শিক্ষা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১৭/১২/২০১২ - ১১:০৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

‘এডুকেশন ছাড়া বের হওয়ার কোন রাস্তা নাই, বুঝছ। তোমাদের পড়তে হবে, অনেক পড়তে হবে। শুধু টেক্সটবই পড়লেই চলবেনা’ তানভীর ভাইয়ের কথায় আমরা সবাই মাথা নাড়ি বিজ্ঞের মত। তানভীর ভাই অনেক স্কলার লোক। ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে পড়েন, চোখে মাইনাস সিক্স পয়েন্ট ফাইভ পাওয়ারের মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। দেখলেই বুঝা উনি আসলে একটা জিনিস। উনার রুম ভর্তি খালি বই আর বই। আর দেয়ালে দাড়ি ওয়ালা কত গুলা মানুষের পোস্টার লাগানো। আমি প্রথম দিন দেখে ভাবসিলাম তানভীর ভাইয়ের আব্বার ইয়াং বয়সের ছবি বুঝি। এটা শুনে উনিতো হাসতে হাসতে শেষ। আমি তো লজ্জায় পড়ে গেসিলাম পুরা। পরে বললেন এগুলা নাকি গুয়েভারা, ক্যাস্ট্রো আরো কার কার জানি ছবি। এদের নিয়া একটা বক্তৃতাও দিসিলেন, কিন্তু এগুলা কি আর আমার মাথায় থাকে! ভার্সিটি থেকে যখনি বাসায় আসেন, এলাকার স্কুলের নাইন টেনের পোলাপান গুলারে নিয়ে অনেক জ্ঞানের কথা বলেন। একবার ম্যাথ অলিম্পিক্স না কি যেন করতে চাইছিলেন, স্কুলের স্যাররা রাজি না হওয়ায় করতে পারেন নাই। আমরা মোটামুটি সবাই উনার ভক্ত, এক মাত্র কিছুটা ব্যতিক্রম রুম্মান। এই ব্যাটার মাথায় যে কি খেলে, আমরা বুঝি না। এমনিতে ছেলে খারাপ না, ছাত্রও অনেক ভালো, রোল এক থেকে পাঁচ এর ভিতরেই থাকে সবসময়। আমার অবস্থা তো লাস্ট বা সেকেন্ড লাস্ট, মাঝে মাঝে ম্যাথ এ কানের লতি ছিদ্র করে গুল্লি যায়, এই টার্মেই ম্যাথে ডি পাইছি। বাপের সাইনটা খাতায় নিজেই করছি, অবশ্য এর আগে বিশ পচিশবার প্র্যাকটিস করে নিছিলাম।

রুম্মান পোলাটা এমনিতে ভদ্রই, কিন্তু ঘাড়ের রগ একটু ত্যাড়া। প্রায় প্রায়ই স্যারদের সাথে ক্লাসে পড়া নিয়ে তর্ক করে, মারটাও খায় সেইরকম। কিন্তু এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলেনা, শব্দও করে না।তার অভ্যাসও কিছুটা তানভীর ভাইয়ের মতই, বই পড়ে, কিন্তু পোলা খুব ডেয়ারিং। বাপের পকেট থেকে টাকা চুরি করে এলাকার পাশের বস্তিতে যায়, কি যে করে ওইখানে কে জানে। আশ্চর্যের ব্যাপার হইল ওর বাপের হাতে ধরা পরার পর রুম্মান আঙ্কেলরে কি যেন বুঝাইছে, আর উনাকে নিয়েও বস্তিতে গেছে।এর পর থেকে আঙ্কেল নাকি নিজেই ওকে বেশি করে টাকা দেন। এসব শুনছি আম্মার মুখে, রুম্মানদের বাসায় ঘুরতে গিয়ে ওর মায়ের কাছ থেকে শুনে আসছে।রুম্মানের আম্মাও জানে না, রুম্মান কি করে ওইখানে গিয়ে। এমনি ওর সাথে আমার খাতির খুব ভালই।কারণ ক্লাস টেস্ট গুলাতে রুম্মানের মত আর কেউ পোলাপানরে উদার মনে দেখায় না। ক্লাসটেস্টে তাই রুম্মানের পাশের জায়গাটা আমি দখল করি সবসময়। আর আমার যেই সাইজ, পোলাপান কেউ আমাকে ঘাটাতে আসে না কখনও।

