌... আমি একটা জুরাসিক যুগের কেঁচো খুঁজে পেলে আমি হয়ত খুশীই হব, বা প্যালিওন্টোলজি সাব্জেক্টের হয়ত লাভই হবে কারণ ওই যুগের কেঁচো নিয়ে খুব বেশী গবেষণা হয়নি, কিন্তু তাতে করে খবরের কাগজের হেড্‌লাইন্স তো আর হবে না, যে বাঙ্গালি প্যালিওন্টোলজিস্ট প্যাটাগোনিয়ায় গিয়ে জুরাসিক কেঁচো খুঁড়ে বের করেছে, আর কাজেই আমাদের এলিজাবেথ মিউজিয়ামে ভিড়ও উপচে পড়বে না, কাজেই ওই জিনিষ পেলেও আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শ্যীওর আমার বস্‌ ওটাকে রেখে আসতে বলবে। আর আমার স্পেশালাইজেশান অবশ্য কুমির আর ডাইনোসরের বিবর্তন নিয়ে।”
- “দেখিস, বেশী বাড় বাড়িস না আবার একা একা ওইসব জায়গায় এক্সক্যাভেশান করতে গিয়ে।”
- “একা একা? কিছু না হোক, কম করে জনা পঞ্চাশের একটা লোকাল টীম থাকবে, মাটি খুঁড়বে, ফসিলের উপযোগী পাথর আইডেন্টিফাই করবে, স্পেশাল ফসিল ট্রীট্মেন্ট করবে, যে পাথরে পাওয়া যাচ্ছে সেটার স্ট্র্যাটিগ্র্যাফি করবে, মলিকিউলার ফাইলোজেনেটিক্স ডিপার্ট্মেন্টের লোক থাকবে এটা বের করতে যে ফসিলটা পাওয়া গেল সেটার ক্লোজেস্ট আত্মীয় কোন জন্তু, যদি গোটা হাড়-গোড় পাওয়া যায় সেগুলো নাড়াচাড়া করার একটা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত টীম থাকবে...মোটের ওপর প্রচুর লোক থাকবে, আমি লীড প্যালিওন্টোলজিস্ট হিসেবে যাচ্ছি, জাস্ট লস্‌-অ্যাঞ্জেলেসের বিখ্যাত এলিজাবেথ মিউজিয়ামের স্টাফ বলে, আর্জেন্টিনার লোকাল টীমের মাথার ওপরে চড়ে বসিয়ে দিয়েছে।”
- “যাক, অনেকে থাকবে তাহলে, আমি ভাবলাম কদিন ধরে যেরকম জিমে যাওয়া শুরু করেছিলি, তোকেই বুঝি খোঁড়াখুঁড়ি সব করতে হবে।”
- “আচ্ছা, এখন রাখছি, কিসব অ্যানাউন্সমেন্ট করছে, দেখি বোর্ডিং করাচ্ছে কিনা এল্‌-ক্যালাফাটের ফ্লাইটের।”

(২)
অর্ক সেন বরাবরই পড়াশোনায় ভালো ছিল। সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের অ্যাবাভ-অ্যাভারেজ স্টুডেন্ট। তবে ক্লাস নাইনে এমন একটা জিনিস হল, যার ফলে অর্কর জীবনটাই একটা অন্য খাতে বইতে শুরু করল। ওর ক্লাস নাইনে পড়ার সময় স্পিল্বার্গের জুরাসিক পার্ক সিনেমাটা এল। সিনেমাটা ও বোধহয় বার দশেক দেখেছিল। আর তারপর থেকেই ডাইনোসর, ফসিল, প্যালিওন্টোলজি, সব কিছু নিয়ে উৎসাহ চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছল। অর্ক ঠিক করে ফেলল ও হাজার হাজার ছাত্রের মত জয়েন্ট এন্ট্র্যান্সে বসে মেডিকাল বা ইঞ্জিনীয়ারিং পড়বে না। ওর আবাল্য বন্ধু সাহানা অবশ্য জয়েন্টে পেয়ে বেলেঘাটার সিরামিক কলেজে পড়তে চলে গেল। আর অর্ক প্রচুর খেটে আই-আই-টি-তে মলিকিউলার বায়োলজি নিয়ে পড়তে গেল। ওখানে থাকতে থাকতেই জি.আর.ই দিল এবং অসামান্য রেজাল্ট করল, প্রফেসারদের থেকে লেটার অফ রেকমেন্ডেশান নিল, অসাধারণ একটা প্রবন্ধ লিখল ওর রিসার্চের সাব্জেক্টের ওপর, আর ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়া, বার্কলের ‘ডিপার্ট্মেন্ট অফ আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস’এ অ্যাপ্লাই করল স্কলারশিপের জন্য। পেয়েও গেল। সেই শুরু হল ওর ড্রিম এজুকেশান। স্ট্র্যাটিগ্র্যাফিক অ্যানালিসিস, ট্যাফোনমি, ম্যাক্রো-এভোলিউশান, প্যালিওবায়োলজি, মর্ফোমেট্রিক্স, ফসিল রেকর্ড অ্যানালিসিস, বায়োমেকানিক্স, টেরেস্ট্রিয়াল ইকোসিস্টেমস্‌, প্রত্যেকটা বিষয়ে ওর গ্রেডস্‌ সবসময় হাইয়েস্ট থাকত। কিন্তু শুধু ঘাড় গুঁজে বই পড়াই নয়, ফিল্ড-ওয়ার্কে, প্যালিওন্টোলজি ল্যাবরেটরির কাজে, মডেলিং অ্যান্ড রি-কন্সট্রাকশানে, সমস্ত কিছুতেই ওর সমান পারদর্শিতা।
লস্‌-অ্যাঞ্জেলেসের বিখ্যাত এলিজাবেথ মিউজিয়ামে জুনীয়ার প্যালিওন্টোলজিস্ট হিসেবে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে সব্বার তাক লাগিয়ে দিয়েছিল অর্ক। মিউজিয়ামের কিউরেটার ডক্টর মাইকেল গর্টন নিজে ওর পিঠ চাপড়ে দিয়েছিল। শুরুই করেছিল বছরে এক লাখ ডলারের স্যালারি প্যাকেজ নিয়ে। সাহানা, ওর বাল্য-প্রেম, তখন অল্‌রেডি কয়েকবছর চাকরি করে ফেলেছে কোলকাতায় একটা নামজাদা মাল্টিন্যাশানাল অ্যান্টি-ভাইরাস প্রস্তুতকারক সফটওয়্যার কোম্পানিতে। অর্কর এলিজাবেথ মিউজিয়ামে চাকরি পাওয়ার সাথে সাথে অবশ্য অনেক কান্নাকাটি, ধরাধরি করে সাহানাও ওই কোম্পানির লস্‌-অ্যাঞ্জেলেস অফিসে একটা ডেপুটেশান বাগিয়ে ফেলেছিল। এই ডিসেম্বারের ছুটির মরশুমে অনেক প্ল্যান করে রেখেছিল সাহানা কাছাকাছি সব জায়গায় ঘুরতে যাবে অর্কর সাথে, কিন্তু অর্ক ছুটল আর্জেন্টিনায়! আর্জেন্টিনার প্যাটাগোনিয়ায় নাকি প্রচুর দৈত্যাকার সব ডাইনোসরের ফসিল পাওয়া গেছে, তাই বেশীরভাগ মিউজিয়ামই প্রত্যেক বছর একটা করে প্যাটাগোনিয়ার প্রজেক্টের বাজেট স্যাংকশান করে রাখে, যদি শিকে ছেঁড়ে, যদি আরেকটা বিরাট ডাইনোসর ঘরে তুলতে পারে নিজের মিউজিয়াম!
- “তা তোদের প্রত্যেক বছরই যখন যেতে হয়, তো ডিসেম্বর মাসে কেন, আগে থাকতে কেন পাঠালো না?” সাহানা যখন প্রথম শুনেছিল, তখনই আপত্তি জানিয়েছিল।
- “আরে সে আর বলিস না, গোটা এলিজাবেথ মিউজিয়ামে একজনই সিনীয়ার লেভেলে আছে যে কোন জিনিস ঠিকঠাক প্ল্যান করতে পারেনা। দুর্ভাগ্যবশত সে আবার আমারই বস্‌। আবার মালটা নাকি বাঙ্গালি, কাজেই লাস্ট মোমেন্ট পর্যন্ত কাজ ফেলে রাখার স্বভাব।”
- সাহানা আশ্চর্য হয়ে বলেছিল “নাকি বাঙ্গালি মানে? তুই সিওর না বাঙ্গালি কিনা?”
- “কি করে সিওর হব। আইকার্ডে ফুলনেম লেখা আছে সন্দীপ দাস। আমি একগাল হেসে স্যার আপনি বাঙ্গালি নাকি জিজ্ঞাসা করাতে বলল আর কখোনো যেন ওয়ার্কপ্লেসে ন্যাস্টি নেটিভ ল্যাঙ্গুয়েজ ইউস না করি। আরো জানালো হি ইস আ প্রাউড আমেরিকান। অন্য কোনো পরিচয় ওর দরকার নেই। ওকে যেন স্যান্ডি বলে ডাকি। পরে খবর নিয়ে জানলাম আমেরিকান সিটিজেনশিপ পেয়েছে মাত্র বছর দুয়েক হল। তাতেই লাঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। যে কোনো গ্যাদারিং-এ সুযোগ পেলেই ইন্ডিয়ার নিন্দা করে নেয়। ন্যাস্টি , নোংরা, আনহাইজিনিক দেশ। ইন্ডিয়ানদের কোনো ওয়ার্ক কালচার নেই, আমরা সব আমেরিকান কন্স্যুলেটের সামনে লাইন লাগিয়েই আছি ফার্স্ট চান্সে দেশ ছাড়ব বলে। এদিকে একদম কার্টুনের মত দেখতে। মাথায় টাক, নাকটা ব্যাঁকা, আর সামনের দুটো দাঁত নেই। ফোকলাটা যখন ত, থ, দ, ধ, ন দিয়ে শুরু কোন শব্দ বলে শোনার মত হয়।”
সাহানা রেগে গিয়ে বলেছিল “তুই সুড়সুড় করে তাতে সায় দিস বসের গুডবুকে থাকার জন্য।“
- “শালা আমি কিছু বলতে পারি না নিজে বিদেশে এসে চাকরি করি বলে। আমাদের দেশে প্যালিওন্টোলজি নিয়ে কাজের সুযোগ থাকলে কি আর এই বিদেশ বিভুঁইতে পরে থাকতাম। স্যান্ডি দাসের বাঁকা নাকে এক ঘুঁষি বসিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যেতাম।“
- “আচ্ছা সে না হয় মানলাম তোর বস লোকটা খুব পাজী কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে ছড়ালে তো আমেরিকার প্রাইভেট মিউসিউয়ামে টিকতে পারার কথা নয়। এতো আর আমাদের সরকারি চাকরি নয়, আমাদের ক্লায়েন্টের কোম্পানিতে তো সিইও কেও একদিনের নোটিসে ফায়ার করেছিল।“
- “সে দিক দিয়ে যদি দেখিস আমার বস হান্ড্রেড পার্সেন্ট বাঙ্গালি। উপরতলায় তেল মেরে, কলিগদের পিছনের কাঠি করে, সাব-অর্ডিনেটদের বাঁশ দিয়ে নিজের পজিসন একেবারে মজবুত করে রেখেছে।“
- “খবরদার বাঙ্গালির নিন্দা করবি না।‘ সাহানা ফুঁসে উঠেছিল। “আমেরিকানরা বুঝি পাজি হয় না? পড়তিস আমার ক্লায়েন্টের পাল্লায়, আমাদের বাথরুমে গেলেও সিটে নোট রেখে যেতে হয় না হলেই আমাদের বসকে গিয়ে কম্পলেন করে অমুক তো সিটেই থাকে না।“
- “আরে স্যান্ডি দাসের প্যাঁচালো মস্তিস্কের কাছে ওসব নস্যি বুঝলি। লোকটার মাথায় এমন প্যাঁচ আছে যে পেরেক ডোকালে স্ক্রু হয়ে বেড়িয়ে আসবে। ও ইচ্ছে করেই এই প্রোজেক্টটা ডিসেম্বরে করেছে যাতে ওর বস আর অন্য কলিগরা ছুটিতে থাকে। আমার মত জুনিয়রকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নিয়ে নিজে ম্যাক্সিমাম ক্রেডিটটা নেবে।“
- “তুই পুরো ক্রিস্মাসের ছুটিটা মাটি করে ঘাড় গুঁজে কাজ করবি আর তোর নাক ব্যাঁকা বস ক্রেডিট নেবে?” সাহানা রাগে জ্বলে উঠেছিল।
- “আরে নিকগে ক্রেডিট, আমার কাজ শেখা নিয়ে কথা। প্লাস সেরকম বড় কিছু পেলে আমিও কিছুটা লাইম লাইটে আসব। আফটার অল আমি প্রোজেক্টটা লিড করছি।”

