কবি আর কিছু কবিতার কথা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২৩/০৯/২০১২ - ৯:২১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কবিতার সবচেয়ে শক্তিশালী বৈশিষ্ট্য হলো মানুষের আবেগে প্রভাব রাখা, কখনো প্রেম জাগানো, কখনো বিরহে শান্তির পরশ বুলানো, কখনো যুদ্ধের ডাক, বিদ্রোহী গানের সুর তুলে আন্দোলিত করা। অনেকেই কবিতা লেখবার চেষ্টা করেন, নিজেকে কবি ভাববার চেষ্টা করেন; কেউ পারেন, কেউ পারেন না। তবে তাঁকেই কবি বলা উচিত যিনি তাঁর অমর লেখনী দিয়ে মানুষের আবেগকে তুলে ধরতে পারেন, এবং পারেন সে আবেগ নিয়ে খেলতে।

মানুষের জীবনে ‘হতাশা’ শব্দটা খুবই স্বাভাবিক। আমিও নানা কারণে কখনো কখনো হতাশাগ্রস্ত হই। তবে একটা কবিতা আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে খুব সাহায্য করে –

কারোর বিরুদ্ধে তুমি কোরো না নালিশ কখনোই,
কোন কিছুকেই দায়ী কোরো না কখনো;
কারণ জীবনে তুমি যা চেয়েছো
তাই তুমি করেছো মূলত।

মেনে নাও নির্মাণের অন্তরায় আর
নিজেকে শোধরানোর শুরুর সাহস।
ভুলের ভস্ম থেকে উঠে আসে প্রকৃত
মানুষের সফলতা।

কখনো কোরো না দায়ী নিয়তি ও একাকিত্বকে
মোকাবিলা করো সব সাহসের সঙ্গে।
যেকোনভাবেই হোক – এ তোমারই কাজের ফসল,
তুলে ধরো নিয়ত জয়ের লক্ষণ।

নিজের ব্যর্থতায় তিক্ত হোয়ো না আর,
অন্যের কাঁধে তাকে দিয়ো না চাপিয়ে,
এই বেলা মেনে নাও কিংবা শিশুর মতো
ভাববে তুমি নিজেকে সঠিক।

যেকোন সময়ই, শোনো, সুসময় সূচনা করার।
ভন্ডুলের জন্য এত ভয়ানক আর কিছু নেই।
ভুলো না, তোমার এই মুহূর্তের কারণটি তোমারই অতীত
যেমন তোমার ভবিতব্যের কার্যকরণ
হবে এ মুহূর্ত তোমার।

শেষ শক্তি এবং সাহস
মেনে যে নেবে না পরিস্থিতিকে;
বেঁচে রও উজানে ও তোমার নিজের
মসিবত নিয়ে ভাবো কম আর কাজ করো বেশি।
তোমার সমস্যাগুলো এমনিই ঝরে পড়ে যাবে।

বেদনার মধ্য থেকে জন্ম নিতে শেখো
বাধার চেয়েও বেশি বড় হয়ে ওঠো।
নিজের দর্পণে দেখো নিজেকে এবং
মুক্ত হও, বলবান হও;
হোয়ো না পুতুল তুমি পরিস্থিতির
কেননা নিজেই তুমি নিজের নিয়তি।

ওঠো, দেখো প্রত্যূষের সূর্যের দিকে
ভোরের আলোয় নেও শ্বাস।
তোমার জিন্দেগিরই অংশ তুমি;
চোখ খোলো, যুদ্ধ করো, হাঁটো আর ঠিক করো নিশানা তোমার;
জয় করো জীবনকে, নিয়তির কথা তুমি ভেবো না কখনো
কেননা নিয়তি হলঃ
ব্যর্থতারই অজুহাত। [১]