তানভীর ভাই লোকটা সবসময়ই দেশ নিয়ে চিন্তা করেন। কিভাবে দেশটারে বাঁচানো যায়, গণতন্ত্র না সমাজতন্ত্র কোনটা আমাদের জন্যে ভালো হবে এগুলা নিয়ে আমাদের সাথে অনেক আলোচনা করেন। অবশ্য আমি এগুলার কিছুই বুঝি না, কিন্তু শুনতে ভালো লাগে, তাই থাকি। সেদিন সন্ধ্যার আলোচনায় তিনি বলছিলেন শিক্ষার গুরুত্বের কথা। আমার সাথে রুম্মানও ছিল সেদিন। তানভীর ভাই বলছিলেন, ‘বুঝছ, ইন দ্যা লং রান শিক্ষাই সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট। নেলসন ম্যান্ডেলার একটা কথা আছে, ‘এডুকেশন ইজ দ্যা মোস্ট পাওয়ারফুল উইপন উই ক্যান ইউজ টু চেইঞ্জ দ্যা ওয়ার্ল্ড’। এই যে দেখ না, আমাদের দেশে ডেমোক্র্যাসি কিভাবে ফেইল করছে। মানুষজন শিক্ষিত হলে কি রাজনীতিবিদদের দশ টাকা কেজি চালের গুলতানি বিশ্বাস করত বল! করত না। তখন নিজের ভালোটা এরা নিজেরাই বুঝত।’
আমরাও সবাই বিজ্ঞের মতন উনার সাথে মাথা নাড়ি। তানভীর ভাই এরপর বলেন, ‘আচ্ছা! একটা কাজ করলে কেমন হয়! আমরা পাশের বস্তির বাচ্চা গুলার জন্যে একটা স্কুল খুলে ফেলি, নাইট স্কুল। ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত।বাচ্চাগুলা পড়াশোনা করেনা, কারণ বাপ মা’র স্কুলে ভর্তি করার টাকা নেই। এরাও অশিক্ষিত থেকে যাচ্ছে, এদের বাচ্চাগুলাও পরবর্তীতে অশিক্ষিতই থেকে যাবে। দেখ, মানুষ গুলা তাদের দারিদ্রের ভিসিয়াস সার্কেল থেকে বের হতে পারছে না।’ আমরা সবাই একবাক্যে বলি, ‘চরম আইডিয়া ভাই, আসেন স্কুল খুলি’।
‘তাদের বই খাতা কেনার টাকা নেই কিন্তু। কাজেই আমাদের এলাকার মানুষজনের কাছ থেকে চাঁদা তুলতে হবে।অনেক পরিশ্রমের কাজ!’
বিল্টু টিপ্পনী কাটে, ‘ভাই আমাদের রাশেদ একাই বিশ জনের সমান, কাজ নিয়ে চিন্তা করবেন না আপনি’।
আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না আমার প্রশংসা করা হল নাকি শরীরের সাইজ নিয়ে মস্করা করল। হেঁড়ে গলায় বিল্টুরে একটা ধমক দেব তার আগেই তানভীর ভাই বলে ওঠেন, ‘তাহলে টাকা সংগ্রহ আর বই খাতা কেনার কাজে টিম লিডার থাকল রাশেদ। এটা কিন্তু অনেক পরিশ্রমের এবং সময়ের ব্যাপার। আমি সবসময় এখানে থাকব না, কাজেই তোমাদের চালিয়ে নিতে হবে। তোমরা পারবে কিনা চিন্তা করে বল’।
‘পারব না মানে ভাই, অবশ্যই পারব!’ আমি জোর গলায় বলি।
‘ওকে তাহলে যত দ্রুত সম্ভব টাকা তোলার কাজে নেমে পড়।সম্ভব হলে কাল থেকেই কাজে নেমে পড়া যাক। আর পড়াবো ভাল কথা কিন্তু কোথায় পড়াব বল তো! জায়গা তো লাগবে!’
‘ বস্তির সামনের খালি মাঠটাতে আমরা পরাতে পারি, যেখানে কংক্রিটের স্ল্যাব আছে। আর ব্যাডমিন্টন খেলার জন্যে আমরা যেই লাইট ইউজ করি সেগুলা কয়টা বাঁশের মাথায় পুতে সেখানে লাগিয়ে দেব!’ লম্বু রাসেল একটা ভালো বুদ্ধিই দেয়।
‘গ্রেট! তাহলে তো খুবই ভালো হয়। তোমরা তাহলে সব জোগাড় যন্ত্রের ব্যবস্থা কর। আর টাকা পয়সাইয় না কুলালে আমাকে বোলো।’
‘আপনি কোন চিন্তাই করবেন না ভাই, কাল থেকেই আমরা টাকা সংগ্রহে নামতেছি।’ আমি বলে উঠি।

