মিডিয়ার প্রতিসাম্য ও বন্ধুর বাড়িতে ঈদ-আড্ডা-২

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১১/০৯/২০১২ - ৫:২২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার আগের লেখাটি অনেকেই বোঝেননি। এ থেকে দুটো অনুসিদ্ধান্ত পেতে পারি। এক, লেখাটি বিরাট হাই থটের; দুই লেখাটি একেবারেই লো-থটের। প্রথম বক্তব্য সত্য হওয়া কঠিন, কেননা আমার বয়স হয়েছে। বয়স্ক রমণীর ক্ষেত্রে হাই-হিল যেমন হাস্যকর না হলেও কৌতুহল-উদ্দীপক, বয়স্ক পুরুষের বেলাতেও হাই-থট সন্দেহজনক। তবে দ্বিতীয়টি সত্য। কেননা, কেউ কেউ একটু একটু বুঝেছেন বলে মনে হলো, মানে বল এতোটাই লো-তে এসেছে যে- এটা ক্যাচ না ড্রপ ক্যাচ তা নিয়ে আম্পায়্যার বেশ চিন্তিত। যাই হোক- পুরোনো দিনের গান গেয়ে লাভ নেই; শখ করে আঙ্গুরীবালা কিনলেও শোনা হয় আসলে লেডি গাগা। তাই আলোচনা সামনে বাড়ুক।

http://www.youtube.com/watch?v=id3Hoq_xIWY&feature=related

আমাদের আড্ডা শুরু হতে না হতেই, বেশ এক প্রস্থ নাস্তা চলে এলো। আমি মূলত শ্রোতা। দু বন্ধু বেশ বকে চলছে। বোঝা যাচ্ছে দেশের অনেক কিছু বদলালেও আমার এই দুই বন্ধুর বাকওয়াজ স্বভাব একেবারেই বদলায়নি। তারা বলছেন। আমি মাঝে মাঝে দু একটা হ্যাঁ হু করছি। তো এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করলাম- হ্যাঁ রে, লোকে যে বলে- তোদের পত্রিকা দুটো নাকি একে অপরের ট্রান্সলেশন।

‘ট্রান্সলেশন তো নয়, ট্রান্সফরমেশন। মানে অর্থ একই থাকবে, তবে রূপ বদলে যাবে’- বেশ একটা গম্ভীর মেজাজে এক বন্ধু উত্তর দিলো। তারপরই দ্বিতীয় বন্ধু ব্যাখ্যা করতে লাগলো- শোন, তোর কী ধারণা, লোকে পত্রিকা পড়ে খবর জানার জন্য?

আমি দৃঢ়ভাবে উত্তর দিলাম- অবশ্যই।

হেসে দ্বিতীয় বন্ধু উত্তর দিলো- ভুল, লোকে পত্রিকা পড়ে খবর যাচাইয়ের জন্য। মানে কি ঘটলো- সেটা ফ্যাক্টর না, ঘটনাটা কে কীভাবে প্রকাশ করলো- তাই ফ্যাক্টর। মনে কর- দেশের অর্থনীতি ডাউন।

আমি তেড়ে উঠলাম- সে কি কথা, ডাউন বললেই ডাউন? বলিস কি এসব? অর্থনীতি তো এতো সহজ বিষয় নয় যে চাইলাম আর ডাউন বলে দিলাম। এই স্ট্যাটম্যান্টের তো একটা ভেরিফিকেশন চাই।

আরেক বন্ধু বললো- ভেরিফিকেশনের দায়িত্ব তো আমাদের না। সেটা দেখবেন সুশীল সমাজ। আমরা কেবল ঘণ্টাটা বাজাবো।

‘বটে, পরিস্কার কর দেখি’- বলে আমি খুব উৎসুক হয়ে রইলুম।

বন্ধু জবাব দিতে লাগলো- লিসেন ফ্রেন্ড। পাবলিক দুটো দলই বোঝে- সরকারি আর বিরোধী। অতএব সরকার পক্ষ বা বিরোধী পক্ষ- যে কোনো পক্ষেরই সমর্থক তোমার হাতের পাঁচ হিসেবে রইলো। তুমি যাই-ই বলো না কেনো, সমর্থক জুটে যাবে। আমাদের প্রতিবেদকের দায়িত্ব হলো- ‘দেশের অর্থনীতি বিপজ্জনক’ টাইটেলে এমন একটি প্রতিবেদন তৈরি করা, যা পড়ে তোর মনে হবে- কেবল টাইটেলটাই বোধগম্য, বাকিটা ধোঁয়াশা।

আমি বললাম- কিন্তু অর্থনীতিবিদদেরও তো মন্তব্য আছে, তাছাড়া সরকারও তো একটা স্ট্যাটম্যান্ট দিবে, মানে অর্থমন্ত্রী, গর্ভনর প্রমুখেরা তো বিষয়টির প্রতিবাদ করবেন, তাই না?