এটি কোন মৌলিক কবিতা না, এটি স্প্যানিস থেকে বাংলায় অনূদিত। অনুবাদকের নাম রাজু আলাউদ্দিন আর মূল কবির নাম রিকার্দো এলিয়েসার নেফতালি রেইয়েস বাসোয়ালতো। অনেকেই কবিকে এই নামে চেনেন না, চেনেন অন্য একটা নামে – পাবলো নেরুদা। পাবলো নেরুদা কবির ছদ্মনাম। উনিশ শতকের চেক কবি জান নেপোমুক নেরুদা থেকে নেরুদা নামটা নিয়েছিলেন নিজের করে। আর ধারণা করা হয় নামের ‘পাবলো’ অংশটুকু ফরাসি কবি পল ভের্লেন থেকে নেওয়া। তৎকালীন সময়ে ছদ্মনাম নেওয়ার রীতিটা বেশ জনপ্রিয় ছিলো আর তিনি তাঁর কবিতাগুলো নিজের বাবার চোখ হতে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন। আমরা পরবর্তীতে দেখেছি যার থেকে নেরুদা নামটা নেওয়া তার থেকে যোজন ব্যবধানে এগিয়ে থেকেছেন পাবলো আর এই নেরুদা নামটাকে নিজের আর বিশ্বের অন্যতম সেরা কবির সমার্থক করে তুলেছেন যার প্রমাণ মেলে কলম্বিয়ান ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কোয়েজ এর বয়ানে –

the greatest poet of the 20th century in any language[২]

১৯০৪ সালের ১২ জুলাই চিলির পাররাল নামক ছোট্ট শহরে এক রেল-শ্রমিক পরিবারে জন্ম হয় পাবলো নেরুদার। শিক্ষিকা মাকে হারিয়েছেন শৈশবেই, আর বাবা আবার বিয়ে করেছেন। শৈশবের কিছুটা কাটিয়েছেন টিমুকো শহরে বাবার সাথেই যেখানে পরিচয় হয় স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা এবং কবি গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রালের সাথে যিনি ছিলেন পাবলোর শুরুর অনুপ্রেরণা। ১৯২১ সালে চলে আসেন সান্তিয়াগোতে। সেই সময়ে, যখন ল্যাটিন আমেরিকা মহাদেশ ইয়োরোপীয় সংস্কৃতি কেন্দ্রের নব-নিরীক্ষার ঢেউয়ে উত্তাল আর স্যুরিয়ালিজম, দাদাবাদ ও কিউবিজমের উদ্ভাবনী উত্তেজনায় শিল্পাঙ্গণ চঞ্চল, নেরুদার কাব্য চর্চায় হাতে খড়ি হয়। তিনি ছিলেন ফরাসী কবিত্রয় বোদলেয়ার-র‍্যাঁবো-ভের্লেনে অনুরক্ত।

১৯২৩ সালে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘Crepuscularin (Book of Twilights)’ বা ‘গোধূলির কথা’ যা আপাতভাবে খুব একটা জনপ্রিয়তা পায় নি। পরের বছর ছোট্ট একটা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় যার নাম 'Veinte poemas de amor y una canción desesperada (Twenty Love Poems and a Song of Despair)' বা ‘কুড়িটি প্রেমের কবিতা আর একটা হতাশার গান’ যা ছিলো স্প্যানিশ ক্যাবসুধায় নতুন কিন্তু চমকসুলভ বাঁক। এই কাব্যগ্রন্থটিতে ছিলো পরাবাস্তব জগতের আলো-আঁধারের খেলা, প্রকৃতির সজীব উপস্থাপনা। জীবনপ্রেমের বলিষ্ঠতার কারণে নেরুদার লেখনী বিশেষ হয়ে ধরা দেয়।

‘মর্ত্যের অধিবাসী’ নামের তিন পর্বের পরবর্তী কাব্যগ্রন্থে পাবলো অধিক দক্ষতার পরিচয় দেন, যেখানে উন্মোচিত হয়েছে জটিল ও আবেগময় ভাবের গ্রন্থি। ঘোর বুর্জোয়া বিরোধী সুরিয়্যালিজম স্পষ্ট চোখে ধরা দেয় এই কাব্যগ্রন্থে। এই কাব্যগ্রন্থে দুই বিদেশি কবির প্রভাব ছিলো স্পষ্টতই – সোভিয়েত কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি এবং মার্কিন কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান। এখানে ‘কাঠুরেরা জেগে থাকুক’ শীর্ষক কবিতায় হুইটম্যানকে সম্বোধন করে বলেছেন,

তুমি আমাকে দাও তোমার উদাত্ত কণ্ঠ,
তোমার ঘুমন্ত হৃদয়ের অসীম শক্তি,
দাও আমাকে তোমার গাছে শিকড়ের মতো উচ্ছ্বসিত মুখাবয়ব
যেন আমার কণ্ঠ গেয়ে উঠতে পারে পুনরুজ্জীবনের গান। [৩]