আমরা একটা স্কুল দিব, সেখানে পিচ্চি পোলাপান পড়তে আসবে। এত্ত সুন্দর আইডিয়া তানভীর ভাই ছাড়া আর কেউ দিতে পারত!এর মধ্যে রুম্মান পোলাটাই প্যাঁচটা লাগায়।সে হঠাৎ বলে ওঠে বলে ‘ভাই, শিক্ষার চেয়ে জরুরী অনেক জিনিস আছে যেটা আপনি মিস করে যাচ্ছেন’। তানভীর ভাইও অবাক হলেন, ‘বল কি!কি সেগুলো?’
‘আপনি তো আমাদের মৌলিক চাহিদা গুলোর প্রথম তিনটাই বাদ দিয়েছেন। খাদ্য, বস্ত্র আর বাসস্থাণ!’ ‘শোনো রুম্মান, শিক্ষাটা হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী সমাধাণ। আমরা ক্ষণস্থায়ী সমাধাণ নিয়ে পড়ে থাকলে তো হবে না!’
‘কিন্তু ভাইয়া, পেটে ক্ষুধা থাকলে কিভাবে পিচ্চি বাচ্চাগুলা পড়াশোনা করবে? পড়াশোনাতো আমরা করাবই কিন্তু এরা বেশিরভাগ সময়ই না খেয়ে থাকে!’
‘পড়াশোনাটা হচ্ছে প্যাশনের ব্যাপার রুম্মান।’ তানভীর ভাই বোঝানোর চেষ্টা করেন।‘তুমি যখন পড়াশোনায় ডুবে যাবা তখন দেখবা ক্ষুধা তৃষ্ণার কথা মনেই থাকে না!পড়ায় মনোযোগ দিলে দেখবা এগুলার কথা মনেই আসে না। বড় বড় ম্যাথম্যাটিশিয়ান, সায়েন্টিস্টদের জীবনী পড়! দেখবা রাতের পর রাত না খেয়ে পড়াশোনা করেছে অথচ টেরই পায় নি!আর সব কিছু থেকে লাভ খুজলে চলে না। প্লেটোর একাডেমীর এক ছাত্র এক দিন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল জ্যামিতি শিখে লাভটা কি? প্লেটো রেগে গিয়ে তার এক শিষ্যকে বললেন, ঐ ব্যাটাকে একটা পয়সা দিয়ে বিদায় করে দাও, সে যা শিখে সেখান থেকেই লাভ খুঁজে।’
‘কিন্তু ভাইয়া এই ব্যাপারটা ভিন্ন।আপনি একবার চিন্তা করেন, খাবার নাই, পড়ার কাপড় নাই, থাকার জায়গার নিশ্চয়তা নাই; এই অবস্থাতে কে পড়বে! আমাদের তো আগে এগুলা নিশ্চিত করতে হবে! শিক্ষা অনেক ইম্পর্টেন্ট আমিও মানি, কিন্তু ক্ষুধা পেটে মানুষ আপন পরও ভুলে যায় অনেক সময়, আর এটাতো পড়াশোনা।’
‘না না, তানভীর ভাইই ঠিক বলছেন’ আমাদের পলিউট্যান্ট সবুজ লাফিয়ে ওঠে(এই পোলার মুখ এত্ত খারাপ, পরিবেশ দূষিত করে দেয়, তাই এই নামকরণ)।‘আমি একবার একটা বই পড়া স্টার্ট দিসিলাম, পড়তে পড়তে রাতের ঘুম, খাওয়া এগুলোর কথা ভুলে গেসিলাম’।
বেলমাথা ফরিদ আবার টিপ্পনী কাটে, ‘বইটা পুরুত্বে অনেক পাতলা ছিল!রং বেরঙ্গের ছবি সহ!’
‘তুই কি কইতে চাস ফরিদ!’ পলিউট্যান্ট কিছুটা উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
তানভীর ভাই নাক গলাতে বাধ্য হন। ‘ওকে, ঝগড়া বন্ধ। আমরা তাহলে কাল থেকে কাজে নেমে পড়ি কি বল!’ আমরা সবাই একত্রে চেচিয়ে উঠি ‘অবশ্যই!’

