আমার মেটে ঘর

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০২/০৯/২০১২ - ৩:০২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মফস্বলের এক কলেজে শিক্ষকতা করতেন আমার বাবা। টাকা বাঁচাতে শহর ছেড়ে জীর্ণ কলেজ কোয়ার্টারে উঠে এলাম আমরা। টিলার ধারের এক গর্তমতো জায়গায় টিনের দোচালা ঘর। মাটির দেয়াল, ওপরে চুনের প্রলেপ দেয়া। মেঝে পাকা করিয়ে নিয়েছিলেন বাবা আর অন্য দু'জন অধ্যাপক মিলে। লাগোয়া তিনটি বাসায় তিনটি পরিবার। ও বাসার যুগলের একান্ত-গোপনীয় প্রেমালাম, জগতের কুৎসিতোতম চাপা-স্বরের ঝগড়া কিংবা অস্ফুটে বলা 'ধুর্‌', এ বাসার সোফায় বসে শোনা যায় অনায়াসে। দুলাভাইয়ের বাসায় বাতকর্ম করে খুব একটা সুবিধা হয় না - বেড়াতে এলে মামারা একথা ঠা-ঠা হাসি সহযোগে বলে বেড়াতেন। (ঢাকঢোল পিটিয়ে এ কর্ম না সারলে শান্তি পেতেন না তাঁরা।) লঘু রসিকতায় বিব্রত বাবা মুখে বোকা হাসি নিয়ে কোনমতে বলতেন - কি সব যে বলেন না আপনারা! আম্মা ইশারায় থামার অনুরোধ জানাতেন -- আস্তে, পাশের বাসার ওরা শুনে ফেলবে! কে কি শুনে ফেললো তা নিয়ে অবশ্য মামারা কোনকালেই চিন্তিত ছিলেন না।

কম বয়সে দুইটি জিজ্ঞাসা ছিলো আমার। এক, আমাদের বাসায় আত্মীয়স্বজন তেমন আসে না কেনো? দুই, এলে কেউ থাকতে চায় না কেনো? অল্পসল্প আক্কেল হওয়ার পর বুঝে নিতে সমস্যা হয় নি। একে মাটির বাসা, তার ওপর রান্নাঘর বাদে দুইটি মাত্র অপ্রশস্ত রুম। পূবের সবটা জুড়ে কবরস্থান; রাতে জানালা খুলে দিলে দেখা যেতো কাঁচা কবরের পাশে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে কোরআন পড়ছেন হাফেজ সাহেব। নিয়মিত বিরতীতে খেক্‌শিয়ালের হুক্কাহুয়া তো আছেই। রীতিমতো মনিকাঞ্চনযোগ।