- (৩)
এক সপ্তাহ ধরে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ‘পেট্রিফায়েড ফরেস্ট’ থেকে সেরকম কিছু চমকপ্রদ ফসিল উদ্ধার করা গেল না। এদিকে অর্কর টীমের একজন সিনীয়ার প্যাটাগোনিয়ান সায়েন্টিস্ট এডুয়ার্ডো সোলা কয়েকদিন ধরেই অর্ককে বলছিলেন ‘লাস্‌ গ্রুটাস্‌’ বীচের পাশে একটা জায়গার কথা, যেখানে ওনার মতে কখনও কোন কাজ হয়নি। ওখানে এক্সক্যাভেশান করার আইডিয়াটা অর্করও মনে ধরল। ও নিজে গিয়ে বুধবার বিকেলে একবার জায়গাটা দেখে এল। বিখ্যাত ‘লাস্‌ গ্রুটাস্‌’ বীচের পাশে একটা পাথুরে এলাকা, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে জোয়ারের সময় ওই পুরো জায়গাটা জলে ঢেকে যায়, শুধু ভাঁটার সময় ওই বিস্তীর্ণ পাথুরে এলাকাটা জেগে ওঠে।
- “মিস্টার সেন, আমাদের কিন্তু টাইডের সময়গুলো জেনে নিয়ে খুব প্ল্যান্ড ওয়েতে খুব তাড়াতাড়ি ফসিল খুঁজতে হবে, হাই-টাইডের সময়গুলো আমরা সেভাবে ফীল্ড্‌-ওয়ার্ক করতে পারব না, আমরা বরং সেই সময় আমাদের ফাইন্ডিংগুলো নিয়ে গবেষণা করব, আবার লো-টাইড এলে ফীল্ডে যাব”, এডুয়ার্ডোর প্ল্যানটা অর্ক অ্যাপ্রুভ্‌ করে দিল, আর কথা হল শুক্রবার থেকে ওরা ‘পেট্রিফায়েড ফরেস্ট’ ছেড়ে ‘লাস্‌ গ্রুটাস্‌’ বীচের পাশে তাঁবু ফেলবে পুরো টীমের।
লোক্যাল গাভার্ন্মেন্টের থেকে যা যা পেপার-ওয়ার্ক করার সেগুলো এডুয়ার্ডো সোলাই করে নিইয়ে এল একদিনের মধ্যে। বেশী কিছু ছিলও না। পেট্রিফায়েড ফরেস্ট একটা ন্যাশানাল পার্ক, সেটার পেপার-ওয়ার্ক অ্যামেরিকা থেকেই করা হয়েছিল, কাজেই ওই জায়গায় খননকার্য না করে লোকাল একটা বীচে শিফট করার প্ল্যানটা খুব সহজেই পাশ করানো গেল।
শনিবার ভাঁটার সময়ে পশ্চিম দিকের একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দেখা গেল অনেক গাছের ডাল পড়ে রয়েছে, সেগুলোও মনে হল ফসিলাইজ্‌ড্‌ ডাল, কিন্তু অর্কর স্পেশালাইজেশান হল ভার্টিব্রেট প্যালিওন্টোলজি, কাজেই উদ্ভিদের ফসিল নিয়ে ও বিশেষ আগ্রহ দেখাল না। বরং ওর টীমের অন্য একজন লোক্যাল ইনভার্টিব্রেট প্যালিওন্টোলজিস্ট মিস মারিয়া ডিক্রুজকে ওইদিকে পাঠিয়ে দিল যদি ওঁর রিসার্চের কোন সুবিধা হয়।
রাত্রে খেতে বসে মারিয়া ইংরেজি আর স্প্যানিশ মিশিয়ে বললেন, “মিস্টার সেন, ওইদিকে অনেক ভালো ভালো ফসিল আছে ট্রায়াসিক এজের গাছের, এটা একটা খুব অনবদ্য আবিষ্কার, ঐ যুগের বড় গাছের ফসিল বড় একটা পাওয়া যায়না। এটা আপনি কি নিয়ে যাচ্ছেন লস্‌-অ্যাঞ্জেলেসে?”
- “আরে না না, আপনি নিশ্চিন্তে ওটা আপনাদের ক্যামেরুন মিউজিয়ামে ট্র্যান্সপোর্ট করে দিতে পারেন কালকেই। এলিজাবেথ মিউজিয়াম অবশ্য ট্র্যান্সপোর্টেশান কস্ট বিয়ার করবে না, কিন্তু আপনার মিউজিয়াম এর খরচা দিলে আপনি স্বচ্ছন্দে নিয়ে যান”, হাসিমুখে অর্কর উত্তর। দীর্ঘদিন ক্যালিফর্নিয়াইয় পড়াশোনা আর চাকরি করার ফলে অর্ক স্প্যানিশ ভাষাটা বেশ ভালোই শিখেছে, ক্যালিফর্নিয়ায় প্রচুর ল্যাটিনো অর্থাৎ মেক্সিকান লোকজন বাস করে যেহেতু ক্যালিফর্নিইয়া স্টেটটা একেবারে মেক্সিকোর বর্ডারে। ভালোই হল আর্জেন্টিনায় এসে স্প্যানিশ ভাষা বোঝা নিয়ে কোন ঝামেলায় পড়তে হল না।
- “একটা ফসিল নিয়ে অবশ্য একটু খটকা লাগছে, জোয়ার এসে যাওয়াতে আমি খুব ভালো করে ইনভেস্টিগেট করার টাইম পাইনি, কিন্তু আমার সন্দেহ ওটা গাছের ডালের ফসিল নয়, ওটা কোন জন্তুর ফসিল, অবশ্য সাধারণ কুমির, হাঙ্গর এসবও হতে পারে।”
- “একেবারে কিছুই তো পেলাম না মিস মারিয়া, কাজেই আর একবার নাহয় চেষ্টা করে দেখে আসব’খন, বলা যায় না, হয়ত রেয়ার কোন ভার্টিব্রেট ফসিল হলেও হতে পারে।”
- “ঠিক আছে, কাল সকাল সাতটায় ভাঁটার শুরু, আমাদের তার মধ্যে ফিল্ডে পৌঁছে গিয়ে রেডি হয়ে থাকতে হবে ক্লিন্তু।”
- “বুয়েনস্‌ নচেস!”, অর্ক সেই রাত্রের মত গুড নাইট বলে শুতে চলে গেল।
পরেরদিন সকাল বেলা পুরো টীম হাজির সেই পাথুরে জায়গায়। বিশেষ ধরণের পাথর ছাড়া ফসিল পাওয়ার আশা দুরাশা মাত্র। যেমন আগ্নেয় শিলা হলে কিছুতেই কোনদিন কেউ ফসিল পাবে না। সেডিমেন্টারি পাথর হলে ফসিল পাওয়ার চান্স সবথেকে বেশী। মিস মারিয়া নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ার আগে অর্ককে বিশেষ ফসিলটা দেখিয়ে দিলেন।
অর্কর জহুরীর চোখ এক ঝলক দেখেই সন্দেহ করল যেটা গাছের ডাল বলে ভুল হছে সেটা এক খুব রেয়ার জলচর ডাইনোসরের শিরদাঁড়ার অংশ। ও শুধু বইতেই দেখেছে এই ডাইনোসরের থীওরি। কিন্তু এখন তো অনেক কাজ বাকি, এই পরো ফসিলটা খুঁড়ে বার করবে কি করে? সময় কই? সময়ের সাথে রেস করতে হবে যে! কয়েক ঘন্টার মধ্যে জোয়ার এসে পুরো ডুবিয়ে দিয়ে লুকিয়ে ফেলবে এই অসামান্য আবিষ্কার। ও পুরো টীমকে লাগিয়ে দিল এই ফসিলটা খুঁড়ে বের করার কাজে। মারিয়া অবশ্য অভয় দিয়ে বললেন যে জোয়ার আসলেও ভয়ের কিছু নেই। ফসিলটাকে ভাসিয়ে নিয়ে তো আর যেতে পারবে না। অর্ক কিছুটা কাজ এগিয়ে রাখল। তাড়াতাড়ি একটা ছোট টুকরো প্রাথমিক ভাবে স্ট্র্যাটিগ্র্যাফিক অ্যানালিসিস করে দেখল জুরাসিক এজেরও আগের ট্রায়াসিক এজকে ইন্ডিকেট করছে। আজকে আবার ভাঁটা আসবে রাতে, তখন ফীল্ড-ওয়ার্ক করা যাবে না। অগত্যা বাকি কাজ আবার কালকে সকালে শুরু করতে হবে। বস্‌কে অবশ্য একটা ইমেইল করে দিতে হবে, ওর সন্দেহ যদি সত্যি হয়, তাহলে এটা একটা সত্যিই যাকে বলে সেন্সেশানাল ডিস্কাভারি।
অর্ক রাত্রে ফিরে এসে ল্যাপটপ খুলে বসল। সাহানার সাথে চ্যাটিং করবে, কিন্তু তার আগে জরুরি ইমেইলটা পাঠিয়ে দিতে হবে বস্‌কে। নাঃ শুধু বস্‌কে নয়, এটা এমনই একটা খবর যে এলিজাবেথ মিউজিয়ামের কিউরেটারকেও একটা কপি দেবে ও এই ইমেইলটার।
নাঃ, সাহানার সাথে একবার ফোনেই কথা বলা যাক। কোম্পানি তো ইন্টারন্যাশানাল রোমিং করিয়েই দিয়েছে ওর মোবাইলটার। লস্‌-অ্যাঙ্গেলেসের সাথে আর্জেন্টিনার এই শহরের টাইম ডিফারেন্স ৫ ঘন্টা, ওর এখন রাত নটা, তার মানে সাহানার বিকেল চারটে সবে।
- “হ্যালো সাহানা, অর্ক বলছি, আরে শোন আজকে একটা দারুণ খবর আছে!”
- “কি? জ্যান্ত ডাইনোসর খাঁচায় পুরে নিয়ে আসছিস এখানে?”
- “বাজে ইয়ার্কি রাখ, শোন, আজকে একটা ফসিল দেখেছি যেটা আমার ধারণা প্রচন্ড রেয়ার মেরিন ডাইনোসরের!”
- “মেরিন ডাইনোসর আবার কি? সমুদ্রে থাকত?”
- “হ্যাঁ, এদের বলা হয় ‘থ্যালাট্টোসর’, সমুদ্রে থাকত, খুব কম হলেও এদের কিছু কিছু ফসিল আগেও পাওয়া গেছে, ১৩ – ১৪ ফুট লম্বা হয়, কিন্তু আমি যেটা দেখেছি, সেটা মনে হচ্ছে প্রায় ৫২ ফুট লম্বা, মানে বুঝতে পারছিস? তুই ৪’১১”, তোর দশ-গুন লম্বা!”
- “আমি ৫’১”, যাইহোক সেটা অবান্তর, আর আমি ডাইনোসরের সঙ্গে পাল্লা দিতেও চাইনা, তুই বলেই ওরকম একটা বাজে কম্প্যারিজন টেনে আনলি। নিজের গার্ল-ফ্রেন্ডকে যে কেউ ডাইনোসরের সাথে তুলনা করে হ্যাটা করতে পারে, বাপের জন্মেও শুনিনি!”
- “এনিওয়ে, যা বলছিলাম, ৫২ ফুট লম্বা থ্যালাট্টোসর একটা সেন্সেশানাল নিউজ আমাদের ভার্টিব্রেট প্যালিওন্টোলজির জগতে! একটা প্রকান্ড টিকটিকি বা কুমির বা গোসাপ কল্পনা কর, যতটা ভয়ংকর ভাবছিস, তার চাইতেও বেশী ভয়ংকর দেখতে, কারণ এদের দাঁতগুলো সাংঘাতিক, আর লেজের আগা একটা বিশাল ত্রিশূলের মতন, ঠিক যেমন শয়তানের লেজটা আমরা কল্পনা করে থাকি। এটা এদের সাঁতার কাটতে আর জলের তলায় স্টিয়ার করতে হেল্প করত। আমার টীমের লাইফ্‌ রেস্টোরেশান সায়েন্টিস্ট এডুয়ার্ডো সোলা কালকের মধ্যে চেষ্টা করবে ফুল টু-ডাইমেনশানাল কালার্ড ফোটো জেনারেট করার। আমি জাস্ট দেখতে পাচ্ছি লস্‌-অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের ফ্রন্ট পেজের হেডলাইন্স, আর আমাদের এলিজাবেথ মিউজিয়ামের লিওনার্দো হল-এ বিশাল ডিস্পলে! যাক সিনীয়ার প্যালিওন্টোলজিস্টএর প্রোমোশানটা বেশ তাড়াতাড়িই পাব মনে হচ্ছে রে।”
- “ইউ ডিজার্ভ ইট্‌ অর্ক, তোর মত পাগল প্যালিওন্টোলজিস্ট আমি আর দেখি নি, আমার চাইতেও তুই তোর এই থ্যালাট্টোসরকে একটু হলেও বেশী ভালোবাসিস, সত্যি কিনা বল?”
- “না সত্যি নয়, তোর থেকে এই থ্যালাট্টোসরকে আমি একটু নয়, অনেকটা বেশী ভালোবাসি!”

(৪)
একে শনিবারের বিকেল, তায় ক্রিসমাস ইভ। এলিজাবেথ মিউজিয়ামের সব ডিপার্টমেন্টই শুনশান্‌। কিন্তু স্যান্ডি দাস অফিসে এসেছিল জাস্ট এটা পরে প্রমাণ করতে যে সে শনিবারেও কাজ করে, কি কাজ করে সেটা মুখ্য নয় অবশ্য। প্লাস্‌ আরেকটা প্ল্যান ছিল আই.টি ডিপার্টমেন্টের ইন্‌ফর্মেশান সিকিউরিটি বিভাগের একজন জুনিয়ার এম্পলয়ীকে ডেকে কিছু নরমে গরমে বাজে যুক্তি দেখিয়ে অন্যদের মেইল-বক্সের ইমেলের অ্যাক্সেস নেওয়া কয়েক ঘন্টার জন্য। চারদিকে কি হচ্ছে সেটা জেনে নেওয়ার এর চাইতে ফুল্‌প্রুফ উপায় আর নেই। অ্যাক্সেসটা নেবে জাস্ট ৩ ঘন্টার জন্য, তারপর রিসেট করে দিতে বলবে এবং সব ট্রেইল বা লগ্‌ ডিলিট করে দিতে বলবে যাতে পরে কেউ কোনদিন না জানতে পারে এই তিনঘন্টার ‘ডিজিটাল আড়িপাতার’ প্ল্যানটা।
ক্রিসমাস বা অন্য কোনো ফেস্টিভালের ছুতোয় কাজ ফাঁকি দেওয়া তার দুচোখের বিষ। তবে এটা ঠিক স্যান্ডির জীবনে ফেস্টিভাল ব্যাপারটার জায়গা নেই। দুচার বছর আগে একজন অল্প পরিচিত বাঙ্গালি তাকে প্রবাসীদের দুর্গাপুজোয় যাবার প্রস্তাব দেওয়াতে সে পরিস্কার জানিয়ে দেয় দুর্গাপুজো ইত্যাদি নিয়ে হুজুগের জন্যই বাঙ্গালির ওয়ার্ক কালচার নষ্ট হয়ে গেছে। যারা দুর্গাপুজোর মত ন্যাস্টি হুজুককে ইউএসেতে চালু করে এখানকার ওয়ার্ক কালচার নষ্ট করতে চায় তাদের আটলান্টিক পার করে দিয়ে আসা উচিত। স্যান্ডির মতে আমেরিকা গভর্মেন্টের উচিত এই পুজো কমিটির বিরুদ্ধে লিগ্যাল স্টেপ নেওয়া। এদিকে আমেরিকানদের নিজস্ব ফেস্টিভাল যেমন ক্রিসমাস, থ্যাঙ্কস গিভিং বা হ্যালোউইন সম্পর্কেও স্যান্ডি পুরোপুরি অজ্ঞ। জীবনকে উপভোগ করার দুটোই উপায় জানে স্যান্ডি, হয় মিস্ট্রেস ন্যাটালির বিছানা নয় লাসভেগাসের ক্যাসিনোতে জুয়া খেলা। এই জুয়ার কারনেই স্যান্ডির স্যালারিটা বেশ মোটা অঙ্কের হলেও কিন্তু সে ক্রেডিট কার্ডের দেনায় জর্জরিত। নিজেকে আমেরিকান বলে জাহির করলেও আমারিকানদের সদ্‌গুন গুলো সে কিছুই রপ্ত করতে পারেনি কিন্তু পাক্কা আমেরিকানদের মত অমিতব্যায়ী হয়ে উঠেছে। বউ ছেলে মেয়ে সকলেই স্যান্ডির মতই অমিতব্যায়ী। বারোটা ক্রেডিট কার্ডের পাঁচটা কার্ডে অ্যাড-অন হিসাবে আছে বউএর নাম আর পাঁচটা কার্ডে আছে মিস্ট্রেস ন্যাটালির নাম। দুটো কার্ড নিজের হাতে রেখেছে লাস ভেগাসে গ্যাম্বলিং এর খরচ সামলানোর জন্য। লাসভেগাসের ক্যাসিনোতেই তার ন্যাটালির সাথে আলাপ এবং বিবাহ-বহির্ভুত সম্পর্কের সূত্রপাত। ন্যাটালি মার্সিডিজ ছারা চড়বে না, ন্যাটালি ভেগাসে বেলাজিও ছাড়া রাত্রিবাস করবে না, ন্যাটালি ‘ভিক্টোরিয়াস সিক্রেট’ ব্র্যান্ডের সবথেকে দামী অন্তর্বাস ছাড়া পড়বে না, আর মিস্ট্রেসের সব ব্যায়ভার অব্‌ভিয়াসলি মিস্টার স্যান্ডি ওরফে সন্দীপ দাসের। মাসের থার্ড উইক থেকেই ন্যাটালি কমপ্লেন করতে থাকে পাঁচটা ক্রেডিট কার্ডের-ই ক্রেডিট লিমিট রিচ করে গেছে। হাল্কা করে দুএকবার বলেওছে এভাবে কিপ্টেমি করলে ন্যাটালি বেশীদিন রিলেশনশিপ রাখতে পারবে না। কাজেই ফাইন্যানশিয়াল কন্ডিশানটা ভিতরে ভিতরে বেশ ফোঁপরা হয়ে গেছে স্যান্ডির।

নিজের ইন্‌বক্সে অর্কর পাঠানো একটা মেইল দেখে ‘ডিজিটাল আড়িপাতা’ বন্ধ রেখে ওই ইমেইলটা পড়তে মনোনিবেশ করল। পড়তে পড়তে চোখটা বড় বড় হয়ে উঠল স্যান্ডির। অর্কর রিপোর্টটা খুঁটিয়ে পড়ল। কিংডম, ফাইলাম, ক্লাস, নোড, সাব-ক্লাস, অর্ডার সব কিছু রিপোর্টে পাঠিয়েছে অর্ক, ছবিও তুলেছে, স্ট্র্যাটিগ্র্যাফিক অ্যানালিসিসের প্রাথমিক ডেটা দিয়েছে। ফসিল-এর সুপার-ফ্যামিলি অ্যাস্‌কেপ্টোসরোইডিয়া। রিপোর্টে এটাও লেখা যে ৫২ ফুট লম্বা এই দানব রেপ্টাইল আগে কোনদিন কোনদেশেই পাওয়া যায়নি। হলে এটা হবে একটা স্টার ফাইন্ড! অর্কর এই ইমেইলটা পেয়ে একটা চমৎকার ফন্দি মাথায় এসে গেল স্যান্ডির। চট্‌ করে একটা ইমেইলের রিপ্লাই দিয়ে দিল স্যান্ডি।
“অর্ক, আমি তোমার অ্যানালিসিস রিভিউ করেছি। তোমার পাঠানো বেসিক স্ট্র্যাটিগ্র্যাফিক অ্যানালিসিসও দেখছি। আন্‌ফরচুনেটলি, আমি তোমার সাথে একমত হতে পাচ্ছি না। স্ট্র্যাটিগ্র্যাফিক অ্যানালিসিসের প্রিসিশান নিয়ে আমার ডাউট আছে। আমার মনে হয় যন্ত্রটা কোন পাতি নন্‌-অ্যামেরিক্যান ম্যানুফ্যাকচারারের তৈরি, এবং এর ডেটা পুরোটাই আন্‌রিলায়েব্ল। আর ফসিলটাও আমার মনে হচ্ছে কোন জায়েন্ট ক্রোকোডাইলের। এটা নিয়ে সময় নষ্ট না করাই ভালো। প্লাস তোমায় তো অ্যাসাইন্‌মেন্ট দেওয়া হয়েছিল পেট্রিফায়েড ফরেস্টে এক্সক্যাভেশান করার, তুমি নিজে কিসের ভিত্তিতে সাইট চেঞ্জ করে ‘লাস্‌ গ্রুটাস্‌’ নামক এক অখ্যাত বীচে কাজ করছ? এলিজাবেথ মিউজিয়ামের ফান্ডস্‌ নিয়ে ছেলেখেলা করার অথরিটি তোমায় দেওয়া হয়নি। তুমি ইমেইল পাওয়া মাত্র রিটার্ন ফ্লাইটে লস্‌-অ্যাঞ্জেলেস এসে পৌঁছও। আর দয়া করে এইসব অ্যামেচারিশ অ্যানালিসিস এবং ভিত্তিহীন গেস্‌ওয়ার্কের গুজব এখানে কোন স্টাফেদের মধ্যে ছড়িও না। আমি তোমার এই ইন্‌কম্পিটেন্ট অ্যানালিসিসকে এবারের মত কোন উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কানে তুললাম না।
রিগার্ড্‌স্‌, অ্যান্ডি”
ইমেইল পেয়ে অর্কর তো মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এত ভুল করবে ওর চোখ? আর শুধু তো ওই নয়, ওর পুরো টীমই তো ওর ধারণায় সায় দিয়েছে। তবে কি শুধুই ও লীড করছে বলে ওর হ্যাঁতে হ্যাঁ মিলিয়ে গেছে স্রেফ? কিন্তু এই টীমের লোকজনকে তো এরকম তোষামুদে মনে হয়নি? আর এখানে তো ওরা সবাই একটা প্রোজেক্ট টীম, কাজেই ওকে তেল দিয়ে ওদের কোন লাভও হবেনা। অর্ক ঘড়ি দেখলো এখন লস অ্যাঞ্জেলসে রাত সাড়ে নটা। এখনো ফোন করলে স্যান্ডিকে পাওয়া যেতে পারে। একবার কথা বললে ও বস্কে বুঝিয়ে দিতে পারবে ওর অ্যানালিসিস ভুল নয়। অর্ক হোটেলের ফোন থেকে বার দশেক বসের সেলফোনে কল করার চেষ্টা করল কিন্তু প্রত্যেকবার ভয়েসমেলে গেল। রাত দশটা নাগাদ হতাশ হয়ে স্যান্ডিকে আবার একটা ইমেল লিখতে বসল। অর্কর মনমেজাজ এতই খারাপ ছিল সাহানাকে প্রাত্যহিক ফোনটাও করতে ইচ্ছা হলনা।
পরদিন সকালে অর্ক ইমেল খুলে দেখল স্যান্ডি ওর ইমেলের উত্তরে একলাইনের একটা ইমেল করেছে। “এলিজাবেথ মিউসিয়ামে কাজ করার ইচ্ছা থাকলে পরশু সকাল নটায় নিজের ডেস্কে হাজির থেকো। না হলে আর অফিসে আসার দরকার নেই। এই টপিকে আর কোনো ইমেল আমাকে বা অফিসের অন্য কাউকে পাঠালে নেক্ট ইমেলে আমি তোমার রিলিজ লেটার পাঠিয়ে দেব। কষ্ট করে আর অফিসে আসতে হবে না।“
এরপর অর্কর না ফিরে আর কোনো উপায় রইল না। অর্ক হঠাৎ ফিরে আসায় সাহানা খুব খুশি হয়েছিল। কিন্তু অর্কর মুড দেখে ও আর কোথাও বেড়াতে যাবার কথা তুলতে পারল না। অর্ক কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না যে স্যান্ডির দুটো ইমেল ৫২ ফুট লম্বা থ্যালাট্টোসরকে বড় সাইজের একটা কুমীর বানিয়ে দিতে পারে। রুমালের বেড়াল হয়ে যাওয়াটাও এর থেকে কম আশ্চর্যজনক।