এরপরের সপ্তাহ আমাদের টাকা সংগ্রহ, বই খাতা কেনা আর বস্তির মানুষ জনকে বুঝাতে চলে গেল। মানুষের বাসায় বাসায় গিয়ে টাকা চেয়ে বেড়ালাম। কিছু মানুষ জন খুবই হেল্পফুল ছিল। অনেকে পুরান বই খাতাও দিয়ে দিসে।আবার কেউ কেউ বলে ‘এই ব্যবসা কবে থেকে ধরছ!টাকা দিয়ে কি করবা!গাজা খাবা নাকি?’ চিন্তা করেন!অনেক কষ্টে আমার রাগ সামলাতে হইছে।

যাই হোক, সব প্রস্তুতির পর আমাদের ক্লাস নেয়া শুরু হল। সবার মধ্যেই অন্যরকম এক্সাইটমেন্ট। এমন কি রুম্মান ও বাচ্চাদের আনন্দের সাথে পড়াচ্ছে। তানভীর ভাই রুম্মানকে প্রায়ই বলেন ‘কি রুম্মান!তুমি না বল পড়ার মানুষ নাই!’ রুম্মান কিছু বলে না।কিন্তু এক সপ্তাহ পরই দেখা গেল পোলাপানের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। আগের মত বাচ্চারা এখন আর আসে না। যেগুলা আসে তারাও আর মনোযোগ দেয় না। একদিন তো তানভীর ভাই পুরাই খেপে গেলেন। পড়াচ্ছিলেন উনি, এক পিচ্চি পেন্সিল কামড়াচ্ছে। উনি বললেন ‘কি ব্যাপার! পড়ায় মনোযোগ দিচ্ছ না কেন!’ পোলা তাকায়ই না! উনি খেপে গেলেন, ‘এই ছেলে এদিকে তাকাও!কি হয়েছে!’ ছেলেটা বলে, ‘এই জিনিস পইড়া লাভ কি!আমি তো সারাদিন না খায়াই আছি! পড়লে কি কাইলকা থেইকা খাওন পামু?’ তানভীর ভাই পুরাই ক্ষেপে গেলেন, ‘এই তুই বের হ! তোর পড়াশোনার দরকার নাই!পড়াশোনার চেয়ে খাওয়া তোর কাছে বেশি জরুরী! বের হ তুই ক্লাস থেকে!’ পোলাটা নির্বিকার ভাবে বেরিয়ে গেল। সাথে সাথে দেখলাম রুম্মান ও বেরিয়ে গেল। ক্লাসে একটা থমথমে ভাব চলে এল।তানভীর ভাই বললেন, ‘এগুলারে পড়ায়ে লাভ আছে কোন! এরা পড়াশোনার মজাটাই নিতে পারে না!’ সেদিন আর ক্লাস হল না।