‘অবশ্যই- আমরাও সাবেক লজিক দাঁড় করাবো’- বন্ধুটি খোঁচা দিয়ে চশমাটা নাকে তুলে বললো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো- সাবেক লজিক বুঝলি না তো; শোন- সাবেক অর্থমন্ত্রী বা অর্থ-উপদেষ্টা, সাবেক গর্ভনর তাছাড়া আমাদের কথা বলবার লোকও আছে।

‘কী রকম!’ আমি জানতে চাইলাম।

‘বিষয়ভিত্তিক সুশীল-বাহিনী’- খুব সিরিয়াসলি উত্তর দিলো এক বন্ধু।

আমি মোটামুটি আঁৎকে উঠলাম- সুশীল বাহিনী!

এক বন্ধু আমার অবস্থা টের পেয়ে বললো- আরে কী মুশকিল, আইপিএল এ যদি চিয়ার্স গার্ল থাকতে পারে, আমাদের কেনো সুশীল বাহিনী থাকবে না? তুই ভাবছিস দুটোর মাঝে মিল কোথায়- এই তো? শোন, চিয়ার্স গার্লদের তখনই দেখা যায় যখন ছয়-চার বা আউট হলে তারা নৃত্য করেন, আমাদের সুশীল বাহিনীও দেশে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলে নানা উছিলায় ফোকাসে চলে আসে।

আমি জানতে চাইলাম- আচ্ছা, ধর সবকিছু করার পরও যদি পাবলিক তোদের রিজেক্ট করে, তখন?

এক বন্ধু উত্তর দিলো- তখন ‘ব্যাক ক্যালকুলেশন উইথ ট্রান্সফরমেশন’ ‍থিউরি চালু হবে।

কেমন?- আমি জিজ্ঞেস করলাম।

মানে আমার শেষ যে রিপোর্টটি পাবলিক প্রত্যাখ্যান করেছে, তা থেকেই ওর (আমার আরেক বন্ধুর দিকে আঙ্গুল তুলে) পত্রিকা নিউজ শুরু করবে। দ্যান পিছনে যেতে থাকবে, একেবারে আমার পত্রিকার প্রথম রিপোর্টটি পর্যন্ত। ঘটনা একই, কেবল আরোহন-অবরোহন পদ্ধতি।

আমি বললাম- তার পরেও যদি!

বন্ধুটি বেশ বিরক্ত হয়ে বললো- শোন, পাঁচতারা হোটেলের খাবার যদি তোর সহ্য না হয়, সেটা তোর সমস্যা- হোটেলের না। আমরা দুজন এখন এমন এক সিচুয়েমনে আছি যে- আমাদের কথা শুনতে পাবলিক বাধ্য। সেজন্যই মাঝে মাঝে অনলাইন এডিশন ডাউন করে দিই। ফেসবুকে স্ট্যাটাসের ধুম পড়ে যায়।

আমি হতাশ হয়ে বললাম- আর নয়, এখন খাবার খাওয়া উচিত। খাবার টেবিলে গিয়ে দেখি রাজ্যের আয়োজন। আমি বেশ উৎসুক হয়ে বন্ধু-পত্নীকে বললাম, বাহ বেশ তো! তবে ইচ্ছে ছিলো খানিক দেশি খাবার খাবো।

এক বন্ধু বলতে লাগলো- উঁহু, তা চলবে না। ওগুলো আমাদের প্রতিযোগিতার জন্য। তুই হয়তো জানিস না- রান্না নিয়ে এখন আমাদের দু দুটো প্রতিযোগিতার আয়োজন চলছে। টেলিভিশনেও দেখায়।

আমি বললাম- রান্নার প্রতিযোগিতা। বাঙালির কি রান্নাঘর নেই যে তোদের পত্রিকার আয়োজিত সেটে তাকে রান্না করে আসতে হবে?

‘তুমি তো দেখি নিজ দেশে পরবাসী’- আরেক বন্ধুপত্নী বেশ মজা করেই বললো কথাটা। তারপর আরও যোগ করলো- বাঙালির কোনো রান্নাঘর নেই, সে রান্নার কলাম পড়ে। তবে এটা ঠিক যে- টিভিতে যে সব রান্না করার গল্প আমরা শুনি– সে সব মশলা এমনই যে, ভূতেরাও অলৌকিক ভেবে কুলকুচি করে ফেলে।

আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম- মানে, বাঙালির নারকোলবাটা, একটু সর্ষে দিয়ে মানকচুবাটা এখন নেই!

‘কী বলিস তুই? এসব তো প্রায় হেরিটেজ সাইট। ছোটো কলাই শাক, বেতো শাক, মেথি শাক প্রাইভেট গোয়েন্দার মতো’- কাটা চামুচে শব্দ তুলে এক বন্ধু বললো।

আমি আফসোস করে বললাম- হায়! হাজার বছর আগে এই বাঙালি শাক দিয়েই মৌরলা মাছ মতান্তরে দারিদ্র ঢাকতো ! আমি যে কতোদিন চিতল মাছের মুইঠ্যা খাই না !