১৯২৭ থেকে ১৯৩৫ পর্যন্ত সরকারের হয়ে দূতিয়ালি করেছেন তৎকালীন বার্মা, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর ও আর্জেন্টিনায়। ১৯২৭ এ রেঙ্গুনে কবিগুরু রবীন্দনাথের সাথে নেরুদার সাক্ষাৎ ঘটে। কবিগুরুর রচনায় নেরুদার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। পূর্বে প্রকাশিত ‘কুড়িটি প্রেমের কবিতা’র একটার স্বচ্ছন্দ অনুবাদ করেছেন কবিগুরু।

In My Sky At Twilight

In my sky at twilight you are like a cloud
and your form and colour are the way I love them.
You are mine, mine, woman with sweet lips
and in your life my infinite dreams live.

The lamp of my soul dyes your feet,
the sour wine is sweeter on your lips,
oh reaper of my evening song,
how solitary dreams believe you to be mine!

You are mine, mine, I go shouting it to the afternoon's
wind, and the wind hauls on my widowed voice.
Huntress of the depth of my eyes, your plunder
stills your nocturnal regard as though it were water.

You are taken in the net of my music, my love,
and my nets of music are wide as the sky.
My soul is born on the shore of your eyes of mourning.
In your eyes of mourning the land of dreams begin.

তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা,
মম শূন্য গগণ বিহারী।
আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে, তোমারে করেছি রচনা –
তুমি আমারি তুমি আমারি ,
মম অসীমগগণবিহারী।

মম হৃদয় রক্তরাগে তব চরণ দিয়েছি রাঙিয়া
অয়ি সন্ধ্যাস্বপনবিহারী।
তব অধর এঁকেছি সুধাবিষেমিশে মম সূখ দুখ ভাঙিয়া –
তুমি আমারি তুমি আমারি,
মম বিজনজীবনবিহারী।

মম মোহের স্বপন-অঞ্জন তব নয়নে দিয়েছি পরায়ে,
অয়ি মুগ্ধ নয়ন বিহারী।
মম সঙ্গীত তব অঙ্গে অঙ্গে দিয়েছি জড়ায়ে জড়ায়ে,
তুমি আমারি, তুমি আমারি,
মম জীবন মরণ বিহারী। [৪]

নেরুদার কবি জীবনের বড় ধরনের মোড় পরিবর্তন ঘটে ১৯৩৬ দিকে স্পেনে থাকা অবস্থায়, যখন তাঁকে স্পেনে চিলির রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো হয়। খ্যাতির মধ্যগগণে থাকা কবি তাঁর মাদ্রিদের কন্সাল ভবনে প্রায়ই জমায়েত হতেন ফেদেরিকো গার্থিয়া লোর্কা, রাফায়েল আলবের্তী, গঞ্জালেস তুনোন এর সাথে।

হিটলার-মুসোলিনীর আশির্বাদে ফ্র্যাঙ্কো-ফ্যাশিবাদ মাথাচাড়া দেয় স্পেনে, আর ‘অন্যের রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন ব্যাপারে নাক গলানো অনুচিত’ নীতিতে মুখ আড়াল করে ফ্রান্স ও বৃটেন সরকার। জনগণ এই ফ্যাশিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে, সাথে থাকেন শিল্প ও সাহিত্য জগতের মহারথীরা – এলুয়ার, আরাগঁ, মালরো, পিকাসো, অডেন, স্পেন্ডার, ডেলুইস, সেকুইরোজ, হে্মিংওয়ে, ডস প্যাসোস, এহরেনবুর্গ, সী্মোনভ প্র্মুখ। ফ্রাঙ্কোর ফ্যাশিবাদের প্রথম শিকার হন গীতিকাব্যের সম্রাট ফেদেরিকো গার্থিকা লোর্কা, কারাগারে পাশবিক নির্যাতনে প্রাণ হারান ‘কাব্যের নীল অগ্নিশিখা’ মিগুয়েল হারনানদেজ, যুদ্ধের ধকল সইতে না পেরে প্রয়াত হন কবি সীজার ভালেথো।