(৫)
অর্কর পাঠানো অ্যানালিসিস রিপোর্টটা পড়ে স্যান্ডির মনে হয়েছিল ও জ্যাকপট পেয়েছে। ৫২ ফুট লম্বা থ্যালাট্টোসর !!। এলিজাবেথ মিউসিয়ামের টার্ণ ওভার ডবল হয়ে যাবে। তারপর স্যান্ডির মাথায় এল তাতে ওর পার্সনালি কোনো লাভ নেই। জুনিয়র ছেলেটাকে ল্যাং মেরে থ্যালাট্টোসর পাবার পুরো ক্রেডিটটা যদি স্যান্ডি হাসিল করে তাতেই বা ওর কি হবে? কিছু পিঠ চাপড়ানি আর শুকনো বাহবা? ওর নেক্ট প্রমোসনটা হল ডিরেক্টর। কিন্তু মাইক না মরলে যতই কাজ দেখাও ডিরেক্টর হবার চান্স নেই। তাছাড়া স্যান্ডির হাতে এখুনি কিছু ক্যাশ টাকার দরকার। স্যান্ডি ওর সেল ফোন থেকে বব কেনেডির নাম্বার খুঁজে বের করল। বব সান দিয়েগোর হিস্টোরিকাল মিউসিয়ামের ডিরেক্টর। মাস ছয়েক আগে আলাপ হয়েছিল একটা কনফারেন্সে। প্রথম আলাপেই স্যান্ডি বুঝেছিল লোকটা ওর ধাঁচের। সোজা রাস্তায় কাজ না হলে, আনায়াসে বাঁকা পথে যেতে পারে। বব ফোন তুলতে স্যান্ডি কোনো রকম ভনিতা না করে বলল “বব তোমার সাথে জরুরি কথা আছে, এখন কথা বলা যাবে?”
বব তখন একটা জমজমাট কক্টেল পার্টিতে ফিফথ্‌ পেগ শুরু করছে। বিরক্ত গলায় বলল “আমি ছুটিতে আছি, থার্ড জানুয়ারী অফিসে ফিরব তখন ফোন কর।“
-“তুমি যদি তোমার মিউসিয়ামের টার্ন ওভার ডবল করতে চাও তাহলে তোমাকে এখোনি কথা বলতে হবে। না হলে আমি অন্য কোনো মিউসিয়ামে কন্টাক্ট করব।“
বব তিরিশ সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল। “ওকে ক্যারি অন।“
-“আমার কাছে ৫২ ফুট লম্বা থ্যালাট্টোসরের ফসিলের খবর আছে। উপযুক্ত দাম পেলে তোমাকে একজাক্ট লোকেশন বলতে পারি।“
৫২ ফুট লম্বা থ্যালাট্টোসরের ফসিলের নাম শুনেই ববের পাঁচ পেগ ড্রিংক্সের নেশা কেটে নার্ভাস সিস্টেম একেবারে টানটান হয়ে উঠেছে। কিন্তু সে পাকা লোক, সহজে উত্তেজিত হয়না। ঠাট্টার সুরে বলল “কেন এলিজাবেথ মিউসিয়াম কি দেউলিয়া হয়ে গেছে? মিউসিয়ামের ফসিল গুলো সস্তায় বিক্রি করে পাত্তাড়ি গোটাবে?”
- “বব, তুমি ভালো করেই জানো যে ৫২ ফুট লম্বা থ্যালাট্টোসরের ফসিল শুধু এলিজাবেথ মিউসিয়াম কেন বিশ্বের কোন মিউজিয়ামেই আজ পর্যন্ত নেই! ডীল করতে চাও তো আজকেই সন্ধ্যে সাতটায় স্টারবাক্সে চলে এস।”
- “ওকে, সী ইউ।”
স্টারবাক্সে বসে স্যান্ডি ববকে পুরো ব্যাপারটাই বলল। জুনীয়ার প্যালিওন্টোলজিস্টকে প্যাটাগোনিয়ায় পাঠানো, প্রস্পেক্টিং সাইটের রদবদল, জোয়ারের সময় ঢেকে থাকা ফসিল, ৫২ ফুট লম্বা থ্যালাট্টোসরের অনবদ্য ফসিলের বিবরণ, আর সবশেষে অর্ককে পাঠানো ওর ইমেইল।
- “কিন্তু সেই জুনীয়ার প্যালিওন্টোলজিস্ট যে আর কাউকে ওই এমাইল ফরোয়ার্ড করেনি তার গ্যারান্টি কি?”
- “আমি নিজে হাতে ওর মেইল-বক্স মেরামত করে দিয়েছি। যে ইমেইল ও পাঠিয়েছে আর তার কি জবাব পেয়েছে সেগুলো সবই আমার ক্রিয়েশান।”
- “এই লোকটা চেঁচামেচি করে যদি?”
- “সেটা তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও। তুমি বল এই সাইটের ইনফোর্মেশান পেলে আমি কি পাচ্ছি?”

(৬)
দিন পাঁচেকের মধ্যে সান দিয়েগোর হিস্টোরিকাল মিউসিয়ামের একটা বিশাল টীম পৌঁছল লাস্‌-গ্রুটাসে। পুরো এক্সক্যভেশানটাই হল অসম্ভব দ্রুতগতিতে। লোকাল প্যালিওন্টোলজিস্টরাও বেশ বিস্মিত হল এটা জেনে যে এত বড় একটা টীম ক্যালিফোর্নিয়া থেকে উড়ে এসেছে। নর্ম্যালি তো কিছু সিনীয়ার প্যালিওন্টোলজিস্ট আসেন আর বাদবাকি পুরো টীমটাই হয় লোকাল। সবথেকে আশ্চর্যের কথা যে লাস্‌-গ্রুটাসে প্রস্পেক্টিং করতে একটুও সময় লাগল না ওই টীমের। এসেই যেন জ্যাকপট পেল। একটা বিসাল ৫২ ফুট লম্বা থ্যালাট্টোসরের ফসিল উদ্ধার করে তিন্দিনের মধ্যে পুরো ফসিল নিয়ে টীমটা ফিরে গেল স্যান-ডিয়েগোয়।
সান দিয়েগোর হিস্টোরিকাল মিউসিয়ামে সেই মাসে প্যালিওন্টোলজিস্টরা নাওয়া খাওয়া ভুলে কাজ করতে লাগল। থ্যালাট্টোসরের এক একেকটা হাড়কে অ্যাসেটোন দিয়ে পালিশ করা, তারপর বি-৭২ অ্যাঢেসিভ দিয়ে জোড়া লাগানো, আবার ভুল হলে খুলে ফেলে ফের গোড়া থেকে শুরু করা, এরকম হাজারটা কাজ চলতে থাকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। এখানে বলে রাখি যে সব মিউজিয়ামে যে ডাইনোসরের বিশাল কঙ্কালগুলো ঝোলানো থাকে, সেগুলো কোনটাই ডাইনোসরের আসল ফসিল বা হাড় নয়, সবই ফাইবার-গ্লাস রেপ্লিকা! কেন? আরে, অত ডেলিকেট লাখ লাখ বছরের পুরনো হাড় কেউ সাহস করে পাব্লিকের সামনে ঝুলিয়ে রাখে? ওত ফ্ল্যাশ-ফোটোগ্যাফি, ময়েশ্চার, অতি-আগ্রহী টুরিস্টের স্পর্শ, এসব থেকে কে বাঁচাবে ওইসব দুষ্প্রাপ্য ফসিল? কোলকাতার মিউজিয়ামে তো ম্যামথের ফসিলের ওপর “মিন্টু লাভ্‌স্‌ বাবলি”র মত গ্র্যাফিটিও আঁচড় কেটে লেখা আছে বহু জায়গায়! কাজেই সান দিয়েগোর হিস্টোরিকাল মিউসিয়ামেও ফাইবার গ্লাস রেপ্লিকা বানানো হল মিউজিয়ামের বিশাল রোটান্ডা হলে ৫৪৩টা স্পট-লাইটের তলায় সুবিশাল থ্যালাট্টোসর-কে ডিস্পলে করার জন্য।
রবার্ট কেনেডি আজকে মিউজিয়ামের ডিরেক্টর হয়েছে, কিন্তু নিজে এক সময় মার্কেটিং ম্যানেজার ছিল। এতোই তুখোড় যে লোকে বলে মার্কেটিং-এর জোরে নাকি বব কোন এস্কিমোকে রেফ্রিজারেটর বেচে দিতে পারে। একটা ছোটখাটো ডিস্কাভারিকে মার্কেটিং-এর জোরে ‘সেন্সেশানাল’ বল প্রেস্‌ কনফারেন্স ডেকে ১ ঘন্টা কথা বলতে প্রে, আর এটা তো সত্যিই এক যুগান্তকারি আবিষ্কার। ববের মাথায় ঘুরছিল আরেক মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি। রোটান্ডা হলে ঢোকার আগে একটা ছোট্ কুড়ি মিনিটের মুভি দেখালে কেমন হয়? হলিউড স্টাইলে যদি একটা ছোট্ট মুভি বনানো যায়, আর তার জন্য এক্সট্রা টিকিট বিক্রি করা যায়, তাহলে এক লাফে মিউজিয়ামের রেভিনিউ ট্রিপ্ল হয়ে যাবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ।
ডাইনোসর রিকন্সট্রাকশানের সবথেকে বিশ্বস্ত আর দামী ওয়ার্কশপ হল হলিউডের ‘ডাইনোমেকানিক অ্যানিমেশান স্টুডিওস’। তার চীফ্‌ আর্কিটেক্টকে ডেকে বব ওর প্ল্যানটা শোনাল।
- “আপনি ঠিক যেরকম অ্যানিমেশান রিকন্সট্রাকশান চাইছেন, সেটা কিন্তু বেশ খরচসাপেক্ষ মিস্টার কেনেডি। সাধারণ স্কেলিটাল রিকন্সট্রাকশানটাই তো করতে কয়েক লক্ষ ডলার খরচ হয়, আর আপনি তো একেবারে থ্রী-ডি রিকন্সট্রাকশান চাইছেন তাও আবার মুভিং অ্যান্ড রোরিং! একেবারে ন্যাশানাল জিওগ্র্যাফিকের ফার্স্ট-ক্লাস ডকুমেন্টারি বা হলিউডের মুভি ছাড়া বড় একটা কেউ সেরকম কিছু প্রজেক্ট নিয়ে আমার স্টুডিওয় বড় একটা আসে না।”
- “আপনি বাজেট নিয়ে ভাববেন না। সেটা আমার ওপর ছেড়ে দিন। কবের মধ্যে প্রজেক্টটা ডেলিভার করতে পারবেন সেটা বলুন।”
- “দেখুন, আমাদের থ্রী-ডাইমেন্‌শানাল রিকন্সট্রাকশানটা করে ইমেজিং সফট্‌ওয়্যরে ট্রান্সলেট্‌ করতেই সপ্তাহ তিনেক লেগে যাবে। আপনি তো বলছেন যে ফসিলটা কম্পলিট, কাজেই সেখানে আমাদের কোন মিসিং মেজর হাড়-গোড় নিয়ে সমস্যায় পড়তে হবেনা।”
- “স্পাইনাল কর্ডের পাঁচটা-ছটা হাড় মিসিং, তবে প্রাইমারি ইনভেস্টিগেশান বলছে সেগুলো মেজর নয়।”
- “ও হাড় মিসিং? তার মানে অ্যাডিশানাল এফর্ট। তাহলে আবার ওর কোন ক্লোজ রিলেটিভের শিড়দাঁড়ার হাড়ের গঠন অ্যাশ্যিউম করে নিয়ে এগোতে হবে। ও ভালো কথা, ফসিলের হাড়গুলো কি ‘আর্টিকুলেটেড’?”
- “সবগুলো কি আর জোড়া আছে? তবে কয়েকটা হাড় একে অপরের সাথে জোড়া লাগানো আছে বৈকি।”
- “ওকে, দ্যাট্‌স্‌ ফাইন। আমাদের সফট্‌ওয়্যরে একটা ‘সেন্টার অফ্‌ গ্র্যাভিটি’ সিমুলেশান মডিউল্‌ আছে, যেটা হাড়গুলোকে আর্টিকুলেট করে নিতে সাহায্য করে আর ডাইনোসরের শরীরের ব্যালেন্স্‌টা অটোমেটিকালি ক্যালকুলেট করে নেয়। কিভাবে চলবে সেটা ডিপেন্ড করবে এটার ওপর। আমরা আবার স্পেশাল শক্‌-অ্যাবসর্পশান কম্পোনেন্ট যেমন ফুট্‌প্যাড, টেন্ডন ইত্যাদিও জুড়ে দিই যাতে এফেকটটা একদম রীয়াল লাগে।”
- “মাসখানেকের মধ্যে প্রজেকটটা নেমে যাবে?”
- “না না, কি যে বলেন? তারপরেও অনেক কাজ বাকি থাকবে। মাস্ল্‌ রিকন্সট্রাকশান করতে হবে। সেটা অবশ্য ফসিলের ওপর কোন ডিপেন্ডেন্সি নেই। এখনকার সব বড় বড় জন্তুদের মাস্ল্‌এর সাইজ আর পজিশান দেখে আমাদের ফসিলের হাড়ের ওপর জুড়ে দিতে হবে। এর পর চামড়া লাগাতেও সপ্তাহ খানেক লেগে যাবে। ভালো কথা,চামড়ার রঙ কি দেব? জানেনই তো, চামড়ার রঙটা প্রায় পুরোপুরি ইম্যাজিনেশান। তবে কোথায় থাকত জানলে আমরা সাধারণত সেই হ্যাবিট্যাটের সাথে সঙ্গতি রেখে রঙ চড়াই। ডেজার্টে থাকলে হলুদ, জঙ্গলে থাকলে সবুজ এইরকম আরকি, কারণ নর্ম্যালি তাতে ক্যামোফ্লেজ করতে সুবিধা হয় বলেই প্যালিওন্টোলজিস্টরা ধরে নেয়।”
- “বুঝলাম। কিন্তু আমি একটা খুব সেন্সেশানাল ডিস্কাভারি চাইছি। আপনি বরং একটা মাল্টি-কালার্ড এফেক্ট দিন।”
- “... কিন্তু... কোনদিন তো মাল্টি-কালার্ড ডাইনোসর কোথাও আছে বলে শুনিনি!”
- “এগ্‌জ্যাক্টলি, আমি চাইছি এটা সব দিক থেকেই একটা অনবদ্য ডিস্কাভারি হয়ে থাক। আপনি লাল, সবুজ, অরেঞ্জ, গোল্ডেন যত খুশি ড্যাজ্‌লিং রঙ ইউজ করতে পারেন। মনে রাখবেন, দ্য ক্রিয়েশান হ্যাজ্‌ টু বি অ্যাবসোলিউটলি আন্‌প্রিসিডেন্টেড!”
- “গ্যারান্টিড!”
দু মাস পরে তামাম মিউজিয়াম জগতে আলোড়ন ফেলে উদবোধন হল ‘দ্য প্রিহিস্টরিক সী মন্সটার’, একটি অনবদ্য কুড়ি মিনিটের মুভি। রূপকথার ড্র্যাগন যেন জীবন্ত হয়ে সমুদ্রের গভীরে সাঁতরে বেড়াচ্ছে। এবং সেই সঙ্গে রোটান্ডা হ’লে ফিতে কাটা হ’ল একটি ৫২ ফুট লম্বা সামুদ্রিক ডাইনোসরের। ববের জবাব নেই। ওপেনিং উইকেই মিউজিয়ামে দশ-হাজার জোড়া পায়ের ধূলো পড়েছে। এখন ক্যালিফোর্নিয়ার সবথেকে প্রফিটেব্ল মিউজিয়াম বলতে সান ডিয়েগোর হিস্টোরিকাল মিউসিয়াম।

