সার্সেন রোডের পিয়ানো বাজানোর মানুষটি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১৭/০৩/২০১৩ - ১:৪১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কলেজ থেকে ফেরার পথে মাঝেমধ্যে সার্সেন রোডের পথ দিয়ে ফিরতাম। শহরের সবচে সবুজ-শান্ত রাস্তার একটা ছিল এই পথটা। এই রাস্তায় চলার সময় চোখে পড়ত এক বাসার গেটের সামনের এক নামফলক, প্রফেসর ডঃ জামাল নজরুল ইসলামের নাম লেখা তাতে। আমাদের হাইস্কুলেরই ছাত্র ছিলেন তিনি, সেই সুবাদে স্যারদের মুখে উনার নাম শুনেছিলাম আগেই, জানতাম খুব উঁচুমাপের বিজ্ঞানী ছিলেন। নিভৃতে, অনেকটা আড়ালে থেকে বিজ্ঞানসাধনা করতেই বেশি ভালোবাসতেন।

১৯৮৪ সাল। একদিকে কেমব্রিজের সোয়া লক্ষ টাকা বেতনের চাকরি, গবেষণার অফুরন্ত সুযোগ, নিশ্চিত জীবন। আর, আরেকদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিধ্যালয়ে তিন হাজার টাকার প্রফেসর পদ, সুযোগ-সুবিধাও অপ্রতুল। ডলার-পাউন্ডের মোহ ছেড়ে তিনি বেছে নিলেন দ্বিতীয়টাই, দেশটাকে বড্ড ভালবাসতেন বলে।

১৯৮৩ সালে তাঁর 'দ্যা আলটিমেট ফেট অব দি ইউনিভার্স' প্রকাশের পর তা ফরাসি, ইতালীয়, জার্মান, পর্তুগিজ সহ বহুভাষায় অনুবাদ, মহাবিশ্বের ভবিষ্যত নিয়ে তাঁর একাধিক গ্রন্থ কেমব্রিজ, প্রিন্সটন, হার্ভার্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হওয়া, পার্টিকেল ফিজিক্স বা মৌলিক কণার ওপর পিএইচ ডি থিসিস, তিন-চার বছর পরই আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি নিয়ে কাজ করা, পরবর্তীকালে কসমোলজি- এই তিনটিই ছিল তাঁর আগ্রহ ও কাজের মূল ক্ষেত্র।

এসব সবাই জানেন। হয়ত জানেন না, খুব সুন্দর পিয়ানো বাজাতে পারতেন তিনি। বন্ধুর ছোট মেয়েটিকে প্রতি শুক্রবার পিয়ানো বাজিয়ে ‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গামাটির পথ’ বাজিয়ে শুনাতেন।

জানেন না, স্ত্রী সুরাইয়া ইসলামকে কী প্রচন্ড ভালবাসতেন! এক কনফারেন্সে পরিচয়, এরপর প্রেম, বিবাহ। ৫৩ বছরের দাম্পত্য জীবনে জামাল নজরুল স্যার স্ত্রীকে ছাড়া কোথাও যেতেন না। কোন অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে চলার সময় সবসময় স্ত্রীর হাত ধরে রাখতেন। বিদেশ সফরে গেলেও স্ত্রী থাকতেন তাঁর সাথে। একবার সুরাইয়া ম্যাডাম পায়ে ব্যথা পেয়ে ঢাকায় মেয়ের বাসায় ছিলেন বেশ কিছুকাল, তখন অনেকটা এতিমের মত হয়ে ছিলেন জামাল স্যার। স্ত্রী-ও নিজে ডক্টরেট হয়েও স্বামীর জন্য নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে আর ভাবেননি।

প্রিয় বন্ধুর সাথে প্রতি শুক্রবার কাটাতেন নিয়ম করে, কখনো উনার বাসায়, কখনো বন্ধুর বাসায়। কোন সপ্তাহে শরীর খারাপ বা অন্যান্য কোন কারণে আসতে না পারলে চিঠি লিখে কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন। হ্যাঁ, এই মোবাইল-ইন্টারনেটের যুগে থেকেও প্রিয় বন্ধুকে চিঠি লিখতেন। বন্ধুকন্যাটিকে ঢাকায় পড়তে আসতে দেন নি, বলেছিলেন- পরিবারের সাথে থেকে যা শিখবা, আর কোথাও তা পাবা না।

সংস্কৃত জানতেন। ভালবাসতেন গজল। বাহাদুর শাহ জাফরের এই গজলটি বড্ড প্রিয় ছিল তাঁর, প্রায়ই গেয়ে শুনাতেন,