তুই আগে বললে পারতিস, এসব এখন হোটেলে পাওয়া যায়। তাছাড়া আমি এবারের রান্না বিজয়ীকে বললে এসে রেঁধে দিয়ে যেতো।

আমি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললাম- তোদের ‘হোটেলে’ বাহারের দামে বিক্রি হয় বা রান্নার সেটে যা রান্না হয় তা অবাঙালি রান্না। রামমোহন রায় থেকে সত্যজিৎ রায় যে মাছের ঝোল খেয়ে বড়ো হলেন – সেইসব ‘নর্মাল’ মাছের ঝোল কোথায় গেলো?

খাবার খেতে গিয়ে দেখলাম- শুধু পাতুড়ি, কোনোটাতেই তেল নেই। আমি জানতে চাইলেই রাধুনী বন্ধু-পত্নী উত্তর দিলো- না গো, তেল খাই না- কোলেস্টরেলের ভয়ে।

হায়! যেনো কোলেস্টরল ছাড়াই বাঙালি উনিশশতক গড়ে ছিলো। একটা জাতির মাঘ-ফাল্গুন শুধু পনির মশালা আর বোনলেশ হিলসা খেয়ে গোল্লায় যাচ্ছে- এটাকে আবার অ্যাপ্রিশিয়েটও করা হচ্ছে।

খাবার শেষ করে উঠলুম, নাহ মিষ্টান্ন নেই।

আমি মনে মনে ভাবছিলাম- আজ আর বাঙালির মিষ্টি নেই, অতিথি আপ্যায়নে দই নেই- কেননা ডায়বেটিক আছে। আইসক্রীম এখন শেষ পাতে। বাকিটা টিসু পেপার। অথচ একটা জাতি তো বড়ো হয় রান্নাঘরেই। রূপকথা আর রান্নাঘর ছাড়া কি ইতিহাস লেখা যায়? মহাভারত লেখাই হবে না শৈশব আর অন্দরমহলের আখ্যান বাদ দিয়ে। যাদের অসনে পথখাদ্য, বসনে হাফপ্যান্ট, উচ্চারণে টেলিসিরিয়ালের ইংরেজী ও জীবনস্মৃতি এসএমএস, তাদের তো ডেকাডেন্সের আভিজাত্যটুকুও হারিয়ে গেছে। স্বপ্নে ঘি খেতে গেলেও তো একটা করুণ রঙিন পথ পার করে আসতে হয়। বাঙালির মুখে ‘কিন্তু’ ছাড়া আর কিছু নেই যে !

অতএব- সার-বক্তব্য তিনটি;

এক: বাঙালি সম্ভবত গ্লোবালি ‘মনের মানুষ’ দেখলেও লোকালি ‘স্থানীয় সংবাদ’ শোনে।
দুই: গরিবদের আজ বড়ো দুর্দিন! মাথায় টাঙানোর মত ইডিওলজির তেরপল নেই। কেবল রাগ করার অধিকারটুকু আছে।
তিন: আদর্শলিপিগোত্রীয় লেখা শিশুদের জন্য, মাস্টারদের জন্য নয়।


মন্তব্য

লুৎফর রহমান রিটন এর ছবি

শখ করে আঙ্গুরীবালা কিনলেও শোনা হয় আসলে লেডি গাগা। চিন্তিত

আঙ্গুরবালা দেঁতো হাসি

হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

অটঃ রিটন ভাই, দরজায় তালা মাইরা কই বেড়াইতে গেছেন?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

''বয়স্ক রমণীর ক্ষেত্রে হাই-হিল যেমন হাস্যকর না হলেও কৌতুহল-উদ্দীপক, বয়স্ক পুরুষের বেলাতেও হাই-থট সন্দেহজনক''
খুব ভাল লাগল লাইনটা।।।
সাস্টিয়ান

স্যাম এর ছবি

চলুক

তানিম এহসান এর ছবি

আপনার নাম জানা হয়নি। লেখা চলুক।

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

চমৎকার গানটা কেবল বন্যার কণ্ঠেই শুনেছিলাম। এখন পাপিয়া সারোওয়ারের কণ্ঠেও শুনলাম। দেওয়া জন্যে আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

সাবেকা  এর ছবি

ভাল লাগছে পড়ে, দেখি আর কি কি পাতে আসে হাসি

বুড়া মকবুল এর ছবি

রীতিমতো গিলছি,আপনি জাত কুলিন তা বুজতে বিশারদ হওয়া লাগে না।
আপনার প্রথম পর্বের শেষ অতিথি খানা আমি ই ছিলাম।
ক্লাসিক
গুরু গুরু গুরু গুরু

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার নামটা যে স্ট্রীট-লাইট সেটা লেখার শেষে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। রাস্তার বাতি তো, কেউ না জ্বালালে জ্বলে উঠতে পারি না। রিটন সাহেবকে অনেক ধন্যবাদ ভুলটি ধরিয়ে দেবার জন্য। সমাজের অসঙ্গতির সাথে ব্যক্তির অসঙ্গতিও তাঁর চোখ এড়ায় না। হাসি

সবাইকে অনেক ধন্যবাদ- মন্তব্যের জন্য।

স্ট্রীট-লাইট

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।