(৭)
এলিজাবেশ মিউজিয়ামের আবহাওয়া তখন বেশ বিষাক্ত। মিউজিয়ামএর মালিক কিউরেটারকে ডেকে যাচ্ছেতাই গালি দিয়েছে। পরেরদিনই বোর্ড অফ ডিরেক্টাররা বিশাল মিটিং রুমে বসে কিউরেটারের থেকে জবাব্দিহি চাইল যে প্যাটাগোনিয়ায় এক্সপেডিশানের বাজেট স্যাঙ্কশান হওয়া স্বত্ত্বেও কেন এলিজাবেথ মিউজিয়াম থ্যালাট্টোসরকে ছিপে গেঁথে তুলতে পারলনা। কিউরেটার তখন প্যাটাগোনিয়ার এক্সক্যাভেশান প্রজেক্টের ম্যানেজার স্যান্ডিকে ডেকে পাঠালো। স্যান্ডি প্রস্তুত হয়েই ছিল। জানত কিউরেটর ওকে খুব একটা সুনজরে দেখেনা, যেহেতু স্যান্ডির প্যালিওন্টোলজি বিষয়ে কোন টেকনিকাল জ্ঞান নেই। কাজেই বোর্ডের কাছে ওকে যে জবাব্দিহির জন্য ডেকে পাঠানো হবে এটা ধরেই নিয়েই স্যান্ডি অর্ক আর ওর ইমেইল কথোপকথনগুলো সাজিয়ে নিচ্ছিল একটা ফোল্ডারে। বলাই বাহুল্য ববের সাথে ডীল হওয়ার পরেই ও একজন বাইরের আইটি স্পেশালিস্টকে ধরে নিজের, এবং অর্কর মেইবক্সএর যাকে বলে মগজ-ধোলাই দিইয়েছিল। এখন ওই সপ্তাহের চিঠির বয়ানগুলো পুরোটাই ওর মস্তিষ্কপ্রসূত।
থম্‌থমে বোর্ডরুমে ঢুকে স্যান্ডি চেয়ারে না বসে দাঁড়ানো অবস্থায়ই দুবার গলা খাঁকড়ে বলতে শুরু করল,
- “প্রত্যেক বছরই আমরা প্যাটাগোনিয়ায় একটা বড় এক্সক্যাভেশান প্রজেক্ট রাখি। এটা আমাদের মিউজিয়ামের একটা ট্র্যাডিশান। কেউ কেউ হয়ত এটাকে বলে বোকামি কারণ প্যাটাগোনিয়ায় নাকি যা ছিল তা সবই প্রায় আবিষ্কৃত হয়ে গিয়েছে। যাইহোক, বোকামিই হোক আর চালাকিই হোক, রীয়ালিটী হল যে এই প্রজেক্টটা আমরা প্রতি বছরই করে থাকি। গত দশ বছরে আমাদের সেরকম বড় কোন ডিস্কাভারি হয়নি, তবুও আমরা নিষ্ঠাভরে প্যাটাগোনিয়ার বিভিন্ন সম্ভাব্য জায়গায় খননকার্য চালিয়ে গেছি। এবছর প্যাটাগোনিয়ায় প্রস্পেক্টিং সাইট হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল ‘পেট্রিফায়েড ফরেস্ট’। আপনারা জানেন যে এই প্রজেক্টএর প্ল্যান, আইটিনারারি, বাজেট, লোকাল টীম সিলেকশান সবই কিউরেটার এবং এই বোর্ড অ্যাপ্রুভ করেছিল। লীড প্যালিওন্টোলজিস্ট হিসেবে আমাদের মিউজিয়ামের স্টাফ কাউকে পাওয়া যাচ্ছিলনা যেহেতু হলিডে সীজনে বেশীরভাগ সায়েন্টিস্ট ছুটিতে ছিল। আমি বেছে নিয়েছিলাম একজন জুনীয়ার প্যালিওন্টোলজিস্টকে, যাকে স্বয়ং কিউরেটারেরও ট্যালেন্টেড মনে হয়েছিল। কারণ বেশীরভাগ কাজই রুটিন এবং অভিজ্ঞ লোকাল টীমের অ্যাসিস্ট্যান্স থাকবে। পেট্রিফায়েড ফরেস্টে যখন কিহু পাওয়া গেলই না অথচ হাতে আরো দু-তিনদিন বাকি ছিল, আমি এই জুনীয়ার প্যালিওন্টোলজিস্টটিকে সাজেস্ট করেছিলাম লাস্‌ গ্রুটাস্‌ বীচের পাশের সেডিমেন্টারি উপত্যকায় একবার প্রস্পেক্টিং করে, কিন্তু ফ্র্যাঙ্কলি, আমাদের এই জুনীয়ার স্টাফের চোখে এই অসামান্য ফসিলটি পড়েনি।” এই পর্যন্ত বলে স্যান্ডি ওর ফাইল থেকে কিছু ইমেইল-এর প্রিট-আউট বোর্ড অফ ডিরেক্টার্সদের প্রত্যেককে ডিস্ট্রিবিউট করল যার সারবস্তু হল এই যে স্যান্ডি ওই জুনীয়ার প্যালিওন্টোলজিস্ট অর্ক সেনকে লাস্‌-গ্রুটাস বীচের পাশের সাইটে প্রস্পেক্টিং করতে নির্দেশ দিয়েছে এবং তার উত্তরে অর্ক সেন ইমেইল করে জানিয়েছে যে সে বীচের বিকিনি-পরিহিতা তন্বীদের ছাড়া কোন উল্লেখযোগ্য কিছুর সন্ধান পায়নি, ফসিল তো কোন ছাড়। বিশাল বোর্ড্রুমে যেন একটা বাজ পড়ল।
- এই প্যাটাগোনিয়ার প্রজেক্টের ম্যানেজার হিসেবে আমি আন্তরিক দুঃখিত, আমারই ভুল প্যালিওন্টোলজিস্ট নির্বাচনের ফলে এই মিউজিয়ামের এত লক্ষ ডলার রেভিনিউ লস্‌ হয়েছে, এর জন্য আমি আমার পদত্যাগপত্র তৈরি করেই এনেছি।” স্যান্ডি জানত যে এটাই হবে ওর মোক্ষম চাল। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে প্রথম থেকে কোন জুনীয়ারের ওপর দোষ চাপাতে চেষ্টা করলে অনেকসময়ই হিতে বিপরীত হয়ে যায়। কাজেই খুব কায়দা করে নিজের ঘাড় থেকে দোষটা ঝেড়েও ফেলতে হবে আবার বোর্ডের সিম্প্যাথি উস্কে দিতে ইস্তফাপত্রের প্রসঙ্গও তুলতে হবে।
বোর্ডের প্রেসিডেন্ট চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিল। বেশীরভাগ ডিরেক্টরই মাথা নাড়িয়ে ইস্তফা গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত জানাল। তখন তিনি দুবার গলা খাঁকড়ে বললেন, “উই উন্ডারস্ট্যান্ড। খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয় যে আমরাই এই যুগান্তকারি ফসিলের আবিষ্কর্তা হত পারতাম কিন্তু আমাদের প্যালিওন্টোলজিস্টএর এক্সপেরিয়েন্সের অভাবে এত বড় একটা ভুল হয়ে গেল। তোমার রেজিগ্নেশান আমরা গ্রহণ করছি না। ওর্ক সেনকেও আমরা বরখাস্ত করছি না, কারণ ওর নেতৃত্ব দেওয়ার মত উপযুক্ত এক্সপেরিয়েন্স তৈরি হয়নি। তবু অ্যাজ আ প্যালিওন্টোলজিস্ট ওর উচিত ছিল লাস্‌ গ্রুটাস সাইটটা খুব ভালো করে এক্সক্যাভেট করা। ওর ইমেইল-এই ওর ইরেস্‌পন্সিবিলিটি আর ক্যাশুয়াল অ্যাটিচুডের পরিচায় পাওয়া যায়। কাজেই অর্ক সেনকে আগামী সাত বছর কোন ফীল্ড-ওয়ার্ক বা প্রস্পেক্টিং বা সাইট-ভিসিট বা এক্সপেডিশানে পাঠানো চলবে না। এবং আগামী পাঁচ বছর এই মিউজিয়মের পক্ষে ওকে কোন প্রোমোশান দেওয়া হবে না। ল্যাব-ওয়ার্ক করতে পারে, আর আমাদের বাচ্চাদের গ্যালারিতে মাঝে মাঝে ডাইনোসর সেজে ঘুরতে পারে। কিউরেটার গর্টন, আপনি অর্ক সেনকে এই ডিসিশান আজকেই জানিয়ে দেবেন।”
স্যান্ডি মিটিং শেষ হলে কিউরেটর গর্টনকে অনুরদধ করল, “মিস্টার গর্টন, আমার একটা অনুরোধ আছে। অর্ককে নিয়ে আমি আর কোন প্রজেক্ট করতে চাইনা। ওকে অন্য কোন ম্যানেজারের উন্ডারে প্লেস করে দিন প্লিজ। এই দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়টা আমি ভুলে যেতে চাই, আর অর্ক আমার আন্ডারে থাকলে রোজ ওকে দেখলেই আমার এই ঘটনাটা মনে পড়ে যাবে।”
লস্‌-অ্যাঞ্জেলেস্‌ টাইমস্‌এ সকালে স্যান-ডিয়েগো মিউজিয়ামের খবরটা পড়ে তো অর্কর আক্ষেপের সীমা রইল না। যে অসামান্য আবিষ্কারটা ওর হতে চলেছিল, সেটা ওর ওই মাথামোটা বস্‌টা কুমীর বলে বাতিল করে দিল, আর এখন সারা দুনি্যায় এই থ্যালাট্টোসরকে নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে। স্যান্ডিকে করা ইমেইলটা এবং স্যান্ডির থেকে আসা ইমেইলটা কিউরেটরকে ফরোয়ার্ড করে একবার সামনা-সামনি কথা বলবে বলে মনস্থির করে ফেলল। যে ওর কেরীয়ারের এত বড় ক্ষতি করল তাকে কোনমতেই একটা ক্লিন চীট দেওয়া যায়না।
অফিসে ঢুকেই শুনল যে কিউরেটরের অফিসে দেখা করতে বলা হয়েছে ওকে। অর্ক বেশ আশ্চর্য হল। তাহলে কি স্যান্ডি নিজের ভুল স্বীকার করে কিউরটরকে বলেছে অর্কর অ্যানালিসিসের কথা? এত ভুল চিনেছে ও স্যান্ডিকে? হয়ত তাই।
কিউরেটরের অফিসে ঢুকতেই মাইকেল গর্টন খুব ঠান্ডা গলায় বলল, “আজকের টাইমস্‌এ নিশ্চয়ই তুমি স্যান-ডিয়েগো হিস্টরি মিউজিয়ামের বিশাল থ্যালাট্টোসরের ফসিল উন্মোচনের খবরটা পড়েছ। আমায় নিশ্চয়ই আর আলাদা করে বোঝাতে হবে না, আমাদের মিউজিয়ামের বোর্ড এই ঘটনাকে কি চোখে দেখছে, এস্পেশালী যখন তোমাকে তোমার বস্‌ স্পেসিফিক্যালি ইন্সট্রাকশান দিয়েছিল পেট্রিফায়েড ফরেস্টে কাজ শেষ করে লাস্‌ গ্রুটাস বীচে এক্সক্যাভেশান করার জন্য।”
- “আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা। কি বলছেন আপনি? আমার বস্‌ আমাকে ইন্সট্রাকশান দিয়েছিল লাস্‌ গ্রুটাস বীচে এক্সক্যাভেশান করার জন্য? সে কি কথা স্যার? আমিই তো বরং লাস্‌গ্রুটাস বীচে এক্স্‌ক্যাভেশান করে ওই ফসিলটা পেয়ে স্যান্ডিকে ইমেইল করেছিলাম যে আমার সন্দেহ ওটা মেরিন ডাইনোস থ্যালাট্টোসরের। তার উত্তরে আমার বসই বরং আমাকে লিখে পাঠিয়েছিল যে আমার অ্যানালিসিস ভুল, ওটা নাকি একটা বড় কুমিরের স্কেলিটন ছাড়া কিছু নয়।”
- “অর্ক, তুমি সবে বছরখানেক হল জয়েন করেছ। আমি এটা মেনে নিতে পারি যে তোমার অনভিজ্ঞ চোখ ফসিলটা মিস্‌ করে গেছে, কিন্তু আমার সামনে দাঁড়িয়ে ঝুরি ঝুরি মিথ্যে বলাকে আমি কিছুতেই ক্ষমা করতে পারবনা। এটা দেখ” কিউরেটর অর্ককে স্যান্ডির ডিস্ট্রিবিউট করা ইমেইলের প্রিন্ট-আউট পড়তে দিল। অর্ক পড়ে বজ্রাহত। এটা কার ইমেইল? এই ইমেইল তো সে লেখেইনি! ওই বিকিনি-পরিহিতা... কি যা-তা লেখা ইমেইল-এ?
- “স্যার, এই ইমেইল আমি লিখিনি। এটা একটা ষড়যন্ত্র। আপনি আমার ডেস্কে চলুন স্যার, আমি দেখাচ্ছি কি ইমেইল আমি পাঠিয়েছি আর কি রিপ্লাই এসেছিল তার।”
- “ওকে, লেট্‌স্‌ গো টু ইয়োর ডেস্ক।” জলদ্গম্ভীর স্বরে মাইকেলের উত্তর।
কম্পিউটার খুলে প্রত্যাশিতভাবেই অর্ক চূড়ান্তভাবে চমকালো। এসব কি? ওর আউট্‌বক্সে এই ইমেইল কার লেখা, কোত্থেকে এল? ইন্‌বক্সেই বা স্যান্ডির আসল ইমেইলগুলো কোথায়?
- -“আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না, স্যার। বিশ্বাস করুন, এগুলো একটাও আমার ইমেইল নয়। স্যান্ডি আমাকে বলেছিল ওই ফসিলটা কুমিরের!”
- -“শোন অর্ক, আই টোল্ড ইউ, আমি মিথ্যে কথা বলা মোটে পছন্দ করিনা। ভুল হলে স্বীকার করার সতসাহস থাকা উচিত। আই অ্যাম সরি। আমি এ ব্যাপারে আর কিছু শুওতে চাইনা। তোমাকে শুধু বোর্ডের নেওয়া দুটো সিদ্ধান্ত শোনাতে চাই। এক, তুমি সাত বছর কোন ফীল্ড-ওয়ার্ক করবে না, আর দুই, তোমার আগামী পাঁচ বছর কোন প্রোমোশান হবে না। তোমার কাজ হবে ফসিলের গায়ে অ্যাঢেসিভ লাগানো আর ‘ফানি ডাইনো’ বাচ্ছাদের গ্যালারীতে টি-রেক্স সেজে ঘুরে বেড়ানো। মার্ক রিটায়ার হওয়ার পর থেকে আর কোন স্টাফই ওই লাস্ট কাজটা করতে রাজি হচ্ছিল না। বাট ইউ হ্যাভ্‌ নো অপ্‌শান।”

(৮)

চাকরি থেকে বের করে দিলেও বোধহয় অর্ক এর চাইতে কম আপমানিত হত। বিকেলে সাহানার কাছে ভেঙ্গে পড়েছিল কান্নায়। এক ধাক্কায় ফেম, স্যালারি, জব্‌-স্যাটিস্‌ফ্যাকশান, প্রোমোশান, সব খোয়াল বিনা দোষে। সত্যিই যদি সাহানার কথা শুনে না নিত অ্যাসাইনমেন্টটা! অর্ক এখনও ওর প্যাটাগোনিয়ার সেই লোকাল টীমের লোকজনদের ফোন করে, ইমেইল করে এর একটা নিষ্পত্তি করার কথা ভাবছিল, কিন্তু সাহানা তাতে সায় দিল না।
-“কি হবে অর্ক? তোর মেইল্বক্স তো দেখেইছিস পুরো সাফ হয়ে গেছে। ওদেরকে পাঠানো ইমেইলও নিশ্চয়ই একইভাবে হাত-সাফাই হয়েছে। ওদেরকে ফোন করে কি হবে? ওরা যদি দুজন বলেও যে হ্যাঁ, ওই ফসিল তুই পেয়েছিলি, তাহলেও বা কি? ওরা বন্ধু বলে মিথ্যে বলতে পারে, ঘুষ খেয়ে বলতে পারে, ভয় পেয়ে বলতে পারে, একটা স্ক্যান্ডাল হলে পাব্লিসিটি পাবে বলে বলতে পারে, এরকম নানান কারণ আছে যেগুলো তোর বোর্ড অফ্‌ ডিরেক্টররা খতিয়ে দেখবে। অত সহজে তোর কথা কেউই বিশ্বাস করবে না। প্লাস এটা বলামাত্র তোর বিরুদ্ধে স্যান্‌-ডিয়েগোর ওই মিউজিয়ামের বোর্ডও তক্ষুনি ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমার মনে হয় ঐসব করে সময় নষ্ট করিস না। তার চাইতে একটা চাকরি খুঁজতে শুরু কর অন্য কোন মিউজিয়ামে। আর দেখ এখানে থেকে স্যান্ডিকে মোক্ষম আ-ছোলা বাঁশ দেওয়া যায় কিভাবে।”
সাহানা নিজে প্যালিওন্টোলজি সম্বন্ধে ছুঁচোর মত অন্ধ, কিন্তু কেউ ইমেইলের কারসাজি করে ওর অর্কর এত বড় ক্ষতি করে দিল, নিজে সফট্‌ওয়্যারের লোক হয়ে এটা শুনে একেবারে রেগে লাল হয়ে উঠল। সারারাত দুজনে বসে অনেক প্ল্যান কষল। প্রতিশোধ ওরা নেবেই।
বার্কলে ইউনিভার্সিটির ‘ডিপার্ট্মেন্ট অফ আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস’এ অর্কর সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল অমিত মাহেশ্বরী। অর্কর সাথে অনার্স নিয়ে পাশও করেছিল, কিন্তু তারপর অমিত ফিরে এসেছিল ইন্ডিয়ায়। গার্ল-ফ্রেন্ডের সরকারি চাকরি, বোনের ডিভোর্স আর বাবার অসুখের কারণে কোন বিদেশী মিউজিয়ামে ইন্টারভিউ-এর চেষ্টাও করেনি। সোজা অ্যাপ্লাই করেছিল ‘জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ্‌ ইন্ডিয়া’তে, এবং ওর যা কোয়ালিফিকেশান ছিল তাতে অনায়াসেই ও ঢুকে গেছিল প্যালিওন্টোলজি ডিপার্ট্মেন্টে। সেই রাতেই অমিতকে ইমেইল লিখতে বসল অর্ক। ওর প্ল্যানটায় অমিতের ভূমিকা খুব গুরুত্ত্বপূর্ণ। থ্যালাটোসরের ঘটনাটাকে বিশদে জানাল। সবশেষে ওর প্ল্যানটাও ডীটেল্‌সে লিখল। বলা যায়না, এখন হয়ত অমিত সেই ডাকাবুকো, বেপরোয়া, নাটুকে, আমুদে অমিত আর নেই। হয়ত নিজেকে এই ব্যাপারে জড়াতে চাইবে না। যাইহোক, দেখাই যাক না, কি বলে।
ওদিকে সাহানার বন্ধু মায়ের পিসতুতো ভাই রঞ্জিতমামার কন্সট্রাকশন কোম্পানির বিসনেস পশ্চিমভারতের বিরাট এলাকা জুড়ে। সাহানার মায়ের পিসেমশাই বিসনেস শুরু করেছিলেন, এখন রঞ্জিতমামা দেখেন। রঞ্জিতমামার বয়স বছর পঁয়তাল্লিশ, বিয়ে থাওয়া করেননি, হুল্লোরবাজ আমুদে মানুষ। কাজের বাইরে একমাত্র নেশা হল থিয়েটার। পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন শহরে যে সব অ্যামেচার বেংগলী থিয়েটার ক্লাব আছে সর্বত্র রঞ্জিতমামা থিয়েটার করে বেড়ান। সেরকল ভাল রোল পেলে কাজকর্ম শিকেয় তুলে সম্পুর্ণ অন্য শহরে গিয়ে বিশ পঁচিশ দিন থেকে আসেন। সাহানার মন বলছিল জলজ্যান্ত থিয়েটারের গন্ধ পেলে রঞ্জিতমামা গুজরাটে ছুটতে পিছপা হবেন না। সাহানা ফোন করে যতটা সম্ভব সাধারণভাবে বোঝানো যায় এরকমভাবে থ্যালাট্টোসরের ঘটনাটা আর ওদের প্ল্যানটা জানাল। রঞ্জিতমামা ভাবতে একমুহূর্তও সময় নিলেন না। এককথায় বললেন রাজি।
পরেরদিন সকালে অমিতের ইমেইল এল, সেও রাজি।