পরদিন শুক্রবার। তানভীর ভাই চলে যাবেন ভার্সিটির হলে।ইউনিভার্সিটির ক্লাস শুরু হবে।আবার হয়ত মাসখানেক পরে আসবেন। এই কয়দিন স্কুল চালানোর দায়িত্ব দিলেন রুম্মান, আমাদের আইডিয়াল ছাত্র সায়েম আর আমার ঘাড়ে। আমি তো খুব খুশি। রুম্মান সেদিন সকাল বেলা আমার বাসায় এসে ডেকে নিল আমাকে বাইরে। সে বলে, ‘দোস্ত, তানভীর ভাইকে বলি বিকেলে যেতে, আজ আমাদের বাসায় তোদের দুইজনের দাওয়াত।দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর আমরা আজকে ফিজিক্স এর কিছু ইন্টারেস্টিং টপিক যেমন রিলেটিভিটি, স্ট্রিং থিওরী এগুলা ওনার কাছে বুঝে নেই।’ আমি বললাম, ‘এগুলা কি জিনিস!’
‘আরে উনি বুঝায় দিলেই পানির মত বুঝবি, কিন্তু আমার আসল আরেকটা উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু তুই আগে একটা কথা দে।’
‘কি কথা?’
‘আমি বাসায় যাই করব তুই মানা করবি না, খালি আমার সাথে থাকবি।’
‘এর মানে কি?’
‘মানে বুঝবি পরে তুই। কিন্তু কথা দে আমার কাজে বাধা দিবি না।’
‘ঠিক আছে’ আমি মেনে নেই। সামনে আরো ক্লাস টেস্ট আসতেছে। রুম্মানের কথা মেনে নেয়াটাই ভালো।
‘ঠিক আছে তাইলে ওই কথাই রইল।’

দুপুর বেলা ওদের বাসায় গেলাম। রুম্মান ওর স্টাডি রুমে নিয়ে গেল। তানভীর ভাই এল একটু পরে। একেবারে ব্যাগ নিয়ে রেডি হয়ে এসেছেন। সন্ধ্যার দিকে এখান থেকেই হলে চলে যাবেন। কিন্তু আমি একটু অবাক হলাম, বাসায় আঙ্কেল আন্টি কেউ নেই। তানভীর ভাই আসতেই রুম্মান ওই কি সব রিলেটিভিটি, কোয়ান্টাম মেকানিক্স এগুলা নিয়ে বিজি হয়ে গেল। তানভীর ভাই বোঝাতে লাগলেন। কিন্তু আমার মাথায় তো এমনিতেই কিছু ঢোকে না তার ওপর লাগছে ক্ষুধা। তিনটার দিকে তানভীর ভাইও বললেন, ‘কি রুম্মান, দাওয়াত দিয়ে খাবার দাবার দিবে না নাকি!’ রুম্মান বলল, ‘সরি ভাইয়া,রান্না হতে একটু দেরি হচ্ছে। আর ধরেন দশ পনের মিনিট। আসেন এই ফাকে আমরা আরেকটু পড়াশোনা করে নেই।’ রুম্মান এই কথাটা বলার পরই আমি ওর আসল উদ্দেশ্যটা ধরতে পারলাম।