প্রিয় সঙ্গীদের হারানোর বেদনা, সাধারণের উপর ফ্যাশিবাদের রোলার চালানোর দৃশ্য কবির হৃদয়ে জ্বালিয়ে দেয় দ্রোহের আগুন। পিকাসোর ‘গোয়ের্নিকা’, হেমিংওয়ের ‘ফর হুম দ্যা বেল টোল্‌স্‌’, ম্যালরোর ‘মানুষের আশা’র মতো করে নেরুদার হাত ধরে জন্ম নিলো আরেক মহৎ শৈল্পিক দলিল ‘Tercera Residencia’, এক ক্ষোভের উদগিরণ যার একটা অংশ ‘I Explain A Few Things’ কবিতা –

You will ask: ‘And where are the lilacs?
And the metaphysics covered with poppies?
And the rain that often beat down
filling its words
with holes and birds.’

To you I am going to tell all that happened to me.

I lived in a quarter
in Madrid, with bells
with clocks, with trees.

From there could be seen
the dry face of Castille
like a sea of leather.
My house was named
the house of the flowers, because everywhere
geraniums exploded: it was
a beautiful house
with dogs and little children.
Raúl, you agree?
You agree, Rafael?
Federico, you agree
beneath the earth,
you agree about my house with balconies where
the light of June drowned flowers in your mouth?
Brother, brother!

All
was loud voices, salt of wares,
agglomerations of pulsating bread,
the markets of my quarter of Argüelles with its statue
like a pallid inkwell amongst the hake:
the olive oil flowed into spoons
a deep pounding
of feet and hands filled the streets,
metres, litres, sharp
essence of life,
stacked fish,
the build of roofs with a cold sun on which
the weathervane tires,
the fine frenzied ivory of potatoes,
tomatoes multiplied down to the sea.

And one morning all of that burned
and one morning the bonfires
leapt from the earth
devouring beings,
and from that moment fire
gunpowder from that moment,
and from that moment blood.
Thugs with planes, and the Moors,
thugs with signet rings, and duchesses,
thugs with black friars blessing
came through the sky to slaughter children,
and through the streets the blood of the children
flowed easily, like the blood of children.

Jackals that the jackal would drive away,
stones that the dry thistle would bite and spit out,
vipers that the vipers would hate!

Opposed to you I have seen the blood
of Spain rise up
to drown you, in a single wave
of pride and knives!
Generals
traitors:
consider my dead house,
consider Spain, broken:
but from every dead house burning metal flows
in place of flowers,
but from every hollow of Spain
Spain rises,
but from every dead child rises a gun with eyes,
but from every crime are born bullets
that will find you one day in the house
of the heart.

You will ask why his poetry
has nothing of the earth, of the leaves,
of the grand volcanoes of his native country?

Come and see the blood through the streets,
come and see

the blood through the streets,
come and see the blood
through the streets!

(কবিতাটার অংশবিশেষ তুলে দিলে ঘটনাটাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হবে, তাই পুরোটাই দিলাম।)

কবি ১৯৪৩ এ চিলি ফিরে আসেন এবং ফিরে এসেই দেশভ্রমণ শুরু করেন। ইনকা সভ্যতা ঘুরে এসে লেখেন বিখ্যাত কবিতা ‘Alturas de Macchu Picchu’ বা ‘মাৎশু পিক্সৎশুর শিখরে’ এবং ১৯৪৫ সালে লেখেন ‘Canto General’ যাতে তাঁর শৈল্পিক দক্ষতায় এক বিন্দুতে এনে মিলিয়েছেন রাজনীতি আর কবিতাকে।

১৯৪৫ এর ১৫ জুলাই নেরুদা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। স্পেনের গৃহযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা তাঁর মধ্যে একটা পরিবর্তন নিয়ে আসে। স্যুরিয়ালস্টিক কবি দীক্ষিত হন মার্ক্সবাদে। স্যুরিয়ালিজমের আদিপিতা ত্রিস্তান জারা, দুই প্রধান প্রবক্তা পল এলুয়ার ও লুই আরাগঁ এর পূর্বেই সাম্যবাদকে জীবনের দর্শণ করে নেন। ঠিক স্যুরিয়ালিস্টিক না হলেও পিকাসোকে তাঁদের সাথের মানুষই বলা যায়। সবার ভাবধার সাধারণ ব্যাপার ছিলো – ধনতান্ত্রিক সমাজকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান।