বাসা-বাড়ির এই দৈন্যতায় কিছুটা হীনমন্বতায় ভুগতেন আম্মা। পারিবারিক অনুষ্ঠান গুলোতে আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত দেয়ার আগে আট-দশবার ভেবে নিতেন। আমরা ভাইরা অবশ্য এসব থোড়াই পরোয়া করতাম। বেড়েই উঠেছি মাটির দেয়ালের গন্ধ শুঁকে, আদিখ্যেতার প্রশ্নই আসে না। মেটে ঘর, পাহাড়-জঙ্গল আর খেলার মাঠ নিয়ে মহা খুশি ছিলাম আমি আর ভাইয়া। অরণ্যের সবুজে হারাতে শিখে গিয়েছিলাম আমরা, কান পেতে তন্ময় হয়ে শুনতে শিখেছিলাম পাখির গান। কাগজী লেবুর ঝোপে যত্নে বোনা টুনটুনির বাসা, সবুজ পাতায় ভোরের রোদের খেলা, বিচিত্র সব স্বচ্ছ ডানার ফড়িং, চকিতে আকাশ ঢেকে ফেলা টিয়ে, হট্টিটি, বকের ঝাক, বাগানের শিশিরভেজা টমেটো, লকলকে লাউ ডগা, লিলিপুট কুমড়ো, তরতাজা ধনে পাতা আর লাল শাকের ব্যাড- এসব দেখতে দেখতেই সকাল ফুরিয়ে যেতো আমাদের। খেলার মাঠটা ছিলো একদম কাছে। দুপুর গড়ালেই চাঁদা তুলে কেনা ৪ নম্বুরী বলটা ধুম্‌- ধুম্‌ ছন্দ তুলে ডাকতো আমাকে। 'এই দিকে, এই দিকে...আমারে, আমারে দে ব্যাডা...ধুস্‌ শালা!'-পাসের জন্য পাড়ার ফুটবল হিরোদের হাহাকার বাতাসে ভেসে আছড়ে পড়তো আমাদের দরোজায়। শীতের বিকেলে কাঁধে ব্যাট আর বগলে স্ট্যাম্প বাগিয়ে জানালায় উঁকি দিতো সেকান্দর, জানাতো -- সময় হইছে! পড়িমরি করে মাঠের দিকে ছুটতাম আমি আর ভাইয়া। বিকেল জুড়ে ফুটবল, ক্রিকেট, সাতচারা, ব্যাডমিন্টন কি না খেলতাম। রোজার মাস জুড়ে চলতো ক্যারম আর দাবা, রোজাদারদের দৌড়ে খেলার শক্তি থাকতো না বলে। মুহূর্তের মধ্যে দুই-আড়াই ঘন্টা উড়ে যেতো। বড়ো জলদি মাগ্‌রিবের আজান দিয়ে দিতেন মুয়াজ্জিন।

নামাজ শেষে ঘরের পথ ধরতাম আমি আর ভাইয়া। পশ্চিমের আকাশ তখনো রক্ত-লাল হয়ে আছে। ধীরে ধীরে বুড়ো বটের আড়ালে চলে যাচ্ছে ক্লান্ত সূর্যটা। বাবু, দেখছো? দারুন না?!-- একেকদিন বলতো ভাইয়া। অস্ফুটে বলতাম - হুম্ম, অনেক সুন্দর! বুকভরা আনন্দ দিয়ে দুইজন কিশোর পা চালাতো চিরচেনা রাস্তায়। ঐ যে আমাদের মেটে ঘর দেখা যায়। ঘরে তখন আলো জ্বলে গেছে। সন্ধ্যার নাস্তা নিয়ে অপেক্ষায় আছেন আম্মা।

১৪ ইঞ্চি সাদাকালো টিভির পর্দায় চোখ রেখে চা-বিস্কুট খেতাম আমরা। সান্ধ্য-নাস্তার সময়টা প্রলম্বিত করার যথাসম্ভব চেষ্টা করতাম দুই ভাই মিলে। খেয়েই যে পড়তে বসতে হবে! পড়ার টেবিলে বসলেই নজর চলে যেতো সামনের দেয়ালে। একটা টিকটিকি চুপিসারে এগিয়ে আসছে তার শিকারের পানে। অসীম তার ধৈর্য্য। গুটিগুটি পায়ে সে খানিকটা আগায়, আবার থেমে যায়। একেকটা সময় মনে হয় ব্যাটা অনন্ত কাল ধরে ওত্‌ পেতে আছে। অনেক সময় নিয়ে শিকার করে এই টিকটিকি, সাথে শুষে নেয় আমার পড়ার সময়ের অনেকটা। আম্মার গাট্টা মাথায় পড়ার আগে হুঁশ হয় না আমার।

কতো অজস্র স্মৃতি সেই মাটির ঘর আর আশপাশটা ঘিরে। দুই কামরার সে ঘরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিলো আমাদের আনন্দ-বৃত্ত। তার পরিধি জুড়ে ছিলো খেলার সঙ্গীরা, সজ্জন প্রতিবেশীরা, কলেজ মসজিদের বেসুরো মুয়াজ্জিন, সদাহাস্য ইমাম সাহেব, আরো কতো প্রিয় মানুষ। ছিলো প্রিয় খেলার মাঠ, খুব কাছের ফুল, পাখি আর গাছগাছালির দল। কলেজ কোয়ার্টার ছেড়ে আসা হলো সে অনেকদিন। বড়ো বড়ো সব পাকা দালানে থাকে এখন মেটে ঘরের ছেলেটা। বেলা ফুরোলে বাসায় ফেরে, রাতের খাবার সেরে বিছানায় গা এলায়। প্রহর গড়ায়। চোখ বুঁজে সে মেটে দেয়ালের গন্ধ শুঁকে বেড়ায়।