তানভীর ভাই বললেন, ‘খাওয়া দাওয়া টা শেষ করে পড়া ধরি। তুমি টিভিটা ছাড়। বার্সার খেলার রিপ্লে দেখাচ্ছে কিনা দেখি।’ সে বলল, ‘ঠিক আছে ভাই, দিচ্ছি’।টিভি ছেড়ে দিয়ে সে আমাকে ডেকে অন্য রুমে নিয়ে গেল। বলল, ‘ক্ষুধা জিনিসটা কি তানভীর ভাইকে আজকে একটু বোঝাবো। তুই কিছু করিস না।’ আমারও সেদিন ভাইয়ের ব্যবহারটা ঠিক ভাল লাগে নাই। আর এখন ক্ষুধা নিয়ে এই ফিজিক্সের কচকচানি শুনতে ভালো লাগছিল না মোটেও। তাই মনে হল রুম্মান একেবারে ভুল বলে নাই। ‘আমি তোর সাথে আছি, প্রব্লেম নাই’ বললাম আমি। রুম্মান রান্নাঘর থেকে দুইটা প্লেট নিয়ে এল, খাবার দাবার নিয়ে এল। এরপর তানভীর ভাইকে চেয়ারে বসতে বলল। ভাই বললেন, ‘প্লেট দু’টো কেন? তুমি খাবা না নাকি?’ রুম্মানে হেসে বলল, ‘খাব ভাইয়া, আপনি এই চেয়ারে এসে বসেন’ তারপর পাশের রুমে এসে আমার হাতে দড়ি দিল, বলল, রুমে গিয়েই ভাইকে শক্ত করে বেধে ফেলবি। আর দেখিস যেন চেচাতে না পারে। সেলোফেন টেপও নিল সে হাতে। তারপর আমরা রুমে গিয়েই তানভীর ভাইকে চেয়ারের সাথে বাধা শুরু করলাম শক্ত করে।‘এই কি হচ্ছে এগুলো! হচ্ছেটা কি! রুম্মান! রাশেদ! কি করছ তোমরা!’ ভাইয়ের চোখে মুখে আতংক।রুম্মান ঠান্ডা মাথায় বলল, ‘ভাই, ভুলেও চেচাবেন না, পাশের ফ্ল্যাটও খালি, চেচালেও লাভ নেই।’
‘হচ্ছেটা কি এসব! কি করতে চাচ্ছ তোমরা!’
‘আমরা দুইজন এখন খাবো। খাওয়ার পর আপনি আবার কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে লেকচার দিবেন। পড়াশোনার প্রতি প্যাশন থাকলে খাওয়া দাওয়া না হলেও হয়, আপনারই কথা!’
ভাই একটু বোকা বনে গেলেন। এরপর ভাইয়ের সামনেই আমরা পোলাউ, গরুর মাংস খেলাম, কোক খেলাম।তানভীর ভাই বসে বসে ঢোক গিলছেন। কিন্তু কোন চিতকার চেচামেচি করেন নি। মান ইজ্জতের ভয়ে হয়ত বা। এরপর আমি সোফায় আর রুম্মান বেডে শুয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল। সাড়ে পাচটা বেজে গেছে ততক্ষণে। বিশ্রামের পর আমি আর রুম্মান চা নিয়ে খেতে খেতে আবার ভাইয়ের সামনে গিয়ে বসলাম। ‘ভাই, এবার শুরু করেন আবার।’ তানভীর ভাই পুরাই চুপ, কোন কথা বলেন না। রুম্মান বলল, ‘কি ব্যাপার ভাই! একবেলা না খেয়েই পড়াশোনার প্রতি সব প্যাশন চলে গেল! আপনি না আমাদের শেখাতে কত ভালোবাসেন!’ তানভীর ভাই এর মাথা পুরা হেট।