১৯৪৮ এ চিলিতে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হলে আশ্রয় হয় প্রবাসে যার শুরুর তিন বছর কাটিয়েছেন আর্জেন্টিনায়, পরে মেক্সিকো সহ বিভিন্ন স্থানে। ১৯৫০ এর জানুয়ারিতে আর্জেন্টিনার ‘লা হোরা’ পত্রিকায় পাবলো নেরুদার একটা সাক্ষাৎকার প্রকাশ পায় যা তাঁর রাজনৈতিক দর্শণকে বুঝতে সাহায্য করবে। ঐ সাক্ষাৎকারে ‘আপনার রাজনৈতিক কার্যকাপের মূল কারণ কী’ প্রশ্নের যে উত্তর দেন তার চুম্বক অংশ তুলে ধরলামঃ

‘আমার সাহিত্যসৃষ্টিতে এক অচলাবস্থায় পৌঁছে আমি বেরোবার প্রকৃষ্ট পথ খুঁজে বের করতে চেয়েছিলাম; দুঃখের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মধ্যেই সে পথ আমি খুঁজে পেয়েছি। আধ্যাত্ববাদ বা ধর্মের ভাষায় যাকে দুঃখ বলা হয় এটা তেমন কোন দুঃখ নয়। যে সামাজিক অন্যায়ের অপরাধে মানুষ নিজেই অপরধী, এটা হল তারই ফল। এই পথ এবং সংগ্রামই আমার নিকট সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হলো। ...... ...... ...... শিল্পের জন্যেই শিল্প – বড় ব্যবসায়ীদের এই মত প্রচার করা হয়। তিয়োফিল গোতিয়ে ধনী ব্যবসায়ী ও শোষকের আদর্শের গুণকীর্তন করেছেন। লেখকেরাও যে এই মত গ্রহণ করেছিলেন সেটা হল উঠতি ধনতন্ত্রের পক্ষে জয়। আর্তুর র‍্যাঁবোর মতো বড় বিদ্রোহীর ইথিওপিয়ায় পলায়ন হল শার্লভিলের মাংসব্যবসায়ীদের অবিসংবাদিত জয়। ...... ...... ......’ [৫]

নেরুদা ১৯৫০ সালে পেয়েছেন বিশ্বশান্তি পুরস্কার এবং ১৯৫৩ সালে পেয়েছেন লেনিন পুরস্কার। ১৯৭০ এ সেরার স্বীকৃতি মিলেছে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভের মধ্য দিয়ে।

নেরুদা ১৯৬৯ সাল কাটিয়েছেন আইলা নেগ্রা অন্তরীপের যেখানে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন প্রকৃতির খেলা। এই নিয়ে আত্মজীবনীতে বলেছেন –

‘আমি প্রায় পুরো ১৯৬৯ সালটা আইলা নেগ্রা অন্তরীপে কাটালাম। সকালে জোয়ার উঠতো ভীষণ ফুলে-ফেঁপে, যেন আদি-অন্তহীন বিশাল এক তাল ময়দা কেউ পিষছে। তার মাথায় ভেসে-আসা ফেনাকে মনে হ’ত হিম-শীতল পাতালের মথিত গাঁজলার ওপর ছড়ানো ময়দার গুঁড়ো। ...... ...... ’ [৬]

সত্তরের দশকের চিলি হয়ে উঠেছিলো এক সংঘাতপূর্ণ স্থান যেখানে লড়াই ছিলো সাধারণ আর মার্কিনী ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার। ১৯৭০ এর নির্বাচনের জন্য নভেম্বরে সোশ্যালিস্ট-কমিউনিস্ট ও অপরাপর সমমনা দলগুলোর একটা জোট করা হয়। অন্যেরা তাদের প্রার্থী ঠিক করতে না পারায় কমিউনিস্ট পার্টি নেরুদাকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দেয়। নেরুদা শুরুতে রাজি না হলেও পরে এই শর্তে রাজি হন যে অন্য দল ভালো কোন প্রার্থী দাঁড় করালে তিনি সরে দাঁড়াবেন এবং তা তার দলকে মেনে নিতে হবে। পরে সালভাদোর আলেন্দেকে প্রার্থী করা হলে নেরুদা সরে দাঁড়ান এবং সরে দাঁড়ানোর ঘোষণায় বিশাল জনসভায় আলেন্দেকে তুলে ধরেন এবং পুরো নির্বাচনী প্রচারণার আলেন্দের হয়ে কাজ করেন।