“উমর-ই-দরাজ মাঙ্গ কার লায়ে থে চার দিন/ দো আরজু মে কাট গায়ে, দো ইন্তেজার মে” ( আমি চারদিনের আয়ু খুঁজে নিয়ে আসছিলাম, দুইদিন কেটে গেল আশায়, আর দুইদিন অপেক্ষায়)

কিন্তু সবচে ভালবাসতেন বাংলাকে। মাতৃভাষায় ভাল বিজ্ঞান চর্চা ও উচ্চতর গবেষণার জন্য সবাইকে উৎসাহ দিতেন। তিনি মনে করতেন, শিশুর বিদ্যার্জনের প্রথম পর্যায়ে অবশ্যই মাতৃভাষার ব্যবহার হতে হবে। তবে অবশ্যই তা ইংরেজিকে অবহেলা করে নয়।

আরো ভালোবাসতেন বাংলাদেশকে, এদেশের মানুষকে। উনি বলেছিলেন, তাঁকে যদি নোবেল প্রাইজ প্রস্তাব করা হয়,আর এর বিনিময়ে যদি তাঁর মেয়ে নার্গিস দেশে এসে স্থায়ী হয়, এদেশের লোকজনের চিকিৎসা করে, তবে তিনি নোবেল চান না। তিনি আরো বলতেন, বিদেশে আপনি যতই ভালো থাকুন না কেন, নিজের দেশে নিজের মানুষের মধ্যে আপনার যে গ্রহণযোগ্যতা এবং অবস্থান সেটা বিদেশে কখনোই সম্ভব না। নিজের দেশের প্লেইস-পিপল-থিংস এর সঙ্গে যেভাবে সম্পর্ক স্থাপন করা যায় তেমনটা তো আর কোথাও, কোনোভাবে সম্ভব নয়। শুধু নিজে নয়, তাঁর প্রিয় সবাইকেই তিনি পড়াশোনা শেষে দেশে ফেরার পরামর্শ দিয়েছেন। জাফর ইকবাল স্যার-ও উনার উৎসাহে এদেশে ফিরে আসেন।

জামাল নজরুল স্যার সবসময় স্যুট-সোয়েটার পড়ে থাকতেন। এমনকি গরমের দিনেও। যুক্তি ছিল, আমাদের পূর্বপুরুষ তো বেদুইন ছিল, তাই ভারী কাপড় পড়ে গরমকে দূরে রাখতে চান।

প্রথম যখন হার্টে বাইপাস সার্জারি করার দরকার পড়ে, উনি করেন নি। এমনকি কোন ঔষধ-ও খান নি। এর বদলে যেসব ঔষধ ডাক্তাররা দিয়েছিলেন, সেসবের উপাদান-উপকরণ শাকসব্জিতে খুঁজে নিয়ে নিরামিষাশী হয়ে গেলেন। রং- চা খেতেন কেবল।

স্বচ্ছল হওয়া সত্বেও অনেকদিন তাঁর কোন গাড়ি ছিল না, ভার্সিটির বাস করে যাওয়া-আসা করে ক্লাস নিতেন। রিক্সা-ট্যাক্সি করে শহরে ঘুরতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন বেশি। অনেকদিন পর মেয়ে আর মেয়ের জামাই একটা গাড়ি কিনে দিয়েছিলেন তাঁদের- ঐটাই একমাত্র গাড়ি ছিল। এরকম সাধারণ জীবনযাপনই ছিল তাঁর। বাড়ির সাজসজ্জা বছরের পর বছর ধরে প্রায় একই থেকে গিয়েছে।

তিনতলা বাড়ির দোতলার তিনটা এবং তিনতলার পাঁচ-ছয়টি কামরায় থরে থরে সাজানো রয়েছে অজস্র বই। আর, সব বইই ছিল তাঁর পড়া। তবে বই ধার দিতেন কম, কারণ যত্নের সাথে বই না পড়াটা তিনি পছন্দ করতেন না। আর, তাঁর মেয়েদের নার্সারি থেকে শুরু করে সব বই এখনো উনার কাছে আছে। এসব বই উনারা বিদেশ থেকে বয়ে এনেছিলেন। তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চাও ছিলো অবাক করার মত।