এরপর রুম্মান আবার ভাইয়ের জন্য খাবার দাবার নিয়ে এল। আর হাত পায়ের বাধন খুলে দিয়ে বলল, ‘সরি ভাই, আমার মনে হয়েছিল আপনাকে বোঝনোর জন্যে এটাই বেস্ট ওয়ে।’ তানভীর ভাই কারো সাথে কোন কথা বললেন না, খাওয়া দাওয়াও করলেন না। ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে সোজা চলে গেলেন।
আমরা এরপর দিন থেকে স্কুল চালানোর জন্যে নতুন প্ল্যান করলাম। আমাদের টিফিনের টাকা থেকে প্রতিদিন সবাই পাচ টাকা করে জমা দিব রুম্মানের কাছে। এছাড়া রুম্মান তো এজন্যেই নাকি ওর বাবার কাছ থেকে টাকা নেয়, বস্তির পিচ্চি গুলাকে খাওয়ানোর জন্যে। সেও কিছু টাকা দেবে। আমাদের বেশ কয়েক জন বাসা থেকে টাকা আনার প্রতিশ্রুতি দিল। কয়েকজন একটু গাইগুই করছিল, আমার চোখ রাঙ্গানীতে ঠিক সোজা হয়ে গেল। ঠিক হল আমরা প্রতিদিন ক্লাসের আগে বাচ্চাগুলাকে দু’টো বনরুটি আর একটা কলা খেতে দেব। স্কুলও আবার ভাল চলতে লাগল। বেশ কয়েকটা পিচ্চিতো অসাধারণ ভালো করতে লাগল! একটা পিচ্চি ক্লাসে একটু বেশি চেচামেচি করে, তাই একদিন রুম্মান বিরক্ত হয়ে ওইটাকে ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত যোগ করে দিতে বলছে। পোলা পাচ সেকেন্ডের মাথায় বলে ৫০৫০। আমরা সবাই অবাক!রুম্মান তো তারে কোলে তুলে নিয়ে নাচতে লাগল! পরে রুম্মান আমাকে বলেছিল ছেলেটা পুরা গাউসের পিচ্চিকালের একটা ওয়েতে প্রব্লেমটা সল্ভ করেছিল।আমি অবশ্য ওইসব কিছু বুঝি নাই। আমাদের কারো সাথেই তানভীর ভাইয়ের আর দেখা হয় নাই।

এক মাস পরে একদিন রুম্মান দুপুর বেলা দৌড়ে আমার বাসায় হাজির! ‘রাশেদ, বের হ তাড়াতাড়ি!’ নিচ থেকে চেচাচ্ছে! আমি একটু ঘুমিয়ে ছিলাম। কোনমতে চোখ ডলতে ডলতে নিচে নামলাম।‘কিরে! কি হইছে!’ রুম্মান একটা খাম দেখায়ে দুইশ ওয়াটের বাল্বের একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘তানভীর ভাই ২০০০ টাকা পাঠিয়েছে কুরিয়ার করে, স্কুলের জন্য।’


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ডকএক্স থেকে কপি করে পেস্ট করার পর নাম লিখতে ভুলে গিয়েছিলাম আগের মতই। লেখকের নাম কোয়াসিমোডো।
(কোয়াসিমোডো)

অতিথি লেখক এর ছবি

অতিথি লেখকের নাম নেই কেন? গল্প বলার ভঙ্গি ভাল। গোপাল ভাঁড়ের গল্পের ধাঁচে।ভাল। তবে একটা প্রশ্ন, তানভিরকে মার্কসবাদী তাত্ত্বিক দেখানোর কারণ কি? সে জ্ঞানী এটা বলার জন্যে? নাকি বাম তাত্ত্বিকদের গণবিচ্ছিন্নতা বুঝাতে? ঠিক কি কারণে? পরিষ্কার নয়। যদি গণবিচ্ছিন্নতা বুঝাতে করা হয়ে থাকে তা হলে, উদাহরণটা বাছাই ভুল। জানালে খুশি হব।