(৯)
মাসখানেক পর যখন এদিকের থ্যালাট্টোসরের আবিষ্কারের খবরটা খানিকটা বাসি হয়ে ধামাচাপা পড়ে গেছে, স্যান্ডি সকালে অফিসে পৌঁছে দেখল একটা ইন্টারেস্টিং ইমেইল।

ডীয়ার মিস্টার দাস,
আমি একটি মাল্টিন্যাশানাল কন্সট্রাকশান কোম্পানিতে (লার্সেন অ্যান্ড টুবরো) কর্মরত। সম্প্রতি একটি বহুতল ফ্ল্যাটের প্রজেক্টের কাজে গুজরাটের খেদা ডিস্ট্রিক্টের বালাসিনোর শহরে পোস্টেড। এখানে সাইটে ভিত খোঁড়ার সময় কিছু হাড়-গোড় পাওয়া গেছে। স্থানীয় লোকের বক্তব্য এখানে নাকি প্রায়ই ডাইনোসরের ফসিল পাওয়া যায়। শুনে আমি একজন দায়িত্ত্ববান নাগরিকের মত আমাদের ভারতবর্ষের জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ্‌ ইন্ডিয়ার সাথে করেস্পন্ডেন্স্‌ করি এবং কিছু ছবি ও ডাইমেনশান পাঠাই। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ্‌ ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে আমাকে জানানো হয়েছে যে ফসিলটি সত্যিই একটি দুষ্প্রাপ্য ডাইনোসরের কিন্তু এই বছরে জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ্‌ ইন্ডিয়ার কোন বাজেট নেই এটা তুলে নিয়ে যাওয়ার মত। আমাকে ওনারাই বিদেশী কয়েকটি মিউজিয়ামের নাম ও সিনীয়ার ম্যানেজমেন্টের ইমেইল আইডি দিয়েছেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন এই মিউজিয়ামের সাথে কন্ট্যাক্ট করে দেখতে এরা ইন্টারেস্টেড কিনা। ই ইমেইলের সাথে আমি কিছু ছবি অ্যাটাচ কর পাঠালাম। যদি আপনি ইন্টারস্টেড থাকেন, আমাকে জানাবেন প্লীজ। আমি জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ্‌ ইন্ডিয়ার অ্যানালিসিস আপনাকে পরের ইমেইলে পাঠাব। আপনি ইন্টারস্টেড না থাকলেও আমাকে জানাল বাধিত হব, কারণ তাহলে আমি এরপর শিকাগো, নিউ-ইয়র্ক আর মিউনিখের তিনটে মিউজিয়ামে ইমেইল পাঠাবো জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ্‌ ইন্ডিয়ার পরামর্শ মত।
ইতি,
রঞ্জিত চ্যাটার্জি
ইমেলটা পরে স্যান্ডি কিছুক্ষন ভাবল কি করবে। ছবি যেগুলো পাঠিয়েছে তা দেখে ভালো কর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। থার্ড-ওয়ার্ল্ডের সিভিল ইঞ্জিনীয়ারের কাছে তো আর ডিজিট্যাল এস.এল.আর এক্সপেক্ট করা যায়না। কিন্তু এর কথা যদি ঠিক হয়, আর জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ্‌ ইন্ডিয়া যদি সত্যিই এই ফসিলকে মূল্যবান অ্যাসস করে থাকে, তাহলে একটু বাজিয়ে দেখে নেওয়াই ভালো। আর পয়সা তো আর লাগছে না। জাস্ট জানিয়ে দিই যে জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ্‌ ইন্ডিয়ার অ্যানালিসিস না দেখে আমি কোণ মন্তব্য করতে পারছি না।
অর্ক-সাহানা-অমিত-রঞ্জিতও এই উত্তরই আশা করছিল। যাক, প্রুথম স্টেপটা তাহলে উতরোল। স্যান্ডি পত্রপাঠ ‘নট ইন্টারেস্টেড’ জানিয়ে দিলে একটু ফাঁপরে পড়ে যেত ওরা। ইমেইলে লার্সেন অ্যান্ড টুবরোর লোগো থেকে আরম্ভ করে সিগ্নেচার সবটা কেরামতিই সাহানার। এইবার নেক্সট স্টেপ। এবারের ভূমিকা সাহানার। অ্যান্টি-ভাইরাস কোম্পানিতে চাকরি করলে যে জিনিসটায় বেশ ভালোরকম দখল জন্মায় সেটা হল অন্য যে কোন কম্পিউটারে রিমোটলি লগ্‌-ইন করে কোথায় কি আছে সেগুলো দেখে, পড়ে, সেগুলো চেঞ্জ করে দেওয়ার ক্ষমতা। হ্যাকিং করতে না পারলে, ভাইরাস কিভাবে বিহেভ করে না ঘাঁটলে অ্যান্টি-ভাইরাস লিখবে কি করে? কাজেই অতি সহজেই সাহানা স্যান্ডির কম্পিউটারে ঢুকে পড়ে মেইলবক্সটায় জাঁকিয়ে বসে আড়ি পাততে শুরু করল। কোন ইমিলটা কাকে ফরওয়ার্ড করার আগেই ডিলিট করতে হবে, কোন ইমিলটার কোন ট্রেস রাখা চলবে না, বা থাকলেও কিছু শব্দ বদলে দিতে হবে, সেটা অর্ক সিদ্ধান্ত নেবে আর সাহানাকে সেটা এগজিকিউট করতে হবে।
পরের ইমেইলটার বয়ান অর্ক তৈরি কর দিল আর সাহানা একটা ভুয়ো কিন্তু আপাত-দৃষ্টিতে বেশ বিশ্বাসযোগ্য একটা ইমেইল আইডি তৈরি করে সেই ইমেইলটা পাঠিয়ে দিল রঞ্জিতকে এবং রঞ্জিত সেটা ফরোওয়ার্ড করে দিল স্যান্ডিক। বলাই বাহুল্য সাহানা ইমেইলটায় একমাস আগের একটা ডেট বসিয়ে দিয়েছিল।

ডীয়ার মিস্টার চ্যাটার্জি,
আমি জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ্‌ ইন্ডিয়ার ডিরক্টর অফ্‌ প্যালিওন্টোলজি ডক্টর শ্রীনিবাসান সুব্বারাও। আপনার পাঠানো ছবি ও স্যাম্পল হাড় আমরা পেয়েছি। আপনি হয়ত জানেন না আপনি গুজরাতের যে শহরে এই বহুতল ফ্ল্যাট নির্মান করছেন সেই বালাসিনোর হল বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ডাইনোসর ফসিলের খনি। আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে এই বালাসিনোরকে এখনও আমরা ‘ইউনেস্কো জিও পার্ক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। এই সাইট থেকে আমরা ১০,০০০ ডাইনোসরর ডিম উদ্ধার করেছি। ২০০৩ সালে আমাদেরই ডিপার্ট্মেন্টের সুরেশ শ্রীবাস্তব এই শহর থেকে একটি অবিশ্বাস্য ফসিল আবিষ্কার করে। টিরানোসরার রেক্স বা টি-রেক্সের জাত-ভাই বলতে পারেন, আমরা এর নাম দিই ‘রাজাসরাস নর্মাডেন্সিস’ অর্থাৎ ‘নর্মদার রাজা’। গোটা বিশ্বে এই নিয়ে হুলুস্থুল পড়ে যায় কারণ এই ডাইনোসর স্পিশিস্‌টি একেবারে ব্র্যান্ড নিউ, আগে কোনদিন কোথাও এর কোন হদিশ পাওয়া যায়নি। প্রায় ত্রিশ ফুট লম্বা আর উচ্চতা আট ফুটের এই ডাইনোসরের নাকের গঠনটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। অনেকটা গন্ডারের মত, এর নাকের ওপরে একটা খড়গ আছে। এই রাজাসরাস শুধুমাত্র ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টে পাওয়া গেছে, এবং মাত্র দু-তিনটে, তাও পুরো স্কেলিটন পাওয়া যানি আজ অবধি। একটা সমস্যা যেটা আমরা প্যালিওন্টোলজিস্টরা কিছুতেই টপকাতে পারছিনা সেটা হ’ল এই রাজাসরাসের জুভেনাইল অর্থাৎ বাচ্চা বয়সের কোন ফসিল পাইনি বলে এদের লাইফ-সাইক্লটা এখনও আমাদের কাছে অনেকটাই ধোঁইয়াশা রয়ে গেছে। এবার তিনটে খবর দিই আপনাকে মিস্টার চ্যাটার্জি। দুটো ভালো, অন্যটা খারাপ। প্রথম ভালো খবর হ’ল যে আপনি যে ফসিলটি পেয়েছেন আমাদের ডিপার্ট্মেন্ট এবং আমারও ব্যাক্তিগত ধারণা সেটা হল জুভেনাইল রাজাসরাসের। কাজেই বুঝতেই পারছেন এটা একটা স্টার ফাইন্ড! তামাম মিউজিয়াম এবং প্যালিওন্টোলজিস্টদের কাছে এটা একটা দুর্দান্ত খবর। অনেক গবেষণার সুযোগ, অনেক কল্পনার অবসান, অনেক নতূন সম্ভবনার সূত্রপাত হতে পারে এই আবিষ্কারের ফলে। এবার খারাপ খবরট দিই। খারাপ খবরটা এই যে আমাদের জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ্‌ ইন্ডিয়ার এই বছরের মত সমস্ত প্রস্পেক্টিং ফান্ডস্‌ শেষ। কাজেই আমি আমার ডিপার্টমেন্ট থেকে যে কোন টীমকে সাইট ভিজিট করতে পাঠাবো তার জো নেই। তাও আমাদের ডিপার্টমেন্টের ওয়ান অফ্‌ দ্য ব্রাইটেস্ট প্যালিওন্টোলজিস্ট গোভিন্দ সিংকে আমি আপনার ওখানে পাঠাতে পারি। ওর নিজের কিছু রিসার্চের কাজে লাগবে। সবশষের ভালো খবরটা হ’ল যে আমরা এটা হয়ত নিতে পারলাম না, কিন্তু বিশ্বের অনেক মিউজিয়াম, প্রধানত অ্যামেরিকা আর ইউরোপ্র কিছু নামকরা প্রাইভেট মিউজিয়াম কিন্তু এই সুযোগ লুফে নেবে বলে য়ামার ধারণ। আমার টীমের যে প্যালিওন্টোলজিস্টটি আপনার ওখানে যাবে তার থেকে আপনি গুটিকয়েক মিউজিয়ামের নাম এবং সিনীয়র ম্যানেজারের নাম ও কন্ট্যাক্ট ডীটেলস্‌ নিয় রাখতে পারেন। এই ফসিলের ভ্যালুয়েশান কিন্তু কম করেও লাখ পঁচাত্তর হবে। কোন অ্যাড্‌ভাইসের দরকার হলে কিছুমাত্র ইতস্তত না করে ইমেইল করবেন।
ইতি,
শ্রীনিবাসান সুব্বারাও
অর্ক জানত যে এই ইমেইলটা হবে খুব গুরুত্ত্বপূর্ণ। তাই ইচ্ছে করেই ও এই ইমেইলটায় সব সত্যিকারের তথ্য দিয়ে লিখেছিল। জানত স্যান্ডির প্যালিওন্টোলজি সম্পর্কে এত জ্ঞান নেই যে সমস্ত কিছু এক নিমেষে বুঝে যাবে। শ্যীওর ব্যাটা ইন্টারনেট খুলে বসবে। তাই অর্কও সেই ব্যাপারে কোন ফাঁক রাখেনি। খোল ব্যাটা, কত ইন্টারনেট খুলবি খোল। বালাসিনোর, রাজাসরাস, শ্রীবাস্তব সবকিছুই সত্যি ঘটনা।
ওদিকে স্যান্ডি ইমেইলটা পেয়ে যেন আরেকটা জ্যাকপট পেল। থ্যালাট্টোসরের ফসিলটা ওর নিজের ফাইন্যান্সিয়াল কন্ডিশান আমূল বদলে দিয়েছে, কিন্তু অফিসিয়ালি কোন বোনাস বা প্রোমোশান দূরে থাক, প্যাটাগোনিয়ায় প্রজেক্ট কম্পলিট করা সৎত্ত্বেও কিছু না পাওয়ার ফলে অফিসে ওর কিছুটা সম্মানহানিই হয়েছ যদিও ও অর্ককেই বলির পাঁঠা বানিয়েছিল, তাও। এই সুযোগে যদি সেই হ্রত সম্মান উদ্ধার করা যায়, মন্দ কি? এ তো মনে হচ্ছে এই এক বছরে সেকেন্ড জ্যাকপট!
অর্ক যদিও এখন অফিসে আর স্যান্ডিকে রিপোর্ট করেনা, বা সোজাসুজি ওর কোন প্রজেক্টে কাজও করেনা, তাও কানে অনেক খবরই আসে একই অফিসে কাজ করার সুবাদে। ক্যান্টিনে, লাইব্রেরিতে, এমনকি বাথরুমেও কান খোলা রাখলে অনেকরকম খবর ভেসে আসে। অর্ক খুব খুশী হল শুনে যে স্যান্ডি নাকি কিউরেটার আর বোর্ডের কাছে একটা প্রজেক্ট প্রোপোসাল নিয়ে আগামী বুধবার মীট্‌ করছে। তার মানে নাক-ব্যাঁকা, ফোকলা স্যান্ডি টোপটা গিলেছে মনে হচ্ছে! বোর্ডের মিটিংএর আগেই স্যান্ডির মাথায় কয়েকটা ব্যাপার গজাল মেরে ঢুকিয়ে ফেলতে হবে। তার মানে আজকে রাত্রে সাহানাকে আরেকবার হাতের কারসাজি দেখাতে হবে।
ডীয়ার মিস্টার চ্যাটার্জি,
আমি জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ্‌ ইন্ডিয়ার সিনীয়ার প্যালিওন্টোলজিস্ট। আমাদের প্যালিওন্টোলজির ডিরেক্টর হয়ত আমার কথা আপনাকে জানিয়েছেন। আমি আমার রিসার্চের কাজের জন্য আপনার সাইটে পাওয়া রাজাসরাসের ফসিলটা একটু স্টাডি করতে চাই। যদি অনুমতি দেন, তাহলে আমি নিযে আমার সব ইকুইপ্‌মেন্টস্‌ নিয়ে একবার দিন তিনেকের জন্য বালাসিনোরের ওই সাইটে যেতে চাই। কথা দিচ্ছি এর জন্য আপনার কন্সট্রাকশানের কোন ব্যাঘাত ঘটবে না। আপনাকে আমার ডিরেক্টারের কথামত আমি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ দশটি প্রাইভেট মিউজিয়ামের নাম এবং তাদের সিনীয়ার ম্যানেজমেন্টের অফিসের অ্যাড্রেস আপনাকে দিয়ে আসব। আমার একটাই প্রার্থনা, যাতে এই অনবদ্য ‘জুভেনাইল রাজাসরাস’এর ফসিলটির কদর হয়।
ধন্যবাদান্তে,
গোভিন্দ সিং।
এই ইমেইলটা রঞ্জিত আবার নিজে ফরোওয়ার্ড করে দিল স্যান্ডিকে এবং এও জানিয়ে রাখল যে গোভিন্দ সিং শীঘ্রই সরাসরি স্যান্ডির সাথে ওগাযোগ করবে। কোন হেল্প লাগলে মিস্টার স্যান্ডি দাস স্বচ্ছন্দে তা চাইতে পারেন।
দুদিনবাদে অমিত থুড়ি গোভিন্দ সিং-এর ইমেইল এল।
ডীয়ার মিস্টার দাস,
আমি জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ্‌ ইন্ডিয়ার সিনীয়ার প্যালিওন্টোলজিস্ট। আমার কথা লার্সেন অ্যান্ড টুবরোর ইঞ্জিনীয়ার রঞ্জিত চ্যাটার্জী নিশ্চয়ই আপনাকে জানিয়েছেন। আমি আমার রিসার্চের কাজের জন্য আপনার সাথে যুগ্মভাবে রাজাসরাসের ফসিলটা নিয়ে স্টাডি করতে চাই। যদি অনুমতি দেন, তাহলে আমি আমার সব ইকুইপ্‌মেন্টস্‌ নিয়ে বালাসিনোরের ওই সাইটে যেতে পারি। আমার গবেষনার জন্য আমি নিজে এই কাজটা ফ্রীল্যান্সে করতে চাই, যেহেতু আমাদের অরগানাইজেশনের এবছর কোন এক্সক্যাভেশানের বাজেট নেই। আমি আপনাকে একটা বিজনেস প্রোপোজিশানও দিতে চাই। আপনি নিশ্চয়ই জানেন ইন্ডিয়া এখন খুব বড় আউট্‌সোর্সিং মার্কেট। জামাকাপড় থেকে সফট্‌ওয়ার সমস্তই ইন্ডিয়ায় আউট্‌সোর্সিং করা হয়। আপনি এই প্রজেক্টের এইট্টিপার্সেন্ট কাজ ইন্ডিয়াতে আউটসোর্স করতে পারেন। আপনি চাইলে আমি এখানে আট দশ জন লোকাল লোক নিয়ে একটা টীম তৈরী করতে পারি, এই টীমের লোকাল ওয়ার্কারদের ঘন্টায় মাত্র চার ডলার দিতে হবে। আমি লীড প্যালিওন্টোলজিস্ট হিসাবে ঘন্টায় আট ডলারে কাজ করতে পারি। আপনার মিউজিয়ামের কোন জুনীয়ার প্যালিওন্টোলজিস্ট এলেও আপনাকে ঘন্টায় নিশ্চয়ই আশি থেকে একশো ডলার দিতে হবে। আমি এই আবিষ্কারের কোনরকম ‘ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি’ ক্লেইম করবনা, পুরোটাই আপনার এবং আপনার মিউজিয়ামেরই থাকবে। আমি শুধু এই অনবদ্য ফসিলের ওপর কিছু কোয়ালিটি ওয়ার্ক করতে চাই, আর আমার একটাই প্রার্থনা, যাতে এই অনবদ্য ‘জুভেনাইল রাজাসরাস’এর ফসিলটির লস্‌-অ্যাঞ্জেলেসের বিখ্যাত মিউজিয়ামে কদর হয়।
ধন্যবাদান্তে,
গোভিন্দ সিং।

