একটু খুশি একটু নেশা

ঈপ্সিত আর চম্পাকলি এর ছবি
লিখেছেন ঈপ্সিত আর চম্পাকলি [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ০৫/০২/২০১৪ - ৩:০৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজ সরস্বতী পূজা, বাণী বন্দনার সাথে কিশোর প্রেমের মেলামেশার দিন । এখন দেখি অনেকে বলছে বাঙালির ভ্যালেন্টাইন দিবস। কিন্তু ভ্যালেন্টাইন দিবস হল শুধুই প্রেমের দিন। জোর গলায়, গোলাপ আর উপহারের নৈবেদ্য সাজিয়ে প্রেমের দাম্ভিক ঘোষনা , আমি শুধু আমি-ই আছি। বসন্ত পঞ্চমীর কিশোর প্রেম হল তাদের জন্য যাদের "জয় করে তবু ভয় " যায় না।

যেমন কালী পুজোটা পাড়ার দাদাদের দখলে , দুর্গাপুজোয় দেখা যায় পাকা মাথার বাবা জ্যাঠা দের, লক্ষী পুজো মা ঠাকুমা , গৃহিনীদের অঞ্চলে বাঁধা, তেমনি সরস্বতী পুজোটা মূলত কচিকাঁচা , কিশোর , কিশোরী , তরুণী , আর প্রমীলা দের দখলে। সরস্বতী পুজোর চাঁদা চাইতে আসা কচিকাঁচা দের সরস্বতী বানান করতে বলাটা বড়দের একটা প্রচলিত র্যাগিং। সেই কর্ম কালিপুজর চাঁদা পার্টির সাথে করতে গেলে ধোলাই খাবার প্রবল সম্ভবনা আছে।

সরস্বতী পুজোর সব আয়োজনের মধ্যে একটা খুশি খুশি আবহ। কাগজ কেটে সাজানো , মায়ের শাড়ি দিয়ে প্যান্ডেল বানানো , আল্পনা আঁকা সবেতেই কিশোর মনের উঁকি ঝুকি। আবার তার মধ্যে লুকিয়ে থাকে প্রথা ভাঙ্গার প্রথা। ভেঙ্গে যায় নারী পুরুষের কাজের বিভাজন। পাশের বাড়ির দাদা চমত্কার আল্পনা আঁকে পুজোর বেদী তে। মেয়ে স্কুলের দিদিমনি আর মেয়েরা কোমরে আচল জড়িয়ে বড়সড় সরস্বতী প্রতিমা টেম্পো থেকে নামিয়ে নেয়।
আয়োজনের শেষের দিকে বাবা, জ্যাঠা, কাকুর উঁকি দিয়ে বলেন কিরে তোদের এখনো সাজানো হলো না? তারপর বয়স ভুলে বসে পরেন কচিদের দলে। এমন চমত্কার শিকলের মালা তৈরী করেন মনে হয় অফিসে রোজ শিকল বানাতেই যান। হঠাত খোলস থেকে বেরিয়ে এসে শুরু করেন ছেলেবেলার গল্প।