স্বয়ম

অতিথি লেখক এর ছবি

সে পড়াশোনা করে ভালই এটা বোঝানোর জন্যে, বাম্পন্থীদের বিচ্ছিন্নতা বোঝানোর জন্যে নয়। ধন্যবাদ হাসি

ইভা এর ছবি

ভাই আপনার লেখা কেমন হয়েছে সে বিচার করবার মত জ্ঞান আমার নেই কিন্তু আপনি যা লিখেছেন এটা যদি বাস্তবে সত্যি করে থাকে তবে আপনাদের কে আমার স্যালুট । মুখে মুখে দেশ উদ্ধার আমরা অনেকেই করি কিন্তু বস্তবের দেশ উদ্ধার হয়না । অস্বাধারন কাজ করেছেন ভাই । আপনাদের কে দেখে মানুষ উৎসাহিত হবে সেটা আশা করি ।

অতিথি লেখক এর ছবি

অত্যন্ত দূঃখিত, এটা গল্পই। তবে আমাদের এরকম প্ল্যান আছে, সমস্যা হচ্ছে এগুলো প্ল্যানিং স্টেজ খুব কম সময়ই পার হতে পারে। ধন্যবাদ।

ফাহিম হাসান এর ছবি

লেখাটা অনেকটা ঈশপের গল্পের মত লাগল।

অতিথি লেখক এর ছবি

আসলে আমার নিজেরও সেরকমই লেগেছিল, সত্যি কথা। হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্পটা অসাধারণ, পড়ে অনেক ভাল লাগলো । গল্পটার মাঝে অনেক বেশী বাস্তবতার ছোঁয়া পেলাম হাসি

ইয়জা

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি
(কোয়াসিমোডো)

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্প ভালো লেগেছে। তাত্ত্বিক লোকেরা প্রায়ই বাস্তবকে অগ্রাহ্য করেন। একবার এক বিখ্যাত বাংলা ব্লগের এডমিন ছদ্মনামে লেখা ও লেখকের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, " কে আমেরিকায় বসে লিখছে, আর কে বসনিয়ায় বসে লিখছে- সেটা কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। লেখার মানই একমাত্র বিবেচ্য।" - অথচ এই ঘরকুনো আঁতেলরা জানে না বাস্তব অনেক কর্কশ এবং পরিবেশ-পরিস্থিতির ঊর্ধ্বে ওঠা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। কৌশল যারা অবলম্বন করতে জানে না তারা টেঁকে না।
খালি পেটে শিক্ষা হয় না। চলুক

নির্ঝর অলয়

অতিথি লেখক এর ছবি

আমারো মনে হয় খালি পেটে শিক্ষা হয় না হাসি আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লাগলো, লিখতে থাকুন।

''দিবাকর''

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

তারেক অণু এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

শাফায়েত এর ছবি

চমৎকার গল্প।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

স্পর্শ এর ছবি

ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
পুর্নিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি...

মজার ব্যাপার হলো, সবচেয়ে বড় মূর্খ খুঁজে পাওয়া যাবে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা এসবের নিশ্চয়তা আছে এইরকম লেখাপড়া জানা মানুষগুলোর মধ্যেই।

গল্প ভালো হইসে। চলুক


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

অতিথি লেখক এর ছবি

সবচেয়ে বড় মূর্খ খুঁজে পাওয়া যাবে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা এসবের নিশ্চয়তা আছে এইরকম লেখাপড়া জানা মানুষগুলোর মধ্যেই।

সহমত।
ধন্যবাদ হাসি

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

চলুক

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি
(কোয়াসিমোডো)

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

(কোয়াসিমোডো)

ধুসর জলছবি এর ছবি

হাততালি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

(কোয়াসিমোডো)

বন্দনা এর ছবি

লেখা ভালো লেগেছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

(কোয়াসিমোডো)

রংতুলি এর ছবি

চলুক হাততালি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

(কোয়াসিমোডো)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।