----
খাইশুই


মন্তব্য

নিবিড় এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

---
খাইশুই

দীপ্ত এর ছবি

সুন্দর। স্মৃতিকে ভাষায় রূপ দিলেন এতো চমৎকার করে, যে দেখতে পেলাম যেন পুরোটাই।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম, দীপ্ত। ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার বাল্যকাল-কিশোরকালের সাথে মিলে গেল। আহা সেই টিনের চালে ঝুম ঝুম বৃষ্টি।

আপনার নামখানা তো পুরাই সেরাম।

--বেচারাথেরিয়াম

অতিথি লেখক এর ছবি

নিক্‌ ভাল্লাগছে? দেঁতো হাসি
আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

অতিথি লেখক এর ছবি

কস্কি মমিন! পুররা মনের মত, হাঙ্গাদিন এইডাই করতে মুঞ্চায়

--বেচারাথেরিয়াম

অতিথি লেখক এর ছবি

সুন্দর লিখেছে। সবকিছু চোখের সামনে চলে এলো শব্দের গাথুঁনিতে। সেলিনা হোসেন এর কথা মনে করিয়ে দিলেন আপনার বর্ননাভঙ্গিতে।
সচলায়তনে স্বাগতম। (আপনার নিক টা মজারু হয়েছে, "কাজের মধ্যে দুই, খাই আর শুই")

- ব্যাঙের ছাতা

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, ব্যাঙের ছাতা হাসি

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ভাল লাগলো আপনার স্মৃতিচারণ। লিখতে থাকুন। ভাল থাকুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, প্রৌঢ় ভাবনা। ভাল থাকবেন।

--
খাইশুই

সাবেকা  এর ছবি

এত মায়াময় একটা লেখা !

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, সাবেকা। আমার শৈশব যতোটা মায়াময়, লেখনী ঠিক ততোটাই দূর্বল। হাসি

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

আপনি খুব চমৎকার লেখেন। আরো লিখুন। বড় লেখা দিন।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, অনার্য সঙ্গীত। হাসি বড় লেখা দেয়ার চেষ্টা করব।

সত্যপীর এর ছবি

হাততালি

আরো আসুক চলুক

..................................................................
#Banshibir.

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, সত্যপীর।

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক লেখার স্টাইল ভাল লেগেছে, আল-মাহমুদের কবিতার কথা মনে পড়ে যায় হাসি

-পাভেল

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, পাভেল। হাসি

স্যাম এর ছবি

চলুক চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

--
খাইশুই

কড়িকাঠুরে এর ছবি

খুবই ভাল লাগছে- অনুভব করতে পারছিলাম যেন... হাততালি

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লেগেছে জেনে আনন্দিত হলাম। হাসি

--
খাইশুই

তিথীডোর এর ছবি

স্মৃতিচারণ ভাল্লাগলো। চলুক
লিখুন আরো... হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

খাইশুই এর ছবি

ধন্যবাদ, তিথীডোর। হাসি

babunee এর ছবি

আমার শইশব এবনং কইশরে আম্রা চিলাম এক রউমের এক টা ঘরে যার চাল টা চিল টিনের। অবস্স এর পর রউম এর সনং্খা দিগুন হয়েচে। ব্রিস্টির সময় তিনের চালের শব্দ এখন জেন সুন্তে পাই চকে বন্দ করলে। এখন অ ব্রিস্তি হয় কিন্তু সেই চতবের ব্রিস্তির গন্ধ জেন আর পাইনা।

খুব এ মায়াময় এক তা লেখা। ভাল লাগ্ল। আর লিখুন।

খাইশুই এর ছবি

ধন্যবাদ, বাবুনী হাসি

মর্ম এর ছবি

সুন্দর সুন্দর একটা লেখা! মারহাবা! হাততালি

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।