(১০)
- “এই ‘রাজাসরাস নার্মাডেন্সিস’ হবে আমাদের মিউজিয়ামের স্টার অ্যাট্রাকশান! এই অ্যামেরিকান মিউজিয়ামে থাকবে টি-রেক্স ফ্যামিলির এমন একটি ডাইনোসরের ফসিল যা ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট ছাড়া কোথাও পাওয়া যায়না। আমাদের মিউজিয়ামের সেন্ট্রাল গ্যালারিতে বিশাল সাইন্‌বোর্ড বসবে ‘দ্য প্রি-হিস্টরিক কিং অফ্‌ ইন্ডিয়া’!” বোর্ড মিটিং-এ স্যান্ডির অত্যুৎসাহী মন্তব্য। এবারের বোর্ড মিটিং-এ স্যাডি দেখিয়ে দেবে ওর এলেম। পুরো প্রোপোজালটা এতটাই লোভনীয় করে বানিয়েছে যে কিছুতেই বোর্ড অফ্‌ ডিরেক্টররা এটা অমনোনীত করতে পারবেনা।
- “মিস্টার দাস, আপনি তো বললেন ফসিলটা একটি টীন্‌-এজ রাজাসরাসের, কাজেই আমার মনে হয় ‘কিং অফ্‌ ইন্ডিয়া’ না বলে ‘প্রিন্স অফ ইন্ডিয়া’ বলা উচিত।”, জনৈক বোর্ড মেম্বারের মন্তব্য।
- “হ্যাঁ নিশ্চয়ই। ঠিকই বলেছেন মিস্টার নেলসন, এই ব্যাপারটা আমার মাথায় আসেনি।” সহাস্য উক্তি স্যান্ডির। তারপর বোর্ডের বাকি মেম্বারদের দিকে ফিরে বলল, “আর এই হল আমার প্রজেক্ট প্ল্যান। স্রেফ একমাসের মধ্যে আমি কথা দিলাম আমার মিউজিয়ামের গ্যালারিতে ‘প্রি-হিস্টরিক প্রিন্স্‌ অফ্‌ ইন্ডীয়া’র একটি রোমহর্ষক ভিডিও এবং তার ফসিলের ফাইবার-গ্লাস রেপ্লিকা ডিস্পলে করা হবে।”
- “একমাসটা কি ইনাফ্‌? আমি কোন তাড়াহুড়োর মধ্যে বাজে কোয়ালিটীর কাজ চাইনা”, ভাইস্‌ প্রেসিডেন্টের গম্‌গমে কন্ঠস্বর।
- “না, কোয়ালিটির কম্প্রোমাইজ হবেনা, তার গ্যারান্টি আমি দিলাম।”
- “কত বাজেট এস্টিমেট করছ? তার একটা ডিটেল্ড ব্রেক-আপ্‌ দেখতে চাই আমি এই পুরো প্রজেক্টটা অ্যাপ্রুভ করার আগে”, এবার স্বয়ং প্রেসিডেন্ট।
- “স্যার, জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ্‌ ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর অফ্‌ প্যালিওন্টোলজি ডক্টর শ্রীনিবাসান সুব্বারাও এই ফসিলের ভ্যালুয়েশান করে পাঠিয়েছেন।”
ডক্টর শ্রীনিবাসান সুব্বারাও-এর নাম প্যালিওন্টোলজি জগতে অত্যন্ত স্বনামধন্য। বোর্ডের অনেকেই এই নামের সাথে পরিচিত। বহু কনফারেন্স ও সেমিনারে ডক্টর শ্রীনিবাসান সুব্বারাও গেস্ট স্পীকার হিসেবে ভাষণ দিয়েছেন এবং দেশ-বিদেশের প্যালিওন্টোলজিস্টরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছে। ওনার নামটা উচ্চারণ করতেই বোর্ডরুমে একটা গুঞ্জন শুরু হল। শেষে প্রেসিডেন্ট প্রশ্ন করলেন, “ভ্যালুয়েশানটা শুনতে পারি?” বোর্ডরুমে আবার পিন্‌ড্রপ সাইলেন্স।
- “ইন্ডীয়ান কারেন্সি-তে পঁচাত্তর লাখ, অর্থাৎ আমাদের কারেন্সিতে দেড় লাখ ডলার”
- “পুরো প্রজেক্টের কস্ট কত? একেবারে এখন থকে উদবোধনের দিন অবধি আমাকে কত টাকা খরচ করতে হবে?”
- “হ্যাঁ স্যার, সেই ডিটেল্ড খরচের হিসেব আমি বোর্ড অফ্‌ ডিরেক্টর্সদের সামনে পেশ করতে চাই”, সাথে সাথে স্যান্ডি প্রত্যেকের সামনে প্রজেক্ট বাজেট-এর একটা প্রিন্ট-আউট রাখল, “ফসিলটা কিনতে দেড় লাখ লাগলেও আপনারা জানেন যে এখনও অনেক কাজ অবশ্য বাকি। ফসিলটার থরো অ্যানালিসিস করা, ইন্ডীয়া থেকে এদেশে নিয়ে আসা, রেপ্লিকা বানানো, রিকন্সট্রাকশান করা... তাও মনে হচ্ছে ওয়ান্‌ মিলিয়ান ডলারের মধ্যে নেমেই যাবে।”
- “ওয়ান মিলিয়ান ডলার্স?” তিনজন ডিরেক্টরের সমবেত বিস্ময়-মাখানো প্রশ্ন।
- “ঠিক আছে, শুধু তোমার অ্যানালিসিসের আর ইন্টুইশানের ওপর ভরসা করে আমি ওয়ান্‌ মিলিয়ান ডলার এই প্রজেক্টের জন্য অ্যাপ্রুভ করলাম। আমার মনে আছে এই বছরের ওই দুর্ভাগ্যজনক থ্যালাট্টোসরের ফসিলটা হাতছাড়া হওয়ার সময় আমরা জেনেছিলাম যে তোমার ইন্টিউশান বলেছিল লাস্‌ গ্রুটাস বীচের পাশে প্রস্পেক্টিং করতে। কিন্তু এলিজাবেথ মিউজিয়ামের প্রিন্স্‌ যেন স্যান্‌ডিয়েগোর ওই সী-মন্সটারকে দ্বৈরথ-সমরে হারিয়ে দেয়। সেই দায়িত্ত্ব তোমার!” প্রেসিডেন্টের ডিসিশানের ওপর আর কারও কিছু বলার নেই। বেশীরভাগ বোর্ড মেম্বারই বেশ খুশি এই চমকপ্রদ আবিষ্কারের খবরে।
- “এখান থেকে কত বড় টীম যাচ্ছে?” ভাইস্‌ প্রেসিডেন্টের প্রশ্ন।
- “এখান থেকে কেউ যাছে না, শুধু আমি যাচ্ছি”, স্যান্ডির কনফিডেন্ট উত্তর।
- “সে আবার কি? কেউ যাচ্ছে না, তা কি করে হবে? আপনি তো শুনেছি নন্‌ টেকনিকাল লোক, আপনি ফসিল অ্যানালিসিস করবেন কি করে?” ভাইস্‌ প্রেসিডেন্ট তো আঁতকে উঠলেন প্রায়।
- “এটাও আমার একটা নতুন ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান। আমরা এতদিন লোকাল প্যালিওন্টোলজির টীম নিয়ে কাজ করলেও সবসময় আমাদের নিজস্ব কয়েকজন সিনীয়ার প্যালিওন্টোলজিস্টকে নিয়ে যেতাম যখনই অ্যামেরিকার বাইরে কোথাও এক্সক্যাভেশান করতে যেতাম। আমি অ্যানালিসিস করে দেখেছি যে তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশে এক্সক্যাভেশান করতে গেলে ওদের গোটা টীমকে আমাদের যত পে করতে হয় তার চাইতে অনেক বেশী টাকা খরচ হয় আমাদের একজন প্যালিওন্টোলজিস্টকে এই পুরো ট্রিপের এয়ার-ফেয়ার, হোটেল, গাড়িভারা, খাই-খরচ আর মিসেল্যানিয়াস্‌ খরচ রিইম্বার্স করতে। এই আউট্‌সোরসিং-এর যুগে এই অনাবশ্যক খরচকে প্রশ্রয় দেওয়ার কিছু আছে কি? আমি তাই ওই থার্ড-ওয়ার্ল্ড কান্ট্রি ইন্ডিয়ারই একজন সিনীয়ার প্যালিওন্টোলজিস্টকে আমার এই প্রজেক্টের লীড বানাতে চাই। এতে আমি ক্যালকুলেট করে দেখেছি প্রায় ৪৩% খরচ বেঁচে যাবে। ওই লোকাল সিনীয়ার প্যালিওন্টোলজিস্ট ঘন্টায় কত ডলার চাইছে জানেন? স্রেফ ১০ ডলার পার আওয়ার!”
- “এই প্ল্যানটা একটু বেশী রিস্কি হয়ে যাচ্ছে না কি?” এতক্ষনে মিউজিয়ামের কিউরেটার মিস্টার গর্টন মুখ খুললেন, “অবশ্য আপনি নিজেও ইন্ডিয়ান বলে হয়ত রিস্কটা একটু কম যেহেতু আপনি লোকাল টীমের সাথে সহজেই মিশে যেতে পারবেন। কোন অসুবিধা হলে কিন্তু ইমিডিয়েটলি আমাকে কন্ট্যাক্ট করবেন।”
- “মিস্টার গর্টন, আমিও আপনার মতই অ্যামেরিকান সিটিজেন”, স্যান্ডির ঝাঁঝাল উত্তর, “আর টীমে মিশে কাজ করাটা অ্যাজ আ গুড ম্যানেজার আমাকে সবসময়ই করতে হয়। ইন্ডিয়ার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই”, কিউরেটারটা বলে কিনা স্যান্ডিও ইডিয়া? এই জন্যেই স্যান্ডির কিছুতেই কিউরেটারকে সহ্য হয়না।
- “আয়াম স্যরি, আই ডিডন্ট মীন ইট্‌ দ্যাট্‌ ওয়ে”, গর্টন দুঃখপ্রকাশ করল।
প্রেসিডেন্ট গম্‌গমে গলায় বললেন, “দিস্‌ মিটিং ইজ নাও ওভার, অ্যান্ড দ্য প্রজেক্ট রাজাসরাস ইজ অ্যাপ্রুভড্‌”।
স্যান্ডি তো খুশিতে ডগমগ। একে মিলিয়ান ডলারের প্রজেক্ট হাতে পেয়েছে, তাও আবার ভারতীয় টাকায় প্রায় পুরো প্রজেক্টটাই নামিয়ে ফেলবে, ওই অমিত না কি যেন নাম, তাকে তো ঘন্টায় ৬ ডলার দিলেই হবে সে নিজেই বলেছে, বোর্ডের থেকে ঘন্টায় ১০ ডলার স্যাংকশান করিয়ে রাখল, এরকম অনেক দিক থেকেই অনেক টাকা হিসেবে গরমিল করিয়ে পকেটস্থ করা যাবে, হয়ত ববের ডীলটার মত ফাটাফাটি হবে না, কিন্তু নেহাতশুকনো বাহবা আর একটা নাম-কা-ওয়াস্তা বোনাসের ছাড়াও অনেক কিছু পকেটে ঢুকবে!