পুজোর দিন সকালে সবার ঘুম উধাও। ছোটরা তাড়াতাড়ি করে রেডি , না হলে দাদা দিদিরা পুজোর কাজে ডাকবে না। কিশোরী তরুণী দের ডবল তাড়া। পুজোর যোগারের সব দায়িত্ব তাদের উপর , এদিকে আজ ই তো প্রাণ খুলে সাজার দিন। মা, কাকিমা বা পাড়ার মাসিমার থেকে শাড়ি ধার করে , মায়ের ব্লাউস , পেটিকোট সেলাই করে রাখা আছে। কিন্তু দিদিমনি বলে দিয়েছে সকাল সকাল স্কুলে পৌছতে। কাজেই ঢলঢলে ব্লাউসে সেপটিপিন গুজে , শাড়ির আচল কোমরে জড়িয়ে , আধ ভেজা চুল পিঠে ফেলে স্কুলের পথে দৌড়।
পাড়ার ছেলেরা প্যান্ডেলের খুঁটিনাটি কাজ সারতে সারতে দেখে "লাল ফিতে সাদা মোজা" র খোলস ছেড়ে বেরিয়ে লাল হলুদ শাড়িতে নীলাঞ্জনা আজ ধরা ছোয়ার মধ্যে। অচেনা পোশাকের মোড়কে ছোটখাটো কিশোরিটি তরুণীতে প্রমোশন পেয়েছে। দেমাকি মেয়েটি কে হঠাত কমনীয় মনে হয়।
ছেলে গুলো প্রসাদ নেবার ছলে ভীড় করে মেয়ে স্কুলের পুজোর আঙ্গিনায়। শিশ দেওয়া , আওয়াজ দেওয়া ছেড়ে ওরা আজকের দিনটা বেশ ভদ্র হয়ে থাকে। বছরে একদিনের জন্য মেয়ে স্কুলে ঢোকার এই লাইসেন্স খোয়াতে ওরা রাজি নয়।
তারপর পুজো , পুস্পাঞ্জলি খিচুড়ি খাওয়া সারা হলে কে কখন কার সাথে জুটি বেঁধে ঘুরতে বেরিয়ে গেল তাই নিয়ে দিদিমনিরাও বেশী উচ্যবাচ্য করেন না। আহা কত খেটেছে মেয়েগুলো, বলে হয়ত নিজেরাও একদিনের পাওয়া অন্যরকম ছুটিতে মগ্ন হয়ে পড়েন।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, পাড়ার ফাংসানের তোড়জোড় শুরু হয়। সারাদিন পড়াশোনায় ডুবে থাকা স্কলার ছেলে পড়াশোনা না থাকা অলস সন্ধ্যায় হঠাত শুনতে পায় ভেসে আসা গান। কে এক মেয়ে গাইছে "তোমারি ঝর্নাতলার নির্জনে " ।
ওই তো সেই কালো মেয়ে যে গত তিন বছর ধরে কনে দেখা পরীক্ষায় ফেল করে আসছে। কিন্তু আজ তো ও পাত্র পক্ষের ফরমায়েসী গান গাইছে না, আজ ও হলুদ শাড়ি পড়েছে,ওকে ভাবতে হয়নি কোন শাড়িতে ওকে কম কালো দেখাবে। আজ ও লক্ষ্মী মেয়ে না, ও আজ সরস্বতী মেয়ে। তারপর হয়ত রূপকথা তৈরী হয়। পাড়ায় পাড়ায় কানাকানি "ওরকম ভালো ছেলের (বিয়ের বাজারে কাটাপোনা) এমন কালো মেয়ে কি করে পছন্দ হলো বলত। " কেউ জানে না , মদন, কন্দর্প নয় বীনা পানির বরে কালো মেয়ের বর জুটেছে।

তার ও পরে সন্ধ্যা যখন রাতের হাত ধরছে; কোনো এক নীতিবাগিস জ্যাঠা মশাই পুজো প্যান্ডেলের আড়ালে এক জুটিকে দেখে অল্প থমকে দাঁড়ান। "শীতের রাতে আর হিমে থাকিস না " বলে মৃদু ধমক দিয়ে বাড়ির পথ ধরেন। এনার কাছে ভ্যালেন্টাইন ডে অবশ্যই অপসন্কৃতি। তাদের কালে ওরকম অসভ্যতা ছিল না। কিন্তু সরস্বতী পুজো ছিল। তাদের কালেও ছিল বসন্ত পঞ্চমীর দিনে ভীরূ প্রেমের নিবেদন। ফেসবুক , টুইট , ডেটিং ওয়েব সাইটের যুগে ও আছে , হয়ত অনেকদিন পরেও থাকবে বাঙালির ভ্যালেন্টাইন ডে। যতদিন থাকবে আনস্মার্ট ছেলের দল, যতদিন থাকবে কনে দেখা আলোয় ফেল করা কালো মেয়ে রা , যতদিন কিছু কিছু লোক রিলেসন শিপ মেকিং কে প্রেম করা বলবে, যতদিন কিছু ফেসবুক না পড়া মানুষ কমপ্লিকেটেট স্ট্যাটাস কে বলবে ভালো লাগা , ততদিন থাকবে সরস্বতী পুজোর দিনে ভিরু দের ভ্যালেন্টাইন ডে।