আলেন্দে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং তিনিই হন চিলির প্রথম প্রেসিডেন্ট যাকে শ্রমিক-জনতা ভালোবেসে ‘কমরেড প্রেসিডেন্ট’ নামে অভিহিত করতো। আলেন্দে এসেই জাতীয় সম্পদ তামা সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে ছিনিয়ে জনগণের হাতে তুলে দেন, সাম্রাজ্যবাদকে হটাতে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু মার্কিনী মদদপুষ্ট ধনতান্ত্রিক সমাজ একটা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের সূচনা করে যার নমুনা – বিশ্ববাজারে চিলির তামা বয়কট, কৌশলে আন্তর্জাতিক বাজারে তামার অবিশ্বাস্য দরপতন ঘটানো, প্রতিশ্রুত সকল ঋণ বাতিল করা ও পুরোনো দায় শোধের জন্য চাপ প্রয়োগ, ভারাটে গুন্ডাদের দিয়ে চিলিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি। এসবের চরম পরিণতি ঘটে সাম্রাজ্যবাদীদের অবৈধভাবে চিলিকে গৃহযুদ্ধসম অভ্যুত্থান জ্যাক-লন্ডনীয় ‘লৌহ-পাদুকা’র সৃষ্টি করার মদ্য দিয়ে, এবং চিলি সরকারকে চরম আঘাত করা হয় ১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩ এ।

এই সময়টাতে ক্যান্সারের সাথে লড়াই করা নেরুদা অবস্থান করছিলেন সান্তিয়াগোর বাসভবনে। রুগ্ন কবির গৃহে মোতায়েন করা হয় সশস্ত্র পাহারা, করা হয় গৃহবন্দী। চারদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে দেয় মেশিনগানের আওয়াজ, আর্ত-চিৎকার, বারুদের ঘ্রাণ, আর রক্ত। কবি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলেও পরিবর্তনের হাওয়া ঠিকই টের পাচ্ছিলেন। ১৫ সেপ্টেম্বর ‘আমার স্মৃতিকথা’তে লিখলেন –

‘আমার স্মৃতিকথা বিষয়ক বইটাতে ছাপার জন্য এক টুকরো কথাগুলো লেখা হয়েছিলো সেই অবিশ্বাস্য সব ঘটনা ঘটে যাওয়ার তিন দিন পরে, যে ঘটনার পরিণতি আমার বন্ধু এবং কমরেড প্রেসিডেন্ট আলেন্দের মৃত্যু।’ [৭]

কবির অসুস্থ্যতা দ্রুত খারাপ থেকে খারাপতর হতে থাকে। অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে ১৯ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে নেওয়া হয়। চারদিন বাদে ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ১১টা বেজে ৩০ মিনিটের দিকে পাবলো নেরুদার জীবনাবসান ঘটে। প্রমাণ না থাকলেও অভিযোগ আছে মৃত্যুর আগেই কবিকে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়তে হয় সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্তে, হাসপাতালে কবির চিকিৎসা না করে তাঁর মৃত্যু তরান্বিত করা হয়।

মৃত্যুর পরপরই ফ্যাশিস্তদল নেরুদার ঘর তোলপাড় করে ফেলে, ঘরের প্রতিটি কোণ তছনছ করে খোঁজা হয় কবি কিছু লিখে গেছেন কি না যা সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে যায়। কফির লাশ ওঠে স্বল্প মুল্যের এক কফিনে এবং ফ্যাশিস্তদলের বন্দুক পাহারায় কফিন বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় শ্মশানে। লোকেরা নানা বাধা সত্ত্বেও দলে দলে ভীড় জমায় লাশের পেছনে, মিছিল করে তবে সবই ছিলো নিঃশব্দ। এভাবেই হয় এক মহা মানবের সাদামাটা বিদায়।