(১১)
এমিরেটস্‌এর ফ্লাইটে দুবাই হয়ে সোজা পৌছাল কোলকাতায়। সুবিধাবাদী স্যান্ডির আগাগোড়া প্ল্যানই ছিল কোম্পানির পয়সায় বিজনেস ক্লাসে একটা কোলকাতা ট্রিপ বাগিয়ে বাড়িতে দেখা করে নেওয়া। দেখা করার মূল উদ্দেশ্য অবশ্যই ভাই বোন , আত্মীয়স্বজনদের কাছে শোঅফ করা। বাড়ির লোকে আশা করেছিল স্যান্ডি বড় দুটো সুটকেসে সকলের জন্য আমেরিকা থেকে গিফট এনেছে। কিন্তু সুটকেস থেকে বেরলো শুধু মিনারেল ওয়াটারের বোতল আর টয়লেট পেপার। কলকাতার বিষাক্ত বাতাসেই নাকি স্যান্ডি অসুস্থ হয়ে পড়ছে, এখানকার জল ওর মত ইউএস সিটিজেনের পক্ষে বিষ সেকথা স্যান্ডি তিনদিনে পঁয়শট্টিবার বলল। তবে স্যান্ডি শৌচকর্মে জলের বদলে টয়লেট পেপার ব্যাবহার করে শুনে স্যান্ডির ঠাকুমা ওকে কিছুতেই রান্নাঘরে খাবারঘরে ঢুকতে দিলেন না। আর স্যান্ডির ব্যাবহার করা খাটবিছানা, চেয়ার, সোফা সমস্ত গঙ্গাজলে শুদ্ধ করে নিলেন।
কলকাতায় দিন তিনেক কাটিয়ে জেট্‌ এয়ারওয়েসে রওনা দিল সুরাটে। সেখান থেকে বালাসিনোর আড়াইশো কিলোমিটার রাস্তা। ন্যাশানাল হাইওয়ে ৪৮ দিয়ে যেতে হয়, ঘন্টা চারেকের পথ। সুরাট এয়ার্পোর্টে স্যান্ডি তো অনেক শো-অফ্‌ করল এখানে ভালো এসইউভি গাড়ি পাওয়া গেল না বলে। অগত্যা ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দিল বালাসিনোরের পথে। ওখানে পৌঁছে স্যান্ডি ‘গার্ডেন প্যালেস’ হেরিটেজ হোটেলে চেকইন করল। ঘরভাড়া দৈনিক ৭৫০০ টাকা, কিন্তু ওর কাছে সেটা দেড়শো ডলার, তাও আবার এলিজাবেথ মিউজিয়ামের তহবিল থেকে রিইম্বার্সড হবে, কাজেই স্যান্ডির কোন অসুবিধা নেই। তবে এটাও ঠিক যে বালাসিনোরে ঐ একটি মাত্র হেরিটেজ হোটেল ছাড়া আর সেরকম কোন ভালো হোটেল নেই। বালাসিনোরের বাবি রাজপরিবারের উত্তরসূরির এখন ওই হোটেলের বর্তমান মালিকানা। বালাসিনোরের ডাইনোসর পার্ক, নির্মীয়মান মিউজিয়াম, হোটেল মালকিনের ইৎসাহ সবকিছু দেখে স্যান্ডি মনে মনে নিশ্চিন্ত হল যে তাহলে ঠিক জায়গাতেই এসেছে। শুনল যে এই জায়গা থেকে নাকি গাদাগাদা ফসিল উদ্ধার করা হয়েছে। অ্যামেরিকা হলে এই সাইট একটা মেগা-টুরিজম্‌ স্পট করে তুলতে প্রাইভেট ওনার থেকে গভর্নমেন্ট সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ত, কিন্তু গুজরাতে কারোরই মাথাব্যাথা নেই এই অসাধারণ ফসিল সাইটকে কোনভাবে ওয়ার্ল্ড ম্যাপে এটাকে হাইলাইট করতে।যাইহোক্তাতে স্যান্ডিরই সুবিধা। অনেক কম খরচে তাড়াতাড়ি রাজাসরাসের ফসিল নিয়ে ফিরে যেতে পারবে।
পরেরদিন সকালে ওর প্রেসিডেনশিয়াল সুইটে দশটায় রঞ্জিতকে আর গোভিন্দকে আসতে বলে দিয়েছিল স্যান্ডি। শো-অফ্‌ করাও হবে, আবার চাক্ষুশ দেখে আলাপ-পরিচয় সেরে তাড়াতাড়ি ঐ কন্সট্রাকশান সাইটে যেতে হবে কাজ শুরু করতে।
- “গুড্‌ মর্নিং স্যার, আমি গোভিং সিং, আর ইনি লার্সেন অ্যান্ড টুবরোর সিভিল ইঞ্জিনীয়ার মিস্টার রঞ্জিত চ্যাটার্জি”, হাসিমুখে অমিত আর রঞ্জিত করমর্দন করল স্যান্ডির সাথে। পাগড়ির কুট্‌কুটানিটা এই অ্যাড্‌ভেঞ্চারের নেশায় অমিত খেয়ামই করলনা। শিখ সেজে আগাগোড়া থাকতে হবে তাকে প্ল্যান অনুযায়ী।
- “গুড মর্নিং, তোমাদের সাথে ইমেইল আর ফোনেই যা কথা হয়েছে। নাইস্‌ টু মীট্‌ ইউ। আচ্ছা, এখান থেকে কন্সট্রাকশান সাইটটা কতদূর? কিভাবে যেতে হয়?”
- “এখান থেকে মিনিট কুড়ির পথ। আমার গাড়িই আপনি এই কদিন ব্যাভার করতে পারেন, এখানে তো সেরকম ভালো ট্র্যান্স্‌পোর্টের ব্যাবস্থা নেই।”
- “ওকে, থ্যাঙ্কস্‌” বেশী কথা না বাড়িয়ে স্যান্ডির সরাসরি প্রশ্ন অমিতকে, “তুমি কি কিছু কাজ এগিয়ে রেখেছ? বোন-অ্যানালিসিস্কিছু করেছ? হাড়-গুলো কত বছরের পুরনো? আমাকে পুরো ডিটেল্ড অ্যানালিসিসটা সাবমিট করো।”
- “হ্যাঁ এই যে স্যার, আমি ইউরেনিয়াম ২৩৮ রেডিওমেট্রিক ডেটিং করে দেখেছি এই হাড়গুলো ক্রেটাশিয়াস যুগের, অর্থাৎ জুরাসিক যুগের কিছু পরে, আনুমানিক ৭০ থেকে ৯০ মিলিয়ন বছর আগেকার। আর জানেনই তো আমাদের রাজাসরাস নর্ম্যাডেন্সিস ঐ সময়ই পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াত।” বলাই বাহুল্য এই পুরো অ্যানালিসিসটাই ভুয়ো, কিন্তু এই ভুয়ো অ্যানালিসিসকে সত্যি প্রমানিত করার জন্য যা যা রিপোর্ট লাগে, সব তৈরি করেই রেখেছিল অমিত। এমনকি যদি স্যান্ডি আবার করে সব মেশ্যরমেন্ট করতে বলে, তাহলেও ও প্রস্তুত হয়েই ছিল। ওর রেডিওমেট্রিক ডেটিং প্রসেস এবং যন্ত্রপাতির প্রিসিশান চেঞ্জ করাই ছিল।
- “আচ্ছা, ভালো কথা। চলো, সাইটে যাই। তার মানে তুমি নিঃসন্দেহ যে এই ফসিলটা রাজাসরাসের বাচ্চার।”
- “স্যার রাজাসরাসের বাচ্চা শুতে কেমন গালাগালি মনে হয়, বরং বাচ্চা রাজাসরাস বলি আমরা”, চিরকালের ফাজিল রাতুলের মন্তব্য।
স্যান্ডি পিরুয়েৎ করার ভঙ্গিতে রাতুলের দিকে ঘুরে বলল, “আমি এখানে ইয়ার্কি করতে আসিনি, আমি যেকোন প্রজেক্ট খুব সিরিয়াসলি করি। বাই দ্য ওয়ে, এই ফসিলটা আমার হাতে তুলে দিতে তুমি কত টাকা চাও?”
- “আপনাকে তো আগেই স্যার ডক্টর সুবারাওএর ভ্যালুয়েশানটা পাঠিয়েছিলাম। ৭৫ লাখটাকা পেলেই ওটার ওনারশিপ আপনার হাতে তুলে দেব।”
- “ঠিক আছে। তোমাকে আমি এলিজাবেথ মিউজিয়ামের পক্ষ থেকে একটা চেক লিখে দেব। এবার চল সাইটে যাওয়া যাক।”
সাইটে পৌঁছে স্যান্ডি দেখল একটা ছোট কন্সট্রাকশান প্রজেক্ট। ভিতের গভীরতা দেখে মনে হয়না দশতলার বেশী উঁচু ফ্ল্যাট তৈরি হবে বলে। যাইহোক, সেই নিয়ে অবশ্য স্যান্ডির মাথাব্যাথা নেই। চারদিকে অনেক মজুর কাজ করছে। ওরা বালি, সুড়কি, সিমেন্ট পেরিযে সাইটের উত্তর-পূর্ব দিকে এসে পৌঁছোল। এবং স্যান্ডি দেখল ছড়ানো-ছেটানো অনেক হাড় চারদিকে। কোনটাই খুব বড় নয়, তবে পরিমণে অনেক।
- “স্যার, এইযে দেখছেন এই হাড়গুলোর সব রেডিওমেট্রিক ডেটিং করিয়েছিলাম। আমাদের সৌভাগ্য যে সেডিমেন্টারি পাথরের পাশেই আগ্নেয়শীলা ছিল তাই ইউরেনিয়াম আইসোটোপ দিয়ে ডেটিং করতেই ক্রিটাশিয়াস যুগের রীডিং দিয়ে দিল, আর এই যে স্যার ডীটেল্ড রিপোর্ট।”
- “ঠিক আছে, এবার বল যে পুরো এক্স্‌ক্যাভেশান করতে কতদিন লাগবে? আর খরচ কত পড়বে?” রিপোর্টটাইয় চোখ বুলিয়ে স্যান্ডির প্রশ্ন।
- “তা স্যার, নয় নয় করেও কাজ কম নেই। জুভেনাইল ডাইনোসর বলে এক্স্‌ক্যাভেশান করতে সময় কম লাগবে ঠিকই, কিন্তু তারপরের কাজগুলো কিন্তু একই সময় নেবে। ভালো কথা আপনি কি চান আমাদের দেশ থেকেই ফাইবার-গ্লাস রেপ্লিকা বানিয়ে নিয়ে যেতে? আমার ধারণা তাতে আপনার অনেক কম খরচ পড়বে। কিন্তু আপনি যদি ওখানে রিকন্সট্রাকশান করাতে চান, তাহলে খুব তাড়াতাড়ি সেই প্রজেক্টটা নেবে যাবে।”
- “হ্যাঁ, সেটা একটা ভালো আইডিয়া। এখান থেকেই ফাইবার গ্লাস রেপ্লিকা বানিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। রেপ্লিকার প্রিসিশান একদম সঠিক হওয়া চাই কিন্তু।”
- “সে নিয়ে কিছু ভাববেন না স্যার। আমি রেপ্লিকা বানিয়ে নিয়ে আপনাকে কয়েকটা অরিজিন্যাল আর রেপ্লিকা পাশাপাশি রেখে দেখাব, তাহলেই দেখবেন খালি চোখে তো কোণ ছাড়, যদি ফিতে দিয়েও মাপ নেন, তাহলেও ১০০% আইডেন্টিক্যাল মেশ্যরমেন্ট পাবেন।”
এক্সক্যাভেশানের কাজ শুরু হওয়ার আগে রঞ্জিতকে স্যান্ডি এলিজাবেথ মিউজিয়ামের পক্ষ থেকে পঁচাত্তর লাখ টাকার একটা চেক দিল এবং তার পরিবর্তে রঞ্জিতকে দিয়ে একটা ‘রিলীজ অফ্‌ ওনারশিপ’ ফর্ম, অর্থাৎ এই ফসিলের মালিকানা বা স্বত্ত্ব ছেড়ে দেওয়ার এগ্রীমেন্টে সই করিয়ে নিল। অর্ক, সাহানা, রঞ্জিত, অমিতের আগে থেকেই প্ল্যান করা ছিল। টাকাটা জমা পড়ল একটা সুইস্‌ অ্যাকাউন্টে, যারা কোন দেশের গরমেন্টকেও তাদের কাস্টমারদের অ্যাকাউন্টের ব্যালেন্স বা ট্রাঞ্জাকশান সম্পর্কে কিছু ফাঁস করেনা।
আড়াই সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যুৎগতিতে এক্স্‌ক্যাভেশান শেষ করে অমিত স্যান্ডির হাতে পুরো স্কেলিটাল রেমেইন্স্‌গুলো তুলে দিল। স্যান্ডিকে জিজ্ঞাসা করল, “স্যার, প্রায় ২০৫ টা হাড় আছে, এর প্রত্যেকটা হাড় কি আপনি থরলি চেক করতে চান? যদি চান এর মধ্যে থেকে টেন পার্সেন্ট হাড় অর্থাৎ কুড়িটা হাড় স্যাম্পলিং করবেন, তাহলে তাও করতে পারেন। আমি রেডি হয়েই এসেছি।“
- “হ্যাঁ, দুশোটা হাড় চেক করার মত সময় নেই আমার।আর দরকারই বা কি?”
- “আচ্ছা স্যার, নো প্রব্লেম, ইনফ্যাক্ট, ভালোই হল আমি একেবারে এই কুড়িটা হাড়ের ফাইবার গ্লাস রেপ্লিকা গুলোও আপনাকে দেখিয়ে নিচ্ছি। বলেছিলাম না স্যার, যে খুব ভাল প্রিসিশান পাবেন। এই দেখুন।”
- “হ্যাঁ খুব ভাল হয়েছে, খালি চোখে তো অ্যাট লিস্ট ডাইমেনশানের কোন পার্থক্য ধরাই যাচ্ছে না।”
- “সেটাই তো চাই স্যার, আপনার মিউজিয়ামের দর্শকরা কি আর স্কেল নিয়ে ঝোলানো কংকাল মাপতে যাবে?”
- “ঠিকই বলেছ” স্যান্ডি কুড়িটা হাড় আর কুড়িটা ফাইবার গ্লাস রেপ্লিকাইয় চোখ বুলাতে বুলাতে সায় দিল।
অমত এরপর ছাড়ল এক মোক্ষম ব্রহ্মাস্ত্র। ডক্টর সুব্বারাও-এর একটা ইমেইল-এর (অবশ্যই সাহানার লেখা) প্রিন্ট-আউট স্যান্ডিকে দিল যেখানে এই ফসিলের কিংডম, ফাইলাম, ক্লাস, নোড, অর্ডার, সাব-অর্ডার, ফ্যামিলি আর সাব-ফ্যামিলি প্রাঞ্জল করে বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করা হয়েছে যে ফসিলটি সত্যিই রাজাসরাসের। এবং সেই ইমেইলএ এই আবিষ্কারের আরও কিছু আকর্ষণীয় দিক বলা ছিল, যেমন এই ফসিলের খুলির হাড়ের কন্ডিশান। এত ভালো অবস্থায় সাধারণত কখনই জুরাসিক বা ক্রেটাশিয়াস যুগের ফসিল পাওয়া যায়না। খুলির চোয়ালের হাড়ে আবার কিছু কিছু দাঁতেরও অবশিষ্টাংশ আছে, যা ফফিলটা যদি রেকন্সট্রাকশান করানো হয় তখন খুবই দরকারে লাগবে একটা জীবন্ত ডাইনোসর তৈরি করার কাজে। স্যান্ডির এই টোপ না গিলে উপায় ছিল না। ও জানত যে ডক্টর সুব্বারাও এর এক্সপার্ট ওপিনিয়ানের দাম ওদের এলিজাবেথ মিউজিয়ামও করে।
বড় লাল হরফে ‘এক্সট্রিম্লি ফ্রাজাইল’ বা ‘ভীষণ ভঙ্গুর’ লেখা এক মাঝারি ক্রেটে এই ফসিলের হাড়গুলো খুব সাবধানে অনেক প্যাডিং দিয়ে প্যাক করা হল। তার পাশে আরেকটা ছোট ক্রেট, তাতে ঐ ২০৫ টা হাড়ের ফাইবার গ্লাস রেপ্লিকা। এই দুটো ক্রেট এখন এমিরেটস্‌এর কার্গোয় লস্‌-অ্যাঞ্জেলেস গিয়ে পৌঁছবে। এর সাথে অমিত একটা সিডি-তে এই ফসিলের ২৫০ টা হাড়ের মাপ, ওজন, ইত্যাদি রেকর্ড করে স্যান্ডিকে দিল। বলল এটাতে স্যান্ডির রিকন্সট্রাকশান করার কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে এবং খুব তাড়াতাড়ি নেবে যাবে।
একমাসের মধ্যে প্রজেক্টটা শেষ করবে বলে স্যান্ডি তো ঢাক পিটিয়ে এসেছিল। তাই এখান থেকেই ডাইনোসর রিকন্সট্রাকশানের সবথেকে নামকরা হলিউডের ‘ডাইনোমেকানিক অ্যানিমেশান স্টুডিওস’ এর চীফ্‌ আর্কিটেক্টকে ইমেইলে স্যান্ডি ওর প্রজেক্টের পরের স্টেপ-এর ডীটেলস্‌টা দিয়ে দিল। সিডি-র ডেটা-টা ইন্টারনেটএ আপ্‌লোড করে পাঠিয়ে দিল। আর বলল যে এক সপ্তাহে যেন একটা দারুণ মুভি তৈরি করে ফেলে ডাইনোমেকানিকরা। এও লিখল স্যান্‌ডিয়েগোর মিউজিয়ামের মুভি যেন এর কাছে একেবারেই পানসে হয়ে যায়।
সাহানা যথারীতি এই কথোপকথন যত্ন করে ফলো করে যেতে লাগল। এই পর্যন্ত ওদের প্ল্যান অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে। এমন বজ্রবাঁধুনি প্ল্যান বানিয়েছিল যে এ পর্যন্ত প্ল্যানটা ফেল করাটাই কঠিন ছিল। তবে এবার প্ল্যানের শেষাংশ। যবনিকা টানার আগে ওদের মাস্টার-স্ট্রোক। তাই এই সময়ে স্যান্ডির মেইলবক্সের ওপর আক্ষরিক অর্থেই চব্বিশ ঘন্টা নজরদারি করতে হবে। ইমেইলের রদবদল করে যে ওর অর্কর এতবড় ক্ষতি করে দিল, তার পালটা মারও ইমেইলেই দেবে।
দুদিন পরে স্যান্ডির মেইলবক্সে ইমেইল এল ডাইনোমেকানিক স্টুডিও থেকে।
-------------
স্যান্ডি,
তুমি কি নিশ্চিত এই স্কেলিটনের রেকন্সট্রাকশান করতে? স্যান্‌ডিয়েগোর মুভির সাথে এর তো কোন তুলনাই করা যাবে না! কনফার্ম করলে তবেই আমরা এগোব।
ইতি,
বিল্‌
-------------
সাহানা পত্রপাঠ উত্তর দিল।
-------------
বিল,
এগিয়ে যাও। আমাদের অডিয়েন্স প্রোফাইল আলাদা ওদের মিউজিয়াম থেকে। প্রত্যেকটা হাড় যেমন পেয়ছ ঠিক তেমনটি রিকন্সট্রাক্ট করো, এমনকি আঙ্গুল, দাঁত, ইত্যাদি যেরকম পেয়েছ, ঠিক তেমন ভাবে রিকন্সট্রাক্ট করো। একদম যাকে বলে টেক্সটবুক অনুসরণ করে।
-------------
সাহানা অবশ্য স্যান্ডির পাওয়া ও পাঠানো দুটো ইমেইলই ডিলিট করে দিল।
তিনদিন পর বিল লিখল
স্যান্ডি,
আমরা তোমার কথামত হুবহু রিকন্সট্রাক্ট করেছি। একটা টুডি ছবি পাঠালাম। ভাল করে দেখে ডিসাইড কর সত্যি তুমি আর এগোতে চাও কিনা। না চাইলে জানিও এখোনো পর্যন্ত আমরা যা কাজ করেছি তার চেক পাঠিয়ে দেব। এরপরেও যদি তুমি চাও আমরা মুভিটা বানাই তবে আমাদের জানিও এই অদ্ভুত প্রাণীকে তুমি মুভিতে কি ভাবে দেখাতে চাও? কি কি অ্যাক্টিভিটি করাতে চাও?
সাহানা কলম থুড়ি মাউস চালিয়ে এই ইমেল মেরামত করে দিল। তারপর ইমেলটা এরকম দাঁড়ালো
স্যান্ডি,
আমরা জানতে চাই এই অভূতপূর্ব প্রাণীকে কে তুমি মুভিতে কি ভাবে দেখাতে চাও? কি কি অ্যাক্টিভিটি করাতে চাও?
সাহানা ইমেলটা চেঞ্জ করে স্যান্ডির মেলবক্সে রেখে দিল তবে টুডি ছবির অ্যাটাচমেন্টটা ডিলিট করে দিল।
স্যান্ডি ইমেইল পড়ে উত্তর দিল
বিল,
এই প্রানীর একটা উপযুক্ত কন্ঠস্বর দাও। বন কাঁপিয়ে ডাকতে ডাকতে জন্তুটা প্রথমবার পর্দায় দর্শন দেবে। তারপর ওকে দিয়ে ওর বয়সের উপযোগী অ্যাক্টিভিটি করাও।
ইতি,
স্যান্ডি।
ইমেল স্যান্ডির মেলবক্স ছেড়ে বেরিয়ে সরাসরি বিলের মেইলবক্সে গেলনা।সাহানার কারসাজিতে সেটা গিয়ে পৌঁছল চীনদেশের এক অজানা সার্ভারে। সাহানা স্যান্ডির ইমেলে আরো দুটো লাইন জুড়ে দিল।

এই ব্যাপারে আর ইমেইল চালাচালি করে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। কবে ডেলিভার করতে পারবে জানিয়ে দাও। আমি সেই বুঝে প্রথম শো-টা অ্যা্রেঞ্জ করব।
-------------

এর পরের ইমেইলটা আর সাহানার ডিলিট করার দরকার হলনা।
-------------
স্যান্ডি,
আমি ১৮ ফেব্রুয়ারি এই মুভিটা রিলিজ করতে পারব।
ইতি,
বিল
------------
এই মেইলটা পেয়েই স্যান্ডি তোড়জোড় শুরু করল এই মুভি প্রেমিয়ারের। এটা ওর কেরিয়ারের একটা সবচাইতে বড় মুভ হতে চলেছে। খুব সাবধানে এই প্রেমিয়ারের প্ল্যানিংটা করতে হবে। শুধু কি কিউরেটরকে ডাকবে? নঃ, তা কেন? পরে যদি কিউরেটরই ওর কাজের অনেকটা ক্রেডিট নিজে খেয়ে নেয় সিনীয়ার ম্যানেজমেন্টের কাছে? তা হতে দেওয়া চলে না। পুরো বোর্ড মিটিংই বরং আরেকবার ডাকার পার্মিশান নেওয়া যাক। আর সেই সঙ্গে প্রেস্‌ কনফারেন্স ডাকলে কেমন হয়? তাহলে এক ঢিলে দুই পাখি, ওর প্রজেক্টের সমস্ত বাহবা ও নিজে পায় একেবারে প্রেসের সাম্নেই, আর এ থেকে পাব্লিসিটিও হয়ে যাবে কারণ পরেরদিনই সমস্ত কাগজে এই খবরটা ফলাও করে ছাপা হবে। হ্যাঁ এটাই বেস্ট আইডিয়া। যেমন ভাবা তেমন কাজ। স্যান্ডি খুব সহজেই বোর্ড অফ্‌ ডিরেক্টর্সদের অ্যাটেনশান আকর্ষন করতে পারল রাজাসরাসের মুভির প্রিমিয়ারের খবর দিয়ে, এবং সেই সাথে প্রায় জনা দশেক সাংবাদিক কনফার্ম করল ওই দিন এলিজাবেথ মিউজিয়ামের মুভি হলে উপস্থিত থাকবে বলে।