কম্পিউটার পছন্দ করতেন না। আর কখনো ক্যালকুলেটর-ও ব্যবহার করতেন না। বলতেন, ওতে মস্তিষ্ককে অলস করে দেয়। খুব স্পষ্টবাদী ছিলেন। মিডিয়া পছন্দ করতেন না, খবর বিকৃত করে দেয় বলে পারতপক্ষে সংবাদপত্র-ও পড়তেন না। তাঁর চিন্তার অনেকখানি জুড়ে থাকে দেশ ও সমাজের উন্নতি এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ। নিজের আয় থেকে কিছু অর্থ জমিয়ে দরিদ্র ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। ইরানের ‘অ্যাস্ট্রো-অলিম্পিয়াডে’ যাওয়ার জন্য আমার ছোট ভাইটিকে সাহায্য করেছিলেন। ২০০১ সালে পৃথিবী ধ্বংসের গুজব উঠলে এই যুক্তিবাদী মানুষটি গণিতের হিসাব কষে দেখান যে, সে রকম সম্ভাবনা নেই।

স্টিফেন হকিং, অমর্ত্য সেন, রিচার্ড ফাইনমেন,প্রফেসর আব্দুস সালামের মত বিশ্ববরেণ্যরা তাঁর বন্ধু ছিলেন। প্রফেসর সালামের স্ত্রীসহ বিদেশ থেকে খ্যাতিমান বিজ্ঞানীরা এদেশে আসলে তাঁর বাসাতে ঘুরে যেতেন। ফাইনমেন দম্পতি একবার তাঁকে সস্ত্রীক নৈশভোজে নিমন্ত্রণ করেন এবং একটি মেক্সিকান ট্যাপেস্ট্রি উপহার দেন যেটা এখনও তাঁর বাড়িতে আছে।

সেই সার্সেন রোডের বাড়ি, পিয়ানো, লাইব্রেরী, রবীন্দ্রসংগীতের ক্যাসেট-সিডি, স্ত্রী সুরাইয়া, দুই মেয়ে, অসংখ্য ছাত্র- বন্ধু- ভক্ত সব মায়া ত্যাগ করে সেই মানুষটা আজ না ফেরার দেশে। ভালো থাকবেন স্যার...

প্রিয়ম


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

মন খারাপ

মৃত্যুময় ঈষৎ এর ছবি

লেখাটির জন্য কৃতজ্ঞতা।


_____________________
Give Her Freedom!

অতিথি লেখক এর ছবি

আমাকে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সেই বন্ধুকন্যা ঈশিতা সাহায্য করেছেন। ধন্যবাদটা তাঁরই প্রাপ্য বেশি।

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

সব মায়া ত্যাগ করে সেই মানুষটা আজ না ফেরার দেশে। ভালো থাকবেন স্যার...

মন খারাপ

এই শুন্যস্থান আসলেই পূর্ণ হবার নয়। লেখাটির জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

অতিথি লেখক এর ছবি

এমন একজন মহৎ লোক অথচ তার ব্যাপারে কোনো কিছু আগে জানতামই না। মন খারাপ এমন নির্মোহ-অন্তরালে থেকে যাওয়া-একনিষ্ঠ জ্ঞান-সাধকের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে গেলাম। শ্রদ্ধা

সামি

আমিনুল ইসলাম এর ছবি

জামাল নজরুল ইসলাম স্যারকে চিনলাম তার মৃত্যুর পর । বিদগ্ধরা জীবদ্দশায় এদেশে ব্রাত্য, জাকির নায়েকেরা হিরু ।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

.. স্যার যেইবার ডিপার্টমেন্টে এসেছিলেন, সেবার ব্যাস্ততাবশত সেমিনারটায় যেতে পারি নাই... এখন ব্যাস্ততাও নাই... স্যারও নাই... ... ... কিছু কিছু আফসোস সারা জীবন থেকে যাবে... ... মন খারাপ

. ... লোকে ভারতীয় টিভিস্টার জাকির নায়ক কে চেনে... অথচ, দেশের বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামকে চেনে না... .. ...... ... এর দায়ভার কিছুটা কি আমারও...?? ... ইয়ে, মানে...

অতিথি লেখক এর ছবি

দায়ভার আপনার কেন হবে ভাই - টিভির তারা বললেন না - তাই লোকে তাকে চেনে। জামাল স্যার নিসশব্দে তার কাজ করে গেছেন। জাফর স্যার ও চেষ্টা করছেন। আমরা আমজনতা জামাল স্যার চিনলে হইত ওনার কাজে অসুবিধা হত।

ডিম পোচ

তিথীডোর এর ছবি

পাঁচ তারা দাগালাম। হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

চমৎকার লেখা অসাধারণ মানুষটিকে নিয়ে। পাঁচতারা।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

পথেরহাট এর ছবি

উনার এতো কাছে থাকতাম; অথচ উনার সমন্ধে জানলাম চিনলাম... আজ এই লেখা পড়ে !

তারেক অণু এর ছবি

শ্রদ্ধা আমার স্কুলজীবনের নায়ক।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।