মন্তব্য

মন মাঝি এর ছবি

ইয়ে, 'স্বরসতী' আসলে 'সরস্বতী' হবে মনে হয়! হাসি

****************************************

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেকদিন পরে লিখলেন। দারুণ লাগলো। আপনার গোয়েন্দা/থ্রিলারগুলো নিয়ে আবার ফিরে আসুন। হাসি

এক লহমা এর ছবি

পান্ডবদা অনেকদিন আপনাদের খোঁজ করছিলেন। এই পোস্ট দেখে ওনার নিশ্চয়ই খুব ভাল লাগবে। আপনার লেখা বেশ ভাল লাগল। তবে, বানান ভুলগুলি ভাল লাগার অনুভূতির সাথে বিস্তর ঝামেলা পাকিয়েছে। ওগুলি ঠিক করা যায় কি?
পরের লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

ঈপ্সিত আর চম্পাকলি এর ছবি

ধন্যবাদ অনেক দিন লেখার সুযোগ হচ্ছে না। একটা গল্প অর্ধ সমাপ্ত পরে আছে। আপনার উত্সাহ বাক্যে শেষ করার ইচ্ছা জাগছে।

ঈপ্সিত আর চম্পাকলি
---------------------------------
বোলতা কহিল, এ যে ক্ষুদ্র মউচাক,
এরি তরে মধুকর এত করে জাঁক!
মধুকর কহে তারে, তুমি এসো ভাই,
আরো ক্ষুদ্র মউচাক রচো দেখে যাই।
--------------------------------------------

অতিথি লেখক এর ছবি

এক লহমার সংগে একমত।
বানান ভুল বহুবার ঘটেছে।
আগেও যা হত এখনও যা হয় সেই নারী পুরুষের চিরন্তন পারষ্পরিক আকর্ষনের বিষয়টি সরস্বতী পুজার জনপ্রিয়তার কেন্দ্র । দিনের আলোতেই বেশ ভাব বিনিময়ের সুযোগ থাকে। অন্যান্য পুজার মত রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়না। আর বিদ্যা তো এইজন্যেই অর্জন করতে হয় যে তা নারী পুরুষের ভবিষ্যৎ জীবনে পাথেয় হবে।
শুরুটা এইভাবে হওয়া মন্দ কি! কালো ধলো, কাটাপোনা-চারাপোনা সবার জন্যই এটা ভাল। আর যদি বসন্তের মত মৃদু মন্দ দখিনা বাতাস একটু বহমান থাকে আহা! জয় হো!

মনোবর।

অতিথি লেখক এর ছবি

কি যে ভাল লাগলো লেখাটা পড়ে! এত সুন্দর করে বলেছেন লেখক। ধন্যবাদ।

-সুষুপ্ত পাঠক

ঈপ্সিত আর চম্পাকলি এর ছবি

সরস্বতী বানান টা ঠিক করে দিলাম. আরো বোধহয় ভুল আছে. নতুন লাপটপ এ অভ্র কাজ করছে না. গুগলে লিখতে গিয়ে অনেক বানান ভুল হলো.

ঈপ্সিত আর চম্পাকলি
---------------------------------
বোলতা কহিল, এ যে ক্ষুদ্র মউচাক,
এরি তরে মধুকর এত করে জাঁক!
মধুকর কহে তারে, তুমি এসো ভাই,
আরো ক্ষুদ্র মউচাক রচো দেখে যাই।
--------------------------------------------

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

চলুক
অনেকদিন পরে আপনাদের পেলাম। নিয়মিত হবেন আশা করি। হাসি

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

চমৎকার একটা লেখা! একটা সময়ের পূর্ণাঙ্গ ছবি পাওয়া গেলো।

অনেকদিন পর আপনাদের লেখা পাওয়া গেলো। আশা করি আবারও রহস্য গল্প নিয়ে হাজির হবেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেকদিন পরে আপনাদের লেখা পেলাম! আপনাদের টিমওয়ার্কে লেখা চমৎকার গল্পগুলো আজও মনে আছে আমার।
অর্ধসমাপ্তটা সমাপ্ত করে ফেলুন, প্লিজ।

ভালো থাকুন, শুভেচ্ছা হাসি

[মেঘলা মানুষ]

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।