তথ্য-সূত্রাবলিঃ
[১] ‘কাউকে কোরো না দায়ী’ – মুলঃ পাবলো নেরুদা, অনুবাদঃ রাজু আলাউদ্দিন।
[২] Plinio Apuleyo Mendoza (1 March 1983). The fragrance of guava: Conversations with Gabriel García Márquez. Verso. p. 49. Retrieved 4 August 2011.
[৩] ‘কাঠুরেরা জেগে থাকুক’ – মূলঃ পাবলো নেরুদা, অনুবাদঃ মফিদুল হক।
[৪] ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’, ‘গীত বিতান’, ৯ আশ্বিন, ১৩০৪ বঙ্গাব্দ।
[৫] ‘পাবলো নেরুদা’ – মফিদুল হক।
[৬], [৭] ‘আমার স্মৃতিকথা’ – মূলঃ পাবলো নেরুদা, অনুবাদঃ মোজাম্মেল হোসেন।

চিত্র-সূত্রাবলিঃ
গ্লগস্টার

দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ


মন্তব্য

পলাশ এর ছবি

দারুন একটা পোস্ট। উনার সম্পর্কে আরো জানতে চাই। আর ৫২ থেকে ৬৯ পর্যন্ত ১৭ বছরের কথা নাই কেনো?

অতিথি লেখক এর ছবি

একটা মানুষের জীবন ও তাঁর জীবন দর্শন দু-চারটে কথা দিয়ে তুলে ধরা সম্ভব না। তাই শুধু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোই টেনে আনার চেষ্টা করেছি। ভবিষ্যতে উনাকে নিয়ে আরো লেখার ইচ্ছে আছে।

আপনাকে ধন্যবাদ।

দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

ভালো লেগেছে। চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ!!

দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ!!

দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ

মৃত্যুময় ঈষৎ এর ছবি

কৃতজ্ঞতা চলুক


_____________________
Give Her Freedom!

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ!!

দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ!!

দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ

অতিথি লেখক এর ছবি

মন্তব্যটা এখানে কীভাবে আসলো?! ইয়ে, মানে...

দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক চলুক

ইফতি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ!!

দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

নেরুদা আবার শিউরে ওঠেন
এখনি পঙ্গু ঈগল সাম্যবাদ
মাদ্রিদ আর চরাচর জুড়ে
লোরকা করেন কৃষ্ণ আর্তনাদ

শিকারী কুকুর তাড়িত একাকী
রুশ কবি মৃত তুষার ধবল ত্রাসে
নিরুদ্দিষ্ট তাঁর ছায়া আজও
মৌন স্মৃতিতে বারবার ফিরে আসে।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ

তারেক অণু এর ছবি

আরো বিস্তারিত লিখুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

এইটাকে ছোট মনে হল, তারেক ভাই?? ইয়ে, মানে...
নেরুদাকে নিয়ে আসলে এক পোস্টে লিখে শেষ করা সম্ভব না। ভবিষ্যতে আরো লিখবার চেষ্টা করবো।

দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ

Dron  এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ!!

দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ

Jannat  এর ছবি

হাততালি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ!!

দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ

কড়িকাঠুরে এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ!!

দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ

আবরার  এর ছবি

নেরুদাঃ বিপ্লবী লাতিনের প্রতিবিম্ব। লেখাটা চমৎকার হয়েছে

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ!!

দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ

রংতুলি এর ছবি

চলুক লেখা -গুড়- হয়েছে

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ!!

দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ

The Reader  এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ!!

দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ

pinake এর ছবি

CORRECTION-You have listed the author of this poem as Pablo Neruda. In actualilty, it is from Rabindranath Takhur (Tagore) , who is the author. Neruda interpreted Tagore's poem into Spanish from Tagore's poetry book, 'The Gardner, ' or as Neruda translated it, 'El Jardino.' Please make the necessary corrections. As a point of reference, you can look at the Penguin publication of Neruda's 'Twenty Love Poems and A Song of Despair.' I believe the poem is numbered in the teens,16 perhaps.

অতিথি লেখক এর ছবি

হ্যাঁ, একটা বড় রকমের ভুলই হয়ে গেছে। আমি যা লিখেছি ঘটনা তার উল্টো। রবীন্দ্রনাথ নেরুদার কবিতার অনুবাদ করেন নি, নেরুদাই রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিজের ভাষায় অনুবাদ করেছেন। প্রকৃত পক্ষে নেরুদার কবিতা লেখার প্রায় ২৬/২৭ বছর আগেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন 'তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা।'

আমি এখানকার অতিথি লেখক হিসেবে লিখএছি, তাই আমার পক্ষে এই পোস্ট সংশোধন করা সম্ভব না। আমি এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের জন্য দুঃখিত।

আর ভুলটি ধরিয়ে দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।