(১২)
১৮ ফেব্রুয়ারি। এলিজাবেথ মিউজিয়ামের মুভি হল। বিশাল প্রজেক্টর রেডি। হলে চারটে নিউজ-চ্যানেল আর তিনটে নিউজপেপারের সাংবাদিক ক্যামেরা নিয়ে অপেক্ষমান। বোর্ড অফ্‌ ডিরেক্টররা তাদের বেস্ট স্যুট পরে হাসিমুখে তৈরি মুভির প্রদর্শনের পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে। মিউজিয়ামের সমস্ত স্টাফও এই প্রিমিয়ারে ইন্‌ভাইটেড ছিল। অর্ক সবার শেষ সীটে গিয়ে বসল। ডাইনোমেকানিক অ্যানিমেশান স্টুডিও থেকে তাদের প্রতিনিধি এখনও মুভির রিল নিয়ে আসেনি, ফ্রীওয়ে তে জ্যামে আটকে পড়েছিল বলে মিনিট দশেক দেরী হচ্ছিল। এইমাত্র খবর পাওয়া গেল মিউজিয়ামে ঢুকে গেছে, যে কোন মুহূর্তে প্রজেকশান শুরু হবে।
বিল হ্যারিস্‌ ডাইনোমেকানিক অ্যানিমেশান স্টুডিওর চীফ্‌। সে এসে প্রজেক্টারে মুভি লাগাতে শুরু করতেই সাংবাদিকরা ওকেই ধরে প্রশ্ন করতে শুরু করে দিল।
“এই প্রজেক্টটা হাতে নিয়ে কেমন লাগল?”
“সব প্রজেক্টই আমার কাছে সমান আকর্ষনীয়”, বিলের সাবধানী মন্তব্য।
“কোন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়নি?”
“নাঃ, বরং যে হাড়ের মেশ্যরমেন্টের সফটওয়ার আমাদের দেওয়া হয়েছিল সেটা প্রায় নিখুঁত বলতে পারেন, এবং আমাদের ইন্সট্রাকশান দেওয়া হয়েছিল একদম মাপ মত রিকন্সট্রাকশান করতে। কল্পনার আশ্রয় নেওয়ার দরকারও অবশ্য হয়নি, এতই সম্পূর্ণ ছিল আমাদের কাছে দেওয়া ইনপুট ডেটা।”
উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। স্যান্ডির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। প্রেসিডেন্ট একবার ঘড়ির দিকে তাকালেন। ‘দ্য প্রিন্স্‌ অফ্‌ নর্মদা’ মুভি শুরু হল। একটা বিশাল জঙ্গল। গা ছম্‌ছমে পরিবেশ। দূরে দেখা যাচ্ছে একটা স্টেগোসরাস আর একটা ব্রঙ্কিওসরাস ঘুরে বেড়াচ্ছে। আকাশে টেরোড্যাক্টিলের ঝাঁক উড়ে গেল। দূরে একটা ছোট্ট কিছুর ওপর ফোকাস করে ক্যামেরাটা জুম্‌ করতে করতে এগোল। গাছ, প্রাণী, ঝোপঝাড় সব পাশ দিয়ে হুশ্‌হুশ্‌ করে সরে যাচ্ছে। হঠাৎ শোনা গেল একটা কান ফাটানো শব্দ। তবে শব্দটা খুব পরিচিত। অবশেষে ক্যামেরা এসে থামল। সামনে যা দাঁড়িয়ে আছে, সেটা কোনমতেই টীন্‌এজের কোন জুভেনাইল জন্তু নয়। একটা বুড়ো গাধা। তারস্বরে রাসভ রাগিনী গাইতে গাইতে বন থেকে বেরিয়ে আসছে।ক্যামেরাটা গাধাটার মুখের সামনে ফোকাস করতে দেখা গেল তার নাকটা একটু বাঁকা আর সামনের দুটো দাঁত নেই।
স্যান্ডির ভয় হল বোধহয় হার্ট-অ্যাটাক হবে। পরক্ষনেই প্রার্থনা করল যেন একটা হার্ট-অ্যাটাক হয়। তার পরক্ষনে ভয় হল যে অত সহজে হার্ট-অ্যাটাকে মরে এই অবস্থার মোকাবিলা করা থেকে নিষ্কৃতি বোধহয় আর তার ভাগ্যে নেই। প্রেসিডেন্ট উঠে চলে গেলেন। বোর্ড অফ্‌ ডিরেক্টররা সবাই একেক করে বেরিয়ে গেলেন। একমাত্র সাংবাদিকরা একটা মুখরোচক স্টোরি নিয়ে হ্রষ্টচিত্তে বাড়ি ফিরল। সেই সন্ধ্যায়ই স্যান্ডিকে এলিজাবেথ মিউজিয়াম ছাড়তে হল। অবশ্যই পাকাপাকি ভাবে। অর্কর একটাই আক্ষেপ। সাহানা, রঞ্জিত আর অমিত এই অনবদ্য প্রিমীয়ারের সাক্ষী থাকতে পারলনা।
ডক্টর সুব্বারাও কড়া করে এলিজাবেথ মিউজিয়ামের কিউরেটরকে ইমেইল করেছেন এই গোলমেলে ব্যাপারে ওনার কোন ইনভল্ভমেন্ট নেই জানিয়ে। এও জানিয়েছেন ওনার আন্ডারে গোভিন্দ বলে কোন শিখ স্টাফ্‌ নেই। বাকি সমস্ত জিজ্ঞাসা যেন দেশের এম্ব্যাসির মাধ্যমে ওনার কাছে আসে। একইভাবে লার্সেন অ্যান্ড টুবরো জানিয়েছে তাদের গুজরাট কেন গোটা ইন্ডিয়ার কোন অফিসেই রঞ্জিত চ্যাটার্জী বলে কোন সিভিল ইঞ্জিনীয়ার নেই। বারবার বিরক্ত করা হলে ওরা লীগাল স্টেপ নিতে বাধ্য হবে বলেও স্পষ্ট জানিয়েছে।
রঞ্জিতমামার সুইৎজারল্যান্ডের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে অনলাইন ট্র্যাঞ্জাকশান মারফত ৪৫ লাখ গেল সাহানার অ্যাকাউন্টে যেটা সাহানা ক্যানাডার একটা ব্যাঙ্কে খুলেছিল একমাস আগে। সুইস ব্যাঙ্কের কর্তৃপক্ষের কাছে এরকম অঙ্কের লেনদেন এতই রোজকার ব্যাপার যে এই নিয়ে মাথা ঘামাবার কোন দরকার বা তাগিদ তারা অনুভব করলনা। বাকি পনেরো লাখ টাকা গেল অমিতের ব্যাঙ্কে যা দিয়ে ও একটা ফ্ল্যাট কিনে ওর ডিভোর্সি বোনকে গিফট্‌‌ করে দিল। আর রঞ্জিত আস্তে ধীরে ওর শেয়ারের পনেরো লাখ টাকা দিয়ে এল্‌আইসি থেকে পেনশান পলিসি কিনে নিল।
অর্ক আর সাহানা এপ্রিলে বিয়ে করতে ইন্ডিয়া পৌঁছল। ততদিনে অর্ক ইউরোপের মিউনিখে ন্যাচারাল মিউজিয়ামে একটা সিনীয়ার প্যালিওন্টোলজিস্টের চাকরি পেয়ে গেছে। নতুন চাকরি, তাই বিয়েতে তিন সপ্তাহের বেশী ছুটি পেলনা। সাহানা আবার কান্নাকাটি করে মিউনিখের অফিসে একটা ডেপুটেশান বাগিয়ে নিয়েছে। অমিত ওদের একটা বড় বাক্সে জনৈক জন্তুর দুটো হাড় দিয়েছে ওদের মিউনিখের অ্যাপার্টমেন্টে সুভেনির হিসেবে ডিস্পলে করে রাখার জন্য।


মন্তব্য

তানিম এহসান এর ছবি

ইটা রাইখ্যা গেলাম...

ঈপ্সিত/চম্পাকলি এর ছবি

পুরোটা পড়া হল? হাসি

roll এর ছবি

চমতকার ..................অসাধারণ।আর স্যান্ডির ... কইলাম না থাক। তবে এ রকম লোক নিজ দেশে পাওয়াও কিন্তু তেমন দুষ্কর নয়।

ঈপ্সিত/চম্পাকলি এর ছবি

খুব ভালো লাগল প্রশংসা শুনে। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লাগলো। চালিয়ে যান।

-অয়ন

ঈপ্সিত/চম্পাকলি এর ছবি

অয়ন ভাই - অসংখ আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

সাফি এর ছবি

আমি এখনও পুরোটা পড়িনি, ভাগ করে করে সিরিজ আকারে দিতে পারতেন লেখাটা। প্রথম অনুচ্ছেদ পড়ে মনে হয়েছে, বাক্যে ইংরেজী শব্দের বাহুল্য অনেক বেশী, যেটা এক্টু চেষ্টা করলে হয়ত এড়ানো যেত। এই কারণে অন্তত প্রথম অনুচ্ছেদ বেশ গতি হারিয়েছে আমার কাছে। বাকীটা পড়ে জানাবো।

ঈপ্সিত/চম্পাকলি এর ছবি

অনেকে সিরিজ আকারে লেখা পড়তে ধৈর্য রাখতে পারেনা। আমরা দুজনেই সেই দলের। তার চাইতে পুরোটা দিয়ে রাখলাম। পাঠক সময়মত শেষ করবে, যেমন বই পড়ি। হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসি আমিও এটাই বলতে চেয়েছিলাম। শেষ করতে পারিনি এখনো। কিন্তু পড়তে ভাল লাগছে বেশ। শেষ করে জানাবো। ইটা রাইখ্যা গেলাম...

ঈপ্সিত/চম্পাকলি এর ছবি

আসলে আর্জেন্টিনা, লস্‌-অ্যাঞ্জেলেস, স্যান ডিয়েগো, গুজরাট সব জায়গাই বাংলার বাইরে। অনেকগুলো চরিত্রও বিদেশী। তাই ইংরেজির বাহুল্য। আমরা বর-বউ-ও দেশের বাইরে। মন খারাপ আমাদের চারপাশের লোকজন বাক্যে এরকমই প্রচুর ইংরেজি শব্দ প্রয়োগ করে কথা বলে। তাই আমাদের মনে হয় এটাই বেশী স্বাভাবিক। তবে পরের গল্প লেখার সময় আপনার কথা মাথায় থাকল।

শাব্দিক এর ছবি

ভাল লাগল তবে অর্ক ওর হারানো সম্মান ফিরে পেল না তাই একটু কষ্ট পেলাম। অর্থ দিয়ে তো সব কিছুর হিসাব হয় না।

পথিক পরাণ এর ছবি

পুরাটা পড়লাম দেঁতো হাসি

ভাল হইসে---

ঈপ্সিত/চম্পাকলি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

কালো কাক এর ছবি

গল্পটা ভালো লাগলো। তবে শুরুর দিকে কথোপকথনটুকু বেশি লম্বা মনে হয়েছে।

ঈপ্সিত/চম্পাকলি এর ছবি

তাই? যাঃ!

বন্দনা এর ছবি

অফিস ফাঁকি দিয়ে পুরাটা পড়ে ফেললাম। ভালো লেগেছে, তবে একবারে পুরাটা স্ক্রিনে পড়তে কষ্ট হয় তাই প্রিন্ট নিয়ে পড়ে ফেললাম দেঁতো হাসি

ঈপ্সিত/চম্পাকলি এর ছবি

এটা খুব বড় অ্যাপ্রিসিয়েশান। এত বড় গল্পটা এক নাগাড়ে পড়েছেন শুনে যারপরনাই খুশী হলাম বন্দনা'দি।
আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রিন্ট না করলেই ভাল করতেন, কত গুলা গাছ নষ্ট করলেন!!!!

মনের রাজা টারজান,

কৌস্তুভ এর ছবি
  • কিঞ্চিত অতিরঞ্জিত মনে হলেও গল্প ভালো হয়েছে।
  • লেখকের নাম কই?
  • মনে হয় মূল চরিত্রটার সাথে লেখকের অনেক মিল আছে চোখ টিপি
  • এত ইংরিজি শব্দ না দিলেই ভালো হত।
  • ট্যাগে 'রিভেঞ্জ' এর বাংলা দেওয়া যেত না?
  • "ঈপ্সিত/চম্পাকলি" ট্যাগটার অর্থ কী?
  • চরিত্রদুটোকে এত সাদা-কালো করে দেখাবার দরকার নেই তো। অর্ক ট্যালেন্টেড ছেলে মানেই যে তাকে প্রত্যেকটা পরীক্ষায় হায়েস্ট এবং লাখ ডলারের চাকরি বাগাতেই হবে এমন দেখানোর তো দরকার নেই। আর স্যান্ডি খারাপ লোক বলেই যে তাকে বিকৃত দেখতে হবে এবং প্রতিটা তালিকাযোগ্য বদগুণে তাকে সাজাতে হবে, এমনও আবশ্যক না। আকর্ষণীয় চরিত্রগুলোয় সবসময় একাধিক শেড থাকে।
  • বোর্ড মিটিংয়ে 'অমুক লাখ ডলার' বলা কি তার পক্ষে সম্ভব?
  • কোনো অফিসের আইটি সাপোর্টের একজন সাধারণ কর্মচারি এভাবে কারো পাসওয়ার্ড-প্রোটেক্টেড ইমেলে ঢুকে সেগুলোর কনটেন্ট এভাবে বদলে দিতে পারে, এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

মন্তব্যে চলুক

ঈপ্সিত/চম্পাকলি এর ছবি

১) গল্প ভালো লেগেছে শুনে যারপরনাই আহ্লাদিত।
২) লেখক/লেখিকার নাম দিতে ভুলে গেছি। ঈপ্সিত/চম্পাকলি - আমরা দুজন বর-বউ মিলে গল্প লিখি।
৩) না। লইজ্জা লাগে
৪) আসলে গল্পটায় বিদেশের প্রেক্ষাপট আর বিদেশী চরিত্রের আধিক্য। তাই ভেবেছিলাম এটা স্বাভাবিক লাগবে।
৫) রিভেঞ্জ-এর বাংলা দেওয়া উচিত ছিল। আসলে আমরা নিজেরাই কথায় বেশী ইংরেজি ব্যাভার করে ফেলছি আজকাল। মন খারাপ
৬) ২-নম্বর দ্রষ্টব্য।
৭) অর্ক চরিত্রটি খুব সুবোধ বালক তো নয়। প্রতিশোধের দুষ্টু বুদ্ধি অর্কের মাথা থেকেই বেরিয়েছে। স্যান্ডি চরিত্র টা গতানুগতিক। মদ , জুয়া , মেয়েমানুষ , মাৎসর্য সবগুল বদ্গুন একটার সাথে অন্য টা জড়িত।
৮) কোথায় রয়েছে ঠিক ধরতে পারলাম না।
৯) সাহানা আইটি সাপোর্টের সাধারণ কর্মচারী নয়। অ্যান্টি ভাইরাস কোম্পানীতে কাজ করে।

কৌস্তুভ এর ছবি

৪) অর্ক-সাহানার কথাগুলো সরাসরি বাংলায়, আর আজকালকার ছেলেপিলে কথায় যেহেতু অনেক ইংরিজি ব্যবহার করে তাই সেগুলোয় ঠিক আছে। কিন্তু গল্পটার বেশিরভাগটাই তো আপনারা লিখছেন, বাংলায়। স্যান্ডির সাথে বসেদের কথাগুলো, এইরকম সবকিছুই আপনারা বাংলায় 'অনুবাদ' করে দিচ্ছেন। সেগুলো ভালো বাংলা হওয়াই ভালো। টেকনিকাল শব্দের বাইরে।

৮) স্যান্ডি বোর্ডরুমে দুবার বলেছে,
"আমারই ভুল প্যালিওন্টোলজিস্ট নির্বাচনের ফলে এই মিউজিয়ামের এত লক্ষ ডলার রেভিনিউ লস্‌ হয়েছে"
"ইন্ডীয়ান কারেন্সি-তে পঁচাত্তর লাখ, অর্থাৎ আমাদের কারেন্সিতে দেড় লাখ ডলার"
আর তাকে ওই সিনেমাকোম্পানির লোকেরা বলেছিল,
"সাধারণ স্কেলিটাল রিকন্সট্রাকশানটাই তো করতে কয়েক লক্ষ ডলার খরচ হয়"
আপনার উচিত হত দেড় লাখ ডলারকে পনেরো মিলিয়ন বলা।

৯) সাহানার কথা বলিনি, (৪) এর শুরুতে দেখুন।

ওহ, আরেকটা কথা - সচলের অধিকাংশ পাঠকের কাছে কিন্তু ধাপার মাঠ নামটা আলাদা কিছু বোঝায় না, গড়ের মাঠ আর ধাপার মাঠ একই ব্যপার তাদের কাছে।

সাফি এর ছবি

ধাপার মাঠের ব্যাপারটা কী?

কৌস্তুভ এর ছবি

ধাপার মাঠ হচ্ছে কলকাতার আদি অকৃত্তিম জঞ্জাল ফেলার মাঠ। সেই বিশাল মাঠে এত বছর ধরে জঞ্জাল ফেলে ফেলে কয়েকটা কৃত্তিম টিলা'ই তৈরি হয়ে গেছে।

ঈপ্সিত/চম্পাকলি এর ছবি

কৌস্তভ, আমি উত্তর দিলাম, পোস্টটা কেন জানি আসেনি।
৪ - এগ্রীড
৮ - মিলিয়নটা বাংলা নয় বলে লাখ বলেছি। কিন্তু এটাও ঠিক যে ডলার আর লাখ কেমন যেন পান্তাভাত আর চপ্সটিক্সের মত শোনাচ্ছে। বাই দ্য ওয়ে, দেড় লাখ ডলার কিন্তু পনেরো মিলিয়ান নয়, তার একশো ভাগের এক ভাগ।
৯- ও, সাহানা নয়? তাহলে কি ইনফর্মেশান সিকিউরিটির লোক। ওরা এসব পারে। আমার কোম্পানিতেই দেখেছি ইমেলের ভেতরের কথা পর্যন্ত পড়তে পারে। চেঞ্জ করে দেয়নি আমারটা। হাসি কিন্তু আমি কনফিডেন্ট ওরা ওটা করতে পারে। আর না পারলেও গল্পের খাতিরে ধরে নিতে হবে যে পারে। হাসি

ঈপ্সিত/চম্পাকলি

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

বাপরে! ডাইনোসর পোস্ট। পড়ছি। পুরোটা শেষ করে মন্তব্য করবো। লেখালেখি চলুক। ভাল থাকবেন।

ঈপ্সিত/চম্পাকলি এর ছবি

হ্যাঁ, পড়া শেষ হলে বলবেন। অপেক্ষায় রইলাম আমরা দুজন।

ঈপ্সিত/চম্পাকলি এর ছবি

এখনো পড়া শেষ হয়নি যা দেখছি। মন খারাপ

সজল এর ছবি

পড়লাম, ভালোই লাগলো। তবে যে বড় পোস্ট, পর্বে পর্বে ভাগ করে দিলে হতো।
কিছু জিনিস খটকা লাগলো। ডায়নোসরের হাড়গোড় নিয়ে সামান্য ধারণা ছাড়াই স্যান্ডি মিউজিয়ামের এত বড় পদে উঠে গেলো। আবার সে কিছু জানে না, তারপরো এত সহজে তার প্রজেক্ট পাশ হয়ে গেলো কোন রকম অডিট ছাড়া!

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

ঈপ্সিত/চম্পাকলি এর ছবি

গল্পের গরু। চোখ টিপি

রু এর ছবি

অনেকদিন পরে লিখলেন। এত বড় লেখা, শেষ করতে পারলাম না। পরে আবার মন্তব্য করব।

ঈপ্সিত/চম্পাকলি এর ছবি

হ্যাঁ, আমরা অপেক্ষা করব।
অনেকদিন ধরে লিখেছি বলে দেরী হল। এখন আমরা একটা ক্রাইম থ্রীলার লিখছি, ওটা এত বড় হবে যে কয়েকটা পর্বে পোস্ট করব ঠিক করেছি।
-ঈপ্সিত/চম্পাকলি

পিয়াল এর ছবি

খুব ভালো লাগলো, আরো লেখা চাই।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।